নাগিন_কন্যা,১ম পর্ব

#নাগিন_কন্যা,১ম পর্ব
লেখা : #Masud_Rana

মানুষের গর্ভে সাপের বাচ্চা জন্ম গ্রহন করতে পারে! এত অবিশ্বাস্য কথা। কিন্তু এই কথাটাই পুরো গ্রামে বলে বেড়াচ্ছে দাই রহিমের মা। তার ভাষ্যমতে গভীর রাতে ওকে ডাকতে আসে রাইমার শাশুড়ি। রাইমা পোয়াতি , ছটফট করছে। দ্রুত বুড়ি দাই রাইমার শাশুড়ির সাথে তাদের বাড়ি যায়। রাইমার কাছে যেতেই বুঝতে পারেন সন্তান প্রস্রোবের সময় হয়ে এসেছে। প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করতে ছুটে যান রাইমার শাশুড়ি। রাইমার পাশে তখন শুধু দাই। ঘরে দুটো হারিকেন আর একটা কুপি জ্বলছে।

রাইমা প্রস্রোবের ব্যথায় গোঁঙাচ্ছে। বুড়ি দাই ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। এমন সময় বুঝে গেলেন চরম মুহূর্ত উপস্থিত। এখন বাচ্চাটার মাথা টেনে বের করতে হবে। প্রথমে একটা মানুষের বাচ্চার মতোই মাথা বেরিয়ে এলো। দাই রহিমের মা , ওটা ধরতে গিয়েই বুঝলেন ওটা মুহূর্তেই বদলে পিচ্ছিল হয়ে গেল। কেমন সরু চ্যাপ্টা মাথা। ওটাকে ধরে টান দিতেই কুণ্ডলী পাকানো একটা সাপ বেরিয়ে এলো রহিমার মায়ের হাতে। নিশ্চুপ হয়ে গেল মুহূর্তেই রাইমার গোঙানি। ভয়ে চিৎকার করে সাপটা ঘরের এক কোণে ফেলে দিয়েই অজ্ঞান হয়ে গেলেন তিনি।

এরপর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলেন একটা বাচ্চা শিশুকে কোলে নিয়ে রাইমার শাশুড়ি মাটিতে বসে কাঁদছে। রহিমের মা ভয়ে ভয়ে উঠে বাচ্চাটার কাছে গেল। কই সাপ , একটা ফুটফুটে দেখতে মেয়ে। এমন সুন্দর নীল চোখ! কেমন ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে। বুড়ির স্পষ্ট মনে আছে রাইমার জরায়ু থেকে একটা সাপ বের করেছে সে। কিন্তু এখন দেখছে বাচ্চা একটা মেয়ে। তাহলে রাইমা যাকে জন্ম দিয়েছে , ওটা কী একটা ইচ্ছাদারি নাগিন !

রাইমার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলেন সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে মেয়েটা। রাইমার শাশুড়ি কেঁদে কেঁদে বিলাপ বকছেন , কাল নাগিনী মাইয়া জন্ম নিছে। পেটে আওয়ার লগে লগে বাপরে খাইছে , এখন জন্মানোর সময় মারে খাইলো। এখন খালি আমারে খাওয়া বাকি আছে। এইটারে নিয়া আমি কী করমু!

বুড়ি দাই উত্তেজিত হয়ে বলল , এই মাইয়ারে এখনই মাইরা ফেল , আমি নিজ চোখে দেখছি এই মাইয়া একটা নাগিন।

যত যাই হোক এই বাচ্ছাটাই এখন রাইমার শাশুড়ির একমাত্র বেঁচে থাকার সম্ভল। দাইয়ের কথা শুনে তিনি ক্ষেপে উঠলেন।

চুপ কর নেমখহারামি। কী কস এইগুলা আমার নাতনিরে?

যা সত্যি তাই কই।

এরমধ্যেই গ্রামের অনেক লোক আশা শুরু করে দিয়েছে রাইমার লাশ দেখতে। বুড়ি দাই সবার কাছে বলে বেড়াচ্ছে তিনি নিজের হাতে রাইমার গর্ভ থেকে সাপ বের করেছেন। ঐ বাচ্চা একটা ইচ্ছাদারি নাগিন। গ্রামের সবাই বুঝতে পারলো বুড়ির মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। ওর এখন অবসর নেওয়া দরকার , নতুন দাই লাগবে আরেকটা। বলে কী বুড়ি! ইচ্ছাদারি নাগি! এত স্রেফ রূপ কথায় হয়।

রাইমার স্বামী রাইমার গর্ভে বাচ্চা আসার এক মাস পরেই সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিল। মাছ ধরতে গিয়েছিল সেদিন দুপুরে। বাড়িতে এসেই ছটফট করতে থাকে। বলে গোখরা নাকি কামড়েছে। ওঝা ডাকা হলো , কিছুই করতে পারলো না । মারা গেল হাসেম। এরপর থেকে রাইমা আর তার শাশুড়ি মিলেই সংসার করছে।

একমাত্র সন্তানকে হারানোর পর এবার হাসেমের মা তার ছেলের বউকে হারিয়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলেন। তার নাতনির জন্য একই সাথে ঘৃণা আর ভালোবাসা দুইই কাজ করতে লাগলো।

সেই দিনের এক সপ্তাহ পর এক সন্ধ্যায় ছুটতে ছুটতে রহিম গ্রামের ওঝার বাড়িতে হাজির হলো। জানালেন তার মাকে সাপে কেটেছে। একজন নাকি সাপটা দেখেছে , কালাচ। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল ওঝা। পুরোনো দাই হওয়ায় গ্রামের সবারই পরিচিত রহিমের মা। নানান ঔষধ , কবিরাজি করেও বাঁচানো গেল না রহিমের মাকে। রহিম আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠে , আগেই কইছিলাম নাগ-নাগিন নিয়া এত উল্টাপাল্টা কথা কয়া বন্ধ কর , একটা বাচ্চা মাইয়ারে নিয়া কুৎসা রটাইও না, কেডা শুনে কার কথা , সত্যি কারের নাগিনই আমার মারে মারতে ঐ সাপ পাঠাইছে!

গ্রামের সবাই আতঙ্কের মধ্যে পড়লো। এই ওয়ালিপুর গ্রামেতো এত সাপের উপদ্রব ছিল না। গত এক বছরে রহিমের মাকে নিয়ে ৮ জন মারা গেল বিষধর সাপের কামড়ে।

হাসেমের মা হামিদাবাণু তার নাতিনকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। দুই দিন ধরে ছাগলের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু কিছুতেই তা খেতে চায় না । দুই গ্রাম খুঁজেও সদ্য সন্তান জন্ম দিয়েছে এমন কোনো মেয়েকে রাজি করাতে পারলেন না তার নাতনিকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য। অনেকেরই ধারণা এই মেয়ে অপয়া। এমন হতে থাকলে তো না খেয়েই মরবে বাচ্চাটা।

গভীর রাত। ঘরের চৌকিতে নাতনিকে নিয়ে শুয়ে আছেন হাসেমের মা। ঘুমিয়ে আছে দুজনেই। হঠাৎ ঘুমের ভেতরেই টের পেলেন তার পুরো শরীর জুড়ে পিচ্ছিল কী একটা যেন বেয়ে বেড়াচ্ছে। তার বুকের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে বয়স্ক স্তনে চিকন জিহ্বা ছোয়াচ্ছে ওটা। এক মুহূর্তেই ঘুম ছুটে গেল বুড়ির। স্পষ্ট অনুভব করতে পারলো একটা সাপ উঠেছে তার শরীর , স্তন চুষছে। বুড়ি সচেতন হয়ে গিয়েছে এরমধ্যেই , লাফালেই কামড়ে দেবে ওটা। ধীরে ধীরে চোখ খুললো , ঘরে হারিকেন জ্বলছে। আরে সাপ কই , তার নাতনি বুকের সাথে লেপ্টে আছে। বুড়ি ব্লাউজ পরে না। তার নগ্ন স্তনে মুখ দিয়ে চুষছে শিশুটি।

বুড়ির বুক ফেটে কান্না আসতে চাইলো । আহা! দুঃখী বাচ্চা । না খেতে পেয়েই মারা যাবে বুঝি শেষ পর্যন্ত। মা পায়নি তাই মায়ের বুকের দুধের জন্য এত উন্মুখ হয়ে আছে। বুড়ি শরীরে কেমন এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করলেন। স্তনের টান অনুভব করলেন। এবং বুঝতে পারলেন তার নাতনি শুধু শুধু ওটায় মুখ দিয়ে চুষছে না। সত্যি সত্যিই দুধ পাচ্ছে।

হাসেমের মায়ের জীবনে এরচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা আর ঘটেনি। এটা যে স্বাভাবিক কোনো কিছু না তা তিনি ভালো করেই বুঝতে পারলেন। পরমুহূর্তে করুণাময়ের কথা স্মরণ করে আনন্দে দুচোখ পানিতে ভরে উঠলো। করুণাময় এতটা নিষ্ঠুর হতে পারেন না , তিনি এই বাচ্চাটার কষ্ট সহ্য করতে পারেনি। তাই এই গায়েবি খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে বাচ্চাটার। কৃতজ্ঞতা আর তৃপ্তিতে মন ভরে উঠলো তার।

হাসেমের মা তার নাতনির নাম দিলেন চন্দ্র। নিজের জীবনের সব ভালোবাসা উজাড় করে পেলে-পুষে বড় করতে লাগলেন নাতনিকে। আশেপাশের মানুষেরা এত রূপবতী কোনো বাচ্চাকে এর আগে দেখেনি । কী সুন্দর , চোখ , নাক , মুখ। চাইলেও ঘৃণা করা যায় না। আস্তে আস্তে তাই প্ৰতিবেশীরাও স্বাভাবিক হতে থাকে তাদের সাথে। চন্দ্রকে সবাই ভালোবাসতে শুরু করে। কয়েক ঘরের মেয়েরা শুধু বুড়ির আড়ালে চন্দ্রকে বলতো কাল নাগিনী।

চন্দ্রের বয়স বাড়ার সাথে সাথে গ্রামে সাপের উপদ্রব ভয়ানক হারে বাড়তে লাগলো। প্রায় প্রতি মাসেই কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে সাপের কামড়ে। গ্রাম থেকে উপজেলা হাসপাতালও অনেক দূরে , তাছাড়া ডাক্তারি বিদ্যায় তাদের বিশ্বাস নেই। ওঝার উপরও ভয়ানক ক্ষেপে আছে সবাই। কিসের ওঝা , একজনেরও বিষ ছাড়াতে পারে না! টাকা খরচ করে দূর গ্রাম থেকে বড় মাপের ওঝা গ্রামে এনে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলো এবার গ্রামের সবাই।

এই ওঝাও সাপে কাটা লোকদের তেমন কোনো মঙ্গল করতে পারলেন না। গ্রামের সবাই কাঁচি , দা , কুড়াল নিয়ে তিন বেলা ঝোপ ঝাড় , গর্ত খুঁজে সাপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। মারা পড়লো শয়ে শয়ে সাপ। কিন্তু এতে যেন আরো বাড়লো সাপের সংখ্যা। সাপের কামড়ে মরার সংখ্যাও বাড়ছে।

দেখতে দেখতে চন্দ্রের ৮ বছর বয়স হয়ে এলো। চন্দ্র খুবই অবাক হয় তার আশেপাশের সব মানুষের সাপ নিয়ে আতংক দেখে। সাপ তার খুব ভালো লাগে। দাদি যদিও সব সময় সাবধান করে দেয়। কিন্তু চন্দ্রের মানুষের সাথে খেলাধুলা করতে ভালো লাগে না। এক অদ্ভুত ধরণের শব্দ করতে পারে সে পা দিয়ে। এটা সে কী করে শিখেছে নিজেই জানে না। কিন্তু চুপিসারে নির্জন ঝোপের আড়ালে গিয়ে পা দিয়ে এই শব্দটা করলেই অনেক গুলো সাপ বেরিয়ে আসে। তাদের সাথে খেলেই সময় কাটে চন্দ্রের। নানান রকম , নানান রঙের সাপ। কোনো মানুষ আশেপাশে আসলেই কী করে যেন বুঝে যায় সাপ গুলো। দ্রুত ঝোপের আড়ালে চলে যায়।

চন্দ্র খুবই আনন্দ পায় এটা ভেবে যে সে যেই ঘরে ঘুমোয় সেই ঘরের খাটের নিচের একটা গর্তে একটা বড় সাপ থাকে কিন্তু তার দাদি এখনো টের পায়নি। ওটার খুব বুদ্ধি। দাদি ঘুমিয়ে পড়লেই চুপি চুপি খাট বেয়ে চন্দ্রের শরীরে উঠে আসে ওটা। ওটার সঙ্গে খেলা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে সে।

চন্দ্রের দশ বছর বয়স। দাদির মেজাজ আজকাল খুব বেশি খিটখিটে থাকে। সারাক্ষণ তাকে অপয়া , অলক্ষী বলে গাল পারে। চন্দ্রের খুব রাগ হয়। ইচ্ছা করে সাপ হয়ে কামড়ে দেয় বুড়িকে। আচ্ছা মানুষ কী সাপ হতে পারে! তার খুব সাপ হতে ইচ্ছা করে। আজকাল সে সাপের ভাষা বুঝতে পারে। তারা কী সুন্দর মাটিতে শব্দ করে একে অপরের সাথে সংকেত দিয়ে কথা বলে।

সে আজকাল ওর সমবয়সী ছেলে-মেয়েদের সাথে খেলাধুলা করে। সেদিন বাড়ির খুব কাছেরই এক ফাঁকা জায়গায় ৭-৮ জন মিলে গোল্লাছুট খেলছিল। শেষ সীমানার সামনে দাড়িয়ে আছে চন্দ্র। মুক্তাকে ছুয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ওকে। সে ফিক ফিক করে হেসে মুক্তাকে ছুটতে বলছে। এমন সময় কম্পনটা অনুভব করলো সে। পায়ের তলার মাটি কেমন যেন মৃদু কম্পিত হলো। কানে মৃদু মাটি কাঁপার শব্দ ভেসে এলো। হুট করেই ফাঁকা জায়গা শেষের ঝোপের দিকে তাকালো সে। কিছু দেখা না গেলেও সে বুঝলো ওখানে এক জোড়া দাঁড়াস সাপ আছে। ওকে ডাকছে। চন্দ্র ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেল। মুক্তা ঠিক তখনই ছুটতে শুরু করেছে শেষ সীমানা স্পর্শ করতে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করলো না ও।

একবার শুধু ঘাড় গুড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে ঝোপের কাছে হাজির হলো। তার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল সাপ দুটো। সে আসতেই পুকুরের পথে ঝোপের কিনার দিয়ে ছুটতে শুরু করলো সাপ দুটো। চন্দ্রও ছুটলো ওগুলোর পিছু। একদম পুকুরের কাছে গিয়ে ওগুলো ঝোপের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।

চন্দ্রের চোখ এবার গেল পুকুরের কিনারে। পুকুরের একবারে কিনারে ফণা তুলে বসে আছে একটা সাপ। সে প্রায় সব জাতের সাপই চেনে। পদ্মগোখরা ওটা। ওটাও মাটি কাঁপিয়ে তাকে ইশারা করে কাছে ডাকছে। ………………..
.
.
. . . চলবে . . .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here