নিরব সে,২য় পর্ব,০৩

নিরব সে,২য় পর্ব,০৩
সাদিয়া_সৃষ্টি
২য় পর্ব

যেমনটা ভেবেছিল জিনিয়া, তেমনটাই হল। বাড়িতে গিয়ে হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হল তাকে। তার বাবা মা ধরার আগে সামনে পড়ল পাশের বাড়ির অ্যান্টি। উনার কথা শুনেই জিনিয়ার মাথায় কিছু ঢুকল না।

–ও তাহলে ফিরেছ? বিয়ের আগের দিন বাসা থেকে কে বের হয়? এমনটা না করলেও পারতে। ২ পর বের হইলে কি দুনিয়া অশুদ্ধ হয়ে যেত? আমি তো ভেবেছিলাম পালিয়ে যাবে। শেষমেশ ফিরলে। শুন, তুমি কিন্তু এমন কথা মাথায় আইনো না। বাবা মার মান সম্মান …

আরও অনেক কথা বলছিলেন তিনি। কিন্তু সেসব কিছুই তার মাথায় ঢুকল না। সে কিছু শোনার অবস্থায় ও ছিল না। তার মাথা ব্যথায় ফেটে পড়ছিল যেন। সেটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে চলেছিল। তাই কিছু শোনার অবস্থায় নেই। ব্যাগ থেকে হাতড়ে ওষুধের প্যাকেট টা বের করে সেটা অ্যান্টিকে দেখিয়ে বলে উঠল,

–অ্যান্টি, মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়ছিল, তাই ওষুধ কিনতে গিয়েছিলাম। বাড়ির সবাই এতো ব্যস্ত তাই নিজেই গিয়ে কিনে আনলাম। এখন খাবো। দুপুর বেলা। ওষুধের দোকান খোলা পাচ্ছিলাম না। আঙ্কেলের ছোট ছেলে বসে ছিল দোকানে। দোকানদার আঙ্কেল আসতে দেরি হয়ে গেল তাই আমারও আসতে দেরি হল। আমি গিয়ে খেয়ে একটু ঘুমাই?

বলে আর উত্তরের অপেক্ষা করল না সে। দ্রুত পদে সেখান থেকে বের হয়ে গেল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকল। নিজের ঘরে গিয়ে ওষুধটা খেয়ে নিয়ে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ল। সে জানে তার দিকে বাকিরাও সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারা মনে মনে গল্প বানাতে বেশ পারে। এতক্ষণে একজন তার পালিয়ে যাওয়ার কথা ভেবে রেখেছে তো অন্য অ্যান্টি আর ও অনেক কিছুই ভেবেছেন হয়তো। কেউ তো এটাও ভাবছেন যে জিনিয়া যদি পালিয়ে যায় তাহলে আগে তার রুম সার্চ করে কোন চিঠি পায় কি না সেটাই দেখবেন। তারপর আর কি কি কথা শোনাবেন সেটা তৈরি করার দরকার নেই। সেগুলো তাদের মুখের গোঁড়ায় লেগে আছে। শুধু একবার খুললেই হাজার কথা বের হবে। এর শেষ নেই। বিশেষ করে নাটক দেখে দেখে এদের এসবের অভ্যাস ভালোই আছে। সেখানে জিনিয়া যদি তাদের কাছে নিজের সাফাই দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করত তাহলে হিতের বিপরীত হত। একদিকে যেমন তাকে নিরলজ্জ উপাধি দেওয়া হত বড়দের সাথে মুখে মুখে কথা বলার জন্য, তেমনি সে এখানে থেকে নিজের সাফাই গাচ্ছে এই কথা ভেবে বলত তার মানে নিশ্চয়ই এমন কাজ সত্যিই করতে যাচ্ছিল সে। আবার সেখানে না থেকে তাদের কথার উত্তর না দিয়ে চলে আসলেও বলবে যে জিনিয়া কিছু লুকাচ্ছে। তাই বাইরে যেহেতু গিয়েছে – এসব তাকে শুনতেই হবে। তাই সে নিজের মাথা ব্যথাকে প্রাধান্য দিয়ে ঘরে চলে আসলো।

ভাগ্য ভালো সূর্যের উত্তাপের তেজ দেখে আগেই ওষুধ কিএ নিয়েছিল সে। নাহলে আরও বেশি সমস্যা হত। অবশ্য সে প্রেগন্যান্ট এই কথা জানার পর তো আরও বেশি সমস্যা হবে। এর থেকে এই ছোট অপমান গুলো আপাতত সহ্য করে নিক – এই কথাই ভাবল জিনিয়া।

আর আগে থেকে ওয়াফিফকে সব জানিয়ে দেওয়ায় এখন তার নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। সে জানে না কেন তখন তার এমন মনে হল। সে নিজের বাবা মা কেও জানায় নি। প্রথমেই মনে হল সে যেন ওয়াফিফকে জানায়। অচেনা একজনের কথাই কেন তার মাথায় সর্বপ্রথম এসেছিল সেটা জিনিয়া জানে না। তবে আজ কথা বলার পর তার বেশ হালকা লাগছে। সে জানে বাবা মাকে বললে তারা এই কথা গোপন রাখতেই বলতেন। সাধারণত এসব কথা প্রকাশ করতে বলবেন এমন বাবা মা হাজারে একটাই পাওয়া যায়। খুব কম। তাই সেই হাজারে একটা যে তারই বাবা মা হবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। আর এখন তার মনে হচ্ছে তার সামনে না জানি আর কি কি সহ্য করতে হবে। কিন্তু এই জন্য একটা নিস্পাপ প্রাণকে মেরে ফেলা যায় না। আর ওয়াফিফ যে ওদের দায়িত্ব নিবে এটা শুনে তার চোখ চকচক করে উঠেছিল। তার এতো ভালো লাগছিল যে সেটা প্রকাশ করা যাবে না। তার বাব মা হয়তো তার জন্য এক হীরা খুঁজে এনে দিয়েছেন। এই জন্য এখন তার মনে হচ্ছে, বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে সে যদি আগের বার সম্পর্কে না জড়াত তাহলে এখন হয়তো অন্য রকম হত তার জীবন। হয়তো জীবনে ‘জাবির’ নামের কেউ থাকত না তার। আর না সে তার অস্তিত্ব একাই বহন করত। মানুষটা তাকে কোন কারণ ছাড়াই মাঝ পথে ছেড়ে দিয়েছে। বার বার তাকে উপেক্ষা করে গিয়েছে। সে কি ই বা করত এখন ওয়াফিফকে বিয়ে করতে রাজি না হয়ে।

তার সত্যিই কি কিছু করার ছিল? সে বাবা মায়ের কাছে বলতই বা কি? যাকে সে তার বাবা মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে ভালবেসেছে, সে তার সাথে কোন কারণ ছাড়াই দূরত্ব তৈরি করেছে। যদি ওর বাবা মায়ের সামনে নিয়ে যেতে বলা হত জাবিরকে তাহলে সে কাকে নিয়ে যেত? তাই সে মেনে নিয়েছে তার মায়ের কথা। এই একটা কথা মানার পর তার বাবার চোখের যে খুশির ঝলক সে দেখেছিল সেটা সে অনেকদিন পর দেখেছিল। তাই না বলার সাহস হয় নি। অনেক বার ভালোবাসার দাবি নিয়ে গিয়েছে জিনিয়া জাবিরের কাছে। কিন্তু আর সম্ভব না।

জিনিয়া সেদিন সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর বিকালে তার গায়ে হলুদের জন্য ডাকতে আসেন তার মা। মা তখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন।। এতে তার ঘুম ভাঙার বদলে আরও বেশি ঘুম পাচ্ছিল। এই ভেবে মনে মনে হাসল সে। অনেকদিন পর তার মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন,

–জিনি এই জিনি মা ওঠ, এখন তো তোর গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান ওঠ।

ওষুধ খাওয়ার পর এখন তার আর ব্যথা হচ্ছিল না। বেশ কমে এসেছিল। তাই সে উঠে পড়ল। স্বাভাবিক ভাবেই তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয়ে গেল সেদিন। যদিও মহিলাদের মধ্যে কানাঘুষো হচ্ছিল আর তাতে তাল মিলিয়েছিল তার পরিবারের লোকেরাও। তাদের আফসোসের সুরে বলা কথাগুলো শুনে জিনিয়ার হাসি পাচ্ছিল। কারণ সে জানে, এখানে যারা কথা বলছেন, কেউ মন থেকে বলছেন না, সবাই অভিনয় করছেন। একটা বিয়েকে মসলাদার বানাতে। নাহলে বিয়ের মজাই যেন থাকে না। তাদের কথা যেন একটা বিয়ের প্রাণ। ৩ তলা বাড়ির ছাদের কোণে কোণে এসব চলছিল। কেউ কেউ সেই আলোচনা সভা থেকে বিরতি নিয়ে অন্যদিকে যাচ্ছিল, তো আবার কেউ কেউ সেই সভায় যোগ দিচ্ছিল। এটা বিয়ে বাড়ির আলাদা এক ঘটনা। কিছু না করলেই কনের সম্পর্কে ১০০ আলোচনা হয়। কেউ করে দৈহিক গথন নিয়ে তো কেউ স্বভাব নিয়ে করে। জিনিয়া তখনও কাউকে নিজের প্রেগন্যান্ট হওয়ার কথা বলে নি। ওয়াফিফ মানা করায় প্রথম দিকে সে চুপ ছিল। এখন বুঝতে পারছে ওয়াফিফের মানা করার আসল কারণ।

________________________

বাসর ঘরে বসে আছে জিনিয়া। তার কোন কাজ নেই তাই বসে আছে। শুতেও পারছে না সে। ওয়াফিফের কাজিনরা এমন কি ওয়াফিফের ২ বোন পর্যন্ত বলে গিয়েছে ওয়াফিফ না আসা পর্যন্ত যেন না শোয়। তাই সে বসে আছে। খুব সাধারণ ভাবেই তাদের বিয়ে হয়েছে। ওয়াফিফের সাথে বিয়ে হওয়ায় ওয়াফিফের মা বেশ খুশি। তিনিই জিনিয়াকে পছন্দ করেছিলেন। আর তিনি তাই বেশ খুশি। তার ছেলেও তার কথা মেনে নিয়েছে। কিন্তু ওয়াফিফের মনে কি চলছে স্তা সম্পর্কে কোনোদিন জানতে চায় নি । ওয়াফিফ ও বলে নি কখনো। খুব চুপচাপ স্বভাবের সে।

জিনিয়া এসব কিছুই জানে না। সে শুধু জানে তার ওয়াফিফ নামের একজন ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে আর সে একজন ডাক্তার। অবশ্য সে যে ডাক্তার এটাও সে জানতো না। বিয়ের সময় তাকে যখন সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছিল তখন বরের সম্পর্কে বোনেরা কথা বলছিল। সেসব থেকেই জানতে পেরেছে। জিনিয়ার বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। তাই সে সোজা ঘরের জানালার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। অর্ধচন্দ্রের সাথে মেঘমালার দৃশ্য – বেশ লাগছে জিনিয়ার। সাথে বাতাসের খেলা। ভারী শাড়ি পরে থাকায় যে ক্লান্তির সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা নিমিষেই উড়িয়ে নিয়ে গেল নিজের সাথে। চাঁদের আলো পড়ছিল তার মুখে। আর সে সেটা চোখ বন্ধ করে অনুভব করছিল । তার কানে ভেসে আসছিল বাতাসের এক আলাদা শব্দ। এর মধ্যে যে আরেকটি প্রাণ সেই ঘরে প্রবেশ করেছে, সেদিকে খেয়াল নেই তার।

ওয়াফিফ প্রথমবারের মতো ঠিক করে তাকিয়েছিল জিনিয়ার দিকে। অবশ্য তাকানোর ইচ্ছা ছিল না তার তবে একবার সেদিকে চোখ যাওয়ার পর নজর সরাতে ভুলে গেল সে। তাই সেদিকেই তাকিয়ে থাকল। জিনিয়াকে চাঁদের আলোয় ঠিক মতো না দেখা গেলেও ওয়াফিফ যেন তাকে স্ক্যান করতে পারছে। সে কি মনে করে তার কাছে গেল। জিনিয়ার কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে হালকা শিশের মতো আওয়াজ করল। তারপর একটু ভৌতিক আওয়াজ বের করল মুখ থেকে। জিনিয়া হঠাৎ এমন আওয়াজ পেয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকল। তার নজরে পড়ল সামনে থাকা তালগাছটা। বাড়ি থেকে একটু দূরে কিন্তু মনে হচ্ছে সেখানেই আছে কোন এক ভুত। জিনিয়া লাফিয়ে উঠতে গেলে ওয়াফিফ তার কোমর দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। এবার জিনিয়ার যায় যায় অবস্থা। সে যে নিজের হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে থাকা ভুতকে সরাবে সেটা করত্ব পারল না। তার মনে হল এবার তার ঘাড় মটকানো হবে। সে মাথা নারাতে সাহস পেল না। ওয়াফিফ আরেক্তু মজা করে ওর কানের কাছে ফু দিয়ে আবার সেই আওয়াজ বের করল। এবার আরেকটা হাত তুলে জিনিয়ার গলার কাছে এক আঙুল দিয়ে স্লাইড করল। এবার জিনিয়া বয় পেয়ে গেল। আর বলে উঠল,

–ভুত সাপ হয়ে গিয়েছে, এবার ছোবল মারবে ওর ভুত মামা, আবার নিজের বাড়ি, মানে সামনের তালগাছটায় চলে যাও না।

ওয়াফিফ একটু মোটা স্বরে বলল,

–যাবো না।

জিনিয়া তখন বলল,

–তাহলে আমি মন্ত্র পড়বো।

এবার সে ওয়াফিফের অপেক্ষা না করে বলতে থাকল,

–ভুত আমার পুত / পেত্নি আমার ঝি

আল্লাহ আমার সাথে আছে/ ভয়টা আমার কি?

চলবে।

”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
৩য় পর্ব

ওয়াফিফ তারপর কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ওর হাত তখনও জিনিয়ার কোমরে ছিল। জিনিয়া ভয়ে ভয়ে তখনও একই কথা বারবার বলে যাচ্ছিল। কিন্তু সে খেয়াল করল সে এখন আর হাওয়ায় ভাসছে না। তার মানে ভুতটা তাকে নিচে নামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ ভাবার পর দেখল, এখানে যদি সত্যিই ভুত থেকে থাকে, তাহলে তার সাথে রোজ এই ঘটনা ঘটবে? তার হয়তো বিয়ের মায়ের কাছ থেকে রান্নার পাশাপাশি ভুত তাড়ানোর উপায় শিখে আসা উচিত ছিল। কিন্তু কে জানবে যে শহরেও ভুত থাকে? নিজের ভাবনায় হারিয়ে যাওয়া জিনিয়া নিজের কোমরে থাকা হাতের উপর হাত রাখল। এটা এখন তার কাছে ভুতের হাতের চেয়ে মানুষের হাত বলে বেশি মনে হচ্ছে। এটা যদি মানুষেরই হাত হয়ে থাকে তাহলে এতক্ষণ একটা মানুষকে ভুত ভাবছিল?

এসব ভাবনা মাথায় আসতেই সে নিজের প্রতি রেগে গেল। কার না কার সামনে সে এতক্ষণ পাগলামি করল। পিছনে ফিরতেই ওয়াফিফকে চাঁদের আলোয় দেখতে পেল। এর পাশাপাশি সামনের রাস্তার সোডিয়ামের লাইট টা ও আছে। যেটা খুবই কম আলো দিচ্ছে। আশেপাশে বিল্ডিং আছে, তবে সেখানে থেকে বেশ কিছু দুরেই। সেখান থেকেও আলোর ছটা এসে ছিটকে পড়ছে ওয়াফিফের ঘরে। সে ওয়াফিফকে দেখে চমকে সেখান থেকে ছিটকে সরে গেল। ওয়াফিফ এবার সামনে থেকে জিনিয়ার অবাক হওয়া চেহারা সাথে ভীতু চেহারা দেখে বেশ আনন্দ পেল। যেন তার এতক্ষনের করা কষ্টের ফল পেয়েছে সে। জিনিয়া কিছ বলতে যাবে তার আগেই ওয়াফিফ বলে উঠল,

–লাইক সিরিয়াসলি জিনিয়া, ভুত তোমার পুত? আই মিন, ভুত তোমার ছেলে? তাহলে নিজের ছেলেকে দেখে এতো ভয় পাচ্ছিলে কেন? বাই দ্য ওয়ে, সামনের গাছটা দেখছ না, সেখানে সত্যিই তোমার ওই ছেলে থাকতে পারে, আমি শুনেছিলাম, অনেকে নাকি দেখেছে। তুমি জানতে চাও ওখানে কে থাকে?

ওয়াফিফ মজা করে বলল। সে ভেবেছিল জিনিয়া তার মজা করা ধরে ফেলবে। কিন্তু হল তার উল্টো। জিনিয়ার মুখ থেকে অবাক হওয়ার ছাপ মুছে গিয়ে আবার ভয় আর জানার কৌতূহল দেখা দিল। জিনিয়া মাথা উপর নিচ নেড়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠল,

–হুম, কে থাকে?

ওয়াফিফ জিনিয়ার এই অবস্থা দেখে মনে মনে আবার হাসল। সে তাই তার অভিনয় চালিয়ে গেল। সে জিনিয়র এক হাত ধরে টানতে টানতে ওকে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে সেখানে বসিয়ে দিল। আর বলল,

–অনেক সময় আগের কথা।

এইটুকু বলতে না বলতেই বাইরে একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে চলে গেল। এতে জিনিয়া আবার ঘাবড়ে গেল। সে এতোটা ভয় পেত না যদি আলো জ্বলত। কিন্তু ঘরে তখন ড্রিম লাইট জ্বলছিল। তাই গা ছমছমে এক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। ওয়াফিফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যেন সে খুব সিরিয়াস একটা কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে আবার বলে উঠল,

–সেই সময় একটা লোক ছিল। এই সামনের তালগাছ টা র নিচে তার পিঠার দোকান ছিল। সেই লোকটা পিঠা বিক্রি করত, নানা ধরণের পিঠা, কিন্তু সে শুধু রাতের বেলা দোকান খুলে বসত, মাঝে মাঝে গান গাইত আর সারা রাত কার সাথে কথা বলত। একদিন এক ঝড়ে তার পিঠার দোকান উড়ে যায়। এখানকার লোকদের থেকে জানা যায় সেই ঝড়ে ওই দোকানের সাথে ওই অশরীরীও উড়ে গিয়েছিল। লোকটা যখন ফিরে আসলো, তখন কয়েকদিন কাউকে ডাকত খালি, গান গাইত,

”আয় ফিরে আয়

আয় ফিরে আয়”

–এইটা কোন গান?

–আমি কি জানব? লোকটা গাইত। তুমি চাইলে উনাকে জিজ্ঞেস করতে পারো।

–কি ভাবে?

–তারপর একদিন সেই লোকটা আরেকজনের বাড়ি থেকে পিঠা চুরি করে। কিন্তু সেই পিঠা নাকি একটা সাপ তুলে নিয়ে যায় আর তার বাড়ি রেখে আসে। লোকটা সাপের পিছনে ছুটতে ছুটে তার বাড়ি যায়। আর সাপটার সাথে অনেক কথা বলে। মিনতি করে যাতে পিঠা ফিরিয়ে দেয়। তারপর সেই সাপটা পিঠা ফিরিয়েও দেয়।

–ফিরিয়েও দেয়? কথাও বলে?

–আরে চুপ করে তারপরের ঘটনা শুনো তো।

–বলুন।

–তারপর সেই লোকটা সাপের সাথে মারামারি করে?

–কিইই?

–হ্যাঁ তো, তারপর সাপটা হেরে গেলে তার পুরষ্কার হিসেবে সাপের বিষ প্যাকেটে করে নিয়ে সেই তালগাছটার নিচে যায়। আর সেই বিষ পিঠায় মিশিয়ে সেটা খেয়ে আত্মহত্যা করে।

–মরার ইচ্ছা থাকলে সাপের ছোবলেই মরত, এতো কষ্ট করল কেন?

–এখন সেই পিঠা কাকু এই গাছে থাকে আর মাঝে মাঝে এখানে কারো না কারো সাথে গল্প করতে আসে। সে কেন কিভাবে মরেছিল, আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে তার সাথে তুমি যোগাযোগ করতে পারো।

–আপনাদের বাড়ি যে ভুতের বাড়ি সেটা আগে বলবেন না? এরপরের বার আর এই ভুল করব না।

–কি ভুল?

–বিয়ের আগে পাত্রের কাছে জিজ্ঞেস করে নেব সেখানে ভুত থাকে কি না?

–বাই এনি চান্স, তুমি আমার বিয়ে করবে? ডোন্ট ডু, তুমি চলে গেলে আমার মা আবার কার না আক্র সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য আমার মাথা খাওয়া শুরু করবে।

–তারমানে আপনি আমাকে ছেড়ে দিবেন?

–না মানে, তুমিই তো বললে…

–যান, আপনার সাথে কথা বলব না।

–ওকে।

বলেই ওয়াফিফ নিজের ঘরের লাইট জ্বালিয়ে প্রথমে নিজের আলমারি থেকে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার বের করল। তারপর ওয়াশরুমে চলে গেল। এতে করে জিনিয়া বোকা বনে গেল।

–আপনি যাও মানে ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা ভাবলেন?

কিছুক্ষণ পর ওয়াফিফ বের হয়ে জিনিয়াকে বলল,

–তুমিও ড্রেস চেঞ্জ করে আসো। ওয়াশরুম এটা আর তোমার জামাকাপড় আলমারিতেই আছে।

জিনিয়াও অনেক ক্লান্ত ছিল তাই দেরি না করে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল আর ভুতের চিন্তা তখনকার মতো ভুলে গেল।

বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখল ওয়াফিফ বিছানার এক কোণে শুয়ে আছে। সে একটু কেশে বলে উঠল,

–আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?

ওয়াফিফ তখন সোজা হয়ে শুয়ে ছিল। এক হাত কপালের উপর দিয়ে। চোখ ঢেকে। সে সেভাবেই বলে উঠল,

–না।

–আমিও কি এখানেই শুব?

–হ্যাঁ। আজ অনেক ক্লান্ত তুমি তাই বেশি কথা না বলে রেস্ট নেও। এখন তুমি একা না। তোমার মধ্যে আরেকটা প্রাণ ও আছে। তার খেয়াল তোমাকে রাখতে হবে। ভুলে যেও না। আর তোমার সাথে আমার কিছু গুরুত্ব পূর্ণ কথা ছিল। কাল একবার মনে করিয়ে দিও। আজ আর বলছি না।

বলেই ওয়াফিফ অপরপাশে কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। জিনিয়াও কোন কথা বলল না। সেও ঘুমিয়ে পড়ল।


সকালের সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল ওয়াফিফের। সে আশেপাশে আড়ামোড়া মারতে গিয়ে খেয়াল করল আজ তার পাশে আরেকজন আছে। একটু খেয়াল করতেই ঘুমন্ত জিনিয়াকে দেখল সে। সকালে দ্রুত ঘুম থেকে ওঠা ওয়াফিফের অভ্যাস তবে, ঘুম থেকে উঠে জিনিয়াকে দেখা তার কাছে নতুন। সে বেশি নড়াচড়া না করে উঠে পড়ল। উঠতে গিয়ে খেয়াল করল জিনিয়া তার হাতের একটা আঙুল ধরে আছে শুধু। একেবারে বাচ্চারা যেমন বড়দের শুধু একটা আঙুল ধরে রাখে তেমনভাবে। ওয়াফিফ হাসল। কয়েকমাস পর যে কি না বাচ্চার মা হবে সে নিজেই এখনো বাচ্চা। ভাবতেই মনে মনে আবার হাসল। সে নিজের হাত থেকে জিনিয়ার হাত ছাড়াল। তারপর দেরি না করে জিনিয়াকে ডাকতে শুরু করল ওর কাঁধে হাত দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে।

–জিনিয়া, এই জিনিয়া ওঠো।

জিনিয়াও উঠে পড়ল। তার ঘুম খুব হালকা। একটু ডাকাতেই উঠে পড়ল সে। ওয়াফিফকে দেখে প্রথমে চমকালেও পরে নিজের দিকে তাকিয়ে আর আশেপাশে তাকিয়ে সব মনে করল, আর নিজের শাড়ি ঠিক করতে করতে ঘুমন্ত কণ্ঠেই বলে উঠল,

–এতো সকালে ডাকলেন কেন? কিছু হয়েছে?

–হ্যাঁ অনেক কিছু হয়েছে। আগে তুমি গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসো। আর শাড়িটাও বদলে নেও। পারলে একেবারে গোসল করে এসো।

–ঠিক আছে।

বলে জিনিয়া বাথরুমে ঢুকে পড়ল অন্য আরেকটা শাড়ি নিয়ে। একেবারে গোসল সেরে বের হতেই ওয়াফিফকে জিজ্ঞেস করল,

–কি হয়েছে?

–চা বানাতে পারো?

–হুম।

–তাহলে এখনই ১ ২ ৩ … ৫ হ্যাঁ, ৫ কাপ চা বানিয়ে বাবা মা ২ ভাই, ভাবিকে দিয়ে আসো। বাকি আত্মীয় স্বজনদের কথাআ তো এখন ভাবা লাগবে না। আর হ্যাঁ, পারলে আমার জন্য করা করে কফি বানিয়ে এনো, কোন চিনি ছাড়া, বাবা আর মায়ের চায়েও চিনি কম দিও।

বলেই ওয়াফিফ আর দেরি না করে নিজেও হাত মুখ ধুতে চলে গেল জামা কাপড় নিয়ে। জিনিয়াও ওয়াফিফের কথা মেনে চা বানিয়ে সবাইকে দিয়ে এলো। ওয়াফিফ ফ্রেস হয়ে বের হয়ে এসে দেখল জিনিয়া তখন কফি কাপ হাতে ঘরে ঢুকছে। সে জিনিয়ার হাত থেকে কাপ নিয়ে বলল,

–ধন্যবাদ।

–আপনি আমাকে এটা করতে কেন বললেন?

–চায়ের কাপ দেওয়ার সময় মায়ের মুখের হাসি দেখেছিলে?

–হ্যাঁ।

–এটার জন্যই। এখন তুমি যদি না চাও যে বাঙ্গা সিরিয়ালের মতো তোমার আর তোমার শাশুড়ির মধ্যে ঝগড়া হোক, তাহলে এখন থেকে মায়ের পিছনে কাঁঠালের আথার মতো লেগে থাকবা আর মায়ের সব কথা মেনে কাজ করবা, তবে নিজের দিকে খেয়াল রেখে। কিছু না পারলে সরাসরি বিনয়ের সাথে মাকে জাজানাবে। তাহলে আম খুশিও হবে আর রাগও করবে না। এটাই অন্তত তোমার শাশুড়ি পটানোর নিনজা ট্রিক। ওকে।

–ওকে।

–এই তো, লক্ষ্মী বউ আমার।

বলেই ওয়াফিফ জিনিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বারান্দায় চলে গেল। জিনিয়া ও লজ্জা পেল নিজের অজান্তেই। তবে ওয়াফিফ ওকে শাশুড়ি পটানোর নিনজা ট্রিক্স শিখিয়ে গেল তাহলে?

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here