নিরুদ্দেশ দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ২৫

নিরুদ্দেশ দ্বিতীয় খন্ড
পর্ব ২৫

মরণ রোগে ধরেছে সূর্যময়কে। শারীরিক এবং পারিবারিক অবস্থা খুব শোচনীয়। সংকেত টাকা দিয়ে যে জমি বাঁচিয়ে ছিল সে-ই জমি চিকিৎসার জন্য বিক্রি করে দিতে হয়েছে। শুধু জমি নয় একটা পুকুরও বিক্রি করে দিয়েছে। মোটামুটিভাবে সুস্থ হলেও বেশিদিন বাঁচবে না তা ধারণা করতে পারে লতা। ক্যান্সার রোগীকে বাঁচানো খুব শক্ত। তাছাড়া চিকিৎসা ব্যয় বহুল। তাদের পক্ষে এত অর্থ ব্যয় করা সম্ভব নয়। করুন অবস্থা। এদিকে সংকেত ওই রাত থেকে নিরুদ্দেশ। সে নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে জানতে পেরে গেছিল বন্ধু ক্যান্সারে আক্রান্ত। তার সমস্ত টাকা পয়সা বন্ধুকে দিয়ে কোথাও উধাও হয়ে গেছে। তাকে আর পাওয়া যায়নি। লতা ভেবেছিল সংকেতের টাকাগুলো খরচ করবে না। অভাবের তাড়না এবং সূর্যময়ের মলিন হাসি তাকে অসহায় করে তুলেছে। সংকেতের টাকাগুলো খরচ করে স্বামীর চিকিৎসা করিয়েছে। সূর্যময় আগের তুলনায় অনেক সুস্থ। উঠতে-বসতে কিংবা একটু চলাফেরা করতে পারে। তবে কাজ একদমই পারে না। সবদিক সামলাতে হয় লতাকে। বাবা-মার বয়স হয়েছে। তাদেরকেও সামলে রাখতে হয়। তাছাড়া রয়েছে ময়ূর। বড়ো দুষ্টু ছেলে। বাবা না হলে কিচ্ছু করে না। স্নান করতে গেলেও বাবাকে চাই খাওয়ার সময়ও বাবাকে চাই ঘুমোতে গেলও বাবা…..। বাবা ছাড়া তার কাউকে প্রয়োজন নেই। সারাদিন বাবার কাছে থাকে। বাবার উপর উঠে বসে। চুল মুঠি করে টানে। ব্যথার স্থানে ইচ্ছে করে আঘাত করে। সে বোঝে না তার এমন দুষ্টুমিতে বাবার কষ্ট হয়। মজা পাওয়ার জন্য এমন করে। সূর্যময়ও অদ্ভুত! ছেলের উপর চোখ রাঙাতে পারে না। দুষ্টুমি গুলো মেনে নেয়। আরও দুষ্টুমি করতে উৎসাহ দেয়। বাবা আর ছেলে খুব পাগল। সারাদিন পাগলামি করতে থাকে। পড়াশোনায় একদম মনোযোগী নয় ময়ূর। পড়তে বসতে চায় না। মায়ের কাছে তো একদমই নয়। বাবা একটুখানি ছেলেকে নিয়ে বসে। খুব আগ্রহে ময়ূর তখন পড়তে বসে। বারান্দার দোলনায় বসে মুড়ি খাচ্ছিলো সূর্যময়। ভেতর থেকে ময়ূর এসে উঠলো। কাছে পৌঁছে বলল,’বাবা, বাবা আমি পড়তে বসবো। চলো আমায় পড়াবে।’ সূর্যময় হেসে উঠলো।
‘এখন পড়ার সময় নয় খোকা। মার সঙ্গে স্নান করে এসো যাও।’
‘না,আমি পড়বো।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আগে স্নান করে এসো। বেলা হয়ে যাচ্ছে না।’ তার কথা না শোনায় মুখ শুকনো করে ফেলল। ছেলের মন খারাপ হয়েছে। স্থির থাকতে পারলো না সূর্যময়। খোকাকে কোলে তুলে নিলো। মাথায় হাত বোলালো। দুটো হাত ধরে হাসিমুখে বলল,’কি হয়েছে খোকা? মুখ শুকিয়ে ফেললে কেন?’
‘আমি পড়তে বসবো।’
‘ঠিক আছে আগে স্নান করে নাও। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে তো।’ ময়ূরের মুখে হাসি ফিরলো না। পাগল ছেলে একটা। এত বেলায় কেউ পড়তে বসে নাকি! ছেলেকে মুড়ি খাওয়ালো। মুড়ি খেতে খেতে ময়ূর বলল,’বাবা, তুমি আর বাইরে যাও না কেন?’
‘এমনি, একটু অসুস্থ তো তাই।’
‘আবার কবে যাবে বাবা?’
‘কিছুদিন পর।’
‘আমায় নিয়ে যাবে? সবসময় ঘরে থাকতে ভালো লাগে না।’
‘আচ্ছা নিয়ে যাব।’ এবার ময়ূরের মুখে হাসি ফুটল। ছেলের মুখে হাসি বাবাকে স্বস্তি দিল। বলল,’তুমি বাজারে যেতে চাইছো কেন?’
‘আমি সাইকেল নেবো।’
‘তুমি তো ছোট। সাইকেল চালাতে পারবে না।’
‘পাশের বাড়ির খোকন যে রকম ছোট সাইকেল চালায় আমার তেমন সাইকেল চাই। আমার জন্য ছোট সাইকেল এনে দেবে?’
‘আচ্ছা এনে দেবো।’ লতা এসে পৌঁছালো। ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল স্নান করার জন্য। পুকুরের জল পেয়ে অস্থির হয়ে উঠল। মাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো। কিছুতেই জল থেকে উঠবে না। লতা বিরক্ত হলো। ছেলের সঙ্গে অতিরিক্ত সময় কাটানোর মতো তার সময় নেই। কত কাজ পড়ে রয়েছে। শেষ করতে হবে। জোর করে তুলে নিয়ে এলো। বাবার কাছে পাঠিয়ে দিলো গা মুছে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তার আগেই সেখানে সূর্যময় উপস্থিত হলো। লতা বড়ো এলোমেলো অবস্থায় ভিজে আছে। স্বামীকে দেখে লজ্জা পেল। লাজুক কন্ঠে বলল,’তুমি আসার সময় পাও না বুঝি!’
‘সুন্দর লাগছে তোমাকে।’
‘মনে হয় এই প্রথম দেখছো আমায়। ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’
‘কত পাতলা হয়ে গেছো।’
‘আর দেখতে হবে না। ছেলের গা মুছে দাও। আমি শাড়ি বদলে আসছি।’ লতা প্রসন্ন হাসি বিনিময় করে চলে গেল। গামছা নিয়ে ছেলের গায়ে হাত মুছে দিল। ময়ূর বায়না ধরল পড়ার জন্য। সূর্যময় এবার বারণ করল না। মাদুর পাতিয়ে বারান্দায় বসলো। ছেলে নিজে থেকে পড়তে চাইছে। বেশ অবাককর বিষয়। ময়ূর খুব বেশি পড়ালেখা করল না। একটুখানি লিখেই হয়ে গেল। তারপর সিলেট খড়ি বাবাকে দিল। তাতে ছবি আঁকতে বলল। এবার সূর্যময় ময়ূরের আসল উদ্দেশ্য বুঝলো। ছবি আঁকার জন্যই পড়তে চাইছিল। বাবা আর ছেলে সারাটা দুপুর ছবি এঁকে কিছু কবিতা আর গল্প বলে বলে সময় পার করলো। দীর্ঘ সময় এমনভাবে কাটলো। লতা এসে খাবারের জন্য ডাকলো। বাবা-ছেলে উঠে গিয়ে আসন পাতিয়ে খেতে বসলো। ময়ূর একা খেতে পারে না কিন্তু একা খাবে। তার জন্য আলাদা থালা বাটি দরকার। তাকে আবার কম ভাত দিলে নেবে না। বাবা যতোটুকু ভাত নেয় তারও ততটুকু দরকার। তার পক্ষে অতটা খাওয়া সম্ভব নয় তবুও দরকার। আনাড়ি হাতে ভাত মাখাতে পারে না আবার কাউকে মাখাতেও দেয় না। নিজে মাখাবে। ভাত মাখাতে গিয়ে অর্ধেক ভাত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মাটিতে পড়ে। লতা বকুনি দিতে পারে না। বকুনি দিলে ছেলে কেঁদে উঠবে। আর রাগ দেখাবে সূর্যময়। ছেলেকে কিছুতেই কাঁদতে দেবে না। তার যা মন চায় তাই করবে। কেউ বাধা দিতে পারবে না। লতার এ সব ভালো লাগে না। ছেলেকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু অতিরিক্ত আদর পছন্দ নয়। তাতে ছেলে মাথায় উঠবে। কোনো কিছুর তোয়াক্কা করবে না। আবার পরক্ষণে ময়ূরের নবীন সূক্ষ্ম মুখমণ্ডল সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। নিজেও ছেলেকে বকুনি দিতে পারে না। বড়ো অবোধ নির্বোধ বালক। তাকে দেখলে মন আনচান করে ওঠে। কি করে বকুনি দেব? সম্ভব নয়। তার যতটুকু মন চায় ততটুকু খায়। এর বেশি খাওয়ানো সম্ভব নয়। তাই দিনের পর দিন সেও বাবা-মার মতো পাতলা হয়ে যাচ্ছে।

অসুস্থতার জন্য একদমই বাড়ি থেকে বের হয় না সূর্যময়। লতা প্রয়োজন ছাড়া কোথাও যেতে পছন্দ করে না। তাই ময়ূর খুব একা হয়ে পড়ছে। এই বয়সে ঘোরাফেরার কথা। পৃথিবীকে চেনার কথা। কিন্তু ঘরের মধ্যে বন্দী থাকতে থাকতে বিষন্নতা চলে এসছে। তারা চায় না তাদের অবস্থার জন্য ছেলে একগুঁয়েমি হয়ে যাক। আনন্দে ভাটা পড়ুক। অতুল বাবু সন্ধ্যার সময় প্রায় বাজারে যান। কোনো কেনার প্রয়োজন না পড়লেও যান। একটু আড্ডা দেন। সারাদিন শুধু শুধু বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগে না। আজকে বাজারে যাওয়ার সময় ময়ূরকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। দাদুর সঙ্গে বাইরে যাওয়ার কথা শুনে কত আনন্দিত সে। ছেলের আনন্দ দেখে সূর্যময়ের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে ছিল। সে যদি সুস্থ থাকতো তাহলে ছেলেকে আজ কত জায়গা থেকে ঘুরিয়ে আনতো। একটা অসুখ কত কষ্ট দিচ্ছে। ভাবতে বসলে খুব যন্ত্রণা হয়। মা পাশের বাড়িতে টিভি দেখতে গেছেন। বাড়িতে লতা আর সে ছাড়া কেউ নেই। অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না। গা হাত আরও বেশি ব্যথা করে। বিছানা ছেড়ে উঠে এসে লতাকে খোঁজ করলো। রান্না ঘরে আছে। উনুনে ভাত চড়িয়ে জ্বালান দিচ্ছে। সূর্যময় পিঁড়ি এনে পাশে বসলো। লতা একটু সরে জায়গা করে দিল স্বামীকে। বলল,’উঠে এলে কেন? শরীর খারাপ করবে তো!’
‘সবসময় শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগছে।’
‘কি করবে বল? এটুকু সহ্য করতে হবে।’
‘তা না হয় করলাম। ছেলে কখন আসবে?’
‘এই তো গেল। এখন-ই চলে আসবে নাকি!’
‘লতা!’ স্বামীর দিকে ঘুরে তাকালো। মুখ মায়ায় ভরে গেছে। তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’কাছে তো বসে আছি। এভাবে ডাকছো কেন?’
‘আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে।’
‘কি যা তা বলছো। এমন কথা শুনতে আমার ভালো লাগে বুঝি?’
‘ভালো লাগে না জানি কিন্তু নিষ্ঠুর বিধাতা তাই বলছে।’
‘তোমার কিছু হবে না। শুধু শুধু চিন্তা করো না।’
‘আমার শরীর আমি বুঝতে পারি ঠিকই।’ মলিন হেসে জবাব দিল। লতার চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। সেও বুঝতে পারে স্বামীর আয়ু খুব কম। শুধু বাস্তবটা মানতে চায় না। এই কঠোর বাস্তব শুনতে চায় না।
‘আমি চলে গেল তুমি দয়া করে আবার বিয়ে করো না। আমি ছোটবেলা থেকে অলৌকিক আর অলৌকিক বলে দৌড়েছি। কিন্তু বাস্তবে অলৌকিক বলে কিছু আছে কিনা জানি না। না জেনে হয়তো চলে যেতে হবে। মৃত্যুর পরে যদি কাউকে মনে করার সুযোগ থাকে তাহলে আমি প্রথম তোমাকে মনে করবো। যদি অনুভব করার সুযোগ থাকে তাহলে তোমাকে প্রথম অনুভব করবো। তখন যদি জানতে পারি তুমি বিয়ে করে নিয়েছো তখন আমার খারাপ লাগবে। আমার ভালোবাসা মিথ্যা হয়ে যাবে।’
‘কি করে ভাবছো আমি আবার বিয়ে করবো?’
‘বয়স তো খুব বেশি হয়ে যায়নি। তোমার বাবা-মা হয়তো তোমাকে নিয়ে যেতে পারে। জোর করে…।’ লতা হেসে উঠলো। বলল,’যারা এতদিন এলো না তারা আর আসবে বলে মনে হয় না। যদি আসেও আমি আর ফিরে যাচ্ছি না।’
‘ওরা তোমার বাবা-মা। আর কতকাল রাগ পুষে রাখবে? তুমি গেলে ওরা মেনে নেবে।’
‘আমি চাই না।’
‘তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি কিচ্ছু করতে বলবো না। ময়ূরকে আগলে রেখো। তাকে একদমই মারবে না। ওই উঠনে পেয়ারা গাছ আছে না! আমি মৃত্যুর পর ওখানে বসে সব দেখবো। ময়ূরটা বড়ো পাগল। বাবা না হলে তার চলে না। আমি চলে যাওয়ার পর সে যে কি করবে….।’ সূর্যময়ের চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে এলো।
‘কাঁদছো কেন? বললাম তো কিছু হবে না।’
‘আমি মরতে চাই না লতা। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। আমার বন্ধুদের কাছে থাকবো। কত কথা কত স্বপ্ন বাকি।’
‘এমনটা কেন বলছো? কিচ্ছু হবে না তোমার। বেঁচে থাকবে তো।’ সূর্যময় নিজের চোখের জল মুছলো। এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না। বাবা-মা স্ত্রী তাহলে আরও ভেঙ্গে পড়বে। নিজেকে শক্ত হতে হবে। লতার দিকে তাকালো। চঞ্চলা কিশোরী এখন যুবতী বয়স পার করে ফেলেছে। তার মধ্যে গৃহিণীপনা চলে এসেছে। চোখেমুখে লাবণ্য আর অন্ধকার। সবকিছু হারিয়ে একজনকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিল আর সে-ই একজন পৃথিবীতে কয়েকদিনের অতিথি। সূর্যময়ের কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়। লতাকে একা করতে চায় না। কিন্তু নিষ্ঠুর বিধাতা! বাইরে সাইকেল রাখা শব্দ হলো সঙ্গে সঙ্গে ময়ূরের কণ্ঠস্বর। তারা ফিরে এসেছে। সে দৌড়ে সোজা বাবার কাছে এসে পৌছালো। দাদু বাজারে বিস্কুট কিনে দিয়েছিল। একা খেয়েছে। কিন্তু বাবার জন্য আনতে ভুলে যায়নি। একটা বিস্কুট বাবার জন্য এনেছে। বাবাকে তা দিতে পেরে তার মুখে কত আনন্দ। সূর্যময় খুব খুশি। তবে একটু নরম কন্ঠে বলল,’মায়ের জন্য কিছু আনোনি?’
‘এমনটা করতে নেই খোকা। শুধু বাবার নয় মা আর দিদার জন্যও আনতে হয়। তারা বাড়িতে আছে না। না হলে কারোর জন্য কিছু আনতে নেই।’ ময়ূর কিছু বলল না। বাবার কোলে কিছুক্ষণ বসে দাদুর কাছে ফিরে গেল। সূর্যময় একটা বিস্কুট ভেঙ্গে দু-টুকরো করলো। একটা নিজে নিল আর একটা লতাকে দিল। লতা নিতে চাইলো না। তাকে খেতে বলল। সূর্যময় না খাইয়ে ছাড়বে না। এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না লতা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল।

গভীর রাতে সূর্যময়ের ঘুম ভেঙে গেল। খেয়াল করে দেখলো লতা তখনো ঘুমোয়নি। এ-পাশ ও-পাশ করে বেড়াচ্ছে। সাড়া দিয়ে বলল,’তুমি ঘুমোয়নি?’
‘ঘুম ভেঙে গেলো।’ লতা যে মিথ্যা বলছে তা ধরে ফেলল। সদ্য ঘুম ভাঙলে কেউ চঞ্চল থাকতে পারে না। তার মধ্যে অলসতা নয়তো ক্লান্তির ভাব থাকে। লতার মধ্যে এ-সব কিছু-ই নেই। ময়ূরের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে লতাকে খুঁজে বেড়ালো।
‘আমি পাশে শুয়ে আছি তো। খোঁজার কি আছে?’
‘প্রথম দিন গুলোর কথা মনে আছে? আমায় দেখে কত লজ্জা পেতে?’
‘এখনো পাই।’
‘তখনকার দিনগুলো খুব সুন্দর ছিল,তাই না!’
‘বর্তমানের দিনগুলো যে অসুন্দর কে বলেছে তোমায়? সব সুন্দর। কোনো কিছু অসুন্দর নয়।’
‘আচ্ছা তোমার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু আমি একটা কথা বলতে চাই।’
‘বলো, আমি সব শুনছি।’
‘সমবায় সমিতিতে আমার নামে এক লক্ষ টাকা আছে….’
সূর্যময়ের কথা আটকে দিল। বড় আশ্চর্য হল। তারা খেটে খাওয়া মানুষ। রোজ আনে রোজ খায়। সেখানে এক লক্ষ টাকা কোথা থেকে আসবে? সূর্যময় কি সব বলছে? মাথা ঠিক আছে তো?
‘কি সব বলছো? মাথা ঠিক আছে তো? কোথা থেকে পেলে এত টাকা?’
‘আমার কথা তো শেষ হতে দাও।’
‘আগে বল কোথায় পেয়েছো?’
‘কোথাও পাইনি। আমি যা রোজগার করতাম তা থেকে কিছু কিছু গুছিয়ে রাখতাম। আমি নিজে পড়াশোনা না করে বুঝেছি আমার ভবিষ্যৎ কতটা কঠিন আর করুন হয়ে উঠেছে। আমি চাই না আমার ছেলের জীবন এমনটা হোক। তাকে অনেক দূর যেতে হবে। আমার মতো সাধারন জেলে হয়ে যেন বাড়িতে থেকে না যায়। টাকাগুলো তার জন্যই আমি গুছিয়ে রেখেছি।’
‘তোমার যখন অপারেশন হলো তখন অনেক টাকার প্রয়োজন ছিল। তখন কেন বললে না তোমার কাছে এত টাকা আছে?’
‘আমি জেনে গেছিলাম আমি বেশি দিন থাকবো না। মিছামিছি টাকা খরচ করে লাভ কি? আমি চলে গেলে তোমরা কি করে থাকবে? ওই টাকায় তোমাদের হয়ে যাবে।’ লতা কেঁদে উঠলো। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলো। সূর্যময় বাধা দিল না। কিছুক্ষণ পর বলল,’আমার বাবা-মাকে ভালো রাখবে। ওদের কষ্ট পেতে দেবে না। সারাজীবন পরিশ্রম করে গেছে। শেষ বয়সে যেন ভালো থাকতে পারে।’
‘সারাজীবন শুধু অন্যের কথা ভেবে গেলে। নিজের কথা কেন ভাবলে না গো?’
‘কাছের মানুষগুলো ভালো থাকলে নিজে তো ভালো থাকি। কাছের মানুষের জন্য কিছু করা মানে নিজের জন্য করা।’
‘বড়ো বড়ো কথা বলছো শুধু।’
‘আমি তো তোমার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। বরং তুমি আমাদের জন্য অনেক কিছু করলে। কত আশা নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিলে। আমি কি দিয়েছি বল?’
‘আমি তোমার কাছ থেকে যা পেয়েছি তা মনে হয় অন্য কেউ পায়নি।’
‘অভিমানে বলছো?’
‘অভিমান কেন হতে যাবে? আমি সত্যি সত্যি বলছি।’
‘মেয়ে মানুষ মানে তো গয়নাগাটি কামনা করে। গয়নাগাটি না হলে তাদের হয় না। আমি যে তোমাকে কিছুই কিনে দিতে পারলাম না। ভালো-মন্দ খাওয়াতেও পারিনি।’
‘শুধু শুধু বকে যাচ্ছ। আমি কি কোনো অভিযোগ করেছি‌। তোমার মনে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছো।’
‘আমি সত্যি কথাগুলো বলছি।’
‘কোনো কথাই সত্যি নয়। চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়ো তো।’ সূর্যময় আর কিছু বলল না। লতা পাশ ঘুরে শুয়ে পড়লো। চুপচাপ রইলো। সে ভালো-মন্দ কিছুই কামনা করেনি। শুধু স্বামীর কাছে থাকতে চাইছিল। ছোট একটা সংসার পেতে চাইছিলো। এমন একটা মানুষের হাত ধরতে চাইছিল যে মানুষটা হবে খুব শক্ত। সমস্ত পরিস্থিতিতে তাকে বের করে নিয়ে যাবে। তাকে খুব ভালোবাসবে। সবসময় আগলে রাখবে। মন খারাপ হতে দেবে না। সূর্যময় তা পেরেছে। বাবা-মার বড়ো আদরের মেয়ে ছিল। এখানে আসার সময় খুব মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু এমন একটা পরিবার পেয়েছে যে বাবা-মার অভাব বুঝতে পারেনি। তাদের অনুপস্থিতির কথা মনে পড়েনি। সুখে শান্তিতে জীবন কাটিয়েছে। আর কি চাই? ভোর রাতে আবার একবার ঘুম ভেঙে গেল সূর্যময়ের। লতা ঘুমিয়ে আছে। বিরক্ত না করে বাইরে বেরিয়ে এলো। ভোরের আলো ফুটতে বেশিক্ষণ বাকি নেই। পৃথিবীত থেকে একটু একটু করে অন্ধকারে সরে যাচ্ছে। আজকাল পুরোনো স্মৃতিগুলো খুব মনে পড়ে। আজ ভোর হয় কিন্তু বন্ধুদের সাথে টিউশনি যাওয়া হয় না। ভোর হয় কিন্তু বাবার সাথে সমুদ্রের মাছ ধরতে যাওয়া হয় না। ছোট বেলায় কত ডানপিটে ছিল। বড়ো উৎশৃংখল আর চঞ্চল ছিল। আর আজ হয়ে গেছে শান্ত ধীর। অলৌকিক কী? পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কি কিছু রয়েছে? এমন ভাবনায় যে ছেলেটা সারাদিন থাকতো আজ সে বাবা হয়ে গেছে। কত দায়িত্ব তার। এখন নিজের কথা ভাবে না। পরিবারের কথা ভাবে। তাদের সুখে নিজে হাসতে চায়। আজ বন্ধুরাও কাছে নেই। সবুজের কথা ভাবলেই গা শিরশির করে উঠে। কি ছিল আর কি হয়েছে। সংকেত তো নিরুদ্দেশ। তার কোনো পাত্তা নেই। আকাশের দিকে তাকালো। একদিন সে বন্ধুদের বলেছিল তার তিনজনের মধ্যে আগে কে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে? তখন বাকি দুজনে কি কাঁদবে? কখনো বুঝতে পারেনি প্রথম জন সে নিজে হবে। চোখ থেকে জল ঝোরে পড়লো। কান্না মাখা চোখে হাসিও ফুটে উঠলো।

ছেলেকে কাঁধে বসিয়ে হাঁটছে সূর্যময়। বাবার চুল মুঠি করে ধরে রেখেছে ময়ূর। তার কত আনন্দ। অনেক দিনের পর শহরে এসেছে সে। বাবা তাকে শহরে নিয়ে এসেছে সাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য। তার আনন্দ আর সইছে না। শুধু প্রশ্ন করছে। এত গাড়ি রিক্সা বড়ো বড়ো বিল্ডিং কখনো দেখেনি। ছোটবেলায় ডাক্তার দেখানোর জন্য অনেকবার শহরে এসেছে। কিন্তু তখন অনেক ছোট ছিল। কথা বলতে জানতো না। কিছু মনে নেই। এখন একটু বড়ো হয়েছে। কত কৌতুহল তার চোখে-মুখে। বাবার কাছে বায়না করতে রইল এটা ওটার জন্য। সূর্যময়ও তাকে এনে দিল। অনেকক্ষণ থেকে কাঁধে বসে আছে ময়ূর। তাকে নামাতে চাইলো। কিন্তু সে নামতে চাইলো না। আর পারছে না সূর্যময়। তার শরীর অসুস্থ -খোকাকে কি করে বোঝাবে! কিছুটা যাওয়ার পর ময়ূর নিজে থেকে নেমে পড়লো। বাবার হাত ধরে হাঁটতে থাকলো। সূর্যময় খোকার ছোট ছোট আঙুল ধরে এগিয়ে গেল। বাবার বাঁধনে বেশিক্ষণ থাকতে চাইলো না। এ-দিক ও-দিক দৌড়াতে লাগলো। বড় বিরক্ত হয়ে উঠল সূর্যময়। ছেলেকে নিয়ে এসে মুশকিলে পড়েছে। শহরে কত গাড়ি ঘোড়া। সেগুলোর খেয়াল করছে না। এ-ভাবে হয় না। কষ্ট হলেও ছেলেকে আবার কাঁধে বসিয়ে নিল। ছোট্ট ছেলেদের জন্য সাইকেল কিনে নিল। তারপর শহরে আরও একটু ঘোরাফেরা করলো। ছেলেকে অনেক কিছু দেখালো। তারপর বাড়ির পথে রওনা দিল। ময়ূরের মন খারাপ নয় কিন্তু সূর্যময়ের কোনো কারণে মন খারাপ হয়ে গেল। একসময় সে বাবার সাথে শহরে আসতো। আজ সে নিজের ছেলেকে নিয়ে শহরে এসেছে। কত দ্রুত সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেল। কত বড়ো হয়ে গেল। দুপুরের দিকে তারা বাড়ি ফিরে এলো। খাওয়া-দাওয়া করলো। ময়ূর আর কাউকে পাত্তা দেয় না। পড়াশোনাও করে না। সাইকেল নিয়ে সারাদিন ঘোরাফেরা করে। হাত-পা ফাটিয়ে আনে। মা বকুনি দেয় গায়ে হাত তোলে তাও শোনে না।
এই অবোধ খোকাকে কিছু বলতে পারে না সূর্যময়। ছেলেকে দেখে শুধু হাসে আর হাসে। তার মুখে মিষ্টি হাসি সূর্যময়কে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। তাকে দেখলে মনের ভেতর মায়া মমতায় কেমন করে ওঠে। ভেতর থেকে তার প্রতি ভালোবাসা জেগে ওঠে। রেগে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। শুধু গভীর ভালোবাসতে পারে।
এভাবে মাস খানেক কেটে গেল। সূর্যময় আবার অসুস্থ হয়ে পড়লো। এবার ডাক্তার আর কিচ্ছু করতে পারল না। উঠতে-বসতে পারল না। বিছানা ধরে গেল। বড়ো খিটখিটে হয়ে উঠল। ছেলেকে আগে কিছু বলতো না। এখন বেশি ঝামেলা করলে বকুনি দেয়। গায়ে হাত তোলে না তবে রেগে রেগে কথা বলে। ময়ূর বাবাকে ভয় পেতে শুরু করেছে। তাকে খুব বেশি হাসতে দেখা যায় না। মাকে একদমই ভালো লাগে না তাই বাবার কাছে সবসময় থাকতো। এখন বাবা তাকে কাছে নিতে চায় না। বাবা কেমন হয়ে গেছে। সবসময় চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকে। কথা বলে না কারোর সাথে। বেশি কিছু বললে রেগে যায়। দুপুর বেলায় বিছানায় বসে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বন্ধুদের কথা ভাবছিল সূর্যময়। সবুজের মুখ বারবার ভেসে উঠছে। সে সবসময় বলতো বিড়ি সিগারেট অ্যালকোহল এগুলো খেলে পাপ হয়। পাপ হয় কিনা জানে না সূর্যময় তবে এগুলো জীবন নষ্ট করে দেয়। তার জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। হয়তো এগুলো না খেলে তার আয়ু দীর্ঘ হতো। আজ লতা, ময়ূর ,বাবা-মা আর সবুজ-সংকেতকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। মৃত্যুবরণ করতে চাইছে না। আরও অনেকগুলো বছর বাঁচতে চায়। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। কেউ যেন তাকে ডেকে পাঠাচ্ছে। কি আর করার আছে। চোখ দুটো জলে ভেজা। মুহুর্তের মধ্যে হাত দিয়ে জল মুছে ফেললো। না শেষ জীবনে আফসোস করলে চলবে না। শেষ জীবনে যদি আফসোস করে তাহলে এতদিনের বেঁচে থাকাটা অর্থহীন হয়ে যাবে। যা পেয়েছে তা অনেক। আর কিছু দরকার নেই। হাসিখুশিতে মৃত্যুবরণ করলে জীবন সার্থক। সবুজ ঠিক কথাই বলতো, ভালো মানুষের মৃত্যু সুখের হয়। মৃত্যুর সময় কোনো যন্ত্রণা হয় না। সে ভালো মানুষ। তাই এত বড়ো রোগ হওয়ার সত্বেও শরীরের কোনো অংশে ব্যথা নেই। হাঁটু থেকে মুখ তুলে দেখলো দরজার একটা পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ময়ূর। দূর থেকে বাবাকে দেখছে স্থির দৃষ্টিতে। সূর্যময়ের চোখে চোখ পড়তে দৌড়ে পালিয়ে গেল। বেশ গাম্ভীর্য কণ্ঠের ডাক দিল,’খোকা, ও খোকা শোনো!’ বার কয়েকবার ডাক দেওয়ার পরও শুনল না। লতা ধমক দিতে বাবার কাছে ফিরে এলো। চুপটি করে বসে পড়লো।
‘কি হয়েছে তোমার? কাছে আসো না কেন?’ ময়ূর প্রতুত্তর করল না। শুধু শুধু বসে রইল। বাবাকে তার ভয় করে। আগে কত সুন্দর মিষ্টি কন্ঠে ‘খোকা’ বলে ডাকতো। এখন ‘খোকা’ বলে ডাকে। কিন্তু আগের মতো মিষ্টি কন্ঠে নয়।
‘মন খারাপ?’ মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলল। সূর্যময় ছেলেকে কোলে তুলে নিল। জড়িয়ে ধরে বলল,’তোমার কি আর কিছু চাই?’
‘না।’
‘তাহলে মুখ কালো করে রেখেছো কেন?’
‘তুমি কবে সুস্থ হবে বাবা? আমার আবার শহরে যেতে ইচ্ছে করছে। আমায় কাঁধে বসিয়ে শহরে নিয়ে যাবে?’
‘যাবো তো। একটু সুস্থ হয়ে যাই তারপর আবার নিয়ে যাবো। দাদু তো রোজ বাজারে যায় তুমি দাদুর সাথে আজকাল বাজারে যাও না কেন?’
‘ভালো লাগে না। আমার তোমার সঙ্গে যেতে ভালো লাগে।’ ছেলের গালে চুমু দিল অনবরত। বুকে আঁকড়ে ধরল। ময়ূরও বাবাকে চুমু দিল। চুমু দিতে গিয়ে ইচ্ছে করে কামড়ে দিল। হা হা করে হেসে উঠলো বাবা আর ছেলে। বাবার নাকে নাক ঘষে দিলো। বুকে মুখ ঘোষলো। বাবার বুক থেকে নামলোই না। কিছুক্ষণ পর তাদের হাসিখুশিতে সঙ্গী হলো লতা। সে এসে তাদের পাশে বসলো। হাসিমুখে বলল,’তোমরা এত হাসছো কেন? কি হয়েছে?’
সূর্যময় হাস্যজ্জল কন্ঠে জবাব দিল,’আমরা বাপ বেটা দুই ভাই মিলে খেলছি। তুমি খেলবে?’ লতা খিলখিল করে হেসে উঠলো। থামতে পারলো না। মুখে কোনো রকম হাত চেপে বললো,’বাপ বেটা কি করে দুই ভাই হয়? কোনোরকম শব্দ মিলিয়ে দিলে ছন্দ হয়ে যায় নাকি!’
‘আমি ছন্দের জন্য বলিনি। আমরা সত্যি সত্যি দুই ভাই।’
‘অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো।’ ময়ূর দৌড়ে চলে গেলো আসন পাতানোর জন্য। সূর্যময় একা উঠতে পারে না। ধরে নিয়ে যেতে হয়। লতা খেয়াল করে দেখলো স্বামী তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
‘কি এতো দেখছো?’
‘তোমাকে।’
‘আবার দুষ্টুমি শুরু করলে!’
‘আর তো মাত্র ক’দিন। তারপর তোমায় আর দেখতে পাবো না।’
‘তুমি সুস্থ আছো। কোনো কষ্ট হচ্ছে না। তারপরও কেন এমন মনে হচ্ছে?’
‘ভালো মানুষের মৃত্যুর আগে কষ্ট হয় না। স্বাভাবিক অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়।’
‘বারবার একই কথা কেন বলছো? খাবে চলো তো।’
‘আচ্ছা চলো।’

পর্ব ২৬ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here