নিরুদ্দেশ পর্ব ১০

নিরুদ্দেশ
পর্ব ১০

আবার একটা বছর ঘুরে এলো কিন্তু লীলা ফিরলো না। সংসারের অনাবিল প্রাপ্তির হাসি পূর্বেই হারিয়ে গেছে। শিশুর মায়ের চোখের জল শুকিয়ে গেছে। সে এখন আর কাঁদে না। নিজেকে সব ক্ষেত্র থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। মা থাকতে সন্তানের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া যে কতখানি বেদনাদায়ক তা কেবল সন্তান হারানো মা-ই বোঝে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছে, মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেরিয়েছে, কত তান্ত্রিকের কত উপাসনা পালন করেছে। কোনো লাভ হয়নি। ঈশ্বর সন্তান হারানো মায়ের কাতর প্রার্থনা শোনেননি। সংসারের দায়িত্ব তাকে ছাড়তে হয়নি। একা একা যেন পূর্বের প্রথা উবে গেছে। এখন তার কথা কেউ শোনে না। সেও কোনো কিছুতে নাক গলায় না। পরিবারের মধ্যে কেমন একটা ছন্নছাড়া ভাব চলে এসেছে। সবাই নিজের মত করে থাকে। কেউ নতুন করে দায়িত্বও নেয়নি। অন্তিমও নিজের সন্তানকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে। এখন আর জুয়ার আড্ডায় যায় না। একটু কাজে মনোযোগী হয়েছে। স্ত্রীর কাছে সবসময় থাকে। সান্ত্বনা বাক্য ছাড়া কিছুই দিতে পারে না। সে আশাবাদী তার সন্তানের কিছু হয়নি। কিছু হতে পারে না। যেখানে আছে সেখানে ভালোই আছে। সান্ত্বনাতে এখন আর খুশি করা যায় না অর্চনাকে। অট্টহাসি হেসে ওঠে। উন্মাদের মতো আচরণ করে। মাঝে মধ্যে কারোর সঙ্গে কোনো কথা বলে না। খাওয়া-দাওয়াও করে না। জোর করলে রেগে যায়। আবার শিশুর মতো কেঁদে ওঠে। তার এমন আচরণে পরিবারের কেউ বিরক্ত হয় না। সবাই বোঝে সন্তান হারানোর কষ্ট। কয়েকদিন হল রায়বাবুর শরীর খুব খারাপ যাচ্ছে। কথা বলা একদমই বন্ধ করে দিয়েছেন। খাবার ঠিকমতো খাচ্ছেন না। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে গেছে। সুস্থ হওয়ার কোনো ইঙ্গিত খুঁজে পাচ্ছে না। এবার রায়বাবুর জন্মদিনও পালন হয়নি। ঘটা করে কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। গ্রামের মানুষও ধীরে ধীরে এই পরিবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তারা রায়বাবুর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। তাদের পরিবারের অবস্থা খারাপ। এই পরিবারের আর সামর্থ নেই তাদেরকে সাহায্য করা। যতদিন ছিল ততদিন নির্বিধায় করে গেছে। এখন অনেকেই রায়বাবুকে দেখতে আসেন। তাঁর পছন্দের খাবার কেউ কেউ বানিয়ে নিয়ে আসেন। তিনি মুখে নিতে পারেন না। তবে নির্মল মুখমণ্ডল দেখে বোঝা যায় তিনি ভীষণ রকমের খুশি। তিনি গ্রামবাসীর ওপর এটুকুই ভরসা করেছিলেন এবং পেয়েছেনও। সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তাঁর বর্তমান অবস্থা দেখে দুঃখ প্রকাশ করে। তারা আর এই পরিবার থেকে সাহায্যের প্রত্যাশা করে না। নিষ্ঠুর মত কেউ পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো বাক্য প্রয়োগ করে না। রায় পরিবার তাদের জন্য যা করেছে রক্তের সম্পর্কে মানুষেরা তা কখনও করেনি। রায়বাবু গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সমস্ত আত্মীয়-স্বজনকে খবর দেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই যেন তারা ফিরে আসে। একে একে বাড়িতে আত্মীয় স্বজনে ভরে উঠলো। সবুজের কানে পৌঁছালো সামনে বৃহস্পতিবার সাথী বাড়ি ফিরছে। আনন্দে কৌতুক মন নড়েচড়ে বসল। একটা বছর হলো তার সঙ্গে দেখা হয়নি। কয়েকটা মাস ঠিক মতো কথাও হয়নি। অনেক অভিমান হয়েছে। তাকে দেখার অসুখ বেড়েছে। মনে মনে তার একটা ছবি বানিয়ে নিয়েছে। এখন যৌবনে পা দিয়েছে। এই বয়সে শরীর মন দুটোই দ্রুত পরিবর্তন হয়। মনের জোর প্রচুর থাকে। সমস্ত কিছুকে জয় করার স্বপ্ন দেখা যায়। এটাই পরিবর্তনের সময়। সাথীর নিশ্চয়ই অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই বালিকা হয়ে নেই। আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখতে রইল। তার নির্জীব মনে কুসুমকলি ফুটে উঠল। সাথীর নরম হাত স্পর্শ করলেই শান্তি। ভালোবাসার মানুষটির চোখের দিকে তাকিয়ে অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সাথী তো শহরে থাকে। সে নিশ্চয়ই অনেক আধুনিক হয়ে উঠেছে। এই গ্রাম্য বাড়ি, কাদা-মাটি, সবুজ গাছপালা, ঘামে ভেজা সাধারণ মানুষ, এগুলো কি সে আর পছন্দ করবে? সেও চাইতে পারে তার পছন্দের মানুষটা তার মতো স্মার্ট উচ্চশিক্ষিত হোক। না না সাথী এমনটা হবে না। সে ভালো মেয়ে। গ্রামেই তার জন্ম হয়েছে। গ্রামের ঐতিহ্য সংস্কৃতি তার মনে প্রাণে জুড়ে রয়েছে। সহজে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। তবুও সবুজের মন বারবার খারাপ কিছু ইঙ্গিত করছিল। অনেকদিন হলো দাড়ি গোঁফ সেভ করা হয়নি। একা একা সেভ করে ফেলল। বাচ্চা দেখালো। তার রূপ এখনও যে কোনো নারীর হৃদয় জয় করতে খুব বেশি সময় নেবে না। যতই বয়স বাড়ছে ততই তার রূপ উপচে পড়ছে। যথাসময়ে সাথী বাড়ি পৌঁছাল। কেমন একটা লজ্জা বোধ হলো সবুজের। তার সামনে গেল না। অপেক্ষা করল সাথী নিশ্চয়ই দেখা করতে আসবে। একট,দুটো,তিনটা দিন পেরিয়ে গেল কিন্তু সাথী তার কাছে আসলো না। বেশ কয়েকবার মুখোমুখি হয়েছে কিন্তু কথা না বলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অভিমান না রাগ হয়েছে বুঝে উঠতে পারল না সবুজ। এই ক’টা দিনে সে লক্ষ্য করেছে, সাথী বেশ সুশ্রী, মুখখানি খাসা,এত কোমল,এত সংবেদনশীল,এত সুখ রুচিসম্পন্না,এত সেবাপরায়না,রুপ-গুনের এমন চমৎকার সুশীল হয়েছে। সারাদিন ফোনে কারোর সাথে কথা বলে। তাকে শহরের নবীনতা ছুঁয়েছে। একটিবার তার সাথে দেখা না করায় খুব অভিমান হল। নিজে থেকে তার ঘরে গেল। পূর্বের মত সম্মান পেল না। তাকে সামান্য বসতে বলল না। তাকে চিনতে পেরেছে এটাই অনেক। হৃদয় যন্ত্রনায় ছটফট করছে তবুও মুখে কৌতুক বজায় রাখল। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সাথী অদ্ভুত আচরণ করল। তার সাথে কথা তো বললো না উল্টে ফোনে কারোর সাথে হাসি আড্ডায় মেতে রইলো। সবুজকে দেখলো তবুও হুঁশ ফিরল না। অনেকটা সময় পর ফোন রেখে সবুজকে জিজ্ঞেস করল,’কিছু বলবে?’ সবুজ ছিটকে উঠলো। কতদিন কথা হয়নি। কত কথা জমে আছে। অথচ সাথী জিজ্ঞেস করছে কিছু বলবে কি না! আচরণ খুবই অপ্রত্যাশিত। সবুজ মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলল। সাথী শান্ত গলায় বলল,’দেখো, তখন তোমার এবং আমার দুজনের বয়স অল্প ছিল। আবেগের বশে অনেক কিছু বলে ফেলেছি। ওইগুলো এখন মাথায় এনো না। আর আনলেও আমার কিছু করার নেই। আমি পারবো না তোমার সাথে থাকতে। তোমার মতো উন্মাদ ছেলে আমার হতে পারে না। শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি। তুমি অসুস্থ। তোমার চিকিৎসার প্রয়োজন। যখন ছোট ছিলাম তখন তোমার আচরণে মজা পেতাম। আবেগে আগ্রহে ঢলে পড়েছিলাম। কিন্তু এখন বড় হয়ে বুঝতে পারছি ওমন আচরণ কোনো সাধারণ মানুষের হতে পারে না। তুমি সত্যি সত্যি অসুস্থ। এত অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে সারাজীবন থাকা যায় না। তুমি একটা ছোট্ট জগতে বেঁচে আছো। বাইরে বেরিয়ে দেখো জগৎটা অনেক বড়। তোমার ওই একটা ধারণা নিয়ে এ জগৎ টিকে নেই। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। পড়াশোনা করো। সবাই চাইবে তার জীবন সঙ্গী তার সমকক্ষ হোক। আমি উচ্চশিক্ষা লাভ করতে চাই, কিন্তু তুমি? আমি বর্তমান বাস্তবকে নিয়ে বাঁচতে চাই,কিন্তু তুমি? তোমার সাথে আমার কোনো মিল নেই। তুমি কেমন একটা। তুমি বড্ড হ্যাংলা গো।’ সবুজ নির্লিপ্তি চোখে শুধু সাথীকে দেখে গেল। সাথী বদলে গেছে। বেমালুম বদলে‌ গেছে। তার চোখে কোনো মায়া নেই। সে অন্যায় করছে। তার জন্য কোনো অনুতাপ নেই। সবুজ কোনো কথা বললো না। সাথী আবার বলল,’আমার প্রতি কোনো অভিযোগ রেখো না। তখন বালিকা বয়স ছিল। আমি কি বলেছি নিজেও জানি না। ওই সব কথাগুলোকে অত গুরুত্ব দিও না।এটুকু স্বীকার করতে আমার আপত্তি নেই,-তুমি ছিলে বলে আমার ছোটবেলা অনেক রঙিন ছিল। অনেক দুষ্টুমি করেছি। তার মানে এই নয় তোমার সঙ্গে ঘর বাঁধতে হবে। সারা জীবন একসঙ্গে থাকতে হবে।’ সবুজ তথাপি চুপ রইল। সাথী আবার বলল,’কোনো অভিযোগ নেই তো?’ সবুজ ‘না’ বলল।
‘বেশ, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। দেখেছো তো বৌদিমণি লীলাকে হারিয়ে কিভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। তোমার মাও ওই ভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। মায়ের কাছে ফিরে যাও।’ সাথী তার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সবুজ যেমন ভাবে ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল অমন ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তার রূপে কত মানুষ আকৃষ্ট হয়েছে। যদিও তার রূপ নিয়ে কখনও অহংকার ছিল না। একসময় সাথীও আকৃষ্ট হয়েছিল তার রূপে। তবে ধরে রাখতে পারল না। এই প্রথম কেউ তাকে ফিরিয়ে দিল। সে খুব শক্ত মানুষ। সহজে চোখে জল আসে না। তবুও দু-চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো। বুক হাহাকার করে উঠলো। নিঃসঙ্গতা নির্জনতা চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ধরলো। ঘনঘন নিশ্বাস পড়ল। সাথী বেশিদিন রইল না। আবার শহরে ফিরে গেল। যাওয়ার সময় একবারও সবুজের সাথে দেখা করলো না। সে যাওয়ার পর সবুজ বার কয়েক বার ফোন করেও কিছু সুবিধা করতে পারল না।

বিকেলবেলা,সূর্য মামার সাথে সাথে এক ঝাঁক পাখি গুনগুন শব্দ করতে করতে বাসায় ফিরছে। অসংখ্য ফড়িং একটা জায়গায় জড়ো হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। দু- তিনটে বাচ্চা ছেলে সাইকেল নিয়ে একই রাস্তায় বারবার যাচ্ছে আর আসছে। সবুজ দো-তালায় রুপাদির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশ দেখছে। সারা মুখমন্ডল জুড়ে অন্ধকার ছেয়ে রয়েছে। বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ করতে পারছে না। সে আবার একবার রূপাদির ঘরের মধ্যে গিয়ে ফিরে এলো। বড়োদি তাকে ডেকেছে। কেন ডেকেছে জানে না। হয়তো কোনো কাজ দেবে। এ-দিক ও-দিক চোখ বুলিয়েও দেখতে পেল না। নিচে নেমেও আসলো না। অপেক্ষা করলো। ধীরে ধীরে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। সবুজ কিছুতেই নিজের মনের বিষণ্নতা দূর করতে পারছে না। একঘেঁয়েমি আর অস্বস্তি বোধ করছে‌। জড়তা কাজ করছে। প্রতিদিন কিছু না কিছু লেখে। এখন লেখায় মন দিতে পারছে না। বিতৃষ্ণায় ভুগছে। বাড়ির বাইরে বের হচ্ছিল কাজল। হঠাৎ সবুজকে উপরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুব বেশি অবাক হলো না। সে অবাদে সব জায়গায় চলাফেলা করে।সেই সুবিধার্তে সে বড় দিদির ঘরের সামনে যেতেই পারে। তবে কয়েকদিন ধরে দেখে আসছে সবুজ কেমন মনমরা হয়ে আছে। মুখ শুকিয়ে ফেলেছে। করোর সাথে ঠিকমত কথা বলছে না। নিজের যত্ন নেয়নি। কি হয়েছে তার? মন খারাপ? সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে আসলো। পাশে দাঁড়ালো। সবুজ তার উপস্থিতি টের করতে পেরে মুখ ঘুরে মুচকি হাসলো। কাজল তার মুখের পানে তাকিয়ে বলল,’কি হয়েছে তোমার? মনে হচ্ছে কোনো বিষয়ে ভীষণ পিড়িত?’
‘কই? কিছু না তো। আমি ঠিক আছি।’ সবুজ সহজ-সরলভাবে জবাব দিল।
‘বল,কি হয়েছে? সবকিছু নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখলে কষ্ট কি দূর হবে? আমি তো আর অন্তর্যামী নয় যে অন্যের সবকিছু বুঝে যাবে।’ সবুজ কাজলের দিকে তাকিয়ে স্লান হাসলো। কাজল আবার বলল,’বলো, কি হয়েছে?’
‘আমি বাড়ি যেতে চাই। বাড়ির জন্য মন কেমন হচ্ছে।’
‘এ তো ভালো কথা। ফিরে যাও। এর জন্য মুখ অন্ধকার করে রেখেছো কেন? হাসো। না হাসলে তোমায় ভালো লাগে না।’
‘আমি বাড়ি ফিরে গেলে এখানে আর আসবো না। যদি কোনোদিন ফিরি তাহলে কিছুদিনের জন্য তারপর আবার চলে যাব।’
‘অসুবিধা নেই। তুমি তোমার বাড়িতে থাকলেই ভালো থাকবে।’ সবুজ হালকা হাসলো। বলল,’তাহলে আমি কালকেই চলে যাই?’
‘যখন ইচ্ছে হয় তখনই যাও। তবে যাওয়ার আগে..।’ একটু থেমে আবার বলল,’বাবা তো অসুস্থ কথা বলতে পারেন না। বৌদিমণিও সুস্থ হননি। মাকে বলে দেখি। চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। তোমার বাড়ি যাওয়া কেউ আটকাবে না।’
সবুজ কিছুটা আশ্বস্ত হলো। তার বাড়ি ফেরা নিয়ে কোনো ঝামেলা হলো না। তবে পরের দিন যেতে দিল না। সবুজ এ বাড়িতে অনেকদিন থেকে গেছে। একটা মায়া পড়ে গেছে। সবুজ এবং তার বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের জন্য নতুন পোশাক কেনা হলো। সেখানকার কিছু বিখ্যাত শুকনো খাবার ডিব্বের মধ্যে ভরে দিল। দুপুরে ভালো মন্দ রান্না হল। বর্ণালী দেবী সবুজের বাবা-মায়ের জন্য সেখানকার পরিচিত পিঠে বানিয়ে দিলেন। গোছানোর দায়িত্ব পড়ল কাজলের উপরে। তাদের আতিথিয়তায় আপ্পায়ন দেখে বড্ড অবাক হলো সবুজ। বাড়ির মেয়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার পূর্বে মায়েরা যেভাবে আদুরি মেয়ের প্রিয় জিনিসের সাথে সাথে ওই বাড়ির সদস্যদের জন্য খাবার কিংবা পোশাক-আশাকে……।
সে শুধুমাত্র এ বাড়ির কাজের ছেলে আর কিছু নয়। তবুও তাকে কত আদর যত্ন করে রেখেছে। বিদায় বেলাও কোনো ত্রুটি রাখতে চায় না। চোখ দুটো জলে ভরে গেল। তাদের সাথে যত মিশছে ততই তাদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ছে। দুপুরের ট্রেনে ফিরবে তাই তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে নিল। খাওয়ার পর অপেক্ষা করল না। তৈরি হয়ে নিল। সবুজের বিদায় সবাই সামনে থেকে মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে সবাই কষ্ট পাচ্ছে। কেউ মানতে চাইছে না। এ বাড়িতে চারটা বছর কাটিয়েছে সে। কত আপন হয়ে উঠেছে। প্রতিটা পদে স্মৃতি গড়ে উঠেছে। দুঃখ-কষ্ট সবকিছুতে আপন হয়েছিল। সবুজ ভীষণ মনমরা। এ বাড়ি ছেড়ে যেতে ভালো লাগছে না আবার এ বাড়িতে থাকার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। সবকিছু অন্ধকার লাগছে। বর্ণালী দেবী তাকে একা যেতে দিলেন না। অন্তিম কিছু কাজের জন্য শহরে গেছে। কাজলের উপর দায়িত্ব পড়ল তাকে ছেড়ে আসার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলো সে। যাওয়ার সময় বৌদিমণি আর রায়বাবুকে পাশে দেখতে না পেয়ে একটু কষ্ট হলো। মানুষ দুটো তার জন্য কম ভাবেনি। প্রতিটি ক্ষেত্রে জুড়ে রয়েছে। শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিজের দায় শেষ করতে পারে না। শেষবারের মতো রায়বাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেল। দরজা খুলতেই একটা বিকট গন্ধ নাকে ভেসে এলো। ঘরটি বেশ অন্ধকার। সুইচ অন করে দেখলো বিদ্যুৎ নেই। জানলা খুলে দিল। হালকা সূর্যালোক ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। ঘরটি বেশ সাজানো-গোছানো হলেও বিচ্ছিরি একটা গন্ধ বেরোচ্ছো। মানুষের যাতায়াত যে খুব কম তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রায়বাবুর মাথার কাছে গিয়ে বসলো। তিনি ঘুমাননি। জেগে আছেন। সবুজ বিড়বিড় করে তার বিদায়ের জন্য অনুমতি চাইলো। তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। হাত-পা নাড়ার শক্তিটুকু নেই। কিছুক্ষণ পর লক্ষ করল উনার চোখ থেকে জলের ধারা কানের গোড়া দিকে বয়ে যাচ্ছে। সবুজ আর চুপ থাকতে পারলো না। মনের কোনো স্থানে ভীষণ পীড়া পেলো। অন্তঃকরণ থেকে হু হু করে কান্না বেরিয়ে এল। মানুষটি তার জীবনে জড়িয়ে পড়েছে। বেশিদিন বাঁচবেন না। এটাই হয়তো শেষ দেখা। মানুষটির নিঃস্বার্থ ত্যাগ কোনোদিন ভুলবে না সবুজ। তাঁকে দেখে অনেক কিছু শিখেছে। অনেক উপলব্ধি করেছে। এই পৃথিবীতে এখনও স্বার্থপর মানুষে ভরে যায়নি। ভালো মানুষ রয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ মুখের পানে তাকিয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আবার একবার উঁকি মেরে দেখল। একটা পিছুটান রয়েছে। তবুও মায়ার বন্ধন ছেড়ে বেরোতে হবে। না, আর অপেক্ষা করতে পারল না। চোখের জল মুছে সোজা সিঁড়ি ভেঙ্গে বউদিমণির রুমে গেল। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাকে জেগে তুলল। ঘুম থেকে উঠে সবুজকে পরিপাটি অবস্থায় দেখে একটু আশ্চর্য হল। ঘুম ঘুম চোখে বলল,’এই ভর দুপুরে কোথায় যাবে?’
‘আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি দুপুরের ট্রেনে।’ বৌদিমণি মাথা চুলকালো। কিছু একটা ভাবল। তারপর অদ্ভুত ভাবে হেসে বলল,’হ্যাঁ, সকালেই তো শুনেছিলাম। দেখেছো সকালের কথা দুপুরে ভুলে গেছি। কিছু মনে থাকে না।’ আবার একবার হেসে উঠল। সবুজের বড় কষ্ট হলো। তার অসুখের সময় বৌদিমণি কত যত্ন করেছিল। সময়ের মত খাবার ওষুধ কোনটাই অভাব রাখেনি। একবার লীলা তার কাছে ছিল আর সে মুখ বন্ধ করেছিল বলে কত বকুনি দিয়েছিল। সেদিন বৌদিমণির উপর একটু অভিমান হয়েছিল। আজ সেই অভিমান নেই। তিনি মা। সন্তানকে না দেখতে পেলে কষ্ট তো হবে। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী আজ সন্তানকে হারিয়ে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে। ইচ্ছে করছিল অনেকক্ষণ ধরে কথা বলতে। কিন্তু সময় নেই। তাকে ফিরতে হবে। ট্রেনের সময় হয়ে আসছে। বৌদিমণির পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। সে সবুজের থুতনি ছুঁয়ে মায়ের মত আদর করলো। বলল,’বড় হও। অনেক বড় হও। আর দ্বিতীয়বার ভুলেও মায়ের থেকে হারিয়ে জিও না। মায়ের খুব কষ্ট হয়। মায়ের কাছে থাকবে আর কোথাও বেরোলে মাকে বলে যাবে। সময় পেলে আবার এই বাড়িতে এসো। তোমার জন্য সবসময় এ বাড়ির দরজা খোলা থাকবে।’
‘কথা দিলাম, মাকে ছেড়ে আর কোথাও হারিয়ে যাব না। সন্তান হারানো এক মায়ের কষ্ট দেখে বুঝেছি, সন্তান হারানোর কষ্ট কতটা ভয়ানক!
সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামার পর একবার কাজলদির ঘরের দিকে যেতে ইচ্ছে করলো। কত স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। ওইখানে বসে অনেক গল্প করেছে। কিছুটা দূরে নিজের ঘর রয়েছে। সেখানেও অগাত স্মৃতি। সব স্মৃতি বুকে পুরে নিল। একা একা হেসে উঠলো।

ট্রেনের মধ্যে খুব বেশি কথা বলল না কাজল। শুধু সবুজের দিকে তাকিয়ে রইল। জানালার পাশে বসে সে দূর দিগন্তে মাঠ দেখে যাচ্ছে। নিজে থেকে কাজলের সাথে কথা বলছে না। তার দিকে তাকাতেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অস্বস্তি বোধ করছে, না কথা বলতে ইচ্ছে করছে না -কিছুই বুঝতে পারলো না। হয়তো কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট আর বাড়াতে চায় না তাই তার দিকে তাকাচ্ছে না। মুখের পানে তাকাতেই বহু স্মৃতি এসে জড়ো হচ্ছে। সে আর স্মৃতিচারণ করতে চায় না। চার বছর পর বাড়ি ফিরছে মনের মধ্যে উচ্ছ্বাস আনন্দ কিছুই নেই। কাজল কিছু একটা খুঁজতে লাগল। সবুজ যেন ঘরের টানে ঘরে ফিরছে না। সে কিছু একটাতে আঘাত পেয়েছে। সেই আঘাতের তীব্রতা এত যে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হচ্ছে। সেই আঘাতটা কিসের, তাও অনুমান করতে লাগল কাজল। সহজে খুঁজে পেল না। নিজের যুক্তি তক্কো গুলো হারিয়ে গেল। ট্রেন থেকে যখন নামলো তখন সন্ধ্যা হতে খুব বেশি বাকি নেই। নেমেই একটা বুকভরা শ্বাস নিল সবুজ। কত দিনের পর নিজের শহরে ফিরেছে। চেনা অলি-গলিতে চলে এসেছে। স্টেশন থেকে কিছুটা হাঁটার পর বাস স্ট্যান্ড। সবুজকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিল কাজল। আর যেতে চাইলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে স্টেশনে ফেরার ট্রেন চলে আসবে। সবুজ বলল,’আজ আর না ফিরলে হয় না? রাতটা আমাদের বাড়িতে থেকে যাও।’
‘তা হয় না সবুজ। অন্য কোনো দিন আসবো।’
‘অন্য কোনো দিনটা আর কখনও আসবে না। চলো না একবার আমাদের বাড়িতে!’
‘বাচ্চাদের মতো জেদ করো না। ট্রেনের টিকিট অলরেডি কেটে নিয়েছি। তাছাড়া বাড়িতে সবাই জানে ফিরে যাব। এভাবে থেকে যাওয়াটা ভালো চোখে দেখায় না।’ সবুজ আর জোর করলো না। কিছুক্ষণ পর বাস এসে পৌছালো। তাড়াহুড়ো করে উঠে পরল। ব্যাগ পত্র গুছিয়ে দিল কাজল। সবুজ জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কাজলদিকে বিদায় জানালো। কাজল হাসিমুখে বলল,’সাবধানে যেও। ভালো থেকো।’
‘রাত হয়ে গেছে। তুমিও সাবধানে বাড়ি ফেরো। রুপাদিকে ফোন করে নেবে। রাতে স্টেশন থেকে দুজন গল্প করতে করতে ফিরে যাবে।’
‘ঠিক আছে। আমি আসছি কেমন?ট্রেনের সময় হয়ে গেছে।’ সবুজ মাথা নাড়ালো। কাজল ধীরে ধীরে স্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে গেল।বাস তখনও ছাড়েনি। জানালা দিয়ে মুখ বের করে কাজলকে দেখলো। সে ধীর পায়ে স্টেশনের দিকে চলে যাচ্ছে। বাস ছেড়ে দিতে মুখ ভরে নিল। পেছনের দিকে একবার ঘুরে দেখল। না, কাজলদিকে আর দেখা যাচ্ছে না। মন খারাপ হয়ে গেল। বুকের মধ্যে কোথাও শূন্যতা অনুভব করল। এতদিন ধরে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।কাল থেকে সেই ঘোর কেটে যাবে। ওই বাড়িতে যে কেউ এসে তার সঙ্গে বসে গল্প করত। তাকে ঘুরতে নিয়ে যেত। কত কথা হতো। একা ফিল হতো না। আজ থেকে আর কথা হবে না। বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকবে। বন্ধুরাও কি আর আগের মত আছে? সাথী যদি একটা বছরে বদলে যেতে পারে তাহলে বন্ধুরা কেন চারটা বছরে বদলে যাবে না? তারা এখন বড় হয়েছে। পড়াশোনার জন্য হয়তো বাইরে কোথাও রয়েছে। তাকে সময় দেওয়ার মত সময় পাবে না। তবুও মন থেকে বিশ্বাস করতে পারল না। না, সংকেত ও সূর্যময় কখনও এমনটা করবে না। তার আশার খবর কানে পৌঁছালে ছুটে আসবে। বন্ধুদের কথা ভেবে মুচকি হেসে উঠলো। যথা সময়ে পৌঁছে গেল। রাত হয়েছে। তাই চারপাশে পরিবর্তনগুলো চোখে পড়লো না।
দীর্ঘদিনের পর সন্তানকে দেখে অপর্ণা দেবী ভয়ঙ্করভাবে কেঁদে উঠলেন। তাঁর কান্নার শব্দ মুহূর্তের মধ্যে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই জানতে পারল সবুজ নিজে থেকে বাড়ি ফিরে এসেছে। তাড়াহুড়ো করে দাদা ওপর থেকে নীচে নেমে আসলো। মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে রইলো। সবুজ দাদার দিকে তাকালো তবে কোনো কথা বলল না। সবুজ বাবার খোঁজ করলো। তিনি বাড়িতে নেই। কাজের জন্য এক সপ্তাহের মতো শহরে গেছেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। বাবা থাকলে বকুনি দিতেন। অনেক কথা শোনাতেন। এখন কথা শোনানোর মত কেউ নেই। মা নিশ্চয়ই ফোন করে তার ফিরে আসার খবর জানিয়ে দেবেন। বাবা যতদিনে বাড়ি ফিরবেন ততদিনে সবকিছু শান্ত হয়ে যাবে। নিজের ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ল। জামা কাপড় খুলতে ইচ্ছে করলো না। মা রান্না চড়িয়ে ছেলের কাছে ফিরে আসলেন। এতদিন কোথায় ছিল? কি কি করেছে? পরিবারের কথা মনে পড়েনি? হঠাৎ ফিরে আসলো কেন? মা আগ্রহের সঙ্গে সমস্ত কিছু জানতে চাইলেন। সবুজ কোনোকিছুই লুকালো না। ওই বাড়ি থেকে পাঠানো সমস্ত জিনিস বের করল। নিজে হাতে একটা একটা জিনিস নাড়িয়ে চাড়িয়ে মাকে দেখাতে দেখাতে সমস্ত ঘটনা বলল। বাড়ির প্রত্যেকের সম্বন্ধে কিছু না কিছু বলল। শুধুমাত্র সাথী ওই বাড়ির ছোট্ট মেয়ে এই কথা বলে এড়িয়ে গেল। তার সঙ্গে যে একটা গভীর সম্পর্ক ছিল সে কথা স্বীকার করল না। নতুন জিনিসের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই অপর্ণা দেবীর। তিনি ছেলের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকলেন। তার হাত নাড়ানোর ভঙ্গি গলার স্বর মাথা নাড়ানোর ধরন ঠোঁট উল্টানোর ভঙ্গি কিছু পরিবর্তন হয়নি। সব একই আছে। তাঁর সবুজ সবুজই আছে। শুধুমাত্র দাড়ি গোঁফ বেরিয়েছে। তিনি কোনো কথা বলতে পারলেন না। একদৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সবুজ মাকে দেখে একটু অবাক হলো। তিনি যেন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছেন। আগের মতো সুস্বাস্থ্য নেই। একটু পাতলা রুগ্ন হয়ে পড়েছেন। পূর্বে মাকে কিছু বললে মা অতটা আগ্রহের সঙ্গে শোনতেন না -এড়িয়ে যেতেন। রাগ করতেন ভালো মতো কথা বলতেন না। এখন তিনি ধৈর্য সহকারে সমস্ত কথা শুনছেন। সবুজ বরাবরই কথা বলতে পছন্দ করে। বকবক করতে ভালো লাগে তার। কিন্তু পরিস্থিতির কাছে অসহায় হয়ে চুপচাপ থাকতে হতো। তাই তো সবসময় বন্ধুদের সাথে বকবক করতো আর ঘরে থাকাকালীন চুপচাপ। আজ মন খুলে কথা বলতে লাগলো। কত কথা জমে আছে। সব একদিনে বলা সম্ভব নয়। মাকে একটাও কথা বলতে দিল না। সে নিজে থেকে বকবক করে গেল। একটা সময় সবুজ গলা শুকিয়ে ফেলল। অপর্ণা দেবী একটু মুচকি হেসে বললেন,’জল খাবে? গলা শুকিয়ে গেছে মনে হয়!’ সবুজ মাথা নাড়ালো। ঘটিতে জল গড়িয়ে সবুজের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ঢকঢক করে গিলে নিল। মা হাসিমুখে বললেন,’হ্যাঁ গো, তুমি এত কথা কবে থেকে বলতে শিখলে? আগে তো চুপচাপ থাকতে!’ সবুজ মৃদু হেসে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। আজ বুঝতে পারছে মাতৃত্ব আসলে কি? নাড়ির টান কতটা শক্ত? একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। তিনি ছেলের চুলের বেলি কাটতে কাটতে বললেন,’ ওই বাড়ির সকলে খুব দয়ালু, তাই না? পরের জন্য কেউ এত ভাবে নাকি?’
‘আসলে ওই বাড়ির সকলেই খুব মিষ্টি। ওদের দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ওদের ছেড়ে আসতেই ইচ্ছে করছিল না।’
‘তাহলে এলে কেন? থাকতে পারতে!’
‘বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ছিল তো।’
‘বা রে, শুধু বন্ধুদের কথা মনে পড়ছিল? আমাদের কথা মনে পড়েনি?’ কণ্ঠস্বরে কেমন একটা অভিমান প্রকাশ পেল।
‘তোমাদের কথাও খুব মনে পড়ছিল। তাইতো ফিরে এলাম।’ অপর্ণা দেবী জবাব দিলেন না। সবুজ বলল,’মা! সংকেত আর সূর্যময়ের কোনো খবর জানো?’
‘তুমি চলে যাওয়ার পর তারা একবার এ বাড়িতে এসেছিল। তারপর আর তাদেরকে দেখতে পাইনি। শুনেছিলাম সংকেত আর তার বাবা নাকি শহরে থাকে।’
‘কোন শহরে?’
‘তা তো জানি না। তবে উনি পূর্বে যে হোটেলে কাজ করতেন ওদের হোটেলেই থাকেন।’
‘কোনো কন্টাক্ট নাম্বার আছে?’
‘না তো।’
সবুজ একটু আশাহতো হলো। তবে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলো না। বন্ধুদেরকে খুঁজে বার করতে বেশি সময় লাগবে না। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়বে। সবুজ খানিকক্ষণ বিষণ্নতা কাটিয়ে বলল,’জানো মা, ওই বাড়ির সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা কে? কাজল দিদি। অদ্ভুতভাবে তার সঙ্গে আমার খুব মিল। সেও আমাকে কখনও হারাতে চায়নি। যেখানে যেত আমাকে নিয়ে যেত। আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমার কত খেয়াল রাখতো। গতবছর আমার বসন্ত হয়েছিল কিন্তু মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। কত আদর যত্নে রেখেছিল। ও খুব মিষ্টি মেয়ে।’
‘সে বুঝি বাড়ির বড় মেয়ে?’
‘না না,বড়ো তো রুপা দিদি। ও খুব গম্ভীর। কম কথা বলে। সব সময় রাগী রাগী ভাব। আর ছোটো মেয়ে..।’ কথা বলতে গিয়ে আটকে গেল। মা বললেন,’ছোট মেয়ে কি? সেও কি বড়দিদির মত গাম্ভীর।’
‘না তো। সেও খুব ভালো। কৌতুক সরলাময়ী চঞ্চলা মেয়ে।’ সবুজ আর কিছু বলতে পারলো না। চুপ করে গেল। মনে মনে অনুতাপ করল। এই প্রথম সে মাকে মিথ্যা কথা বলল। মাকে কিছুতেই সাথীর সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বলতে পারল না। পরে বুঝলো মিথ্যা কথাটা আজ নয় দীর্ঘদিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে। সে তো কাউকে জানায়নি সাথী সঙ্গে তার একটা আলাদা সম্পর্ক রয়েছে। এটা কি অন্যায়? অন্যায় কেন হবে? কেউ তো জানতে চায়নি তাদের কথা? তাহলে সে কেন মিছামিছি সবাইকে জানাতে যাবে? সে সত্য গোপন করেনি। করতেও চায় না। যদি কেউ কোনোদিন জানতে চায় তবে সত্যিটাই বলবে সে।

ক্লান্ত শরীর বিছানা পেয়ে আরাম বোধ করলো। তবে ঘুম আসলো না। বারবার এ-পাশ ও-পাশ করছে। দীর্ঘদিন ধরে এই রুমের মধ্যে কেউ প্রবেশ করেনি। ইঁদুরের উৎপাত বেড়েছে। মাঝেমধ্যেই তারা চেঁচামেচি করছে। জানালা দিয়ে হালকা চাঁদের আলো এসে মশারীর উপর পড়েছে। সবুজ উঠে বসলো। বই গুলোর দিকে তাকালো। কতদিন হলো সেগুলো ছুঁয়ে দেখেনি। ধুলো-ময়লা জুড়ে রয়েছে। মাকড়সা বাসা বেঁধেছে। হালকা মশারী তুলে বইগুলোকে ছুঁয়ে দেখলো। আহ্ কি শান্তি! একসময় এগুলোই তার প্রাণ ছিল। এগুলো নিয়ে সারাটা দিন কাটিয়ে দিত। কত স্বপ্ন দেখতো। বই খুলে ভেসে যেত রূপকথার দেশে। আরও দুই একটা বই নাড়িয়ে দেখল তার পাঠ্যবই এখনও পড়ে আছে। নিজে অনেক নোট বানিয়েছিল। সেগুলো পড়ে আছে। কেউ হাত দেয়নি। শুধু ধুলো ময়লা জমে আছে। প্রত্যেক বছর প্রথম হওয়ার জন্য কিছুতো রহস্য ছিল। সারাদিন শুধু পড়াশোনা নয় নিজের চিন্তার জন্য সময় দিতো। সুশীল চিন্তা তাকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়। সবকিছুতেই প্ল্যান করতো। আর সেটা সময়মতো শেষ না করা পর্যন্ত ঘুমাতো না। কেউ তাড়িয়ে বেড়াতো। নিজের কাজ কখনও ফেলে রাখতো না। পুরনো স্মৃতি মনে পড়ছে। একা একা হেসে উঠলো। দিন গুলো রামধনুর মতো বড্ড রঙিন ছিল। বড্ড পাগলামো করেছে। তবে আবার কি পড়াশোনা শুরু করবে? আবার স্কুলে প্রথম হবে? বাবা-মার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে? নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে? তা হতে পারে না। সে যে কথা দিয়েছে। কথার খেলাপ হবে না। জীবনে সুখ শান্তি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত তবে কথার খেলাপ করবে না।
অনেক রাত জাগায় সকালে বেশ অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে রইল। বেলা হতেই বাইরে এসে দাঁড়ালো। চারটে বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তাদের জন্য নতুন বাড়ি হচ্ছে। রাজমিস্ত্রি কাজ করছে। তাতে তার বাগানে অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। খুব খারাপ লাগলো। তার লাগানো শখের গাছ গুলো কত সুন্দর ভাবে কেটে ফেলেছে। কাউকে কিছু বলার মত কথা খুঁজে পেল না। সামনে দাদা দাঁড়িয়ে রয়েছে। দাদাকে বরাবরই ভয় পায় সবুজ। সেখান থেকে সরে পরল। সংকেত কোথায় থাকে জানে না। কিন্তু সূর্যময় কোথায় জানে। স্থির করলো খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। কিন্তু তার আগেই সূর্যময় আর সংকেত এসে হাজির। গতকাল রাতে সূর্যময়ের কানে পৌঁছায় সবুজ বাড়ি ফিরেছে। একা একা এই বাড়িতে আসতে মন সায় দিচ্ছিলো না। সংকেতকে সুখবরটা জানাতে বেশি দেরি করেনি। সে জানা মাত্রই উতলা হয়ে পড়ে। সকাল হতেই গ্রামে ফিরে আসে। দুজনকে দেখে সবুজ আর স্থির থাকতে পারলো না। কতদিন দেখেনি তাদেরকে। চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল। কাছে পৌঁছে সংকেত কেমন যেন লজ্জা পেল। সূর্যময়ও লজ্জা পেয়েছে। তবে কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। এ-দিক ও-দিক তাকিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সবুজ বুঝতে পারল না, তাদের লজ্জা পাওয়ার কারণ কি? তিনজনে এতটা উতলা হয়ে ছিল যে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। চুপচাপ দাঁড়িয়েই রইল। সবুজ তাদেরকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এলো। একটা জায়গায় গোল হয়ে বসল তিনজনে। সূর্যময়কে দেখে কিছুটা খটকা লাগলো। তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,’তোমার শরীরের অবস্থা কী হয়েছে? মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন কোনো রোগব্যাধি ধরেছে!’
‘আমার কথা বাদ দাও। আগে তুমি বলো, এতদিন কোথায় ছিলে?’
‘সে লম্বা কাহিনী। এক বেলাতে শেষ হবে না। একটু একটু করে সব বলব।’
একটু থেমে বলল,’এখন কি করছো? কলেজে?’
‘পড়াশোনা হয়নি। ওই উচ্চমাধ্যমিকটা কোনোরকম উত্তরে গেছি।’
‘কলেজে যাওনি কেন?’
‘ইচ্ছে করলো না। পড়ায় মন দিতে পারলাম না।’ সবুজ মাথা দুলিয়ে স্থির হল। সংকেতকে খেয়াল করলো। সে কোনো কথা বলছে না। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাকে দুলিয়ে বলল,’কি ব্যাপার! তুমি কোনো কথা বলছো না কেন? শহরে গিয়ে স্মার্ট হয়ে গেছো? আমাদের আর দরকার নেই বুঝি!’
‘জানো সবুজ, তুমি না আরও সুন্দর হয়ে গেছো। গোঁফ দাঁড়িতে বেশ সুদর্শন পুরুষ দেখাচ্ছে।’
‘ব্যাস, তোমার শুরু হয়ে গেল।’ তিনজনে হো হো করে হেসে উঠলো। সবুজ বলল,’তুমিও আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়ে গেছো। আগেতো কেমন একটা ছিলে। এখন শরীরটাও ঠিক হয়েছে। বেশ স্বাস্থবান তাজা সুপুরুষ।’
‘হবে না কেন? সে এখন নিয়মিত শরীরচর্চা করে। পুলিশে জয়েন করছে।’
‘সূর্যময় সঠিক কথা বলছে তো?’ সংকেতের দিকে ইঙ্গিত করে বলল সবুজ। তাতে সম্মতি জানাল সংকেত। সবুজ বেশ খুশি। সে ফুরিয়ে গেলেও সংকেত নিজের লক্ষ্যে স্থির আছে। এগিয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে। অন্তত তার বাবার ইচ্ছে গুলো পূরণ করতে পারবে। কিছুক্ষণ গল্প করার পর সংকেত বলল,’তুমি আমার সঙ্গে একবার আমাদের বাড়িতে যাবে? বাবা তোমায় নিয়ে যেতে বলেছেন। তিনি তোমায় খুব মিস করেন। তোমায় একটিবার দেখতে চান। কত বড় হয়ে গেছো।’ সবুজ কিছু বলতে চাইছিল তার আগেই সূর্যময় বলল,’আরে দাঁড়াও। ও তো কাল এসেছে। বাড়িতে কিছুদিন থাকতে দাও। তারপর না হয় যাবে।’ সবুজ একটু হেসে বলল,’অবশ্যই যাবো। যাবো না কেন?’
সংকেতের মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল,’আমাদের কথা মনে পড়তো?’
‘খুব, তোমাদের আমার কথা মনে পড়েনি?’
‘সব সময় মনে পড়তো। আর সংকেত তো যেখানে যাবে সেখানেই তোমার প্রসঙ্গ তুলবে। তোমায় হারিয়ে বড্ড অনুতাপ করছিল। সবসময় বলে, তার জন্য নাকি তোমার ভবিষ্যৎ-টা নষ্ট হচ্ছে।’
‘তাহলে তুমি এখনও কাঁদুনে আছো?’ সংকেত একটু রেগে গেল। তবে প্রকাশ করল না। বন্ধুরা যদি মজা না করে,তাহলে মজা কে করবে? সবুজ বুক ভরে প্রশ্বাস নিল। বুকের মধ্যে অনেক দুঃখ কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে। যন্ত্রণা তিলে তিলে ব্যথা দিচ্ছে। কিন্তু এমন মুহূর্তে সমস্ত কিছু ভুলে গেল। সেখান থেকে উঠে যেতে পারল না। কত কথা জমে রয়েছে। সব বলতে হবে। আড্ডা ক্রমশ জমে উঠলো। হাসির আড্ডা হৈ-হুল্লোড় খিল্লি চলতেই রইল। কেউ বাধা দিতে আসলো না। দুপুরের দিকে আড্ডা ভাঙলো। যাওয়ার পূর্বে সংকেত বলল,’একবার ঘুরতে গেলে হয় না?’
‘কোথায় বলতো?’
‘আমাদের প্রিয় জায়গা.. ওই যে সমুদ্রের পাড়…।’
‘ঠিক আছে চলো। তবে আজ নয় কাল। আমার শরীরকে একটু রেস্ট দিতে হবে।’ সবাই রাজি হয়ে গেল। সংকেতের গ্রাম ছেড়ে শহরে যেতে ইচ্ছে করলো না। এখানে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বাবাকে জানিয়ে দিল দু-দিনের মতো গ্রামের বাড়িতে থাকবে। বাবা সম্মতি জানালো। খাবারের একটু সমস্যা রয়েছে। তবে সমস্যাটা খুব গুরুতর নয়। সূর্যময় তাকে একা একা বাড়িতে থাকতে দিল না। নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। দুদিন কেন গোটা মাস তাদের বাড়িতে থাকলেও কারোর কোনো আপত্তি থাকবে না।
সবুজের বাড়ি থেকে সমুদ্রের দূরত্বটা অগাত। হেঁটে হেঁটে যাওয়াটা কষ্টকর। তবুও পা ক্লান্ত হচ্ছে না। পাশের ছোটবেলার বন্ধুরা রয়েছে কোনো কিছুতে বিষন্নতা আসার প্রশ্নই উড়তে পারে না। কত গল্প কত মজা কত ইতিহাস লুকিয়ে আছে অন্তরে। সব প্রকাশ করতে পারলেই শান্তি। এই মুহূর্তে রাজনীতি, ধর্ম, বর্ণ, কোনো কিছু স্থান পায়নি। সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে রয়েছে পবিত্র ভালোবাসা। মুখের ভঙ্গিতে কৌতুক মিলেমিশে একাকার। যেন অনেক দিনের পর পৃথিবীতে বৃষ্টি নেমেছে। মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট পোকা গুলো সে-ই আনন্দে একসঙ্গে নেচে বেড়াচ্ছে। তারা জানে এই বৃষ্টি তাদের জন্য ক্ষতিকর, তবুও তারা নাচছে। কারণ, এখানে কোনো বিতৃষ্ণা নেই। কোনো ব্যাকুলতা নেই। উজাড় করে ভালোবাসা যায়। সমুদ্র উপকূলে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি পর সংকেতের মনে পড়ল সবুজের হারিয়ে যাওয়ার এক মাসের পরের ঘটনা। সূর্যময় সাথে মাছ ধরতে এসে ভুতের অভিজ্ঞতা। সবুজকে সে কথা বলতেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। তার হাসিটা গ্রহণ করল না সংকেত ও সূর্যময়। সংকেত গম্ভীর কণ্ঠে বলল,’আমরা মিথ্যা কথা বলছি না। সেদিন তুমি থাকলেও ভয় পেতে। সত্যি সত্যি ভূত ছিল।’
‘ভূত বলে কিছু হয় না। ও তোমাদের মনের ভুল নয়তো কোনো সাধারণ মানুষই ছিল। তোমরা মিছামিছি ভয় পেয়েছো।’
‘না গো সবুজ। আমিও প্রথমে তাই বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু পরে একটাও পায়ের ছাপ পাইনি। অনেক যুক্তি সাজিয়েও হেরে গেছি। শুধু আমরা নয় অনেকেই এখানে মাছ ধরতে এসে এমন অভিজ্ঞতার সাক্ষী রয়েছে। একটা বুড়ো সবার কাছে রিনরিনে কণ্ঠে বিড়ি চায়। কাকতালীয়ভাবে একই ঘটনা বারবার ঘটতে পারে না। কিছুতো একটা রহস্য রয়েছে। কয়েকদিন আগে সেখানে একজন বাইক নিয়ে বিদ্যুৎ খুঁটিতে ধাক্কা মারে। সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। মাঝরাত্রি সারা রাস্তা ফাঁকা। আর সে পাশে পোঁতা বিদ্যুৎ খুঁটিতে ধাক্কা মারলো! কেমন একটা আজগুবি না!’
‘হতে পারে মদ খেয়েছিল।’
‘মানলাম মদ খেয়েছিল। শহর থেকে এত দূরে চলে এলো কিছু হলো না সেখানে এসেই বিপদটা ঘটলো। পূর্বেও কিন্তু ওই স্থানটি সম্বন্ধে অনেক ভয়ঙ্কর রহস্য লুকিয়ে রয়েছে।’
‘ও সব কিছু নয়। সবই মানুষের কল্পনা নয়তো গুজব। না হলে কিছুটা কাকতালীয়।’ সবুজ বেশ জোর গলায় বলল। সংকেত রেগে আগুন। তারা রাতে সেখানে থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে অথচ সবুজ কিছুতেই বিশ্বাস করছে না। রেগে বলল,’তুমি ঈশ্বর বিশ্বাস করো না?’
‘অবশ্যই করি।’
‘যদি ঈশ্বর বিশ্বাস করো তাহলে তোমাকে ভূতকেও বিশ্বাস করতে হবে। শুভ শক্তি যদি থেকে থাকে তাহলে অশুভ শক্তিও আছে।’
‘পৃথিবীতে যতদিন শুভ শক্তি থাকবে ততদিন অশুভ শক্তিও থাকবে, এ আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তা বলে ভূত মানে অশুভ শক্তি আমি মানতে পারব না। আমার সামনে একটা ঠাকুরের মূর্তি দাঁড় করিয়ে দেবে আর বলবে এটা ঈশ্বর আমি তা বিশ্বাস করতে পারবো না। আমি ভূত প্রেত বিশ্বাস করি না। আমার কাছে শুভ শক্তি হচ্ছে সত্য আর বিশ্বাস আর অশুভ শক্তি হচ্ছে মিথ্যা আর অবিশ্বাস।’ সবাই চুপ করে গেল। তবে সংকেত নিজের রাগ সামলাতে পারল না। রেগে বলল,’এত কথা বলার কি আছে? তুমি এখানে একটা রাত থেকে দেখো, ভূত বলে কিছু আছে কিনা!’
‘ঠিক আছে। আজ সারারাত আমি ওই স্থানটা কাটাবো।’ সূর্যময় আঁতকে উঠল। ভূত আছে কিনা জানে না। তবে প্রিয় বন্ধুর ওখানে থাকাটা সুবিধার হবে না। বহু মানুষের বহু অভিজ্ঞতা। নিছক হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সে শান্ত কন্ঠে বলল,’তোমরা আবার শুরু করলে? ঠিক আজ থেকে চার বছর আগে এমন একটা কথা দেওয়া আর নেওয়ার মাধ্যমে সবুজ হারিয়ে গেল। মাঝখান থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল চারটি সোনালী বছর। তোমরা কি আবার তেমন কিছু চাও?’
‘এবার কিচ্ছু হবে না। আমি ঠিক বাড়ি ফিরতে পারব।’ সংকেত আর কিছু বলল না। জেদের বশে সেখানে রাত কাটাতে চাইলো সবুজ। সূর্যময় অনেক বোঝালো কিন্তু শুনল না। রাতে খাবার খেয়ে মাকে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল সবুজ। একটা টর্চ লাইট ছাড়া হাতে কিছু নিল না। ওই স্থানে এসে চুপিচুপি খালপাড়ে নেমে পড়ল। আশেপাশে নর-মানুষের চিহ্ন নেই। চারিদিকে ফাঁকা। উপরের রাস্তায় একটা ষাঁড় শুয়ে আছে। মাঝেমধ্যে তারই গলার স্বর ভেসে আসছে। চতুর্দিকে ঘন নিস্তব্ধতা। নির্জনতা ঘিরে ধরেছে। সবুজ ভয় পেল না। সুপুরুষের মত দাঁড়িয়ে রইল। হাতে ঘড়ি পরে আছে। বারবার ঘড়ি দেখল। কখন ভোর হবে? ভোরে সূর্যময় আর সংকেতর আশার কথা। তারা না আসা পর্যন্ত সে ফিরতে পারবে না। ঘুম পেলেও চোখ বন্ধ করলো না। সৎ সাহসের সঙ্গে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার জন্য অপেক্ষা করল। সে শুধুমাত্র বন্ধুকে কথা দিয়েছে বলে আসেনি। সত্যি পৃথিবীতে কোনো অলৌকিক ঘটনা রয়েছে কিনা তা জানার জন্য এসেছে। সারা রাত জাগলো। তবে কোনো অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে পরিচয় হতে পারল না। ভোরের দিকে খাল পাড়ে বসে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ল। ভোর হওয়ার অনেক আগেই সূর্যময় আর সংকেত সেখানে পৌঁছালো। সবুজকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখে একটু অবাকই হল। সবুজ সারারাত অন্য জায়গায় কাটিয়ে ভোরে সেখানে চলে আসতে পারে। এই ভাবনাটা প্রথমে তাদের মাথায় এসেছিল। কিন্তু পরে উড়িয়ে দিয়েছে। সবুজ আর যাই হোক কখনও মিথ্যা কথা বলবে না। মিথ্যাকে সে ভীষণ ভয় পায়। সবকিছু স্বাভাবিক দেখে সংকেতের একটু খটকা লাগলো। তাহলে ভূত বলে কিছু নেই? যদি থাকতো তাহলে সবুজ কেন দেখতে পারলো না। সূর্যময়ের সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসল সবুজ। আর একটা সাইকেল একা চালালো সংকেত। কিছুটা যাওয়ার পর সংকেত সবুজকে প্রখরভাবে পর্যবেক্ষণ করল। বেশ ঝিমিয়ে রয়েছে। চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল। কথায় হেরে যাওয়ায় বন্ধুর সাথে বেশি কথা বলতে চাইল না। নিঃশব্দে সাইকেল চালালো। সূর্য তখনও ওঠেনি। বেশ আঁধার রয়েছে। আকাশ পরিষ্কার হতে সময় লাগবে। হালকা ধোঁয়া রয়েছে। তাড়াতাড়ি সাইকেল চালালো। সামনে বটগাছ। বটগাছের কিছুটা আগে সংকেতের মনে হলো তার পেছনের ক্যারিয়ারের কেউ এসে বসে পড়ল। ভারী অনুভব করল। ঘুরে দেখল কেউ নেই অথচ ভারী। চুপ থাকতে পারলো না। চুপ থাকলেই ভয় বাড়বে। সবুজের দিকে তাকিয়ে বলল,’কেমন অবিজ্ঞতা হলো?’ সবুজ তার দিকে তাকাতেই সংকেতের মধ্যে একটা শিহরণ জেগে উঠলো। তার চোখটা সাধারণ মানুষের নয়। ভীষন লাল। গাল দুটো ফুলে গেছে। কেমন একটা লাগলো সংকেতের। বলল,’কালকে রাতে তোমার কেমন অভিজ্ঞতা হল?’ সবুজ শান্তকণ্ঠে চোখ বড় বড় করে বলল,’জানো, কালকে রাতে এই বটগাছটার নীচে ছুরি দিয়ে আমাকে খুন করা হয়েছে।’ সংকেত মুহূর্তের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে নিচে পড়ে গেল। সূর্যময় সাইকেলের প্যাটেল আর ঘোরাতে পারল না। পা দুটো থর থর করে কেঁপে উঠলো। সাইকেল ছেড়ে সেও গিয়ে পড়লো রাস্তায়।

পর্ব ১১ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here