নিরুদ্দেশ পর্ব ১২

নিরুদ্দেশ
পর্ব ১২

জগদীশচন্দ্র বসু বহু বছর আগে বলে গেছেন গাছেরও প্রাণ আছে। গাছেরা উপলব্ধি করতে পারে, কারা তার শত্রু আর কারা তার মিত্র! সবুজ যে গাছেদের ক্ষতি চায় না, তা তারা বুঝতে পারে। একটুও বাতাস নেই। চতুর্দিকে নির্জনতা। অথচ সবুজ বাগানে ঢুকতেই তার মনে হল একটা গাছ নড়ে উঠলো। গাছটি যেন নত মুখে সেলাম ঢুকলো। সে আশ্চর্য হল না। গাছটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রায় পাঁচ বছর আগে কৃষ্ণচূড়া গাছটি লাগিয়ে ছিল। এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। তার অনুপস্থিতিতে গাছটির অনেক শাখা-প্রশাখা কেটে দেওয়া হয়। সে-ই অংশটি এখন শুকনো হয়ে গেছে। সবুজ সেখানে হাত দিতেই শুকনো অংশটি খসে পড়ল। গাছটি আবার একবার নড়ে উঠলো। ধীরেসুস্থে গাছে হাত বোলালো। এরা যেন মানব সন্তান। সব কিছুই বুঝতে পারে। গাছেদের প্রতি অনুভূতি এত মধুর কেন? প্রকৃতিকে ভালোবাসা দিলে প্রকৃতিও ভালোবাসা ফিরিয়ে দেয়। একটা মানুষ যতই খারাপ হোক না কেন তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে সেও সৎ ভাবে আচরণ করবে; যদি তার হৃদয় বলে কিছু থাকে। সবুজ গাছেদের ভীষণ ভালোবাসে। নিখুঁতভাবে ভালোবাসে। গাছেদের একটা পাতাও ছিঁড়ে না। কেউ গাছের শাখা প্রশাখা ভেঙে নিলে তার কষ্ট হয়। ভেতরটা কেমন দুঃখের আগুনে জ্বলে ওঠে। বুকের রক্ত শক্ত হয়ে যায়। তার এই সূক্ষ্ম যন্ত্রণা কোনো মানব বুঝতে পারে না কিন্তু গাছেরা বুঝতে পেরে যায়। গাছেরা একতরফা শুধু ভালোবাসা নিতে জানে না ফিরিয়ে দিতেও জানে। তবুও বহু মানুষ গাছেদেরকে ভালোবাসে না কেন? গাছেদের ভালোবাসা অনুভব করতে হয়। তারা বাহ্যিক ভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে না। এই কারণে কি বহু মানুষ গাছেদের অবজ্ঞা করে? কিন্তু গাছেরাও বাহ্যিকভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে। দুঃখের কথা হলো মানুষ তা বুঝতে পারে না। তাদের ভালোবাসা বোঝার জন্য জরুর দৃষ্টির প্রয়োজন। আর যারা বুঝতে পারে তারাই গাছেদের প্রকৃত বন্ধু। সবুজ বাগানের মধ্যে নড়েচড়ে বসলো। একনাগাড়ে গাছেদের দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের মৃদু বাতাবরণ লক্ষ করল। তারা যেন একে অপরের সঙ্গে নীরবে ভাব বিনিময় করছে। তারা কথা বলতে পারে। মানুষ সে-ই ভাষা আবিষ্কার করতে পারেনি। বুক ভরে শ্বাস নিল। কেমন একটা শান্তি লাগছে। সবকিছু উজাড় করে দেওয়ার জন্য তৈরি সে।বাড়ি ফিরে লক্ষ করেছিল তাদের বাড়ির বাগানের অবস্থা শোচনীয়। তার অনুপস্থিতি তীব্রভাবে অনুভব করেছে গাছেরা। কিন্তু কয়েকটা মাস যেতে না যেতে তারা আবার সতেজ হয়ে উঠেছে। পরিচর্যার অভাবে নেতিয়ে পড়েছিল। বাজার থেকে আরও কয়েকটা গাছ এনে বসিয়েছে। রোজ জল পায় সময় মত খাবার পায়। পরিচর্যার অভাব হচ্ছে না। তারা কথা বলার সঙ্গীও ফিরে পেয়েছে। তরতর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা সকাল বেলা বাগানে বসে কাটিয়ে ফেললো। গতকাল রাত থেকে মন ভালো নেই সবুজের। দাদা ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে চাকরি পেয়ে গেছে। তা নিয়ে গত রাতে বাবা অনেক কথা শোনালেন। রাধাশ্যাম বাবুর যোগ্য সন্তান কেবল রিপন। সবুজ যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। তিনি ছোট ছেলেকে পড়াশোনার কথা বলেন। চারটা বছর নষ্ট হয়েছে হোক। কিন্তু এখন আর সময় নষ্ট করা চলবে না। তিনি চান, ছেলে আবার স্কুলে ভর্তি হোক। কিন্তু সবুজকে রাজি করানো শক্ত। সে রাজিও হয়নি।গতকাল রাতে এই নিয়ে প্রচুর কথা কাটাকাটি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি রেগে রাতে খাবার খাননি। সকালে উঠে কাজের জন্য শহরে ফিরে গেছেন। গাছেদের কাছে থাকতেই তার মনটা ভালো হয়ে উঠেছিল। এখন আবার একটু একটু করে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সত্যি কি সে সঠিক পথে চলছে? কোনো অন্যায় হচ্ছে না তো? বাবা কাল বারবার একটা কথা বলছিলেন, আবেগে জীবন চলে না। বাস্তবতা বোঝো। একটা সময়ের পর জীবনে টাকার প্রয়োজন হবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব আর কর্তব্যগুলো বাড়বে। দায়িত্ব নিতে শিখতে হবে।যখন আরও পাঁচটা বছর পেরিয়ে যাবে তখন কি -সে বাবার কাছে চুল দাড়ি কাটার জন্য টাকা চাইবে? নিজের বিবেক বলে কিছু নেই? একটা সময় বাবা সন্তানের দায়িত্ব নেয় আবার একটা সময়ের পর সন্তানকে বাবার দায়িত্ব নিতে হয়। তাইতো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রয়োজন আছে। আর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সর্বপ্রথম পড়াশোনা করতে হয়। তাই তো ছোটবেলা থেকে প্রত্যেক বাবা-মায়ই তার সন্তানকে পড়াশোনা শেখার। কিন্তু পড়াশোনা না করে তো বহু মানুষ বহু জায়গায় গেছে। সে কেন পারবে না? মনোবল রয়েছে। ইচ্ছে শক্তি রয়েছে। সবকিছুকে হারাতে সক্ষম। রবি ঠাকুর তো অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল। আর তিনি আজ বিশ্বকবি। সে কি বিশ্বকবি হতে পারবে? হেসে উঠলো। নিজের চিন্তা নিজের কাছে স্পষ্ট নয়। একটা সময় সাহিত্যের প্রতি মানুষের প্রচুর ঝোঁক ছিল। মানুষ প্রচুর বই পড়তো। এখন তা অনেক কমে গেছে। এখন খুব অল্প মানুষ রয়েছে যারা সাহিত্যপ্রেমী। তাহলে সবুজ কি করবে? লেখালেখি ছেড়ে দেবে? না, সে কোনোদিন ছাড়তে পারবে না। তাহলে লেখালেখির উপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু এখান থেকে তো রোজগার খুব কম হবে। সবুজ আঁতকে উঠল। এ কি ভাবছে সে? এখানে রোজগারের প্রসঙ্গ আসছে কেন? ভালোবাসা তো টাকার উপর নির্ভরশীল নয়। সে লেখালেখি করে ভালবাসার জন্য। তীব্র বেগে মাথা দোলাতে লাগলো। এমন ভাবলে চলবে না। তাকে লেখালেখির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। সবাই ছুটছে। তাকেও ছুটতে হবে। বাগান থেকে উঠে পড়ে হন হন করে বাড়ির ভেতরের দিকে চলল। মন বড় বিচলিত। এই সময় বন্ধুদের কাছে থাকলে ভালো হতো। কিন্তু কেউ ধারে কাছে নেই। সংকেত ট্রেনিংয়ের জন্য জলপাইগুড়ি গেছে। নিজের লক্ষ্যে স্থির। স্বপ্ন পূরণের জন্য মনোযোগ দিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে হয়তো সে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। সূর্যময়,সে বাবার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। বাবার সাথে সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। চাষবাস করতেও সক্ষম সে। বলতে গেলে সে এখন প্রতিষ্ঠিত। বাকি থাকলো সে নিজে। তাকেও প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। কিছু করতে হবে। এভাবে ঘুরেফিরে আর দিন কাটানো যাবে না। উঠে দাঁড়াতে হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছে। আর নয়। এবার ময়দানে নামতে হবে।নিজের রুমের মধ্যে এসে সোজা বইয়ের তাকের কাছে চলে গেল। অনেক ছোট বড় কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। সেগুলো জড়ো করলো। ছোটবেলা থেকে লেখার অভ্যাস রয়েছে। অনেক ছোট গল্প কবিতা লিখেছে। সেগুলো খুঁজে বের করে একটা জায়গায় জড়ো করলো। তারপর চিন্তায় ডুবে গেল। একটু একটু করে ভাবতে রইল। কি করা যায়? কিভাবে মানুষ বই লেখে? প্রকাশনীর কেউ কি লেখকের কাছে আসে, না লেখক নিজেই প্রকাশনীর কাছে যায়! এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অচল। একটা বই বার করার জন্য কি কি প্রয়োজন? না,কিছু ভেবে পেল না। কারোর কাছে সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন। কিন্তু কার কাছে নেবে? তার পরিচিত সবাইতো এ বিষয়ে আনাড়ি। কেউ সঠিকটা জানাতে পারবে না। দুটো সপ্তাহের মতো পরিশ্রম করে একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করল। ঠিক করল শহরে গিয়ে প্রকাশনীদের কাছে পান্ডুলিপি জমা দেবে। তারা নিশ্চয়ই বই আকারে ছাপিয়ে দেবে। হাজার হাজার মানুষ বই কিনবে। সবাই অটোগ্রাফ চাইবে। তার বাড়ির সামনে ভিড় জমবে।তাকে একটিবার দেখার জন্য মানুষ কত আগ্রহে বসে থাকবে। অনেক বড় বড় জায়গা থেকে আমন্ত্রিত হবে। তার বক্তৃতা শোনার জন্য ধৈর্য ধরে মানুষ বসে থাকবে। সে খাতা দেখে বক্তৃতা দেবে না। বাড়ি থেকে প্রস্তুত হয়ে যাবে। একদম স্বয়ং সম্পূর্ণরূপে বক্তৃতা দেবে। কৌতুকের সীমানা ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। আর ভাবতে পারছে না। সত্যি সত্যি সে লেখক হতে চলেছে। এতদিনের কল্পনা সত্য হতে চলেছে। আবেগ হৃদয়ে নড়েচড়ে বসল। অনেক দিনের পর অন্তঃকরণে সুখের ব্যথা অনুভব করছে। কাউকে কিছু জানালো না। মনে মনে স্থির করলো, সবটা হয়ে যাওয়ার পর সবাইকে জানাবে। তাতে সবাই আরও বেশি খুশি হবে। সবাই তার প্রশংসা করবে। খবরের কাগজে তার নামে আর্টিকেল বেরোবে। যৌবনে পদার্পণ করলেও হঠাৎ করে তার মনে বালকের উচ্ছ্বাস জেগে উঠলো। নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করল তার শরীর আনন্দে ঝড়ের মত কাঁপছে। সারা মন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে। পরের দিন সকালে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পৌঁছালো শহরে। খুব ভোরে শহরে পৌঁছে গেল। বেশ কয়েকজন মানুষকে জিজ্ঞেস করে প্রকাশনীর ব্যাপারে সমস্ত কিছু জেনে নিল। তবে এত সকালে প্রকাশনীর অফিস খোলে না। অপেক্ষা করল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে তার অভিজ্ঞতাও বাড়লো। হঠাৎ করে মাটিতে আছড়ে পড়লো। বাস্তব জীবন যে এত সহজ নয় -প্রথম বুঝল প্রথম প্রকাশনীর কাছে গিয়ে। প্রকাশনীর সম্পাদক তাকে প্রথমে প্রশ্ন করলেন,তার বই তাঁরা কেন ছাপবে? সবুজ নিরুত্তর। কি উত্তর দেবে? এর উত্তর কি হতে পারে? সোজাসাপ্টা হেসে বলল,’আমি একজন লেখক। লেখকের বই ছাপবেন না তো কার ছাপবেন?’
‘আপনি যে লেখক কোনো প্রমাণ আছে?’ সবুজ যেন আকাশ থেকে পড়লো। লক্ষ করল বিপরীত মানুষটি মুচকি হাসছেন। হাসিটা সহ্য করতে পারলো না। অশান্ত,অস্থির হয়ে উঠল। লেখক হওয়ার জন্য আবার প্রমান দরকার নাকি! তার মুখের কথাতে বিশ্বাস হচ্ছে না! সে এত বড় একটা উপন্যাস লিখে নিয়ে এসেছে, তাও বিশ্বাস হচ্ছে না!কি করলে বিশ্বাস করবে? সবুজ একগাল হেসে বলল,’আমি কবিতা,গল্প,উপন্যাস লিখতে পারি। আর যারা লিখতে পারে তারা তো লেখকই হয়।’
‘আমার বাড়িতে আমার আট বছরের মেয়ে রয়েছে। সে কিন্তু একটা দুটো ছন্দ মিলিয়ে লিখতে পারে। তাহলে সেও কি লেখক?’ সবুজ এবার একটু থতমত খেয়ে গেল। নির্লিপ্তির চোখে তাকিয়ে রইল। কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না নিজেকে। উত্তেজিত হয়ে পড়ছে বারবার। লোকটির কথা গুলো কেমন চটচটে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি হেসে বললেন,’আপনার বোন কিংবা দাদা কেউ রয়েছে?’
‘হ্যাঁ, দাদা আছে।’
‘সে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু লিখতে পারে, তাহলে সে কি লেখক?’
সবুজ মাথা নাড়ালো। লোকটি এবার দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন,’আশা করি বুঝতে পেরেছেন আমি কি বোঝাতে চাইছি। চেষ্টা করুন। দেখবেন একদিন সফল হতে পারবেন। এখন ছোট তো পড়াশোনা করো। পড়াশোনায় মন দাও। উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যাবে। লেখালেখি এত সহজ নয়। এর জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। যদি মনে হয় করতে পারবে তাহলে মনের জোর বজায় রেখো। সফলতা একদিন উঠোনে আসবে।’ দামি কথাগুলো বলে লোকটি তরতর করে বেরিয়ে গেল। সবুজের আশা স্বপ্ন সমস্ত কিছু শেষ হয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা পায়ে অফিস থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। এবার কি করবে সে? কি করা উচিত? একটুখানি শহরে ঘোরার পর ভাবলো ওই মানুষটা পাগল আছে। কিছু জানে না।ওরা ওর গল্প ছাপায়নি তো কি হয়েছে আরও কত প্রকাশনী রয়েছে। তাদের কাছে যাবে। নিজের একটু পরিচয় হয়ে যাক। তারপর তারা নিজেরাই তার কাছে আসবে। আবার একবুক সাহস নিয়ে পরবর্তী প্রকাশনী অফিসে গিয়ে হাজির হলো। সেখানে ঠিক একই প্রশ্ন, তার বই ছাপতে যাবে কেন? তার লেখার মধ্যে নতুন কিছু রয়েছে? এর আগে কি সে কখনও লেখালেখি করেছে? কোনো পত্রিকায় লিখেছে? তার লেখা কোনো ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেয়েছে? কোনো লেখালেখি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে? ফেসবুকে লেখালেখি করে? ফেসবুকে কত ফলোয়ার রয়েছে? সবুজ একটাও উত্তর দিতে পারল না। ফেসবুক নামটা শুনেছে। কিন্তু সেটা আসলে কী এখনও পর্যন্ত জানে না। অজ্ঞাত স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হল। পরবর্তী আবার একটা প্রকাশনীতে গিয়ে হাজির হলো। সেখানে শুধুমাত্র ফেসবুক প্রসঙ্গটা তুললো না। বাদ বাকি সমস্ত প্রশ্ন করল। মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসলো। লজ্জায় ঘৃণায় মাথা কাটা যাচ্ছিল। সাহস করে আর কোনো প্রকাশনীর কাছে যেতে পারল না। সবাই তো একই কথা বলছে। কি করবে এখন সে? সকালে এসেছিল এখন বিকেল হয়ে গেছে। বাড়ি না ফিরলে দুশ্চিন্তা করবেন মা। তাড়াতাড়ি বাসে উঠে পড়ল। সারাদিন কিচ্ছু খায়নি। ভীষণ খিদে পাচ্ছে। কিন্তু খেতে ইচ্ছে নেই। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। গালের উপর কালো আস্তরণ পড়েছে। চুল বড্ড উস্কোখুস্কো। চোখ দুটো মিটমিট করছে। বিছানা পেলে শান্তি। বাড়িতে পৌঁছাতেই মা প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, কাজ সঠিকভাবে হয়েছে কিনা!সবুজ ক্লান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে মাকে আশাহত করল। যদিও মা একদমই আশাহত হলেন না। ছেলের পিঠে হাত চাপড়ে ভরসা যোগালেন। কিন্তু তিনি আসলে জানেন না, ছেলে কোন কাজে শহরে গিয়েছিল। তিনি যদি জানতেন সবুজ প্রকাশনীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে তাহলে হয়তো টাকাটা দিতেন না। তিনি জানতেন ছেলে কোনো কাজের জন্য যাচ্ছে। খুব অল্প খেয়ে সন্ধ্যায় গা এলিয়ে দিল বিছানায়। মুহুর্তের মধ্যে রাজ্যের ঘুম এসে জুড়ে বসল। সন্ধ্যার দিকে ঘুমিয়ে যাওয়ায় গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে পড়ে দুটো হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে চুপচাপ বসে রইল। অস্থির বোধ করলো। মুখের জালুস হারিয়ে গেছে। গতকাল রাতে কি ভাবছিল আর আজ কি হয়েছে? সত্যি, বাস্তব জীবনে সবকিছু সহজ সরল নয়। কাল এই সময় এক বুক শ্বাস নিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। অথচ আজ ঘুমাতে পারছে না। ছটফট করছে।মনে হচ্ছে সব স্বপ্ন শেষ। আর কিছু হবে না। সবুজ দ্রুতবেগে মাথা ঝাঁকালো। না না এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। সে অনেক গল্প পড়েছে, উপন্যাস পড়েছে। গায়ের জোরের চেয়ে আত্মবিশ্বাসের জোর অনেক বেশি। গায়ের জোর না থাকলেও মানুষ জয়লাভ করতে পারে কিন্তু আত্মবিশ্বাস না থাকলে মানুষ কখনও জয়লাভ করতে পারবে না। আবার একবার ভাবতে বসলো। সারা দিনের ঘটনা মনে করলো। কোথাও গিয়ে প্রথম মানুষটির কথা তার মনে গেঁথে গেছে। তিনি শেষে একটি কথা বলেছিলেন লেখালেখি করতে গেলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। শুধু লেখালেখি না সমস্ত কিছু ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য। কিছু পেতে গেলে কিছু ত্যাগ তো করতেই হবে। তাকে ভীষণ রকমের কল্পনা প্রেমী মানুষ হতে হবে। তাকে অনুভূতিপ্রবণ মানুষ হতে হবে। খুব কাঁদতে হবে, খুব হাসতে হবে। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অভিনেতা তো লেখকরা। কারন,তাদেরকে প্রত্যেকটা চরিত্রে নিখুঁতভাবে অভিনয় করতে হয়। প্রতিজ্ঞা করলো আবার গোড়া থেকে শুরু করবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে সে সোজা চলল সূর্যময়ের বাড়িতে। ফেসবুক কথাটি প্রথমে তার মুখ থেকেই শুনেছিল। সূর্যময় নির্বিধায় তাকে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করে দিলো। একটুখানি বুঝে নিল। এতেই ভীষণ রকমের খুশি সে। একটু একটু করে ফেসবুক সম্বন্ধে তার ধারনা জন্মালো।বর্তমানে কিছু লেখক-লেখিকার গল্প-উপন্যাস পড়েছে সে। তাদের নাম সার্চ করে অ্যাকাউন্ট গুলো খুঁজে নিল। তাদের লেখালেখি পদ্ধতি অবলম্বন করল। নতুন জিনিস। বেশ আগ্রহ জন্মেছে। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে এখন ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকে। বেশ কয়েকদিন পর ফেসবুকে একটা আস্ত বড় কবিতা লিখে পোস্ট করল। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করে দেখল -তিনটা লাভ রিয়্যাক্ট পড়েছে, আর তারা হল সূর্যময়, সংকেত,তৃধা। আশাহত হলো না। মনোবল জোর রেখে কাজ করে গেল। একটু একটু করে লাইক কমেন্টের সংখ্যা বাড়ল। তারপর হঠাৎ-ই একদিন কিছু ভেবে প্রোফাইলের ছবি পরিবর্তন করে নিজের ছবি দিল। মুহুর্তের মধ্যে অনেক লাইক কমেন্ট চলে এলো। সবুজ অবাক হলো! এত পরিশ্রম করে গল্প কবিতা লিখলো সেটা কেউ দেখলো না। অথচ তার ছবি সবাই দেখছে। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার রূপ রয়েছে। এই রুপ যে কোনো মানুষকে মুগ্ধ করতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করছে না এটা তার ছবি। বেশিরভাগ ফ্রেন্ডের ধারণা ছেলেটা আসলে অনলাইন থেকে কোনো ছবি নিয়ে প্রোফাইলে রেখেছে। মেসেঞ্জারেও এমন অনেক মেসেজ পেয়েছে। সবুজের আগ্রহ ক্রমশ ফিকে হয়ে গেল। ছবিতে তো সে নিজেই। কি করে তাদের কে বিশ্বাস করাবে? আবার একটা বছর ঘুরে এলো কিন্তু কিছু করে উঠতে পারল না। ফেসবুক এখন তার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে। প্রথম প্রথম বেশ ভালো লাগছিল। তারপর হঠাৎ করে তার গল্প আর কবিতা লাইক কমেন্টের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে তো বাড়তেই থাকে। তারপর আবার আছড়ে পড়ে। এখন খুব বেশি হলে একশো কিংবা আর একটু বেশি -এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তার ভালো লাগে না। এই অ্যাপেসের প্রতি দিন দিন ভালোবাসা হারিয়ে ফেলছে। ইতিমধ্যে সে অনেক মেয়ের ম্যাসেজ পেয়েছে। অনেকেই তার রূপের প্রশংসা করেছে। অনেকে তাকে ভালবাসার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু এ সব কিছু ভালো লাগে না। শুধুমাত্র কর্তব্য খাতিরে রিপ্লাই দেয়। শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ বোঝে। নিজে গিয়ে বলে তাঁর গল্পে লাইক কমেন্ট করতে। কিন্তু কেউ করতে চায় না। বর্তমানে নারীদের তার খুব বেশি ভালো লাগে না। সেই যে সাথীকে মন দিয়ে ভালোবেসে ছিল তার পর আর কাউকে মন দিতে পারে না। কারোর প্রতি কোনো আগ্রহ জন্মায়নি। নারীবর্জিত জীবনে বেশ ভালোই রয়েছে। এখনও ওই কিশোরীর মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলে সবকিছু ভুলে যায়। ক্লান্ত চোখে কল্পনায় ডুবে যায়। তার চোখে আর কোনো নারীকেই সুন্দর লাগে না। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। তবুও তার প্রতি কৌতূহল একদমই কমেনি। এখনও কথা বলার ইচ্ছা জাগে। কিন্তু বলার সুযোগ হয়ে ওঠে না। নিজের হৃদয়টাও ধীরে ধীরে যেন পাষাণ হয়ে উঠেছে। তার কথা মনে পড়লেই হেসে ওঠে। কল্পনায় আদর করে দেয়। চোখ দুটো ভিজে যায়। আবার মুহূর্তের মধ্যে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। লক্ষ্য স্থির রাখতে পারে না। শুকনো পাতার মতো সে বাতাসের গতি দিকে উড়ে যায়। এই এক বছরে অনেক পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে লেখা জমা দিয়েছে। কিন্তু কেউ গ্রহণ করেনি।অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে কোনো গুলোতে সুবিধা করে উঠতে পারেনি। একটা সময় সে ভীষণ ভেঙ্গে পড়ল। না, আর পারছে না। এভাবে চলতে পারে না। বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তাকে উৎসাহ দেওয়া মতো কেউ নেই। মানসিক শান্তি কার কাছে পাওয়া যাবে? পরিবার লেখালেখির বিরুদ্ধে। সবসময় কথা শুনিয়ে যায়। ওই সব লেখালেখি দিয়ে কিচ্ছু হবে না। সংকেত দূরে থাকলেও রোজ ফোন করতে ভুলে না। ভরসার পাত্র একমাত্র সে। সব সময় বলে, এক বছর পরিশ্রম করে কি জয় করা যায়? তাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে। সবুজ বলে, সে তো এক বছর নয় ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি করছে। অনেক পরিশ্রম করেছে। আর পারছে না। তবুও সংকেত বোঝায়, তাকে পারতেই হবে। লড়াইয়ের ময়দান ছোট নয়। তাকে উড়তে হবে, পড়তে হবে, আবার ভেঙ্গেও পড়তে হবে। সকালের মোটিভেশন বিকালে হারিয়ে ফেলে। রিপন এখন বাড়িতে থাকে না। তাই বিকেল হলে সূর্যময় চলে আসে। সবুজের ভরসার আর এক পাত্র সূর্যময়। সেও চেষ্টা করে বন্ধুকে সান্ত্বনা দেওয়ার। সবুজ সব শুনে কোনোরকম ভাবে টিকে রয়েছে। মনের জোর আগের থেকে অনেক কমে গেছে।

কয়েকদিন ধরে বাড়িতে খুব অশান্ত হচ্ছে। রাধাশ্যাম বাবু শহরে ফ্ল্যাট কিনেছেন। তিনি আর বড় ছেলে সেখানে থাকেন। ওখান থেকে রিপনের অফিস খুব কাছে। আর তিনিও খুব সহজে ব্যবসা-বাণিজ্য দেখতে পারবেন। রোজ রোজ গ্রাম থেকে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি চান, তার ছোট ছেলে এবং স্ত্রী যেন শহরে গিয়ে থাকে। তাতে ভালো হবে। সপ্তাহের শেষে আসার কোনো প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া অফিস থেকে এসে নিজেদেরকে রান্না করে খাবার খেতে হয়। ঘরবাড়ি পরিষ্কার করতে হয়। জামা কাপড় ধুতে হয়। এতকিছু পেরে উঠেন না। কাজের মাসি আছে কিন্তু সে তো এক বেলা রান্না করে আর বাসনপত্র ধুয়ে দিয়ে চলে যায়। আর বাদবাকি কাজগুলো কে করবে? বাকি দুবেলা রান্না কে করবে? তিনি স্ত্রীকে নিয়ে যেতে চান। অপর্ণা দেবীর যেতে অসুবিধা নেই। সবুজকে রাজি করালেই হবে। তাঁর ধারণা, সবুজ কিছুতেই গ্রাম ছেড়ে যাবে না। তাকে রাজি করানো সহজ হবে না। এই নিয়ে সকালে কথা কাটাকাটি হয়েছে। রাতে তিনি ছোট ছেলেকে ডেকে পাঠালেন। নতুন বাড়ি সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে গেছে। এখন সবুজ বাদে সবাই নতুন বাড়িতে থাকে। সবুজের জন্য এখানে নিজস্ব দুটো কক্ষ রয়েছে। কিন্তু তার নতুন বাড়ির প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। সে এখনও পুরনো বাড়িতে থাকে। পেছনের অংশটা ভাঙ্গা হয়ে গেছে। পুরো ভাঙ্গার কথা ছিল। সবুজের অনুরোধে তা হয়নি। যেটুকু ভাঙ্গা হয়েছিল সেটা পরে সুন্দর করে গড়ে তোলাও হয়েছে যাতে কেউ বুঝতে না পারে ওই অংশটা ভাঙ্গা। পুরনো বাড়ি থেকে নতুন বাড়ির ব্যবধান অল্প। অথচ সবুজ একবারও সেখানে যায়নি। খাবারের সময় মা পুরনো ঘরে এসে খাবার দিয়ে যান। রাতে একা এই ঘরেই থাকে। অপর্ণা দেবী ছোট ছেলেকে বারবার ডেকেছেন নতুন ঘরে। সে রাজি হয়নি। তার ভালো লাগে না। যেখানে আছে সেখানেই বেশ আছে। গতকাল রাতে দাদা আর বাবা বাড়ি ফিরেছে। সকালে কিছু একটা নিয়ে গন্ডগোল হয়েছিল সেটাও তার কানে পৌঁছায়। রাতে তার ডাক পড়ায় সে বুঝে গেল গন্ডগোল তাকে নিয়েই হয়েছে। কোনোরকম সংকোচন ছাড়া নতুন বাড়িতে পৌঁছালো। গৃহ প্রবেশের দিন এই বাড়িতে প্রথম আর শেষ বারের মতো এসেছিল। নীচেই ছিল উপরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। তবে খুব বেশি সময় ছিল না। বাড়িতে প্রবেশ করতেই একটু অবাক হলো। কত নামি দামি জিনিস রয়েছে। বিলেতি ধাঁচে বাড়িটি গড়া। অনেক নামিদামি পেন্টিং রয়েছে। দেওয়ালের একপাশে কাচের মধ্যে গ্রামীন শিল্পীদের গড়া অনেক ভাস্কর্য দেখতে পেল। এগুলো রিপন ভীষণ পছন্দ করে। সে এগুলো কিনে এনে রেখেছে। চোখ ধাঁধানো বাড়ি। এই তল্লাটে এমন বাড়ি আর নেই। চোখ দুটো জুড়িয়ে গেল। বুঝতে পারল, এতকিছু গৃহপ্রবেশের পরে করা হয়েছে। গৃহ প্রবেশের দিন সেগুলো দেখতে পায়নি। নিজের বাড়ি নিজের সবকিছু। অথচ তার কোনো কিছুর প্রতি লোভ নেই। সমস্ত কিছু তোয়াক্কা করে হল ঘরে গিয়ে বসলো। টিভিতে প্রোগ্রাম চালিয়ে দেখতে রইল। কিছু সময় পর বাবা মা আর দাদা এসে সামনাসামনি বসলেন। ভালোমন্দ একটু কথা বলেই রাধাশ্যাম বাবু জোর গলায় বললেন,’তোমার সমস্যা কি, আমায় একটু খুলে বলবে?’
‘আমার তো কোনো সমস্যা নেই?’ সহজ-সরল জবাব দিলো সবুজ।
‘তাহলে এ বাড়িতে এসে থাকো না কেন? উপরে দুটো কক্ষ তোমার জন্যই রয়েছে। সেগুলো তুমি চাও না? তুমি কি ভাবছো যে দাদার কক্ষে দামি দামি জিনিস রয়েছে আর তোমার কক্ষে কম দামি জিনিস রয়েছে? এমনটা আমি কখনও করতে পারি না। সবার ঘরে সমান দামে জিনিস রয়েছে। তোমার যদি উপরে থাকতে অসুবিধা হয় তাহলে নিচে চলে আসো। তোমার দাদা উপরে চলে যাবে।’
‘আমার তো কোনোরকম অসুবিধা নেই। আর আমি জানি, আমার বাবা কখনও এমনটা করবেন না। আমার চকচকে বাড়ি ভালো লাগে না। আমি ওই বাড়িতে বেশ আছি। পুরনো বাড়ির প্রতি আমার কেমন একটা টান পড়ে গেছে। ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। আমার ইচ্ছে করলে নিশ্চয়ই এ বাড়িতে এসে থাকবো।’
‘তা বললে তো হবে না। পাড়া-প্রতিবেশী আমাদের কথা শোনাচ্ছে। বড় ছেলে বাবার কাছ থেকে সব লুটে নিচ্ছে আর ছোট ছেলের ভাগ্যে কিছু নেই। ছোট ছেলে শান্ত কিছু বলতে পারে না তাই বড়ো ছেলে যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছে।’ রিপন বেশ জোর গলায় বলল। সবুজ শান্ত থেকে জবাব দিল,’লোকের কথায় কিছু আসে যায় না। ওরা অনেক কিছুই বলবে। শুনতে যাব কেন?’
‘এমনটা হয় না, ভাই। তুমি কেন বুঝছো না! লোকে ভাবছে আমি বাবা-মাকে তোমার থেকে আলাদা করে নিয়ে বাবার সমস্ত সম্পত্তি হস্তগত করতে চাই।এখন আমাদের বিয়ে হয়নি অথচ আমরা আলাদা আলাদা ঘরে থাকি। তাহলে বিয়ের পর আমাদের সম্পর্ক কোথায় পৌঁছাবে? এটা কি শোভনীয়?’
‘লোকে কি জানলো তা জেনে আমি কি করবো? কিন্তু তুমি আর আমি জানি আমরা কাউকে ঠকিয়ে সম্পত্তি নেওয়ার চেষ্টা করছি না। তাহলে আর অসুবিধা কোথায়? আর বাকি থাকলো আমাদের মধ্যে সম্পর্ক। আমাদের মধ্যে কেমন সম্পর্ক তা আমরা ভালোভাবে জানি। আমরা জানলেই তো হল। লোককে দেখানোর প্রয়োজন নেই।’
‘কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশী তো আমায় খারাপ ভাবছে।’
‘ভাবুক, তাতে তোমার কি? তাদের ভাবনায় কি তুমি খারাপ হয়ে যাচ্ছ?’
‘তোমায় বুঝিয়ে লাভ নেই। তুমি বুঝবে না।’ রিপন হতাশ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। বুঝে নিল ভাইকে বুঝিয়ে লাভ নেই। সে বুঝবে না তার কষ্ট। সবুজ শান্ত হয়ে গেল। চুপচাপ বসে নিঃশ্বাস ফেলল। রিপন কিছুটা সময় পর আবার বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যেখানে খুশি থাকো আমাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু তুমি কোনো কাজ করছো না কেন? বয়স তো হয়েছে। এবার কিছু কর।’
‘আমি চেষ্টা করছি। শীঘ্রই কিছু করব।’
‘তা কোনদিন হবে না। পড়াশোনা করোনি ঠিক আছে। কিন্তু এবার বাবার বিজনেস দেখাশোনা করো। বাবার সঙ্গে শহরে যাও। বাবার সঙ্গে একটু ঘুরতে ঘুরতে তুমি কাজ গুলো শিখে যাবে। কি বল বাবা?’ রাধাশ্যাম বাবু বলে উঠলেন,’হ্যাঁ, ঠিক তো। সবুজ, তুমি কাল থেকে আমার সঙ্গে শহরে চলো। একটু একটু করে কাজ শিখে নেবে। রিপন চাকরি করছে করুক। তুমি আমার ব্যবসা দেখাশোনা করো। আমারও বয়স হয়েছে। আমি একটু হালকা হতে চাই।’
‘দুঃখিত, আমার ব্যবসা সম্বন্ধে কোনো আগ্রহ নেই।’
‘তাহলে তোমার আগ্রহ কোথায়? তুমি কি সাধারণ মানুষ নও? সাধারণ মানুষের মতো ব্যবহার করছো না।’ রিপন বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ল। সবুজ কিছু বলল না। রিপন এবার জোর গলায় বলল,’তোমার জন্য আমি রাস্তায় বের হতে পারি না। কেউ-না-কেউ ঠিক আমাকে কথা শুনিয়ে যায়। ছোট ছেলে একদম উচ্ছন্নে গেছে। পড়াশোনা তো করল না। এখন টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। এগুলো আমার শুনতে ভালো লাগে না। যখন কেউ এসে আমায় বলে তুমি তো প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে কিন্তু ভাইটার কি হলো? তার কিছু হবে না? ওই ভাবে ঘুরতে থাকবে নাকি! তখন আমার কষ্ট হয়। রাগ হয়। ওদেরকে জবাব দিতে পারি না। শুধু কৃত্রিম হাসতে হয়। ওদেরকে কি জবাব দেবো বলতো?’
‘আমার পরিচয় দিতে যদি তোমাদের অসুবিধা হয়, তাহলে আমার পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই। আমার কিছু প্রয়োজন নেই।’
‘দেখেছো বাবা, ওর মুখ ফুটেছে। আগে কথা বলতো না। এখন মুখের উপর কথা বলছে। ওই শালার ব্যাটা সূর্যময়ের জন্য। ওর সাথে মিশে মিশে এমন হয়েছে।’
‘পরিবারের মধ্যে তাকে টানছো কেন? সে কি করলো?’
‘কি করেনি বল?’
এতক্ষণ ধরে কথা শুনে আসছিলেন অপর্ণা দেবী। তিনি আর শান্ত থাকতে পারলেন না। উত্তেজিত হয়ে বললেন,’কি হচ্ছে কি রিপন? সবুজ তো শান্তভাবে কথা বলছে। তুমি শান্তভাবে কথা বলতে পারো না?’
‘তুমি আর ওর হয়ে কথা বলো না। তুমি ঘরে থাকো কিছু জানো না। বাইরে বেরোলে বুঝতে পারতে। প্রতিটি পদে তোমার ছোটছেলের জন্য আমাকে কতটা অপমানিত হতে হয়।’ অপর্ণা দেবী জবাব দিলেন না। তিনি স্থান ত্যাগ করে ছোট ছেলের কাছে এসে বললেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’ওদের কথা বাদ দাও। তুমি আমায় বল। তুমি জীবনে কি হতে চাও?’ সলজ্জ চোখে মায়ের দিকে তাকালো। বলল,’আমি লেখালেখি করতে চাই। আমি লেখালেখির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই।’
‘ওই গুলো তোমার কাজ নয়। লেখালেখি আমাদের বংশে কেউ করেনি। তুমি কেন করতে যাবে? তাছাড়া আমার অবর্তমানে আমার এত সম্পত্তি দেখাশোনা কে করবে? এই সমস্ত কিছু তো তোমার দুই ভাইয়ের জন্য। আমি এতদিন সামলে এসেছি এবার তোমরা সামলাও।’ সবুজ জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,’আমার দাদু কি কাজ করতেন?’
‘হঠাৎ!’
‘বল না?’
‘বাবা কৃষক ছিলেন। মাঠে কাজ করতেন।’
‘তাহলে তোমারও তো মাঠে কাজ করার কথা। তুমি কেন বিজনেস করছো?’ সবুজের মুখে এমন কথা মোটেও প্রত্যাশা করেননি রাধাশ্যাম বাবু। তিনি থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন। রেগে উঠল রিপন। দাঁড়িয়ে পড়ে রাগে গনগন করতে রইল। নাকের ডগা কানের লতি গরম হয়ে উঠেছে। জোর গলায় বলল,’মাথায় তুললে যা হয়। আগে দশটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে একটা উত্তর দিতো। এখন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে সে দশটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে। তোমার ছেলের উন্নতি হয়েছে। তাকে সামলাও। আমি পারবো না। ও কি করল না করল সে-ই নিয়ে আমি আর কিছু মন্তব্য করব না। তোমরাও ওর সম্বন্ধে আমাকে কিছু বলো না। আমি আর এর ব্যাপারে নাক গলাতে চাই না।’ রিপন রেগে নিজের ঘরে ফিরে গেল। কিছুক্ষণ নিরবতা রইল। ঘন নীরবতা। একটু পর নীরবতা ভেঙ্গে রাধাশ্যাম বাবু বললেন,’দেখো সবুজ, এমনটা হয় না। তুমি বড়দের কথা শোনো। বয়স তোমার অল্প। কিছু বছর পর বুঝতে পারবে লেখালেখি করে কিছু হবে না। ও সব মধ্যযুগে চলতো। সেগুলো এখন আর চলবে না। তখনকার মানুষের সময় কাটতো না তাই তারা বই পড়তো। আর এখন মানুষ সময় পায় না। একটা সময় আমিও প্রচুর বই পড়তাম কিন্তু এখন পড়ি না। সময় যে নেই তা কিন্তু নয়। বইয়ের প্রতি আগ্রহ নেই। এখন যুগ আধুনিক হয়েছে। ঘরে ঘরে টিভি মোবাইল রয়েছে। এত সুবিধার পর মানুষ কেন বই পড়তে যাবে?’ তিনি থামতেই অপর্ণা দেবী বললেন,’তোমার বাবা ভুল কিছু বলছে না। তুমি বোঝার চেষ্টা করো। যুগ আধুনিক হয়েছে তুমি পেছনে থাকলে চলবে না। তুমি নিজেই বর্তমানে কয়েকজন লেখকের নাম বলতে পারবে? হাতেগোনা একটা কিংবা দুটো। তাই তো!’
‘তোমাদের কথা অমূলক নয়। কিন্তু তোমাদের কথাও সম্পূর্ণ সঠিক নয়। আমাদের ছোটবেলা কেটেছে রবি ঠাকুর শরৎচন্দ্রকে চিনে। তাঁদের সৃষ্টি কিছু চরিত্র মাথার মধ্যে সব সময় ঘুরতো। আমরা সেগুলো নকল করে সময় কাটাতাম। কিন্তু বর্তমানে অনেক বাচ্চাই তাদের নাম শুনেনি। আমি একটা বছর অনলাইনে ঘুরে দেখে নিয়েছে মানুষের ঝোঁক কোন দিকে বেশি। আমরা যে সমস্ত লেখকদের শ্রদ্ধা করতাম ভক্তি করতাম। এখনকার কিছু কিছু মানুষ আমাদের প্রিয় লেখকদের নিয়ে ট্রোল করে মিম বানায়। এরা রবীন্দ্রনাথের একটা দুটো রচনা পড়ে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করে। তাদের সঙ্গে অন্তত আমার তুলনা করো না।’ একটু থেমে আবার বলল,’বিজ্ঞান আমাদের অলস বানায়। আর সাহিত্য আমাদের ভাবতে শেখায়। আর পৃথিবীর প্রত্যেক সৃষ্টিই ভাবনা থেকে এসেছে। বিজ্ঞানের আগে সাহিত্যের প্রয়োজন। পৃথিবীতে যতদিন নতুন সৃষ্টির প্রয়োজন থাকবে ততদিন পর্যন্ত সাহিত্যরও প্রয়োজন থাকবে। এগুলো আমার মুখের কথা নয়। একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই জানতে পারবে পৃথিবীর বড় বড় সমস্ত বৈজ্ঞানিক সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন। তাঁরা এত কিছু আবিষ্কারের মধ্যেও দিনের অনেকটা সময় বই পড়ে কাটাতেন।’

পর্ব ১৩ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here