নিরব সে,৬ষ্ঠ পর্ব,০৭

নিরব সে,৬ষ্ঠ পর্ব,০৭
সাদিয়া_সৃষ্টি
৬ষ্ঠ পর্ব

–আপনি সিগারেট খান কেন?

বিছানায় শুয়ে এই প্রশ্ন করবে কি করবে না এটা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল জিনিয়া। কিন্তু সাহস পাচ্ছিল না। সে এই বাড়িতে আসার পর সর্বোচ্চ কথা ওয়াফিফের সাথে বলেছিল। তবুও এতটাও কাছাকাছি তারা নয় যে একেবারে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বসবে। তবুও জিনিয়ার এই মানুষটাকে জানার ইচ্ছা প্রবল। এই মানুষটাকে তার প্রচুর ভালো লাগে। এমন মানুষ কি আসলেই হয়? তাকে কি সুন্দর মেনে নিল? এতটাও ভালো কি সত্যিই কেউ আছে পৃথিবীতে? থাকার কথা তো না হয়তো। জিনিয়া তাই এই মানুষটাকে সম্পূর্ণ জানতে চায়। কিন্তু তাকে জানতে হলে তাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তার সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। যেটা জিনিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। জিনিয়া ওয়াফিফকে একটা প্রয়োজনীয় প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে গেলেই ১০ বার ভাবে। ১০ বার ভাবার পরও হয়তো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না যে প্রশ্ন করা ঠিক হবে কি না। সেখানে শুধুমাত্র কৌতূহলের বশেই যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, তাহলে সেটা কি ঠিক হবে? জিনিয়া চায় না তার কোথায় কেউ আঘাত পায় এমনটা হোক। এই জন্য নিজে সব সময় চুপ থাকতেও রাজি। আর সেটা যদি ওয়াফিফ হয় তাহলে সে সারা দিন না কথা বলে থাকতে পারবে। তবু কোন প্রশ্ন করবে না।

চিন্তারা ঘুরপাক খাচ্ছে জিনিয়ার মাথায়। একেক সময় একেক টা। যতই সময় যাচ্ছে , তার চিন্তা ততই গভীর হচ্ছে। সে চাচ্ছে না এতো চিন্তা করতে। তবুও অনেক ভাবনা এসে জড়ো হচ্ছে তার মস্তিষ্কে। সে চাচ্ছে সে ঘুমিয়ে পড়ুক, যাতে আর ভাবনা না আসে। কিন্তু সে চেয়েও ঘুমাতে পারছে না। একজন হয়তো ঠিকই বলেছেন।

আমরা যখন অনেক করে চাই যে ঘুমিয়ে পড়ি, তখন ঘুম আসে না। আবার যখন চাই ঘুমাব না, তখন ঘুমের ঘোরে বেশি থাকে মানুষ। আবার অনেকে ঘুমানোর জন্য চিন্তার সাহায্য নেয়। কারো চিন্তায় ঘুম আসে না তো কেউ চিন্তা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে সেটা টেরই পায় না। বড়ই অদ্ভুত মানবদেহ ও তার কার্যাবলী !

জিনিয়া ঘুমানোর চেষ্টায় বিছানায় নিজের জায়গায় শুয়েই একেক বার একেক দিকে ঘুরছে। একবার ডান দিকে তো একবার বাম দিকে। তবু ঘুমের দূরদূরান্ত পর্যন্ত দেখা মেলে নি। পাশেই থাকা ওয়াফিফ কারো অনবরত নড়চড় থেকে আর ঘুমাতে না পেরে চোখ খুলে তাকায়। সে জিজ্ঞেস করে,

–জিনিয়া, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?

–জ্বি, না।

–ঘুম আসছে না?

–হুম।

খুব ধীরেই বলল কথাটা। এতো ধীরে যেন ওয়াফিফ শুনতেই না পায়। তার খারাপ লাগছে এখন, সে কেন এতো নড়তে গেল? তার জন্য ওয়াফিফের ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু ওয়াফিফ তার কথাটা শুনতে পেল। ওয়াফিফ জিনিয়াকে বলল,

–এখন ঘুমিয়ে পড়, কাল অনেক কাজ আছে। আর আমি তোমাকে সেদিন একটা কথা মনে করিয়ে দিতে বলেছিলাম। তুমি দেও নি। কাল সকালে আবার দিও । ওটা বলা জরুরি। আর মনে না করিয়ে দিলে আবার ভুলে যাবো।

–এখনই বলুন।

–কেন?

–নাহলে আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়ার কথা আমারও মনে থাকবে না।

এইবারও কথাটা ধীরেই বলল জিনিয়া। কিন্তু রাত হওয়ায় ধীরে বলা কথাও ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছে। তাই ওয়াফিফ জবাব দিল,

–আচ্চা, তোমার মনে করানোর দরকার নেই। আমিই বলব। এখন ঘুমিয়ে পড়। আর কোন কথা চিন্তা করো না। আর একটা কথা, তোমার কি সিগারেট সহ্য হয় না?

–না।

–ওকে। তাহলে আর তোমার সামনে সিগারেট বের করব না। তাছাড়া এটা বেবির জন্যও ঠিক হবে না। এটা নিয়ে আর চিন্তা করো না, ঘুমিয়ে পড়।

বলেই ওয়াফিফ চোখ বন্ধ করে ফেলল। জিনিয়া আবারো ধীরেই বলে উঠল,

–ওটা ছেড়ে দেওয়া যায় না?

জিনিয়া বলার পর থেকে ওয়াফিফ চুপ করে থাকল। কোন কথা বলল না। জিনিয়া ভাবল সে কেন বলতে গেল কথাটা। হয়তো ওয়াফিফ শুনে নি। ভালোই হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়লেই ভালো।

অনেকক্ষণ পর ওয়াফিফ বলে উঠল,

–আমি … আমি চেষ্টা করব ছেড়ে দেওয়ার। নাহলে বেবির সমস্যা হতে পারে।

জিনিয়া এই শুনে আর কিছু বলল না। শুধু মনে মনে ভাবল,

”আমি ওটা বেবির কথা ভেবে বলি নি, আপনাকেই বলেছিলাম , ডাক্তার সাহেব।”


সকালে আবার ওয়াফিফ জিনিয়ার আগেই উঠল। এটা ওর অভ্যাস। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বাইরে হাঁটতে যাওয়া। কিন্তু এই কয়দিন বাইরে হাঁটতে যাওয়া হয় নি। সে গত কয়েক বছরের অভ্যাস যে ২ – ৩ দিনেই খেয়ে বসে আছে আর যেকোনো সময় হজমও করে ফেলতে পারে, ভালোই বুঝতে পারছে। সত্যিই মানুষের অলস হতে বেশি সময় লাগে না। আজকাল সকালে উঠতেও ইচ্ছা হয় না তার। তবে প্রায় অনেক পুরনো অভ্যাস হওয়ায় হয়তো সে না চাইতেও উঠে পড়ে। এই ২ দিনে ঘুম থেকে উঠে আবার জিনিয়াকে ডেকে বিছানায় শুয়ে পড়ার অভ্যাস ও গড়ে উঠছে তার। তাই সে দেরি না করে জিনিয়াকে ডেকে তুলল। জিনিয়া ফ্রেস হতে চলে গেলে সে আজ আর ঘুমাল না। গত রাতের কথা মনে পড়তেই সে বিছানায় সোজা হয়ে বসে রইল আর জিনিয়ার বের হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকল।

কিছু সময় পর জিনিয়া বের হলে সে জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে। কিন্তু তার মুখ থেকে আর কথা বের হল না। জিনিয়াকে ভেজা চুলে খারাপ লাগছিল না। অন্যরকম অনুভূতি তার মনেও এসেছিল। যতই হোক, সে তো একজন পুরুষ। নিজের অনুভূতির উপর নিয়ন্ত্রণ আনলেও কিছুটা হলেও তো অনুভূতি তার কথা না মেনে থাকবেই। কিছু মুহূর্তের জন্য তার অদ্ভুত সব ইচ্ছা জাগ্রত হলেও মুহূর্তেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনল সে। নিজের চিন্তা চেতনাকে এক পাশে সরিয়ে সে জিনিয়াকে বলে উঠল,

–আজ তোমার চেক আপের জন্য যাবো। বিকালে তৈরি থেক। আর যেরকম বলছি , সেরকম করবে , ঠিক আছে?

জিনিয়া মাথা নাড়িয়ে আবার তোয়ালে দিয়ে নিজের চুল মুছতে থাকল। ওয়াফিফ আবার বলে উঠল,

–আর তোমার প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট আমাকে দিয়ে দিও। ওটা আমি আমার কাছে রাখব। সঠিক সময় আসলে বাড়িতে জানাব যে তুমি প্রেগন্যান্ট, আর সেটা আমার বাচ্চা, ঠিক আছে?

এই কথা শুনে জিনিয়া চোখের কোণ বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। জিনিয়ার কি হল সেটা আর জানা নেই। তবে সে মুহূর্তে সে গিয়ে ওয়াফিফকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। ওয়াফিফ জিনিয়ার অবস্থা বুঝতে পারল। তাই তাকে সরানোর চেষ্টা করল না। বরং সেখানেই বসে থাকল, আর জিনিয়াকেও নিজের দুহাত দিয়ে আগলে নিল। জিনিয়ার কাছে ওয়াফিফ এখন সম্পূর্ণ ভরসার একটি স্থল বলেই মনে হল। কিছুক্ষণ পর সে কি করেছে খেয়াল হতেই সরে দাঁড়াল। ার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ওয়াফিফ জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল যে সে কি বোঝাতে চাইছে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পেরে হাসিমুখে জবাব দিল,

–আর কিছু বলব না , এখন যেতে পারো।

ওয়াফিফের বলা দেরি, কিন্তু জিনিয়ার রুম থেকে বের হতে ১ সেকেন্ডও দেরি হয় নি। সে বারান্দায় তোয়ালে মেলে দিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ওয়াফিফ জিনিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। আর ভাবল, বউ জুটেছে একটা তার কপালে। মুখে একটা কথাও বলবে না। তার দিকে তাকিয়ে বুঝে নিতে হবে সব। জিনিয়ার মনের কথা বুঝতে এখন থেকে তার বেশ পরিশ্রম করতে হবে।

ওয়াফিফ হাত মুখ ধুয়ে বাইরে হাঁটতে চলে গেল।


বিকালে ,

ওয়াফিফ আর জিনিয়া ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলেছে। ওয়াফিফ সামনে আর তার পিছনে জিনিয়া হেঁটে চলেছে। জিনিয়া হাঁটছে আর ভাবছে যে আজ ওয়াফিফ নিজের কাজ থেকে দুপুরে ফিরে আবার বিকালেই হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। একটুও বিশ্রাম নেওয়ার সময় পেল না। দুপুর বলতে একপ্রকার বিকাল বলা যায়। ৩ টায় বাড়ি ফিরে আবার সব দ্রুত শেষ করে ৪ টায় বের হওয়া আর তার আগে আফিয়া রহমান কে রাজি করানো কম কথা নয়। জিনিয়া নিজের প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট ওয়াফিফকে সকালেই দিয়ে দিয়েছিল এটা ওয়াফিফ কোথায় রেখেছে সেটা ওয়াফিফ ছাড়া কেউ জানে না। তারপর আসলো দুপুরে মাকে রাজি করানো। ওয়াফিফ তার মাকে বলল, জিনিয়াকে নিয়ে একটু ঘুরে আসবে। আসার পর থেকেই সে বাড়িতে আসে। আশেপাশের পরিবেশ চিনে না। যদি কখনো দরকার পড়ে তাহলে কিভাবে কি করবে, সেজন্যই শুধু কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গা একটু চিনিয়ে দিবে। কিংবা আজ একটু নদীর পাড় থেকে ঘুরে আসবে। আফিয়া রহমান প্রথম দিকে একটু চিন্তা করলেও পরে তিনি রাজি হয়ে যান। অবশ্য তিনি জিনিয়ার উপর সন্তুষ্ট। ওয়াফিফের গাইডলাইন পেয়ে জিনিয়া ভালোই শাশুড়ির মন জয় করতে পেরেছে। আর তাই আফিয়া রহমান কে রাজি করাতে বেশি কষ্ট করতে হয় নি। কিন্তু তখন আবার জিনিয়া আফিয়া রহমানের আঁচল ধরে পিছনে লুকিয়ে পড়ে আর মাথা নিচু করে ডানে বামে ঘোরায়, যার অর্থ সে যাবে। সে মায়ের কাছে থাকবে। এতে করে আফিয়া রহমান আরও খুশি হয়ে নিজে থেকেই জিনিয়াকে পাঠিয়ে দেয়। সকালে ওয়াফিফ এটাই জিনিয়াকে শিখিয়ে দিয়েছিল। তাতেই মা রাজি হয়ে যায়। সত্যিই ওয়াফিফ তার মাকে ভালোই চেনে।

এসব ভাবতে ভাবতে জিনিয়া একটু পেছনে পড়ে যায়। আর সে চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে ওয়াফিফ কে খুঁজতে থাকে। মানুষের ভিড় মোটামুটি পর্যায়ে আছে। ওয়াফিফ অনেকক্ষণ ধরে নিজের আশেপাশে জিনিয়ার অস্তিত্ব না পেয়ে জিনিয়া আদৌ তার সাথে আছে কি না সেটা দেখতে পিছনে তাকিয়ে দেখে জিনিয়া নেই। সে মাথা একটু উঁচু করে ভীরের মধ্যে জিনিয়াকে পেয়েও যায়। তারপর নিজে পিছনে গিয়ে জিনিয়ার হাত ধরে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে আসে। জিনিয়া প্রথমে ভয় পেলেও পরে ফাঁকা জায়গায় আসার পর ওয়াফিফকে দেখে চুপ হয়ে যায়।

–কোথায় জাচ্ছিলে। সাথে সাথে চলতে পারো না। এখন আমি তোমার হাত ধরে হাঁটব। আর এতে কোন ‘না’ শুনব না। তুমিও ভালো বাচ্চার মতো আমার পিছন পিছন আসবে।

বলেই আর দেরি না করে জিনিয়া র হাত ধরে ওয়াফিফ ভীরের মধ্যে আবার চলা শুরু করে আর এক পর্যায়ে ঈক্তা রিকশায় উঠে যায়। রিকশায় ওঠার পরও সে জিনিয়াকে এক হাত দিয়ে ধরে রাখে। যাতে জিনিয়া পড়ে না যায়। ওয়াফিফের এই ছোট ছোট খেয়াল রাখা গুলো জিনিয়ার বেশ ভালো রাখছে।

”মানুষটা সত্যিই ভালো, অনেক ভালো।”

মনে মনে ভাবে জিনিয়া।


ডাক্তারের সাথে দেখা করে জিনিয়াকে নিয়ে সে নিজে যেই হাসপাতালে কাজ করে সেখানে নিয়ে আসে। শহরের ভেতরে কোন হাসপাতালে এখন ওয়াফিফ জিনিয়াকে দেখায় নি। আর যাকে দেখাল, তিনি হলেন ড. আফসানা রায়। তিনি ওয়াফিফের পরিচিত। তিনি জিনিয়ার চেক আপ করে ওয়াফিফ কে তার অবস্থা সম্পর্কে জানান আর পরে কবে আবার চেক আপের জন্য আসতে হবে সেটা বলে দেন। তারপর আবার রিকশায় করে ওয়াফিফ আর জিনিয়া ফিরে আসে ওয়াফিফের হাসপাতালে। ওয়াফিফ একটা বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করে গত সাড়ে ৪ বছর ধরে। ওয়াফিফ জিনিয়ার রিপোর্ট নিজের কেবিনের একটা লকারে আটকে রেখে জিনিয়াকে নিজের কেবিন দেখায় আর ওকে একটু অপেক্ষা করতে বলে। একজন ইমারজেন্সি পেশেন্ট আসায়। তাকেই দেখতে চলে যায়। জিনিয়া বসে বসে বোর হচ্ছিল। তাই সে ওয়াফিফের কেবিনের টেবিলের কাছে যায় আর দেখতে থাকে। তার নজরে পড়ে ওয়াফিফের আইডি কার্ড। সেখানে দেখতে জিনিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

ওয়াফিফের বয়স ৩১ বছর। জিনিয়া নিজে হিসাব করে। তার বয়স ২৩ বছর। কয়েকদিন পর ২৪ হবে। আর ওয়াফিফের কয়েক মাস আগেই ৩১ হয়েছে। তার মানে ওয়াফিফ তার থেকে ৭ – ৮ বছরের বড়?

চলবে।

”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
৭ম পর্ব

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর থেকে জিনিয়া ওয়াফিফের সাথে একবারও কথা বলে নি। আজ তার ভীষণ ইচ্ছা করছে ওয়াফিফের উপর রাগ করার। বিশেষ করে হাসপাতাল থেকে। তারা খুব দ্রুতই বাড়ি ফিরে এসেছিল। যাতে কেউ কোন প্রশ্ন না করতে পারে। তাছাড়া আফিয়া রহমান যেখানে নিজে অনুমতি দিয়েছেন, সেখানে কেউ কোন প্রশ্ন করার সুযোগ পেত না। তবুও সাবধানতা অবলম্বন করাই শ্রেয়। তাই দ্রুত ফিরে এসেছে। সেই যে হাসপাতাল থেকে বের হয়েছে, তখন থেকে ওয়াফিফের সাথে একটা কথাও বলে নি জিনিয়া। শুধু প্রশ্নের উত্তরে মাথা নেড়েছে। এর বেশি কিছু না। রাস্তায় জিনিয়া যখন হাওয়াই মিঠাই এর দিকে অনেক সময়ের জন্য তাকিয়ে ছিল, তখন ওয়াফিফ তাকে সেটাও কিনে দিয়েছিল। কিন্তু তাও জিনিয়া কিছু বলে নি। রাতে খাবার টেবিলেও কিছু বলে নি। সবার সাথে সে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছিল। কিন্তু ওয়াফিফের সাথে কথাই বলছিল না। ওয়াফিফের বেশ অবাক লাগল। যেই জিনিয়া কি না শুধু তার সাথেই কথা বলত, সে আজ তার সাথে কথাই বলে নি। এক বাক্যও না। এতক্ষণে ৫ লাইন বলা মেয়ে ১ লাইনও বলে নি। কেন?

এদিকে জিনিয়া ভেবে যাচ্ছে, ওয়াফিফ নিশ্চয়ই হাসপাতালের ওই নার্সের প্রেমে পড়েছে। কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছিল লোকটা। কই? তার সাথে কথা বলার সময় তো বুড়ো এতো হাসে না। হাসি যেন তখন উপচে পড়ছিল। কি দরকার ছিল এতো হেসে কথা বলার। একটা ছেলের সাথে হাসুক, কাশুক, যা ইচ্ছা করুক, কিন্তু একটা মেয়ের সাথে অতো হেসে কথা বলার কি দরকার? সামনে বউ, তাও সদ্য বিবাহিত নতুন বউ বসে আছে, আর উনি নার্সের সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন? রোগীর ব্যাপারে কথা বললে মুখে হাসি না থেকে মুখ গম্ভীর করে রাখত।

এসব চিন্তায় যখন এক দিক বিবেচনায় হচ্ছে, তেমনি অন্য দিকে জিনিয়া এটাও ভাবছে – ওয়াফিফের সাথে তো তার চেনা জানা শুধু কয়েকদিনের। কিন্তু এই কয়দিনেই কি সে এই অধিকার অরজন করেছে যে সে ওয়াফিফের উপর রাগ বা অভিমান করবে। এটা কি বেশি বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে না। নিজের চিন্তায় সে নিজেই উলঝে আছে। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক , সেটা নিজে বুঝতে পারছে না জিনিয়া। নিজে একটা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে, তো তার বিপরীত যুক্তিও সে নিজেই দাঁড় করাচ্ছে। নিজেই গুলিয়ে ফেলছে তার কি করা উচিত।


পরের দিন সে স্বাভাবিক ব্যবহারই করল ওয়াফিফের সাথে। তবে সেই আচরণে ছিল এক জড়তা, যেটা বুঝতে ওয়াফিফের দেরি হল না। সে শুধু সুযোগ খুঁজছে যে কি করে জিনিয়ার সাথে কথা বলবে, কিন্তু পাচ্ছে না। জিনিয়া সকাল থেকেই ওয়াফিফের কথা অনুযায়ী আফিয়া রহমানের সাথে থাকে। এছাড়া ভাবি সুফিয়াও আছেন। সুফিয়া আর জিনিয়ার মধ্যে ভালো বন্ধন তৈরি হয়েছে। যদিও জিনিয়া তেমন একটা কথা বলে না। অন্যদিকে সুফিয়া কথা বলায় ওস্তাদ। ভালোই মিলেছে দুজনের। সুফিয়া আর জিনিয়া একসাথে থাকলে সবসম্য সুফিয়াই কথা বলে। আর জিনিয়া মাঝে মধ্যে হা হু করে। মাথা নাড়ে। সুফিয়ার ক্ষেত্রেও ভালোই হয়েছে, সুফিয়ার কোন কথায় যদি ভুল ধরত তাহলে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হত এটা নিশ্চিত। কিনতি জিনিয়া চুপচাপ থাকা মেয়ে। সবার কথায় হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলানো ওর স্বভাব। তাই ওর সাথে কেউ চেয়েও ঝগড়া করতে পারবে না। এ দিক থেকে সাংসারিক শান্তি বজায় থাকছে। এই নিয়েও বেশ খুশি আফিয়া রহমান। সুফিয়া বেশি কথা বললেও সে খুব মেনে চলে আফিয়া বেগমের তাই কোন চিন্তাই নেই তার। সুফিয়া ওয়াফিফের মেজ ভাই আফরান রহমানের স্ত্রী। তার থেকে ছোট বোন মিলা, ভাই আরিফ আর সবচেয়ে ছোট মেয়ে মিনা। আফরান একটা কোম্পানিতে ভালো পদে চাকরি করে। মিলা ভার্সিটির চতুর্থ বর্ষে। আরিফ ভার্সিটির ১ম বর্ষে আর আর মিনা দ্বাদশ শ্রেণীতে। এখানে আফরান আর সুফিয়া ছাড়া সবাই জিনিয়ার থেকে ছোট। কিন্তু জিনিয়ার তাও অবাক লাগে, ওয়াফিফের ছোট ভাই হয়েও আফরান এর বিয়ে আগে হয়েছে।

সকাল থেকে ওয়াফিফের বাড়িতে আরেক তোড়জোড় চলছে। জিনিয়া আর ওয়াফিফ দুজনে জিনিয়ার বাড়িতে যাবে। সাধারণত বিয়ের পর ৩ দিন ওয়াফিফের বাড়িতে থাকার পর ই জিনিয়া বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। কিতু ওয়াফিফ হাসপাতালের কাজে আটকে গিয়েছিল। আগের ছুতিও বাতিল করেছিল সে। এটার কারণ জিনিয়া নিজেই , কথা বলতে বলতেই জিনিয়া একদিন বলে উঠেছিল,

–আপনাকে কি আপনার চাকরি থেকে বহিস্কার করে দিয়েছে?

–না, কিন্তু এটা কেন মনে হল?

–আপনি এত দিন ধরে বাসায় আছেন কিন্তু আপনি একজন ডাক্তার।

–আমার কাজের কথা ভাবতে হবে না তোমার। ওটা তো মা ২ সপ্তাহের ছুটি নিতে বলেছিল তাই…

–২ সপ্তাহ?

–হুম।

–ওহ।

–সমস্যা নেই, আমি আবার কাল থেকে হাসপাতালে যাবো।

–কিন্তু এখনো তো ২ সপ্তাহ হয় নি। ১৪ দিন হতে তো এখনো দেরি আছে।

–কিন্তু আমি চিন্তায় আছি। আ তুমি জিজ্ঞেস করলে, এরপর অন্যরা জিজ্ঞেস করলে মান সম্মানের ১২ তা বাজবে, অনেক কথা শুনতে হবে। মনে করিয়ে দিয়ে ভালোই করেছ।

এর পর থেকে হাসপাতালে যাওয়া শুরু করে ঠিকই, কিন্তু মাঝে এক রোড এক্সিডেন্টে এক সাথে অনেক রোগী ভর্তি হয়, তাদের দেখতে গিয়েই অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়ে ওয়াফিফ। এর মাঝে জিনিয়ার বাড়িতে যাওয়ার কথা এক প্রকার মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। আর জিনিয়া নিজেও মুখ ফুটে কোন কথা বলার মেয়ে না। এদিকে আফিয়া রহমান ও কয়েকবার বলার কথা ভেবেও ভুলে গিয়েছিলেন। সেদিন জিনিয়ার বাবা ফোন দিয়ে যখন জিজ্ঞেস করল তখনই ওদের খেয়াল হল আর ওরা সব দিক দেখে যাওয়ার পরিকল্পনাও করে ফেলল।

জিনিয়া যাওয়ার আগে শেষবারের মতো নিজের ব্যাগ চেক করতে উপরে এসেছিল। কিন্তু তখন জিনিয়া রুমে ঢোকার কিছু সময় পর ওয়াফিফ ও ঢুকে পড়ে আর বলে ওঠে,

–তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও জিনিয়া?

জিনিয়া ওয়াফিফের এমন হঠাৎ ডাকে চমকে ওঠে আর সোজা হয়ে দিয়ে পিছনে ঘোরে। কারণ ওর মাথায় এখনো আছে কে ওয়াফিফের ঘরের সামনে তালগাছ আছে আর সেখানে পিঠা কাকুর ভুত থাকে। আই দিনের বেলা হওয়া সত্ত্বেও ভয় পেয়ে যায়। ও হয়তো এই কথা ভুলেও যেত, কিন্তু মিলা আর মিনা সেদিন যখন মেনে নিল যে সত্যিই পিঠা কাকু আছে, তাহলে ভুত ও আছে। তাই এখনো সে সেই কথা মাথায় রেখেছে। আর ওয়াফিফের কণ্ঠও গম্ভীর ছিল, যার কারণে ওয়াফিফ কে সে আবার সেই ভত ভেবে বসে। ওয়াফিফ সাধারণত জিনিয়ার সাথে কথা বলার সময় অতটা সিরিয়াস ভাবে কথা কখনো বলে নি। দিনে দুপুরে ভুত আসার সম্ভাবনা না থাকলে যেকোনো কিছু হতে পারে। জিনিয়া ওয়াফিফ কে দেখে বলে উঠে,

-ওহ, আপনি।

–হ্যাঁ আমি। আর আমি বলছি, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?

এর উত্তরে জিনিয়া ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে না জানাল। তারপর আবার নিজের লাগেজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওয়াফিফ জিনিয়ার এই কথা বিশ্বাস করল না। সে জিনিয়াকে আরও কয়েকবার জিজ্ঞেস করল। প্রথম দিকে জিনিয়া পাত্তা না দিলেও এখন বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। এক কথা কেন বারবার জিজ্ঞেস করছে ওয়াফিফ ? সে রেগেই বলে উঠল,

–আমাকে কেন এতো জিজ্ঞেস করছেন? যান না , হাসপাতালের ওই নার্সকে জিজ্ঞেস করুন। উনি বলে দিবেন সব।

জিনিয়ার পুরো কথা বলার পর খেয়াল হল যে সে কি বলেছে। সে আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওয়াফিফ প্রথম দিকে কথাটা শুনে বুঝতে না পারলেও পরে ঠিকই বুঝতে পারল যে কি হয়েছে। সে জিনিয়াকে আবার ডাকল। আগের বার রাগ হলেও এবার জিনিয়া লজ্জায় মুখ তুলল না, পিছনেও ঘুরল না। ওয়াফিফ জিনিয়ার ২ বাহু ধরে ওকে সামনে ঘোরাল আর ওকে বিছানায় বসাল। তারপর ওর দিকে ঝুকে বলে উঠল,

–তুমি কি জেলাস?

জিনিয়া সাথে সাথে মাথা ডানে বামে জোরে জোরে কয়েকবার নাড়াল। এটা দেখে ওয়াফিফ আবার হেসে ফেলল। ওয়াফিফের হাসির আওয়াজ শুনে জিনিয়া মাথা তুলতেই ওয়াফিফের হাসি মুখ দেখতে পেল। যেটা দেখে সে নিজেই সেখানে আটকে গেল। ওয়াফিফের হাসি মুখ তার কাছে বেশ ভালো লাগল। ওয়াফিফ ও জিনিয়ার এমন মুখ দেখে নিজের হাসি থামিয়ে বলল,

–কাল ওই নার্স তোমার সম্পর্কে কথা বলছিল আর অভিনন্দন জানাচ্ছিল, এর বেশি কিছু না। আমিও ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এসেছিলাম। আর এই জন্য কাল থেকে তুমি আমার সাথে কথা বলছ না?

এই কথা শুনে জিনিয়া আবার মাথা নিচে নামিয়ে ফেলল। অয়াফিফ জিনিয়ার অবস্থা বুঝতে পেরে ওকে স্বাভাবিক করতে বলে উঠল,

–ঠিক আছে, আমি এরপর থেকে কোন মেয়ের সাথে কথা বলব না, বললে তোমার সামনে বলব। ঠিক আছে?

জিনিয়া এখন বেশ লজ্জা জনক পরিস্থিতিতে পড়েছে। সে নিজের শাড়ির আঁচল একবার ঠিক করছে তো একবার নিজের কানের পিছনে চুল গুঁজে দিচ্ছে, যদিও মখের সামনে চুল ছিল না। তার কান লাল হয়ে যাচ্ছে। সে জবাব দেওয়ার মতো কোন কথা পেল না। ওয়াফিফ আবার বলে উঠল,

–এর পর থেকে মনে আমাকে নিয়ে কোন কথা বা সন্দেহ থাকলে আমাকে বলে ক্লিয়ার হয়ে নিবে। এভাবে মনে মনে কথার জাল বুনবে না। আর চিন্তা করবে না বেশি। ঠিক আছে? আরে কথা বলছ না কেন? জবাব দাও।

জিনিয়া কোনোমতে মাথা একবার নেড়ে বলল,

–হুম।

–এবার নিচে চল। তোমার লাগেজ আমি নিয়ে যাচ্ছি আর গাড়িতে অপেক্ষা করছি, মায়ের সাথে আর কারো সাথে কথা বলার থাকলে বলে আসো। বেশি দেরি কর না। রোদ বাড়ছে। রাস্তায় জ্যামে আটকে গেলে তোমার মাইগ্রেনের ব্যথাও বেড়ে যাবে। জলদি কর।

বলেই ওয়াফিফ বিছানা থেকে লাগেজ তুলে সেটা নিয়ে চলে যেতে লাগল। দরজা পর্যন্ত পৌঁছে সে আবার বলে উঠল,

–তবে জিনিয়া, মাঝে মাঝে ঝগড়া করা সম্পর্কে বাঞ্ছনীয়, তোমাকে বেশ মানায় এতে। সম্পর্কও মজবুত হয়। তবে বেশিক্ষণ রাগ বা অভিমান নিয়ে থেকো না। আর আমি তো আছিই রাগ ভাঙাতে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here