দ্বিতীয় জন 💔,পর্ব দশ (শেষ পর্ব)
Sumana Easmin
বর্ষা ভয় পেয়ে হিমুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। হিমু অনিচ্ছা সত্ত্বেও বর্ষার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে রুমের ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো। যেখানে ছাদ থেকে রক্ত পরছিলো।
হিমু সেখানে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই রক্ত পরা বন্ধ হয়ে গেলো। বর্ষা বিছানা থেকে তাড়াহুড়া করে উঠে এসে হিমুর পেশে দাঁড়ালো। বর্ষার ভেতর ভয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। হিমু বর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে সেটা আন্দাজ করতে পেরে ওকে বলল-
-‘তুমি গোসল সেরে ফ্রেস হয়ে নাও। আমি ছাদে গিয়ে দেখি ঘটনা টা কি!’
-‘আমার খুব ভয় করছে হিমু। আমি এখন একাই বাথরুমে ঢুকে গোসল করতে পারবোনা।’
বর্ষা ছোট বাচ্চাদের মত আবদারের সুরে কথাগুলো বলল। হিমু বর্ষাকে আশ্বস্ত করার জন্য ওর এক হাত ধরে বলল-
-‘ছাদে মনে হয় অনেক পানি জমে গেছে। তাই ওগুলো পরছে। তুমি একদম ভয় পেওনা। এই ভরদুপুরে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তুমি না হয় মার রুমের বাথরুমে গিয়ে গোসল সেরে নাও।’
-‘সে না হয় যাচ্ছি। কিন্তু তুমি কি এখন ছাদে যাবে?’
-‘হুম!’
-‘না, তুমি যেওনা! আমার কাছে এগুলো সব অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে! প্লিজ তুমি যেওনা। এখন তো আর কিছু পরছে না।’
-‘আচ্ছা এখন না পরুক। একটু আগে তো পরলো। দেখে আসতে সমস্যা কি? আর আমি তো একাই যাবো না, আমজাদ (কাজের লোক) চাচাকে নিয়ে যাবো!’
বর্ষা আর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
হিমু তার আমজাদ চাচাকে নিয়ে ছাদে চলে লাগলো। রুমের ঠিক যে যায়গাটায় রক্ত পরেছিলো হিমু সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। সেখানে সে কোন জমে থাকা পানি বা রক্ত জাতীয় কিছুই দেখতে পেলো না। বরং যায়গাটা একদম শুকনো দেখতে পেলো।
হিমুর ভেতরে কিছুটা ভয় কাজ করতে লাগলো। সে আর বেশিক্ষণ দেরী না করে সোজা রুমে চলে আসলো। রুমের ভেতরে ঢুকতেই সে দেখলো গোটা ফ্লোর রক্তে ডুবে আছে। লাল-কালচে রংয়ের রক্ত। এই দৃশ্য দেখে ভয়ে ওর শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো। ওর দম অলরেডি আটকে গেছে। ও কোন রকমে রুম থেকে বের হয়ে ওর মায়ের রুমে যেতে লাগলো।
হিমুর মা তখন রুমে বসে পেপার পরছিলো। হিমুকে অমন হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে আসতে দেখে উনি পেপার রেখে হিমুকে গিয়ে ধরলেন। হিমু ওর মায়ের কাঁধে মাথা রেখে টলিয়ে পরলো।
একটু পর ওর অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে ও নিজ থেকেই বলল-
-‘মা আমার রুমে নিশ্চয় কোন অশরীরী আছে। আমি এখনি গোটা ফ্লোর ভর্তি রক্ত দেখে আসলাম। এমনকি ছাদ থেকেও রক্ত পরতে দেখেছি!’
হিমুর মা একটু ঘাবড়ে গেলো বটে। তবে নিজে চোখে কিছু না দেখা পর্যন্ত তিনি ভয় পাওয়ার বান্দা নন। তাই তিনি হিমুকে ওনার রুমে রেখে গিয়ে কাজের মহিলাকে নিয়ে হিমুর রুমে যেতে লাগলেন।
রুমের দরজা খোলায় ছিলো। উনি ধীরে ধীরে রুমের সামনে গিয়ে দেখলেন ফ্লোরে কোন রক্ত নেই। আর ছাদেও কোন রক্ত লেগে নেই। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজের মহিলাকে বললেন-
-‘জানিস রহিমা, হিমুর মাথাটা দিনে দিনে আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যতোই দিন যাচ্ছে ততোই যেনো ও ছোট বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে!’
-‘হ আফনে ঠিক ই কইছেন। কাল রাতে দেখলাম ঐ পুষ্করিণীর পাশে গিয়া পায়চারী করতাছে!’
এদিকে বর্ষা গোসল সেরে বাথরুমে থেকে বের হতেই দেখে হিমু ওর মায়ের বিছানায় শুয়ে আছে। ও হিমুর কাছে গিয়ে পার্শে বসে বলল-
-‘কি হয়েছে? তোমার মুখ এমন শুকনা দেখাচ্ছে কেনো?’
হিমু আসল ঘটনাটা লুকিয়ে বলল-
-‘আমার শরীর টা একটু খারাপ করছে তাই!’
-‘ওহ্ আচ্ছা! গোসল দাও যাও। তারপর একটা ঘুম দিও। তাহলেই ঠিক হয়ে যাবে। আমি কাপড় শুকাতে দিতে গেলাম।’
-‘আচ্ছা!’
একটুপর হিমুর মা রুমে এসে বললেন-
-‘তোর মাথাটা না দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কই আমি তো রুমে গিয়ে রক্তের কোন ছিঁটে ফোঁটাও দেখতে পেলাম না। কয়েকদিন থেকে তোর শরীরে জ্বর যাচ্ছে এই জন্য এমন হচ্ছে।’
হিমু ওর মায়ের কথায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলো। ও বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল-
-‘তোমার কথাই যেনো ঠিক হয় মা!’
-‘তা নয়তো কি!’
হিমু গোসল করার জন্যে বাথরুমে চলে গেলো। পুরো গায়ে সাবান মেখে নিয়ে সে ঝরনা টা ছেড়ে দিলো। তারপর চোখ বন্ধ করে স্থির হয়ে ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে রইল। আর সে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো ভাবতে লাগলো। হঠাৎ সে খেয়াল করলো গায়ে ঠান্ডা পানির বদলে গরম কিছু পরছে। সে সাথে সাথে চোখ মেলিয়ে দেখলো ওর গোটা শরীর রক্তে মেখে আছে। ভয়ে ও জাস্ট জোরে একটা চিৎকার দিয়েই সেন্সলেইস হয়ে পরে গেলো।
ওর চিৎকার শুনে সবাই ছুটে গেলো বাথরুমের কাছে। বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে লক করে দেওয়ায় ওরা দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকলো। কিন্তু ওরা ভেতরে কোন অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পেলোনা।
হিমুর জ্ঞান ফিরলে সবাই ওর কাছ থেকে জানতে চাইলো বাথরুমে চিৎকারের কারন টা। কিন্তু ও কাওকে কিছু বলল না। জাস্ট শরীর খারাপের কথা বলে কেটে দিলো। কারন বললে প্রথমত বর্ষা ভয় পাবে আর দ্বিতীয়ত বাড়ির সবাই আতঙ্কের মধ্যে থাকবে।
বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আর তেমন কোন অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে বর্ষা ও হিমু শুয়ে পড়লো।দুজনের চোখের পাতায় ঘুম নেই। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকার পর হিমু বলল-
-‘বিয়ের পর থেকে একটার পর একটা সমস্যা লেগেই আছে। একটা দিন ও শান্তি মতো কাটাতে পারলাম। বর্ষা হিমুর বুকে মাথা রেখে বলল-
-‘এখন তো কোন সমস্যাই নেই। তুমি এখন কেনো এতো ঘাবড়ে যাচ্ছো বুঝতে পারছি না।’
হিমু আসল কথা লুকিয়ে ফেলে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলল-
-‘না এখন তো কোন সমস্যা নেই। তবু ভয় হয়, আবার না জানি কোন সমস্যা দানা বাঁধে!’
-‘আর কোন সমস্যাই দানা বাঁধবে না সোনা দেখে নিও!’
হিমু কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল-
-‘হয়তো বা। তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে!’
-‘কি?’
-‘আমি কাল থেকে বাবার ফ্যাক্টরী তে জয়েন করতিছি। এখন থেকে সব কিছু আমিই দেখা শুনা করবো।’
-‘হঠাৎ কি মনে করে এমন সিদ্ধান্ত নিলে?’
-‘বাবার বয়স বাড়ছে, আর কতোই না না করে কেটে দেই বলো!’
-‘হুম!’
কিছুক্ষণ গল্প শেষে হিমু লাইট অফ করলো। বর্ষা হিমুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। হিমু বর্ষার শরীরে আদরের হাতে স্পর্শ করতেই বর্ষা ওকে কিস্ করলো। তারপর হিমুকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো-
-‘আমার শরীর টা খুব খারাপ লাগছে।’
হিমু বর্ষার কপালে একটা কিস্ করে বলল-
-‘হুম, বুঝতে পারছি!’
মাঝরাতে কারো পায়ের শব্দ শুনে বর্ষার ঘুম ভেঙে গেলো। সে ধীরে ধীরে চোখ মেলাতেই দেখলো ওর সামনে কুসুম দাঁড়িয়ে আছে। ওর শরীর থেকে রক্ত মাংস গলে গলে পরছে।
বর্ষা সে দৃশ্য দেখে সর্বশক্তি দিয়ে চিল্লানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা। ওর মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। এমনকি ও কোনপ্রকার নড়াচড়াও করতে পারছে না। ওর শরীর শুধু থরথর করে কাঁপছে। আর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে।
একটু পর কুসুম বর্ষার শরীরের মধ্যে ছাঁয়ার মতো হয়ে প্রবেশ করলো। তখন বর্ষার মনে হলো যেনো কেউ ওর শরীর টা ছিড়ে দুই ভাগ করে ওর মধ্যে প্রবেশ করছে।
সে প্রচন্ড যন্ত্রণায় সেন্সলেইস হয়ে গেলো।
শেষ রাতের দিকে বর্ষার ডাকে হিমুর ঘুম ভেঙে গেলো। সে চোখ বন্ধ করেই রাখলো। বর্ষা ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো-
-‘আই লাভ ইউ হিমু….!
হিমুর তখনো পুরোপুরি ঘুম ভাঙেনি। তাই সে চোখ না মেলিয়েই বলল-
-‘এই শেষ রাতে তোমার আবার কি হলো?’
-‘তোমার স্পর্শ খুব মিস্ করছি!’
হিমু বিরক্ত হয়ে বলল-
-‘তোমার নাকি শরীর খারাপ?’
-‘আমি কখন বললাম?’
বর্ষার কথা শুনে হিমুর ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেলো। সে চোখ মেলিয়ে বর্ষার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো। ওর দুই চোখ রক্তের মতো লাল হয়ে আছে। তার চেয়েও বেশি অবাক হয়ে ও বর্ষাকে জিজ্ঞেস করলো-
-‘ঘুমানোর আগে কি বলে ঘুমিয়েছিলে ভুলে গেছো?’
-‘হুম ভুলে গেছি!’
-‘তাহলে আর কি করার। আমায় ঘুমাতে দাও! এখন আমার খুব ঘুম পাচ্ছে!’
বর্ষা আর কিছু বলল না। ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে হিমু অফিস চলে গেলো। আর বর্ষারুপি কুসুম ঘরকন্নার কাজে লেগে পরলো।
[সমাপ্ত]