রাহেলার_রাত_দিন ৫ম এবং শেষ পর্ব

#রাহেলার_রাত_দিন
৫ম এবং শেষ পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

যেই রাহেলা এই শহরের প্রতি ভয় কমিয়ে ধীরে ধীরে রোমাঞ্চ অনুভব করতে শুরু করেছিল সেই রাহেলাই এই শহরকে আগের চেয়ে দ্বিগুন ভয় পেয়ে এখন পালাতে চাইছে। সে কী করছে , কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু হাঁটছে। সবকিছু কেমন যেন বিষাদ-মাখা লাগছে । রাতের সেই ভয়ংকর স্মৃতি মোছার জন্য বারবার আমজাদের কথা মনে করতে চাইলেও পারলো না। এই মুহূর্তে খুব কাছের কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু কেউ নেই এখানে তার।

এটা , তার সাথে কী হয়ে গেল। সবাই যদি জেনে যায় এই ঘটনা তাহলে তার কী হবে। সে আমজাদকে মুখ দেখাবে কী করে! গ্রামে ফিরে গিয়ে ভাই-ভাবিকেই বা মুখ দেখাবে কী করে। নানান চিন্তা মাথায় ঘুরছে। হুস নেই রাহেলার। সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকালো। কত মুখ , ইস! একটা পরিচিত মুখ নেই।

সেই ছোট্ট ছেলে রাব্বির দেখা যদি সে পেত! সব রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে সে। চিনে গত সন্ধ্যার সেই জায়গায় যেতে পারবে না সে। বিপদের আশঙ্কা অনুভব করতে করতেই ধীরে ধীরে সজাগ হতে চাইল তার মস্তিস্ক। আবার ভয়াবহ স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠতেই পালাতে চাইল এই জায়গা ছেড়ে যতদূর যাওয়া যায় ততদূরে।

হঠাৎ পেছন থেকে সেই পাষণ্ড ছেলের ডাক শুনে শিউরে উঠলো রাহেলা। পেছনে একবার তাকিয়েই আবার উদ্ভ্রান্তের মতো হাটতে লাগলো। ছেলেটা ছুটে তার দিকে আসছে। তারও ছুটে পালাতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এত মানুষের মাঝে তা করতে সঙ্কোচবোধ করছে। সে উন্মাদ হয়ে যায় নি। তার সুস্থ জ্ঞান আছে। ছেলেটা একেবারে তার কাছে চলে এলো। সে এখন কী করবে! চেঁচিয়ে লোকজনের সাহায্য চাইবে! ছেলেটার দিকে আবার তাকালো রাহেলা , ভয়ংকর মনে হচ্ছে না তো তাকে। কান্নাভেজা চোখ , করুণা প্রার্থনা করে এই মুখ।

ছেলেটার হাতে রাহেলার বোরকা। সে এতক্ষনে নিজের দিকে তাকালো। এত মানুষের মাঝখানে বোরকা ছাড়া এতক্ষন শুধু শাড়ি-কাপড় পরে হেঁটেছে ভাবতেই অস্বস্তি লাগলো। বোরকাটা নিয়ে , রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পরে নিল সে। আবার হাটতে লাগলো। ছেলেটাকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলছে সে। ছেলেটা তার পিছু ছাড়ছে না।

আপা , প্লিজ আমারে মাপ করে দেন। আমি এই মুখ কাউরে দেখাতে পারবো না। আমি এই পাপের মূল্য দিতে যে কোনো কিছু করতে পারি। আপনার স্বামীরে আমি পুরো শহর হলেও খুঁজে বের করবো।

রাহেলা কোনো উত্তর দেয় না। হনহন করে হাটতে থাকে। অলি-গলি পেরিয়ে যায় । কোথায় যাচ্ছে নিজেও জানে না। অন্তত এই নোংরা ছেলেটার থেকে দূরে যেতে চাইছে সে। ছেলেটার গতি না কমায় দুজনের দূরত্বও কমছে না। ছেলেটা তার স্বামীকে খুঁজে দেয়ার কথা বলতেই তার মনে ক্ষীণ আশার আবির্ভাব হলেও ছেলেটাকে সে আর বিশ্বাস করে না।

ছেলেটাকে তার পিছু নিতে না করার মতো শব্দও তার মুখ দিয়ে বেরোলো না। ঘৃণায় আড়ষ্ট হয়ে রইলো জিহ্বা। এইভাবে আরো অনেকক্ষণ হাটলো রাহেলা। একসময় বুঝতে পারলো তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই , কোনো আশা নেই। ছেলেটা তাকে একটা কাজ জোগাড় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। নিরাপদ থাকার জায়গার কথা শোনালো। ছেলেটার দিকে না ফিরে তাকিয়ে হাঁটছে আর হাঁটছে সে। মাথা চক্কর দিচ্ছে এবার, চারপাশ আধার আধার হয়ে এলো ক্লান্তিতে। রাহেলা এবার থামলো ছেলেটার দিকে তাকালো।

ছেলেটা রাহেলার ক্লান্ত চোখজোড়া দেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো। অনুধাবন করলো হার মেনে নিয়েছে রাহেলা। যেকোনো মুহূর্তে ঢলে পড়বে। তারপর একটা রিক্সা ডাকলো। রিকশাতে রাহেলাকে উঠতে সাহায্য করলো। রাহেলা জানে না তার সাথে কী হচ্ছে। ছেলেটা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে । তার শুধু কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। হয় মনু , নয় আমজাদ, নয় মেজভাবি। সেই পথশিশু রাব্বি হলেও হবে। কিন্তু এই পশুর থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছে সে। একটা নিরাপদ আশ্রয়। শরীরে শক্তি নেই যে! ক্লান্তি , অবসাদে তার পুরো শরীর আড়ষ্ট হয়ে এলো।

কতক্ষন মনে নেই রাহেলার। ছেলেটা বিড়বিড় করে পুরো পথে করুনস্বরে তাকে কী বললো তার কিছুই শুনতে পায়নি সে। রিক্সা থামলো একটা বড় বাড়ির গেটের সামনে । ছেলেটার সাথে বাড়ির গেট পেরোলো রাহেলা। রাহেলাকে এবারও মিনতির সুরে বলল :

আপা , আপনি আমাকে মাফ করে দেন। আমি জানি আপনি হয়তো কোনোদিন করবেন না। আমারে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে দেন। এখানে আপনি সবচেয়ে নিরাপদে থাকবেন। এদের ছেলের দেখাশোনার জন্য একটা লোক খুঁজছেন তারা। আপনে এই বাড়িতে কিছুদিন থাকেন , কাজ করেন। আমি আপনার স্বামীরে যেখান থিকা পারি খুঁজে আনবো।

তবুও নীরব রাহেলা। বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতেই অনেকটা ক্লান্তি দূর হয়ে গেল রাহেলার। বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে চারদিকে তাকালো সে। এত সুন্দর আর বড় বাড়ি এতকাছ থেকে সে আগে কখনো দেখেনি। ফুলের বাগান , মাঠ , মাঠের ওপর ছাতার মতো চালের নিচে টেবিল চেয়ার ফেলা । একটা মৎসকন্যার পাথরের মূর্তির পাশ থেকে পানি ঝর্ণার মতো করে পড়ছে।

ছেলেটা বলল , সে এই বাড়িতে টিউশনি করায়। ঐ ছেলেটার দেখাশোনা করার জন্য একটা লোক খুঁজছে বাড়ির ম্যাডাম। ছেলেটা রাহেলাকে তার গ্রামের লোক বলে পরিচয় করিয়ে দিল ম্যাডামকে।

রাহেলা আভিজাত্য আর রূপে ঠাসা এই ম্যাডামের দিকে মুগ্ধ ভাবে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকেই মাথা নিচু করে ফেলল। ম্যাডাম বলল :

মুখোশ সড়াও। কী নাম তোমার?

পুরো পথে ছেলেটার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। কন্ঠটা তাই আড়ষ্ট হয়ে ছিল। বিড়বিড় করে বলল :

রাহেলা।

ছেলেটা কিন্তু তার শহরে আসার পেছনের কারণ কিছুই লুকালো না । বলল কিভাবে স্বামীর খোঁজে গ্রামের এক লোককে ধরে একা শহরে এসে হারিয়ে গিয়েছিল। বাড়িয়ে বলল , সে মেয়েটাকে খুঁজে পায়। আপা বলেই ডাকে। তার গ্রামের মেয়ে যে তা চিনতে তার ভুল হয়নি।

রাহেলা কোনো কথা বলেনা চুপচাপ ঠায় দাঁড়িয়ে রয় । ম্যাডাম বিস্মিত হয়ে বলে :

আচ্ছা বোকা মেয়েতো তুমি ! এমন বোকামি কেউ করে ! ইচ্ছা করে এই শহরে এসে হারিয়ে গেলে কাউকে বুঝি খুঁজে পাওয়া যায় ? কি আশা নিয়ে এই ভরসা , বিশ্বাস পেলে তুমি? সেতো মনে হচ্ছে স্বেচ্ছায় তোমাকে ত্যাগ করেছে। তার ছবি আছে কোনো ?

ম্যাডামের কথাগুলোতে ঝাঁজ ছিল না । ছিল মায়া আর কৌতূহলতা। রাহেলা না সূচক মাথা নাড়লো। ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন ,

তবে ?

রাহেলার আর কিছু বলার নেই। মেয়েটি তার সাথে কথা বলতে সংকোচ বোধ করছে বুঝতে পেরে ম্যাডাম এবার ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বললেন :

সে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে না কেন ?

কোন মুখে ফিরে যাবে বলছে। তাছাড়া সেখানে আপন কেউ নেই। মা-বাবা ভাই-বোন সবাই মৃত।

আন্দাজে বলল ফয়সাল। রাহেলা শুধু একবার তার দিকে চাইতেই চোখ নামিয়ে নিল। ম্যাডাম আবার বললো , এমন গোমড়া হয়ে থাকলে চলবে না। হাসিখুশি থাকতে হবে। আমি চাই আমার ছেলেটা হাসি-খুশি মানুষের সঙ্গে মিশুক।

রাহেলার সরল মুখায়ব দেখে তাকে প্রথমেই পছন্দ করে রেখেছিলাম গৃহকর্ত্রী। এবার বললেন , যাও ভেতরে । মন্টুর মা তোমাকে ঘর দেখিয়ে দেবে। ক্লান্ত মনে হচ্ছে। কিছু খেয়ে নিও। আমি মন্টুর মাকে বলে দিচ্ছি। মন্টুর মা?

মাঝবয়সী এক মহিলা এসে রাহেলাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। ফয়সাল ভয়ে সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে জানে রাহেলা যদি এই ম্যাডামের কাছে একবার গত রাতের কথা প্রকাশ করে দেয় তাহলে নিশ্চিত তাকে জেলে মরতে হবে। তবুও সে এই বাড়িতেই তাকে আনলো। এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই। ম্যাডামের অনুরোধেও তাই বাড়ির ভেতর গেল না। নিজের বাড়ির পথে রওনা হলো।

শুরু হলো রাহেলার জীবন নতুন করে। সেই মানসিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে যদিও সময় লাগলো। কিন্তু ধীরে ধীরে এই বাড়ির সঙ্গে মানিয়ে নিল সে। এরা বড়লোক হলেও এদের ভেতর কোনো অহংকার নেই। স্যার, ম্যাডাম এমন কী যে ছেলেটার দেখাশোনা করার জন্য তাকে রাখা হলো তার প্রতি সবার আচরণে মুগ্ধ হলো সে। বাড়ির কর্তা লোকটাও কয়েকবার তার স্বামী প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। চেহারা গায়ের রং জেনে নিয়েছেন।

ফয়সাল নামের ছেলেটা রাহেলাকে এখানে এনে দেওয়ার কয়দিন পরই এই বাড়ির টিউশনি ছেড়ে দিল। বাড়ির কর্ত্রী খুব অবাক হলেও ছেলেটা স্বাভাবিক ভাবে বলেছিল জায়গা বদল করছে সে তাই এখানে এসে পড়ানো সম্ভব না। তারপরেও মাঝেমধ্যে রাহেলাকে দেখতে , তার খোঁজ খবর জানতে এই বাড়িতে আসতো ছেলেটা। রাহেলা যতটা সম্ভন দূরে সরে থাকতো। এমন কী ছেলেটা তার স্বামীকে নিয়ে কথা বললেও বিদঘুটে লাগতো , এক রকম অস্বস্তিতে ভুগতো। ভয়ার্ত এক স্মৃতির জন্ম দিয়েছে যে ছেলেটা তার ভেতর।

একদিন ফয়সাল তার এক আর্টিস্ট বন্ধুকে নিয়ে এলো। বাড়ির কর্ত্রীর কাছে বলল :

আমি , রাহেলা আপার স্বামীর একটা স্কেচ করাতে চাচ্ছি। দেখি চেহারা কেমন যদি জানতে পারি তবুও খুঁজে পাওয়ার একটা ক্ষীণ আশাতো থাকবে!

বাড়ির কর্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন ছেলেটার প্রতি আবারও ভালোবাসা অনুভব করলেন। একজন পরনারীর জন্য ছেলেটা যা করছে তা সত্যিই তাকে আনন্দ দেয়। হোক এক গ্রামের মেয়ে। কিন্তু রক্তের সম্পর্ক না থাকার পরও রাহেলার স্বামীকে খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে আছে ছেলেটা।

ফয়সালের আর্টিস্ট বন্ধু আধা ঘন্টা ধরে রাহেলার বর্ণনা অনুসারে একটা স্কেচ দাঁড় করানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু রাহেলার পর্যবেক্ষণ বা বর্ণনা এতই কাঁচা যে শেষমেষ বিরক্ত হয়ে উঠে যায় সে । ফয়সালকে জানায় এই কাজ তার দ্বারা হবে না। ফয়সালের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও আর দ্বিতীয়বার চেষ্টা না করে বাড়ি থেকে চলে যায়।

সময় কাটতে থাকে। রাহেলা আমজাদের কথা সব-সময় এখনো ভাবে। কিন্তু ২ মাস এখানে থেকে নতুন করে অনেক কিছুই উপলব্ধি করতে পারে সে। আমজাদকে খুঁজে পাওয়া যে খুব সহজ কাজ না, এই শহরের সব মানুষের লিস্ট বলে যে কিছু নেই , ঢাকা শহর যে কেবল একটা ছোট্ট জায়গা নয় এমন অনেক কিছু অনুধাবন করতে পারে সে। এই বাড়ির ম্যাডামের সঙ্গে খুব সামান্য কথা হলেও রাহেলা বুঝতে পারে তিনি খুব বুদ্ধিমান। প্রচুর পড়ালেখা জানা মেয়ে।

আলম মিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত খুটিয়ে জেনে নেয় রাহেলার কাছ থেকে ফরিদা বেগম। এবং সে যে নারী পাচারের দালাল ছিল এবং পুলিশ তাকে না ধরলে এতক্ষনে রাহেলার কী অবস্থা হতো তা অনুমান করতে বেশি মাথা খাটাতে হয় না তার। ভাগ্যিস ফয়সালের হাতে পড়েছিল , নইলে যে আর কী বিপদে পড়তো মেয়েটা। মানুষ যে এতটা বোকা , সহজ , সরল হতে পারে তা বিশ্বাসই করতে পারতেন না ফরিদা বেগম যদি না সামনাসামনি রাহেলাকে দেখতেন।

মেয়েটার জন্য একটা টান অনুভব করেন তিনি। চান কোনো একটা উপকার করতে। কিন্তু মেয়েটা তার স্বামী সম্পর্কে এমন কোনো তথ্যই জানে না যার মাধ্যমে তাকে খুঁজতে শুরু করবে সে। এমন কী এটাও নিশ্চিত না ঢাকাতেই আছে সে। ফয়সালেরও যে কী হলো তার ফোন বন্ধ। কিছুদিন যোগাযোগ রেখে রাহেলার স্বামীর অনুসন্ধানের তদবির করলেও অনেকদিন ধরে এই বাড়িতে আসে না সে। রাহেলা যে ফয়সালকে দেখে কেমন সংকুচিত হয়ে যায় তা তার নজরে পড়েছে। কিন্তু এরমধ্যে জটিল কিছু থাকতে পারে এমন চিন্তা তার মাথায় আসেনি। তার ৮ বছরের ছেলে সবুজও এই রাহেলাকে খুব পছন্দ করে। তার অনেক কথাই না শুনলেও রাহেলার কথা শোনে ।

তাই তিনি ভাবলেন , থাকুক মেয়েটা এখানে। যতদিন থাকতে চায়। তিনি বা তার স্বামী সারাদিন বাড়িতে থাকেন না। সবুজের দেখা-শোনাটাতো অনায়াসে করছে রাহেলা।

এভাবে আরো কয়েক মাস গেলো। এখন নিজের বাড়িই যেন হয়ে গেছে এটা রাহেলার। তার সঙ্গে কেউই এখানে কাজের লোকের মতো ব্যবহার করে না। সবুজের প্রতি আশ্চর্য এক রকম মায়াও জন্মে গেছে তার। মাঝেমধ্যে গ্রামের কথা , ভাইয়া-ভাবী মনুর কথা মনে পড়ে তার। কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া ম্যাডাম জানে গ্রামে তার আপন কেউ নেই। যদি জানে সে মিথ্যা কথা বলছে হয়তো তাড়িয়েও দিতে পারে।
ম্যাডাম তার গ্রাম , ফয়সালের বাড়ি কতদূর তাদের বাড়ি থেকে ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলতেই সে চুপসে যায়। এমন কোনো রাত নেই অবশ্য আমজাদকে তার মনে পড়ে না ।

আরো ৩ বছর পেরিয়ে যায়। এখন পাকাপোক্ত এই বাড়ির লোক রাহেলা। এই বাড়ি , সবুজ , স্যার – ম্যাডাম , মন্টুর মা , বাড়ির কেয়ার টেকার আবুল ভাই , দারোয়ান জামসেদ ভাই, মালি রজব চাচা এর বাইরে তার আর দুনিয়া নেই । তার মন এরমধ্যেই বিচরণ করে। খুব একটা বাড়ির বাইরে যাওয়া লাগে না তার।

মন্টুর মায়ের সঙ্গে যদিও বা একটু যায়। রাস্তায় হাঁটার সময় বুক ধকধক করে। আড়চোখে পরপুরুষের দিকে তাকায়। শুধু একটা পরিচিত মুখ দেখতে পাবে এই আশায়। আমজাদের মুখ ভর্তি হয়তো দাড়ি , হয়তো আরেকটু মোটা হয়েছে সে। রাহেলা যেমন আমজাদকে খুঁজছে । আমজাদও হয়তো তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ যদি চলতে চলতে কোনো একদিন আমজাদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে যায় কী বলবে সে। ভাবতে থাকে। এখনো মাঝরাতে একটা সংসারের স্বপ্নে বিভর থাকে রাহেলা , জানে না আমজাদ কী করে জানবে সে এখানে আছে, তবুও আশায় থাকে খুঁজে খুঁজে একদিন হয়তো এখানে চলে আসবে আমজাদ , তাকে নিয়ে চলে যাবে নতুন ঘরে। যে বাড়ির কর্ত্রী হবে সে। মাসিক বাজারের লিস্ট করবে সে। সৃষ্টি কর্তার করুণায় হয়তো মনু কিংবা রাব্বি কিংবা এই সবুজের মতো ফুটফুটে একটা সন্তান হবে তার।

___________________________________________

গল্পটাকে এখানেই শেষ করে দেওয়া হলো। কিন্তু রাহেলার রাত-দিন কী এখানেই সমাপ্ত হবে ? না! সে আরো দীর্ঘদিন বাঁচবে। সে একটা আশ্রয় পেয়েছে এখন। এখন তার স্বপ্ন দেখতে বাধা কোথায়। আমজাদকে দুনিয়ার আর কেউ না চিনলেও রাহেলা চেনে। আমজাদ বোকা , স্বপ্নবাজ , অকর্মা হতে পারে। কিন্তু জোচ্চোর না , বিশ্বাসঘাতক না। এই বিশ্বাস তার মনে না থাকলে এতদিন বেঁচে থাকতে পারতো না রাহেলা। বা গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার মতো মনোবলও পেত না।

একবার ভেবেছিলাম রাহেলাকে আবার কিছু সময়ের জন্য গ্রামে পাঠাতে। ভাগ্যিস পাঠাইনি। এই দুঃখী , সরল মেয়েটার জীবনে দুঃখ আর বাড়িয়ে লাভ কী! তার স্বপ্ন -আশা এর খুন করার আমি কে? কিছু সত্য তার অগোচরেই থাক না! সে তার বাকি জীবনে আর গ্রামে ফিরে যায়নি। জানতে পারেনি তার জীবনের কঠিন সত্যটা।

সে যদি ফিরে যেত তাহলে দেখতো তার মেজো ভাইয়ের সাজানো গোছানো সংসারটি আর নেই। গ্রামের ধান ক্ষেতের আইলে ৭-৮ বছরের একটা ছেলের ছেড়া একটা নোংরা প্যান্ট আর খালি গা নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো, সব-সময় আতংক নিয়ে ছুটে চলা ছেলেটা যে তার সেই অর্ধেক ভালোবাসা পাওয়া মেজো ভাবীর ছেলে মনু তাও সে চিনতে পারতো না। যার মুখ দেখলেই এখন সবাই ” জারজ” “জারজ” বলে খেপিয়ে তোলে , তাড়িয়ে দেয়। মেজো ভাবি জেল-খানায়। মেজো ভাই ব্যবসা ছোট আর বড় ভাইকে বুঝিয়ে দিয়ে সারাদিন ঘরে বসে নেশা করে।

আমজাদ নিখোঁজ হওয়ার আগের দিনে মেজো ভাবি তার জীবনের সমস্ত গোপন কথা মেজো ভাবীর আপন বড় ভাইয়ের কাছে প্রকাশ করে । তার বড় ভাই তার ওপর রাগ করে না। বুঝতে পারে এছাড়া এই সংসারে টিকে থাকার আর কোনো পথ খোলা ছিল না। শুধু এখন তার বোন-জামাতা আর অন্য কেউ এই কথা না জানলেই হলো।

রাহেলার মতো আমজাদও যখন গভীর রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবছিল রাহেলা তার জন্য জীবনে কত কিছু করেছে। এই সুযোগ তাকে একটু সুখের মুখ দেখানোর। এই গয়না-টাকা আর রাহেলাকে নিয়ে কালই ঢাকায় চলে যাবে। এমন সময় বাড়ির বাইরে মেজ ভাবীর ডাক শুনে আমজাদ বাইরে বেরোয়। ভাবীর পেছন নিয়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে যায়। ভাবি তাকে দাঁড়াতে বলে কোথায় গেল ! এমন সময় মাথার পেছনে ভারী কিছু একটার আঘাত পায়। শেষবারের মতো দুনিয়াকে ঝাপসা দেখে। তার লাশের সাথে সন্তর্পণে ঘরে ঢুকে আনা আমজাদের সমস্ত জামা-কাপড়ও পুঁতে ফেলা হয়। গয়না গুলোও পুঁতে ফেলা হয় তার সাথে। চারদিকে সেই লোক দিয়ে ছড়িয়ে দেয় ঢাকায় যাওয়ার গাড়িতে উঠতে দেখেছে আমজাদকে।

মেজো ভাবীর বড় ভাই যার সাহায্য নিয়ে কাজটি করেছিল সে অনেকদিন পর অন্য একটা মামলায় ধরা পড়ে তার পূর্বের এই অপরাধের কথা স্বীকার করে। সাথে সাথেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় পুরো গ্রামে।গ্রামের এমন কোনো মানুষ নেই সেদিন মাটিখুড়ে আমজাদের কঙ্কাল তোলার সাক্ষী হয়নি । ও ! শুধু একটি মেয়ে বাদে। সে তখন শহরের রাস্তা দিয়ে মন্টুর মা নামে পরিচিত এক মহিলার সাথে হাটতে হাটতে আড়চোখে পর-পুরুষের দিকে তাকিয়ে পরিচিত একটা মুখায়ব মেলানোর চেষ্টা করছিল।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here