নিরুদ্দেশ প্রথম খন্ড,পর্ব ১

নিরুদ্দেশ প্রথম খন্ড,পর্ব ১
লেখা: শুভজিৎ জানা

নীলাদ্রি গড়।
ঘুম ভাঙ্গার পর জানালার বাইরে তাকাতেই চোখ গেল জবা ফুলের গাছের উপর। আজ গাছটিতে প্রথমবারের মতো ফুল ফুটেছে। লাল ফুলের উপর সদ্য বের হওয়া সূর্য রশ্মি পড়ায় আরও বেশি লাল দেখাচ্ছে। হালকা বাঁকা লাল রশ্মি জানালা আর মশারী ভেদ করে বিছানায় পড়েছে। ঘুম ঘুম চোখে বিছানা ছাড়লো ষোল বছরের কিশোর সংকেত। প্রত্যেক সকালের থেকে আজকের সকালটা একটু আলাদা। নিজের হাতে লাগানো জবা গাছটিতে ফুল ফোটায় মন আনন্দে কলরব করে উঠলো। বাহিরে বেরিয়ে এসে গাছটির সামনে দাঁড়ালো। একা একা হাসলো। কি নির্বোধ, অবোধ, অসহায় হাসি! কাঁচা সোনার রঙের শরীরের উপর সূর্যরশ্মি পড়ে শরীর চকচক করে উঠেছে। দূরে ভোরের আলোয় ফোটা গন্ধরাজ ফুলের মোহ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের জগৎপ্রাণকে মিষ্টি করে তুলেছে।
জ্যোতির্ময় বাবু পাশে এসে দাঁড়ালেন। ছেলের স্নেহমাখা কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে আনাড়ি ভাবে হাসলেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন,’ভেতরে গিয়ে গায়ে জামা দাও। সকাল সকাল ঠান্ডা করবে।’ সংকেত মাথা নাড়ালো। গায়ে ঢিলেঢালা একটা পোশাক গলিয়ে উনুনের পাশ থেকে ছাই নিয়ে আবার বাইরে এসে দাঁড়ালো। দাঁত মাজলো। পুকুর ঘাটে গিয়ে ভালো করে হাত-মুখ-পা ধুয়ে ফেলল। ঘরের মধ্যে গিয়ে বিছানা গোটালো। খাটের উপর বইপত্র বিলিয়ে গুনগুন করে পড়তে আরম্ভ করলো। বেশ কিছুক্ষণ পড়ার পর -ঘরের মধ্যে জ্যোতির্ময় বাবু আসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
‘বাবু, স্কুলে যাবে তো আজ?’ বাবার মুখে বাবু শব্দটা শুনতে বেশ ভালো লাগে সংকেতের। মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।
‘আমি খাবার রেখে দিয়েছি। সময়মতো খেয়ে সাবধানে স্কুলে যাবে। আসছি, কেমন!’ সে আবার মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল। তিনি ছেলের কাছে এগিয়ে গেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে ছেলেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন দিলেন। হালকা হাসলেন। সংকেত কয়েনটি নাড়িয়ে বলল,’এত টাকা আমার কি হবে? তুমি নিজের কাছে রেখে দাও।’
‘তোমার কাছেই থাক। জানি বাড়তি খরচ করবে না।’
কাঁধে ঝোলা ঝুলিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলেন। পুরনো ভাঙ্গা সাইকেল বাড়ির সামনে পর্যন্ত গড়িয়ে নিয়ে গেলেন। আগড় খুলে রাস্তায় পৌঁছলেন। আবার আগড় লাগিয়ে কাজে বেরিয়ে গেলেন। জ্যোতির্ময় বাবুর পুরো নাম জ্যোতির্ময় সামন্ত। সন্তান জন্মানোর কয়েক বছর পর জননী ছেড়ে চলে যান। প্রতিবেশীরা আত্মীয়-স্বজনরা সবাই দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা বলেন। অন্তত সংকেতের মুখের দিকে তাকিয়ে জ্যোতির্ময় বাবুর বিয়ে করা উচিত। তিনি করেননি। নিজে হাতে ছেলেকে কোলে পিঠে মানুষ করেছেন। মায়ের অভাবও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন পূরণ করতে। কতটুকু পেরেছেন জানেন না। বাড়ির চারিদিকে তাকালে নগ্ন দারিদ্রতার নিষ্ঠুর রূপ লক্ষ্য করা যায়। তবুও বাবা কখনও ছেলের অভাব বুঝতে দেননি। জ্যোতির্ময় বাবু খুব ভালো রান্না করতে পারেন। পাশে সমুদ্র উপকূলে এক হোটেলে রান্ধুনী পেশায় নিযুক্ত। ওখান থেকে যা রোজগার হয় তাতেই সংসার চলে। দু-বেলা দুজনেই হোটেলের খাবার খায়।
নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই বই ছেড়ে উঠে পরল সংকেত। দাঁত মাজার পর কিছু খায়নি। পেটে ইন্দুর লাফাচ্ছে। রান্না ঘরে গেল। বাবা তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বাসনপত্র ধুতে ভুলে গেছেন। একটা মাত্র স্টিলের থালা রয়েছে। সে আবার কাঁসার থালা ছাড়া খায় না। পুকুর ঘাটে গিয়ে রাতের সমস্ত বাসনপত্র ধুয়ে আনলো। তারপর পান্তা খেলো।

বনতুলসী ঘেরা পথ দিয়ে হেঁটে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে সংকেত। তার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে সবুজের বাড়ি। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু দুজন -সবুজ আর সূর্যময়। সবুজের বাড়ির সামনে পৌঁছে ভেতরে প্রবেশ করতে কোনোরকম দ্বিধাবোধ করল না। এ যেন নিজের বাড়ি। তার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো। সবুজ বেশ পরিপাটি হয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে। বই গোছাতে ব্যস্ত। সংকেত তার কাছে পৌঁছে তাকে জড়িয়ে ধরলো। সবুজের আন্দাজ ভুল হলো না। তার এমন মিষ্টি ভালোবাসা খুব বেশি ভালো লাগে না। আবার অস্বস্তি বোধও করে না। পেছনে ঘুরে হাসিমুখে বলল,’আমাকে দেখলে কি তোমার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে? আমি তোমার বউ নাকি?’
‘তুমি যদি মেয়ে হতে তাহলে তোমাকেই বিয়ে করতাম।’
‘হুশশ।’
‘সত্যি, তোমার মতো সুদর্শন পুরুষ এখনও আমার চোখে পড়েনি। কি রূপ! এমন রূপ মেয়েদেরকেই মানায়। তোমার তো আবার শুধু রূপ নয় গুন মেধা সব দিক দিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছো।’ সবুজের মুখখানি ঈষৎ রঞ্জিত হয়ে উঠল। নিজেও জানে, বন্ধু কোনো অমূলক কথা বলেনি। সারা বাংলায় না হোক নীলাদ্রি গড়ের সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ মানুষটি সে নিজেই। প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য প্রায় সময়ই তার রূপের প্রশংসা কানে ভেসে আসে। নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে! তার রূপের প্রশংসা চতুর্দিকেই প্রতিধ্বনিত হয় অথচ তার দুই বন্ধুর মতো তার গায়ের রং সাদা নয়। দুই বন্ধুর মতো স্বাস্থ্যও অতটা সুঠাম নয়। শ্যাম বর্ণ স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি পাতলা সে। মাথায় মাঝারি সাইজের চুল সুঠাম ভাবে সজ্জিত। তার দয়ামাখা নবীন মুখের হাসি সবাইকে মুগ্ধ করে। যৌবনের শুরু এবং বয়সন্ধিকালে রুপ যেন আরও অপূর্ব হয়ে উঠেছে। খুব সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারে। প্রত্যেকটি বাক্য সহজ সরল যুক্তি দিয়ে বোঝায়। খুব মেধাবী। স্কুলে সবসময় প্রথম হয়। একবারের জন্যও দ্বিতীয় হয়নি। বাংলা সাহিত্য তার ভীষণ প্রিয়। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দুই বন্ধু বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসলো। সবুজের সাইকেল রয়েছে। তার সাইকেলের কেরিয়ারের বসে রোজ স্কুলে যায় সংকেত। বাইরে সূর্যালোকে সবুজকে নতুন করে দেখলো সংকেত। তার গায়ে স্কুলের নতুন পোশাক দেখে খারাপ লাগলো। ঈর্ষা বোধ করলো। বলল,’নতুন জামা কিনেছো?’
‘হুম,বাবা গতকাল নিয়ে এসেছেন।’ নিরুত্তর রইল সংকেত। সাইকেলের প্যাডেল সাইকেলের ঘোরালো সবুজ। তার বাবা না চাইতেই তাকে কতকিছু দেন। অথচ সংকেত অনেক কিছু চেয়েও পায় না। যখন ক্লাস নাইনে প্রথম উঠেছিল তখন বাবা একটা নতুন স্কুলের প্যান্ট আর জামা এনে দিয়েছিলেন। দশম শ্রেণী শেষ হতে যায় সে-ই একই পোশাক রয়েছে। অথচ সবুজের বাবা সবুজকে দশম শ্রেণীতে নতুন পোশাক কিনে দিয়েছিলেন। ছয় মাস যেতে না যেতে আবার নতুন পোশাক পেয়েছে। কত ভাগ্যবান সে! হঠাৎ করে মনের কোনো স্থান ব্যাথায় টনটন করে উঠল। আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিল। সে জানে,তার তিন বন্ধুর মধ্যে সবচেয়ে অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে সবুজ। তার বাবা মানে রাধাশ্যাম বাবু এই এলাকার একমাত্র চাকুরীজীবী। ধনসম্পত্তি বেশ রয়েছে। স্ত্রী এবং দুই ছেলেকে নিয়ে বড্ড সুখে আছেন তাঁরা। অভাব জিনিসটা কখনও বোঝেননি। আর্থিক অবস্থা সচ্ছলতার জন্য রাধাশ্যাম বাবু এবং অপর্ণা দেবী বেশ অহংকার করেন। দুই ছেলেকে সবার সঙ্গে মিশতে দেয় না। সব ক্ষেত্রেই ভালো খারাপ বিবেচনা করেন। অথচ সবুজের মধ্যে এমন একটাও ব্যবহার নেই। ও খুব ভালো। সবার সঙ্গে মিশতে ভালোবাসে না ঠিকই তবে কাউকে হীন চোখে দেখে না। ভীষন সাহসী। পাপ কাজকে খুব ভয় পায়। কোনো কিছুর বিনিময়ে সামান্য পাপ কাজ করতে চায় না। একটু উল্টাসিধা অদ্ভুত চরিত্রের অধিকারী। সংকেত আর সূর্যময়ের কাছে থাকাকালীন তাদেরকে হাসিয়ে ভালো কথা শুনিয়ে নিজের প্রশংসা অর্জন করে। আর অন্যদের মানে পরিবার আত্মীয়-স্বজন এবং বড়োদের কাছে খুব শান্ত নম্র ভদ্র থেকে সুনাম অর্জন করে।
দুজনে গল্প করতে করতে সূর্যময়ের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল। সে তৈরি হয়ে তাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। সূর্যময় জেলে পরিবারের ছেলে। নিজেদের ট্রলার রয়েছে। সমুদ্রের মাছের ওপর নির্ভর করে তাদের জীবনযাপন। দুজনে তার কাছে পৌঁছে হেসে উঠলো। সংকেত সবুজের সাইকেল থেকে নেমে পড়ে সূর্যময়ের সাইকেলে বসল। এমনটা রোজই হয়। কিছুদূর সবুজ আর কিছুদূর সূর্যময় তাকে নিয়ে যায়। সাইকেল চালাতে জানে না সংকেত।
রবীন্দ্র বাবুর অঙ্ক ক্লাস। তিনি একজন কঠোর শিক্ষক। পড়া না পারলে কাউকে রেহাই দেন না। ছেলেমেয়ের সবার সমান শাস্তি রয়েছে। ক্লাসে ঢুকেই সবার হোমওয়ার্ক দেখলেন। যারা হোমওয়ার্ক করে আনেনি তাদেরকে বাইরে বের করে দিলেন। আজ সবুজও হোমওয়ার্ক করেনি। একটু সন্দেহ হল! এ ও কি সম্ভব? সবুজ কখনও নিজের কাজে ঢিলেমি করে না। সবসময় সততার সঙ্গে নিজের কাজ শেষ করে। তাহলে আজ কি হলো? তার দুই বন্ধুকে দেখে সন্দেহ দূর হলো। সঙ্গদোষে ছেলেটি শেষ হয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে বদমাইশির জন্য সকলের কাছে পরিচিত সূর্যময়। সংকেত মোটামুটি ভালো পড়াশোনা করলেও বদমাইশি তার রক্তে মিশে আছে। সবসময় কারোর না কারোর পেছনে লাগতে থাকে। কারণে অকারণে কোনো ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে যায়। রবীন্দ্র বাবু সবুজের কাছে এগিয়ে গেলেন। সবুজ মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ তুলতে বললেন। সাহস পেল না সে। তারস্বরে রবীন্দ্র বাবু বললেন,’উচ্ছন্নে যাওয়া শুরু হয়ে গেছে? এমন বন্ধু থাকলে উচ্ছন্নে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তোমাকে নিয়ে স্কুলের অনেক স্বপ্ন রয়েছে, সেগুলো নিজে হাতে শেষ করো না। নিজেকে সময় দাও। দ্বিতীয়বার এমন হলে তোমার বাবাকে জানাতে বাধ্য হব।’ সবুজ কোনো জবাব দিল না। মুখ নিচু করে রইল। রবীন্দ্র বাবু আবার রুমে ফিরে আসলেন তবে তাকে শাস্তি থেকে মুক্তি দিলেন না। প্রত্যেকদিন পড়া করে একদিন পড়া করেনি মানে ছাড় পাবে -তাঁর কাছে অন্তত তা হচ্ছে না। সবার হোমওয়ার্ক দেখা শেষ হওয়ার পর তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে পরবর্তী অনুশীলনীর অঙ্ক করতে শুরু করলেন। ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে বোর্ডে কি লেখা আছে বুঝতে অসুবিধা হবে ছাত্র-ছাত্রীদের। তাই তিনি পেছনে এসে দাঁড়ালেন। অল্প সময়ের পর একটা খাতা দেখে অবাক হলেন। হাতের অক্ষর দেখে চিনতে অসুবিধা হলো না। সবুজের খাতা ছাড়া অন্য কারোর হতে পারে না। খাতা উল্টে নাম দেখে সন্দেহ দূর করলেন। পেছনের বেঞ্চটিতে তারা তিন বন্ধু সবসময় বসে। পাশে কাউকে নেয় না। স্কুলে মোটামুটি সবাই তাদের বন্ধুত্বের কথা জানে। আজকের হোমওয়ার্ক তার খাতায় রয়েছে। তবে কেন স্যারকে মিথ্যে বলল? রবীন্দ্র বাবু খুব চটে গেলেন। বন্দুকের নল থেকে বেরিয়ে আসা গুলির মতো দ্রুত সবুজের সামনে গিয়ে হাজির হলেন।
‘তুমি তো হোমওয়ার্ক করেছো, তাহলে মিথ্যা বললে কেন? স্যারের সঙ্গে ফাজলামি করো?’ সবুজ কোনো জবাব দিল না। ভয়ে বুক ধড়পড় করে উঠলো। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। তিনি আবার জবাব চাইলেন। সবুজ আর চুপ থাকতে পারলো না। মিথ্যাও বলল না। মিথ্যা বলা পাপ। খুব প্রয়োজন ছাড়া মিথ্যা কথা বলে না সে।
‘আমার বন্ধুরা আজ হোমওয়ার্ক করেনি। তাই আমিও..।’
‘কি?’বেশ দারুন একটা হাসি ফুটে উঠল রবীন্দ্র বাবুর মুখমন্ডলে। তিনি যেন এমন উত্তরের প্রত্যাশা করেছিলেন। শক্ত খোলসের ভেতরের থাকা নরম মানুষটা তাদের বন্ধুত্বটাকে খুব ভালো চোখে দেখেন। সংকেত আর সূর্যময় সবটাই জানতো। দুজন বন্ধুর দিকে তাকালো। স্যার ভীষণ খুশি হলেন। সবাইকে মুক্ত করে দিলেন। কিছুক্ষণ আগে তাদের বন্ধুত্ব নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন, আর এখন তাদের সৌহার্দ্য সম্পর্ক দেখে খুশি হলেন। এমন বন্ধুত্ব সমাজে খুব প্রয়োজন। সামনে গাম্ভীর্য প্রকাশ পেলেও মনে মনে তিনি আশীর্বাদ করলেন,এ বন্ধুত্ব শুধু মাত্র যেন স্কুল জীবনে সীমাবদ্ধ না থাকে। সারা জীবন এই ভাবে পাশে থাকুক তারা। বিপদের সময় কেউ কাউকে যেন পর না ভাবে।
স্কুল ছুটি হওয়ার পর তিন বন্ধু মিলে আবার বাড়ি ফিরল। বাড়ি ফেরার পথে সূর্যময় সন্ধ্যার দিকে সমুদ্রের মাছ ধরতে যাওয়ার কথা বলল। এই সমস্ত কাজে বেশ পারদর্শী সে। পড়াশোনা তার একদম ভালো লাগে না। কাঁকড়া ধরতে মাছ ধরতে বেশ মজা পায়। প্রায় সময় এগুলোই করে। মা যদি অনুমতি দেয় তাহলে যেতে অসুবিধা নেই সবুজের। বেঁকে বসলো সংকেত। সে যেতে চায় না। মাধ্যমিক বেশি দেরি নেই। পরিক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে।
‘দূর বাবা,এত পড়াশোনা করে কি হবে? চলো না ..।’ সূর্যময় কিছুটা কড়া কিছুটা আদুরে কন্ঠে বলল। সংকেত মাথা নাড়িয়ে না-ই বলল। সূর্যময় আবার বলল,’তোমার চাইতে সবুজ কত ভালো পড়াশোনা করে সে যেতে রাজি আর তুমি যাবে না!’
‘তার একটু পড়লেই হয়ে যায়,আমার হয় না। আমাকে বেশি পড়তে হয়। সময় দিতে হবে। আমার বাবা প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে আমায় পড়াচ্ছে। একটা বই কিনে দিতে অনেক লড়াই করে। আমার বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বাবার অবাধ্য হতে পারবো না।’
‘ছাড়ো তো। ও যেতে চাইছে না জোর করে লাভ নেই।’ সবুজ বলল। সংকেত একটু থেমে হাসিমুখে বলল,’পরিক্ষা শেষ হোক তারপর যেখানে যেতে বলবে যাবো, অসুবিধা নেই। এখন যাবো না।’ সংকেতকে কিছুতেই রাজি করানো গেল না। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সবকিছুতে না বলল। আরও বেশ কিছুক্ষণ পরে সে বললো,’আমি একবার ক্লাসে প্রথম হতে চাই। খুব ইচ্ছা আমার। এবার মাধ্যমিকে স্কুলের মধ্যে আমিই প্রথম হবো, দেখে নিও। তখন তোমরা আমায় নিয়ে গর্ব করবে। তোমাদের বন্ধু স্কুলে প্রথম হয়েছে। কত আনন্দ হবে তোমাদের।’ সংকেতের অকাট্য কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠলো সূর্যময়। এই হাসিতে যোগ দিল না সবুজ। ভীষন ক্ষেপে গেল সংকেত। রাগে গজগজ করতে করতে বলল,’হাসলে কেন?’
‘যে ক্লাসে সবুজ পড়ে ওই ক্লাসে অন্য কেউ প্রথম হতে পারে,বুঝি?’ বন্ধুর মুখে নিজের প্রশংসা শুনে চোখমুখ উজ্জলতায় ভরে উঠলো।
‘অবশ্যই পারে। পারবে না কেন?’ সংকেতের নিজের প্রতি বিশ্বাস দেখে অবাক হলো সবুজ। ভালো করে দুজনের কথা শুনলো। একসময় কথাবার্তা চরমে পৌঁছোলো। তাদের সামলাতে সবুজ সংকেতকে বলল,’ আচ্ছা তোমার রোল নাম্বার কত?’
‘পনেরো।’
‘ তাহলে, আগে সামনের চৌদ্দ জনকে হারিয়ে দাও তারপর না হয় আমায় হারাবে।’ এই কথা শুনে খুব কষ্ট পেল সে। তাকে তাচ্ছিল্য করল সবুজ। সূর্যময়ের কথা গুলোর চেয়ে সবুজের কথা বেশি আঘাত দিল। রাগ আরও বেড়ে গেল। রাগের চোটে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। বলল,’এই বলে রাখলাম আমি ঠিক প্রথম হবো।’
‘আর যদি না হও, তাহলে?’ সবুজ বলল।
সংকেত জানে তার মধ্যে এমন কিছু লুকিয়ে রয়েছে যা খুব বড়। সেটাকে কাজে লাগালে সে অনেক দূর যেতে পারবে। সে-ই উপলব্ধি থেকে বলল,’তুমি যা বলবে তাই করবো।’
‘প্রমিস!’
‘প্রমিস!’
‘কিন্তু আমি যদি প্রথম হই, তাহলে তুমি কি করবে?’ কোনো চিন্তাভাবনা না করেই নিজের প্রতি বিশ্বাস আটুক রেখে সবুজ বলল,’তাহলে আমি পড়াশোনা ছেড়ে দেব। আর পড়বো না।’ দুজন একে অপরের কাছে প্রমিস করলো আর সাক্ষী রইল সূর্যময়। কথা কাটাকাটি আর ঝগড়া পর্যন্ত ঠিক ছিল কিন্তু এই প্রমিস মানতে পারলো না সূর্যময়। সে নিশ্চিত কিছু একটা অঘটন ঘটবে। প্রথমত, সবুজ খুব মেধাবী তাকে হারানো সহজ নয়। দ্বিতীয়ত, সংকেত কোনো অংশে কম নয়। ভীষণ জেদি ছেলে। যে কাজ করবে বলেছে সে কাজ না করে ছাড়বে না।
রাতে কিছুতেই পড়াতে মন বসাতে পারলো না সবুজ। বারবার সংকেতের কথা মনে পড়লো। ভালো করে বন্ধুকে চেনে। নিজের কথা রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। সেও কোনো অংশে কম নয়। তবুও বুক কেঁপে উঠলো। এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। পরিশ্রম করলে সব কিছু পাওয়া যায়।
জ্যোতির্ময় বাবু আর সংকেত রাতের খাওয়া শেষ করলেন। ছোট ঘরটায় একটা মাত্র বিছানা রয়েছে।রোজ বাবা ছেলে পাশাপাশি ঘুমোয়। কাঁথার ভেতরে মশারী গুজে দিয়ে জ্যোতির্ময় বাবু লক্ষ্য করলেন -ছেলে গুন গুন করে পড়ে যাচ্ছে। বেশ ভালো লাগলো। ছেলেকে কখনও পড়তে বসতে বলতে হয় না। নিজে থেকে পড়তে বসে যায়। ভোরে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেও হয় না,সময় মতো উঠে পড়ে। সারা দিন উনুনের পাশে বসে কঠোর পরিশ্রম করার পর রাতে জেগে থাকতে পারেন না। তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ছেলে আবার বাবা না হলে খেতে বসতে চায় না। তার কাছে বাবাই সবকিছু। সে খাওয়ার খাবার পর পড়াশোনা করে আর জ্যোতির্ময় বাবু ঘুমিয়ে পড়েন। মাঝেমধ্যে ভাবেন, ছেলের পাশে বসবেন কিন্তু ক্লান্ত শরীর বসে থাকার ইচ্ছাকে গলা টিপে হত্যা করে। সংকেত অনেকবার ঘুমোনোর সময় বাবাকে বলেছে ক্লাসে প্রথম হতে চায় সে। বাবা শুধু ভরসায় জুগিয়ে গেছেন কিছু করে উঠতে পারেননি। কি-ই বা করবেন তিনি? ছেলে দীর্ঘ সময় ধরে পড়ে কিন্তু মনে রাখতে পারে না। তাই হাজার চেষ্টা করেও কখনো ক্লাসে প্রথম হতে পারেনি। প্রথম তো অনেক দূরের কথা দশের মধ্যেই আসতে পারেনি। ছেলের কষ্টে বাবার চোখ থেকে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। আজ কিছুতে চোখে ঘুম আসলো না। আলো চোখে এসে পড়েছে। চোখে ঘুম এলেও স্থায়ী হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন। বললেন,
‘বাবু,আর কতক্ষন পড়বে? ঘুমোবে আসো।’ সংকেত বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। কিশোর ছেলের চোখে হালকা হাসি বাবাকে মুগ্ধ করলো। হাসিমাখা কন্ঠ বললেন,’তুমি কখনো প্রথম হতে পারোনি তো কি হয়েছে? তোমার বন্ধু তো ক্লাসে প্রথম -এ ও অনেক গর্বের। বন্ধুকে হারিয়ে কি খুশি হতে পারবে?’
‘জানো বাবা, সবুজ কী বলে? সে বলে, ক্লাসে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হওয়া কিছু নয়। পড়াশোনা শব্দের আসল অর্থ শব্দকে ভালোবাসা, অক্ষর চেনা। যে শব্দকে ভালোবাসতে পারবে অক্ষরকে ভালোবাসবে তাকে কেউ আটকাতে পারবে না।সে কখনও পড়ায় অমনোযোগী হবে না। যদি সে কখনো দ্বিতীয় হয়, তাহলে কি সে মন খারাপ করবে? আমিও তার মতো হয়ে গেছি। তার কথা বিশ্বাস করেছি। কিন্তু আমি আমার ইচ্ছে কে বিসর্জন দিতে পারিনি। দেখবে আমি একদিন ঠিক প্রথম হবোই।’
ছেলের নিজের প্রতি বিশ্বাস দেখে অবাক হলেন জ্যোতির্ময় বাবু। তিনি নিজেকেও এতটা বিশ্বাস করেন না। ছেলে হ্যারিকেন জ্বালালো। বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে দিল। একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন,’কি হলো? আলো নিভিয়ে দিলে কেন?’
‘বৈদ্যুতিক আলো জ্বললে তোমার ঘুমাতে অসুবিধা হবে। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।’
‘ কিন্তু তোমার পড়ায় তো অসুবিধা হবে‌।’
‘আমার কিছু হবে না। আমার পড়াশোনার থেকেও তোমার ঘুম ভীষণ প্রয়োজন।’ কথা বাড়ালেন না।শুয়ে পড়লেন। ছেলের ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন। সেদিন বিয়ে না করার সিদ্ধান্তটা ভুল হয়নি। তিনি পেরেছেন ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করতে। মা না থেকেও মায়ের অভাব পূরণ করতে পেরেছেন। ছেলে সঠিক শিক্ষা পেয়েছে। শেষ রাতে বই রেখে বাবার কাছে চলে আসলো। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
সময় মতো মাধ্যমিক শেষ হলো। ফল প্রকাশিত হলো। এবারের ফল একটু অপ্রত্যাশিত হলো। সংকেত পেরেছে সবুজকে পেছনে ফেলে প্রথম হতে। স্কুলে মার্কশিট হাতে পাওয়ার পর আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। কারোর সঙ্গে এক মুহুর্ত দেখা করার জন্য সময় পেল না। বাবার কাছে ফিরতে চাইলো। তিনি আজ কাজে যাননি। তিনিও এমন একটা মুহূর্তের অপেক্ষায় আছেন। স্কুলে দুই বন্ধুকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে পায়ে হেঁটে সোজা বাড়ি চলে আসলো। জ্যোতির্ময় বাবু বাড়ির সামনে নারকেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে মিহি চোখে তাকিয়ে আছেন। সংকেত কাছে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। সবকিছু জানার পর কেঁদে ফেললেন। শক্ত কঠিন চোখ দুটো আজ কোনো বাঁধাই মানলো না। ছেলের খুশিতে নিজের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরল। কিন্তু বাবার কিছু ব্যবহার সংকেতের কাছে অপ্রত্যাশিত লাগলো। ছেলে স্কুলে প্রথম হওয়ায় তিনি খুব বেশি খুশি নন। কিন্তু কেন? তিনি তো বাবা। ছেলের খুশিতে খুশি নন! বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলো না। অনেক প্রশ্ন জমা হল। ঘরের মধ্যে যেতেই জ্যোতির্ময় বাবু ছেলেকে বললেন,’সবুজ আর সূর্যময় কেমন রেজাল্ট করেছে?’
‘ভালো, সবুজ আমার চেয়ে মাত্র এগারো নাম্বার কম পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছে।’ সবুজের রেজাল্ট শুনে খুব বেশি অবাক হলেন না। এমনটা হওয়ার কথা ছিল। সংকেতের দুই বন্ধুকে তিনি নিজের ছেলের মতোই ভাবেন। সূর্যময় পড়াশোনা করে না তাই তার খারাপ রেজাল্ট হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সবুজ? বেচারা খুব কষ্ট পেয়েছে নিশ্চয়ই।
‘বাবু, সবুজকে দেখেছো স্কুলে?’
‘স্কুলে তো একসঙ্গে গিয়েছিলাম। কিন্তু মার্কশিট হাতে পাওয়ার পর তাকে আর খুঁজে পাইনি।’
‘নিশ্চয়ই কোথাও মন খারাপ করে বসে রয়েছে।’
‘না বাবা,ও মন খারাপ করবে না। ওর কাছে পড়াশোনা মানে ক্লাসে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হওয়া নয়, অক্ষরকে ভালোবাসাই ওর কাছে পড়াশোনা।’
‘তবুও! কোনো স্থানে অনেকদিন থেকে গেলে হৃদয় যতই নিষ্ঠুর হোক না কেন ওই স্থান থেকে চলে আসলে মন খারাপ হবেই। ওটা যদি পাণ্ডববর্জিত জায়গা হয় তবুও মন খারাপ হবে। ওই স্থানটির সঙ্গে একটা আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সবুজও একটা জায়গায় দীর্ঘদিন ছিল। মন খারাপ হওয়া আমার কাছে স্বাভাবিক লাগছে।’
‘আমি এক্ষুণি আসছি তার বাড়ি থেকে। দেখবে,ও মন খারাপ করেনি।’ স্কুলের জামা-প্যান্ট না বদলেই সবুজের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরল। অপর্ণা দেবী সংকেতকে দেখে অদ্ভুতভাবে মুখ প্যাঁচালেন তাতে গুরুত্ব দিল না সে। নিচু মানুষদের সামনেথেকে অগাধ ভালোবাসা দেখালেও অন্তর থেকে শ্রদ্ধা টুকু নেই তাঁদের। সে সোজা সবুজের ঘরে চলে গেল। সাজানো-গোছানো ঘরের কোণায় চেয়ারের উপর বসে রয়েছে সবুজ। ঘরের মধ্যে কারোর পায়ের শব্দ পেয়ে মুখ তুলে চেনা মুখ দেখে ম্লান হাসলো। শান্ত উগ্রতাশূন্য উদার চোখে সংকেতের দিকে তাকালো।
‘ সবুজ, তোমার কি মন খারাপ?’ সে মাথা নাড়িয়ে না বলল।
‘আমার কাছে পড়াশোনা মানে অক্ষরকে ভালোবাসা। প্রথম দ্বিতীয়তে কিছু এসে যায় না।’
‘আমি জানতাম তুমি মন খারাপ করবে না।’ একটা বিজয়ী হাসি দিল সংকেত। তার পাশে বসে পরলো।
‘তুমি তো বেশ ভালোই নাম্বার পেয়েছো। সাইন্সে ভর্তি হবে?’
সংকেত তাড়াতাড়ি বলল,’না না, ওই সাবজেক্ট গুলো আমার একদমই পছন্দ না। আমি কলা বিভাগে ভর্তি হব।’
‘ বাহ্, ভালো। যা ভালো লাগে তাই করো।’ কথাটি একদমই পছন্দ হলো না সংকেতের। কথার মধ্যে কেমন একটা ঈর্ষা প্রকাশ পেল। তার বন্ধু তো এমন নয়।
‘তুমি কি নিয়ে পড়বে? আমরা তিনজন কিন্তু এক স্কুলে ভর্তি হব।’
‘না গো, আমি আর পড়াশোনা করবো না।’
‘কেন?’
‘তোমায় কথা দিয়েছিলাম না আমি যদি দ্বিতীয় হই তাহলে পড়াশোনা ছেড়ে দেব।’ খিলখিল করে হেসে উঠল সংকেত।
‘ওই গুলো তো কথার কথা। তুমি ওই সব কথা এখনো মনে রেখেছো! বাদ দাও না। প্রমিস করা হয় প্রমিস ভাঙ্গার জন্য। তাছাড়া, আমি তো কিছু বলছি না। আমি যদি প্রথম হতে না পারতাম, তাহলে কি তোমার শর্ত মানতাম? মানতাম না।’
‘কিন্তু আমি যখন কথা দিয়েছি তখন কথা রাখবো। আমার কথার খেলাপ হবে না।’ ভারী কন্ঠে জবাব দিল সবুজ। এবার থতমত খেলো সংকেত। সারা শরীর জুড়ে মৃদু শিহরণ জাগলো‌। আমতা আমতা করতে লাগলো।
‘কি পাগলামো করছো? এই সামান্য কারণে পড়াশোনা বন্ধ করে দেবে? এতে আমার কোনো ক্ষতি হবে না, -ক্ষতি তোমার হবে।’
‘লাভ-ক্ষতি আমি বুঝি না। কথা খেলাপ হবে না এটুকু বলতে পারি।’
‘এই সবুজ, কি সব বলছো? ভালো লাগছে না আমার।’
অনেক চেষ্টা করেও সংকেত সবুজকে রাজি করাতে পারল না। নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল। তার চোখে-মুখে কোনোরকম ভয় নেই। অবোধ বালকের মত মায়াময় হাসি মাখা রয়েছে। কি মিষ্টি,কি হৃদয় ভাঙ্গা হাসি! ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসলো সংকেত। কোথাও নিজেকে অপরাধী মনে করল। সবুজ যদি সত্যি সত্যি পড়াশোনা বন্ধ করে দেয় তাহলে সারা জীবন একটা বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে। একটা অপরাধ আজীবন দগ্ধ করে বেড়াবে। পারবে তো এই কঠিন জাল ছিঁড়ে বেরোতে?
জ্যোতির্ময় বাবু বিকেলে সবুজকে তাদের বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। বড়োদের কথা অমান্য করার সাধ্য তার নেই। ছুটে তাদের বাড়িতে পৌঁছালো। তিনি সবুজের প্রিয় লুচি তরকারি বানিয়ে দিলেন। খাবারের সময় পড়াশোনার বিষয়টি উঠে আসলো। দুপুরে ছেলের মুখ থেকে সবুজের সমস্ত পাগলামি শুনেছেন। হতভম্ব হয়েছেন। সারা বিকেল জুড়ে নিজের মতো করে বোঝালেন। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে বললেন। এই সামান্য ব্যাপারে জীবনে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। এ ভাবে নষ্ট করা ঠিক নয়। কিন্তু কিছুতেই কোনো কিছু করে উঠতে পারলেন না। সে কথা দিয়েছে মানে কথা রাখবে। কথা ফেলতে পারবে না।পরে যেন কোনোভাবেই কারোর মুখে শুনতে না হয় সে কথা দিয়ে কথা রাখেনি।

রাতে ছেলেকে নিয়ে বসলেন রাধাশ্যাম বাবু। অনেক বোঝালেন উদাহরণ দিলেন কিন্তু ছেলের মন বদলাতে পারলেন না। মা অপর্ণা দেবী এবং বড়ো দাদা রিপন…..। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। আভিজাত্য পরিবারে জন্ম তাদের। সমাজে ভালো একটা পরিচিতি রয়েছে। ছেলের এমন পাগলামিতে বিরক্ত হলেন রাধাশ্যাম বাবু। যখন বুঝিয়ে আদর করে ভালোবেসে হলো না তখন তিনি শাসনটাই বেছে নিলেন। কড়া ভাষায় বললেন, এ বাড়িতে থাকতে হলে এই বাড়ির বড়োদের কথা শুনে চলতে হবে। নতুবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। নিজের রাস্তা নিজেকে দেখতে হবে। কতই বা বয়স হয়েছে? এই বয়সে নিজের মত থাকবে বললে চলবে না। সহজ-সরল সবুজ বাবার মুখের উপর জবাব দেওয়ার সাহস পেল না। গুটিগুটি পায়ে নিজের ঘরে চলে এলো। রাতে কেউ খেলো না। সারাবাড়ি স্তব্ধতায় ছিয়ে গেল। কিন্তু সবুজের মনে অন্য কিছু চলছিল। সিঁদুর মাখানো ভোরে কোথাও হারিয়ে গেল সে। বাড়ি থেকে একটা জিনিসও নিয়ে যায়নি। চিঠি পর্যন্ত রেখে যায়নি। সকালে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সবার বাড়িতে খোঁজ করা হলো। কোথাও পাওয়া গেল না। থানায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি লেখা হলো। ছেলে ফিরে আসার জন্য পত্রিকায় দিনের-পর-দিন বিজ্ঞাপন ছাপা হলো। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞাপনের লেখা পরিবর্তন হয়ে সবুজের শরীরের বর্ণনা দিয়ে বলা হলো কেউ খোঁজ দিতে পারলে তাকে আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হবে। আর্থিক পুরস্কারের পরিমাণ দিনের পর দিন বাড়তে রইলো কিন্তু সবুজ ফিরলো না। কেউ খোঁজও দিতে পারলো না।

লেখা: শুভজিৎ জানা

বিঃদ্রঃ এটি দুটি খন্ডে শেষ হবে। তবে একটা খন্ড প্রকাশ পাওয়ার পর আর একটা খন্ড প্রকাশ পেতে বেশি সময় লাগবে না। পরপরই প্রকাশিত হবে। উপন্যাস সম্বন্ধে সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here