দ্বিতীয় জন 💔,06,07

দ্বিতীয় জন 💔,06,07
Sumana Easmin
পর্ব ছয়

হিমুর সামনে মেয়েটি পানি হাতে দাঁড়াতেই হিমু হাত বাড়িয়ে গ্লাসটি নিয়ে নিলো। এক চুমুক পানি খেয়ে গ্লাসটি রেখে দিলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-
-‘নাম কি আপনার?’
-‘জ্বী, কুসুম।’
-‘এই বাসায় কি শুধু আপনি একাই থাকেন? নাকি আরো কেও থাকে?’
-‘না। আমার আরো দুই বোন আছে। আমরা তিনজন একসাথে থাকি।’
-‘ওহ্ আচ্ছা। আমায় এখানে আনলেন কি করে?’
-‘আমার বড় দুই বোনের সহযোগিতায় আপনাকে এখানে আনতে পেরেছি।’

হিমু চুপচাপ মাথা নিচু করে বেডের উপর আধাশোয়া হয়ে আছে। কুসুম ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। হিমু কুসুম কে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। কারন ও জানে রায়ানের ফুফুর বাসায় কুসুম বা ওর বোনেরা কি ধরনের কাজ করে। হিমু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলালো! কুসুমদের প্রতি ওর অজানা একটা মায়া কাজ করতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পর হিমু নিরবতা ভেঙে কুসুমকে জিজ্ঞেস করলো-
-‘আপনারা তো আমায় কেউ চেনেন না। তবু আমার হয়ে এতো কিছু করলেন? কোন উদ্দেশ্য আছে নিশ্চয়?

হিমুকে রায়ানের ফুফুর বাসা থেকে আনার পেছনে বর্ষার ই পুরো হাত ছিলো। তার কথা মতোই কুসুম ও তার বোনেরা মিলে হিমুকে নিয়ে এসেছে। বিনিময়ে বর্ষা ওদের বিশাল অংকের টাকা দিয়েছে। কিন্তু বর্ষা ওদের একথা বলতে নিষেধ করায় কুসুম হিমুকে ঐ বিষয়ে কিছু বলল না। তাছাড়াও কুসুম হিমুকে কিছুই বলতো না। কারন সে অলরেডি হিমুর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। কুসুম একটু পর ইতস্তত করতে করতে বলল-
-‘ সব মানুষই কি স্বার্থের জন্য কাজ করে? স্বার্থহীন ভাবে কি একজন মানুষও কাজ করেনা?’
হিমু কুসুমের কথায় লজ্জায় কৃতজ্ঞতায় আড়ষ্ঠ হয়ে বলল-
-‘এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই দুরূহ। প্লিজ আমার কথায় আপনি কিছু মনে নিবেন না।’
কুসুম হিমুকে দেখে যতোটা না মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো ওর কথা-বার্তা শুনে তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়ে গেলো।

একটুপর হিমু বলে উঠলো-
-‘আপনারা আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ। আমি সারাজীবন আপনাদের উপকার মনে রাখবো।’

হিমুর চোখে সম্ভবত পানি টলমল করছে। সে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল-
-‘এখানে কিছুদিন থাকতে পারলে আমার বেশ ভালোই লাগতো। কিন্তু কোন উপায় নেই। বাসার সবাই না জানি আমার দুশ্চিন্তাই কতোটা অধীর হয়ে আছে! আমার সেলফোন টা কি এনেছিলেন?’
-‘সরি, তাড়াহুড়াতে তো ঐ টা নিতে ভুলে গিয়েছিলাম।’
-‘ওহ্! ইট্স্ ওকে। আমায় এখনই একটা ফোন দিতে পারবেন কথা বলার জন্য?’

কুসুম একটু বিচলিত হয়ে গেলো। কারন সে চাচ্ছেনা হিমু তার কাছ থেকে চলে যাক। হিমুতে সে মুগ্ধ হয়ে গেছে। হিমুর ফোন টা ওর কাছেই আছে। তবু সে মিথ্যা বলল। যাতে হিমু ওর থেকে দুরে যেতে না পারে। কুসুম কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে বিড়বিড় করে বলল-
-‘আমার কাছেও তো কোন ফোন নেই। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, বড় আপু সন্ধ্যা নাগাদ আসবে তখন কথা বলে নিয়েন। এখন তো আপনার শরীরও খুব দুর্বল। খেয়ে একটু রেস্ট নিন!’
হিমু আর কোন কথা বলল না। কুসুম রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মনে হয় খাবারের বন্দোবস্ত করছে।

এদিকে বর্ষা হিমুর ফোনের অপেক্ষায় বসে আছে। কারন সে জানে হিমুর জ্ঞান ফিরলেই সে বর্ষাকে ফোন করবে। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো তবু সে হিমুর কোন ফোন পেলোনা। না পেয়ে বর্ষা দুশ্চিন্তাই অস্থির হয়ে পরলো। কুসুমকে ফোন দিলো ওর ফোন সুইচড অফ বলছে। ওর দুই বোনকে ফোন দিলো তারাও ফোন রিসিভ করছেনা। টেনশনে বর্ষা শুধু রুমের মধ্যে পায়চারী করতে লাগলো।

কুসুমদের সাথে বর্ষার কথা হয়েছিল এই শর্তে যে, হিমু ফোন করার পর বর্ষা ওকে ওদের বাসায় নিতে যাবে! কিন্তু সেটা যে এইভাবে ওলটপালট হয়ে যাবে কে জানত!

কুসুম খুব যত্ন করে হিমুকে দুপুরের খাবার খাওয়ালো। হিমুর শরীর বেশ দুর্বল থাকায় সে খেয়েই ঘুমিয়ে পরলো।
কুসুম ওর বোনদের এই সুযোগে ফোন দিয়ে বলে দিলো তারা যেনো বাসায় না আসে। আর বর্ষা তাদের ফোন করলে যেনো তারা বলে রায়ানের ফুফুর লোকজনরা তাদের ধরতে পেরে আটকে রেখেছে। আর বেরুতে দিচ্ছে না। তাই বাসায় কি হচ্ছে না হচ্ছে তারা কিছু বলতে পারে না।

বর্ষা হিমুর বাবা মা কে মিথ্যা কথা বানিয়ে বলে সান্ত্বনা দিয়ে রেখেছে। যে হিমু কোথায় গেছে সেটা ওকে বলেই গেছে। জাস্ট আসতে কয়েকদিন সময় লাগবে।

রাতে কুসুম হিমুকে বলল যে ওর বোনদের রায়ান ও তার ফুফু মিলে আটকে রেখেছে। হিমু আরো দুশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে পড়লো। ওর শরীর সবে মাত্র একটু সারতে ধরেছে। পুরোপুরি এখনো সারেনি। এমত অবস্থায় সে কি করবে ভাবতে লাগলো। সাথে টাকা নেই, ফোন নেই, বাইক ও নেই।
কুসুম হিমুকে চুপ থাকতে দেখে মনে মনে খুব খুশি হলো। কারন সে বুঝতে পেরেছে হিমুশএখন নিরুপাই। তাই হিমু যে আগ বাড়িয়ে এখন কিছু করতে চাইবেনা সেটা ওর প্লাস পয়েন্ট আর খুশির কারন।

হিমু ভাবছে বর্ষার কথা। কারন সে যদি জানে একলা বাড়িতে সে আর শুধু কুসুম ছিলো তাহলে সে এই বিষয়টা কিভাবে মেনে নিবে? পরক্ষণেই আবার ভাবলো, বর্ষা তো ওকে ভালোই বাসেনা, মেনে নেওয়া না নেওয়ার প্রশ্ন কই থেকে আসছে? যেখানে কিনা ভালোবাসায় নেই! সেখানে মেনে নেওয়ার হিসেব বৃথা। হিমু ওর বাবা মার কথা ভাবতে লাগলো।

বর্ষা কুসুমের বোনদের কাছ থেকে ওদের আটকে রাখার কথা শুনে আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পরলো। যদিও রায়ান ও তার ফুফু এখনো বর্ষার কব্জাতেই আছে তবুও। কারন রায়ান বা ওর ফুফুর তো লিংক টিংক ও থাকতে পারে। কখন কি হয় কে জানে!

বর্ষা কোনমতে রাত টা কাটিয়ে দিয়ে সকালে একাই কুসুমদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। বাসা খুঁজে নিয়ে যেতে যেতে দুপুর হয়ে গেলো। অবশেষে সে ঠিক বাসাতে পোঁছালো।

দরজায় কয়েকবার নক করার পর কুসুম দরজা খুলে দিলো। বর্ষা ওর পরিচয় দিলো। বর্ষাকে দেখে কুসুম মনে মনে খুব বিরক্ত হয়ে গেলো। বাড়ির ভেতরে তো ঢুকতে বললই না বরং মিথ্যা কথা বলে ওকে গেট থেকেই তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। বর্ষা কিছুটা ইতস্তত করতে করতে বলল-
-‘হিমু যদি চলেই যায়, তো যাক। আমি বহুদূর থেকে এসেছি, খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি। তোমার বাসায় যদি একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দাও তাহলে খুব উপকার হয়।’
-‘কিন্তু আমি তো এখন বাইরে যাবো, বাজারে কিছু কাজ আছে।’
-‘ওহ, সমস্যা নেই! আমি একাই থাকতে পারবো।’
-‘না না, তা কি করে হয়! একলা বাসায় আপনাকে কি করে একলা রেখে যাই বলুন? আর আপনার স্বামী যদি এখানে থাকতো তাহলে না হয় একটা কথা ছিলো।’

বর্ষা মনে মনে খুব রাগান্বিত হয়ে গেলো। প্রথমে সে কুসুমের কথা বিশ্বাস করেছিলো। কিন্তু পরে সে ওকে সন্দেহ করা শুরু করলো। এতোদুরের পথ মানুষ শত্রুর বাসাতে গেলেও আদর যত্ন করে! অন্তত এমন খারাপ ব্যবহার করে না। আর এই মেয়ে কোন শত্রুতা ছাড়াই কেমন ব্যবহার করছে, বিষয়টা বর্ষার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে। সে কিছুই হয়নি এমন নরমাল ভঙ্গিতে কুসুম কে বলল-
-‘আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি বাজারে যাও! আমায় শুধু বসার একটা চেয়ারে বা টুল দিয়ে যাও আমি বাহিরে বসেই তোমার জন্য ওয়েট করবো। তারপর ধীরে সুস্থে বাসায় রওনা দিবো। আর এর মধ্যে যদি হিমু ফোন করে তাহলে তো কোন কথাই নেই। চলে যাবো।’

কুসুম বুঝতে পারলো আর বেশি ইগনোর করলে সে বর্ষার কাছে ধরা পরে যাবে। তাই সে বর্ষাকে তার রুমে নিয়ে গেলো। বর্ষা বাসার ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো হিমুর পরনের কাপড় রোদে শুকোতে দেওয়া হয়েছে। সে কুসুমের রুমে ঢুকতে ঢুকতে শুধু এদিক সেদিক দেখতে লাগলো। কুসুম বর্ষাকে ওর রুমে রেখে হিমুর রুমে গেলো। গিয়ে দেখে হিমু ঘুমাচ্ছে। তারপর ও চুপচাপ দরজায় তালা মেরে বর্ষার কাছে চলে আসলো। বর্ষা যে ওর পিছু পিছু গিয়েছিল সেটা ও তাড়াহুড়াতে একটুও বুঝতে পারলো না।

একলা বাড়িতে হিমুর সাথে কুসুম কে এমন একাকী ভাবে দেখে বর্ষার মাথায় চরচর করে রাগ উঠতে লাগলো। তার উপর আবার কুসুমের অমন মিথ্যা কথা আর খারাপ ব্যবহারের জন্য ওর হাত পায়ের রক্ত যেনো টগবগ করতে লাগলো। সে গতকাল কুসুমের নাম্বার বন্ধ পাওয়ার পর থেকেই এমন একটা কিছু আন্দাজ করেছিলো।

কুসুম রুমের ভেতরে ঢুকতেই বর্ষা ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল-
-‘তা রাতে কেমন সুখ নিলি?’
-‘মানে?’

বর্ষার রাগান্বিত মুখ ভঙ্গি দেখে কুসুম হতভম্ব হয়ে গেল। সে থতমত খেয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বলল-
-‘কি বলছেন এইসব? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা!’
বর্ষা কুসুমের একদম সামনে এসে বলল-
-‘দেহ ব্যবসা করে তোর তৃপ্তি মেটেনা বুঝি? তাই আমার স্বামীকে দিয়ে তৃপ্তি মেটাতে চাস?’
কুসুম এবার বর্ষার কথা গুলোর মানে ধরতে পেরে মুহুর্তেই রাগান্বিত হয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
-‘মুখ সামলে কথা বল! ভুলে যাসনা এখন তুই আমার বাসায়! আমি তোর যে কোন কিছু করতে পারি!’
রাগে ক্ষোভে বর্ষা ফেটে পরতে লাগলো। কুসুম কে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে দিতে বলল-
-‘নতুন করে আর কি করবি তুই আমার? যা করার তা তো করেই ফেলছিস। এখন শুধু আমি করো আর তুই চেয়ে চেয়ে দেখবি! এক রাতের মধ্যেই এতো সুখ নিয়েছিস যে তাকে পাওয়ার জন্য হাজার মিথ্যা কথা বলতেও তোর মুখে বাধছে না! বে*** আমার যায়গায় যদি তুই থাকতিস তাহলে তুই কি করতিস? তোর কেমন লাগতো? বল?’

কুসুম রেগে গিয়ে বর্ষাকে ফ্লোরে ফেলে বর্ষার “হাত-পা মুখ” শাড়ি দিয়ে বাধতে লাগলো। বাঁধতে বাঁধতে হঠাৎ ওর মনে হলো যদি বর্ষাকে চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তার আর হিমুর মধ্যে কোন বাঁধা থাকবেনা। এমনিতেও কুসুম বর্ষার সাথে বেশি কথা বাড়াতে চাচ্ছিলো না। কারন হিমু যদি আসল সত্যিটা জেনে যায় সেই ভয়ে।

পার্শেই টেবিলের উপরে হিমুর জন্য ফল কেটে কুসুম একটা চাকু ফেলে রেখেছিল। সেটা নেওয়ার জন্য বর্ষাকে ফেলে রেখে ও টেবিলের কাছে যেতে লাগলো। বর্ষা এই সুযোগে ওর চুল থেকে কাঁটা টা বের করে নিলো। তারপর বিদ্যুত বেগে কুসুমের কাছে গিয়ে পেছন থেকে ওর ঘারে কাঁটা টা ঢুকে দিলো। আর সাথে সাথে কুসুমের নাক-মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরলো। একটু পর কুসুম ফ্লোরে টলিয়ে পরলো।

To be continue….

দ্বিতীয় জন 💔
Sumana Easmin
পর্ব সাত

কুসুম ফ্লোরে টলিয়ে পড়ার সাথে সাথে বর্ষা ওর ঘার থেকে কাঁটা টা বের করে নিলো। ওর শাড়ির আঁচল দিয়ে কুসুমের ঘারের রক্ত মুছে দিলো। তারপর ওকে ওর বেডে শুইয়ে দিলো। দেখে মনে হচ্ছে কুসুম ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। কিন্তু না! সে কিছুক্ষণ আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।

বর্ষা হিমুর রুমের তালা খুলে তারাতারি করে ওর কাছে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো হিমু তখনো ঘুমাচ্ছে। বর্ষা ওকে এক ডাক দিতেই ওর ঘুম ভেঙে গেলো। ও চোখ ডলতে ডলতে বলল-
-‘তুমি এখানে?’
-‘হ্যাঁ, কুসুমের বোন গতকাল রাতে আমায় ফোন করে সব ঘটনা বলেছে। তারপর এই ঠিকানাই আসতে বলেছে।’
-‘কখন এসেছো?’
-‘ প্রায় ঘন্টা খানেক আগে। তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই আমি কুসুম কে ডাক দিতে দেইনি। ওর সাথে এতক্ষণ গল্প করলাম। আর একটু দেরি করে রওনা দিলে আমাদের বাসায় যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। তাই তোমায় ডাক দিলাম।’
-‘খুব ভালো করেছো।’
হিমু মনে মনে অনেক খুশি হলো। এই ভেবে যে বর্ষা ওকে একটু হলেও ভালোবাসে। ওর জন্য এতোদুর চলে এসেছে। এতো কিছু করেছে। এই সুযোগে তো ও রায়ানের কাছেও যেতে পারতো! কিন্তু সেটা করেনি! ভাবতেই হিমুর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।

বর্ষা বাইরে থেকে হিমুর কাপড় গুলো এনে দিয়ে ওকে পরতে বলল।

হিমু রেডি হয়ে বর্ষার সাথে রুম থেকে বের হলো। ওর শরীর এখনো অনেক দুর্বল। তাই বর্ষা ওর হাত ধরে রেখেছে। হিমু বাড়ির আঙিনায় বের হয়ে কিছুটা দ্বিধা বোধ করতে করতে বলল-
-‘যাওয়ার আগে একবার কুসুমকে বলে গেলে হতোনা?’
-‘ও তো ঘুমিয়ে পড়েছে। আমায় ডাকতে না করেছে। ওর শরীর টা অনেক খারাপ। এতোদিন ঠিক মতো ঘুম হয়নি। তবু চলো ওর রুমে গিয়ে দেখি ঘুম থেকে উঠেছে কিনা।’
-‘চলো!’

কসুমের রুমে ঢুকে বর্ষা ওকে দুইবার ডাকলো। কিন্তু ওর কোন সারা শব্দ পেলো না। মৃত মানুষ সারা দিবে কিভাবে? হিমু বর্ষাকে থামিয়ে দিয়ে বলল-
-‘থাক আর ডাকিওনা। মনে হয় গভীর ঘুমে আছে। তোমার সাথে যখন কথা হয়েই গেছে তখন আর কথা বলা লাগবেনা।’
-‘হুম। তার মধ্যে এটা রায়ানের এলাকা। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যাওয়ায় ভালো।’
-‘ঠিক ই বলেছো।’

হিমু বর্ষাকে নিয়ে চলে যেতে লাগলো। তারপর বিকেলের ট্রেন ধরে ওরা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

দুইজন পাশাপাশি বসে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। হিমু যেচে বলল-
-‘তোমার কি মুড অফ? নাকি কুসুমের সাথে আমায় ঐ বাসায় একাই….
হিমুকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বর্ষা বলল-
-‘তুমি কার সাথে থাকলে না থাকলে সেটা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমি ঐসব নিয়ে কিছু মনেও করিনি!’

কথাটা যতো সহজে বর্ষা বলতে পারলো ততো সহযে যদি মেনে নিতে পারতো তাহলে হয়তো ভালোই হতো। কিন্তু না। ওর ভেতরে এই বিষয়টা নিয়ে ঝর বয়ে যাচ্ছে। তবু সে হিমুকে কিছু বলতে পারছেনা। কারন সে চায়না হিমু বুঝতে পারুক যে সে হিমুকে কতোটা ভালোবাসে।

বর্ষার কথা শুনে হিমুর মনটা ভেঙে গেলো। একটু আগেও ওর মনে বর্ষাকে নিয়ে কতো জল্পনা কল্পনা চলছিলো। আর এখন সেটা নিমিষেই নষ্ট হয়ে গেলো। বর্ষা যে ওকে একটুও ভালোবাসেনা! ভাবতেই হিমুর মুখটা কালো মেঘের ছায়ায় ঢেকে গেলো। ও চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইল।

বর্ষা সেটা বুঝতে পেরে হিমুর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল-
-‘একটা বিষয় খেয়াল করেছো?
-‘কি?’
-‘তুমি আমায় তুমি তুমি করে বলছো!’
হিমু কোন উত্তর দিলোনা। চুপ করে রইলো। বর্ষা ওকে চুপ থাকতে দেখে বলল-
-‘কি ভাবছো?’
-‘না তেমন কিছু না। আমি ভাবছি তুমি তো রায়ান কে অনেক ভালোবাসো, এই সুযোগে তুমি ওর কাছে যেতে পারতে, তাহলে গেলে না কেনো? তুমি তো জানো ও তোমাকে পাওয়ার জন্য আমার সাথে ঐরকম করেছিলো?
-‘হুম জানি। কুসুম আমায় প্রায় সব বলেছে। আমি রায়ানকে যতোই ভালোবাসিনা কেনো। এখন তুমি আমার স্বামী। ওর কাছে গিয়ে তোমার সাথে অতো বড় অন্যায় করতে পারবো না। আগে যা হয়েছে হোক। এখন আর আমি ওকে চাইনা!’
-‘ওহ্, তাহলে তুমি এখনো ওকে ভালোইবাসো?’

বর্ষা কোন উত্তর দিলোনা। কারন বর্ষা নিজেই চাচ্ছে হিমু বুঝুক সে রায়ান কে ভালোবাসে। সেখানে উত্তর দিয়ে কি লাভ। দুজনের মধ্যে আর কোন কথা হলোনা।

কুসুমের প্রাইভেট নাম্বার বন্ধ পেয়ে ওর দুই বোন তাড়াহুড়া করে বাসায় ছুটে আসলো। এসে দেখলো সব দরজা খোলা। হিমুকে যে রুমে রাখা হয়েছিল সেই রুমে গিয়ে দেখলো হিমু নেই। কুসুমের রুমে এসে দেখলো কুসুম শুয়ে আছে। প্রথমে ওরা ভাবলো হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। তাই ডাকতে লাগলো কিন্তু অনেক ডাকাডাকির পরেও যখন সে উঠলো না তখন ওরা ভালো করে চেক করে দেখলো কুসুমের শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আছে। আর ঘাড় দিয়ে রক্ত বয়ে বয়ে পরছে।

তবু তাড়াহুড়া করে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার জানালো সে অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছে।

ওরা তাল সামলাতে না পেরে হিমুর কাছে কল দিলো। কারন ওরা বুঝতে পেরেছিলো এটা খুন। কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। হিমু তখন ওর ফ্যামিলির সাথে বসে গল্প করছিল। মিথ্যা গল্প বানিয়ে বলছিলো এই দুইদিন কোথায় ছিলো, ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ কুসুমের নাম্বার থেকে কল পেয়ে সে সাথে সাথে রিসিভ করলো-

-‘হ্যালো?’
-‘আপনি কি হিমু বলছেন?’
-‘জ্বী, আপনি কে?’
-‘আমি কুসুমের বোন। আজ দুপুরে কুসুম মারা গেছে, আই মিন তাকে হত্যা করা হয়েছে। আর আপনিও বাসা থেকে উধাও। বিষয় টা কেমন অদ্ভুত লাগছে না?’
কুসুমের মৃত্যুর কথা শুনে হিমু আকাশ থেকে পড়লো। ও কোন কথা বলতে পারছিলো না। এমন সুস্থ স্বাভাবিক একটা মানুষের মৃত্যু, তাও আবার হত্যা!

বর্ষা ওর পিছে এসে এতক্ষণ সব কথা শুনছিলো। হিমুর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বর্ষা লাইন টা কেটে দিলো। হিমু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-‘লাইন কেটে দিলে যে?’
-‘আমরা দুজন ওখানে গিয়েছিলাম। আর ওরা এখন আমাদের দুজনকেই সন্দেহ করবে। তুমি তো জানো আমরা দুজনেই নির্দোষ। কিন্তু ওরা কি সেটা মানবে? তাই আমাদের ভেবে চিন্তে পরে কথা বলতে হবে!’

হিমু আর কিছু বলল না। সোজা ওর রুমে চলে গেলো।

বর্ষা তাড়াহুড়া করে ওর ফ্রেন্ডের কাছে কল দিয়ে রায়ান ও তার ফুফুকে ছেড়ে দিতে বলল! আর রায়ানকে ফোনে বলল-
-‘তোর ফুফু কে তুলে আনতে, তোর কাছ থেকে হিমুকে গুম করতে কুসুম ও তার দুই বোন আমায় সাহায্য করেছিলো। so, একটু সাবধানে থাকিস। কাছের মানুষের দ্বারাই কিন্তু মানুষ বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়, বুঝলিই তো!!
বলেই বর্ষা লাইটা কেটে দিলো।
রায়ান রাগে ক্ষোভে ফেটে পরতে লাগলো।

রাত তখন দুইটার কাছাকাছি। হিমুর মন খারাপ। দুশ্চিন্তাই ওর ঘুম ধরছিল না। শুয়ে শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ ফিরছিলো। বর্ষা ঘুমে বিভোর। একটু পর হিমুর নড়াচড়াতে ওর ঘুম ভেঙে গেলো। ও ঘুম ঘুম চোখেই হিমুর গলা জড়িয়ে ধরে বলল-
-‘কুসুমের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি?’
-‘নাহ, ওর জন্য কেনো কষ্ট হবে?’
হিমু বুঝতে পারলো বর্ষা ঈর্ষান্বিত হয়ে কথাটা বলল!
-‘তাহলে এতো দুরত্ব কেনো? স্বামী যখন অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায় তখন বউয়ের সাথে দূরত্ব তৈরি করে, তাইনা বলো?’

হিমুর শরীর দুর্বল। তার উপরে সে দুশ্চিন্তাই ভরাক্রান্ত। তবু সে বর্ষার কথা শুনে রাগে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না।
রাগান্বিত হয়ে বলল-
-‘আমার মনে শুধু তোমারই বসবাস। আমার মন টা এতো সস্তা না যে প্রয়োজনের তাগিদে কাওকে দিয়ে দিবো!’
এমন খোঁচা মারা কথা শুনেও বর্ষা মনে মনে খশিতে ফেটে পরলো। কারন সে এটাই তখন থেকে শুনতে চাচ্ছিলো। বর্ষা হিমুকে জড়িয়ে ধরলো।

হিমু আর কোন কথা না বাড়িয়ে বর্ষার মাঝে ডুবে যেতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎই একটা মেয়েলী কন্ঠে কান্নার শব্দ শুনে দুজনেই থমকে গেলো। এমন অদ্ভুত কন্ঠস্বর ওরা আগে কখনো শোনেনি।

To be continue…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here