কুঞ্জবাড়ি,পর্ব ১

কুঞ্জবাড়ি,পর্ব ১
মাহফুজা মনিরা

-” মিঃ নেহাল,ইউ আর প্রেগন্যান্ট!!”

ডক্টর আদিত্য বললেন ভীষণ উত্তেজিত ভাবে৷ নেহাল হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিল লম্বা হয়ে। কথাটা শোনামাত্রই সে লাফিয়ে উঠে বসলো৷ মুখে তীর্যক ভাব রেখে জিজ্ঞেস করে,
-” হোয়াট ইজ দিস ডক্টর? জোক করতেছেন আমার সাথে?”
-” আজব! আমি কেনো জোক করবো আপনার সাথে? রিপোর্টে যা বলছে তাই তো জানালাম।”

নেহাল বিষ্মিত চোখে তার পাশে বসে থাকা স্ত্রী চন্দ্রিকার দিকে তাকায়। চন্দ্রিকা ভয়ার্ত চোখে নেহালের দিকে তাকিয়ে। ডক্টর বিড়বিড় করলেন,
-” ও গড! হাও ইজ দিস পসিবল!!”
নেহাল বলল,
-” আমার মনে হয়,কোনো মহিলার রিপোর্ট আর আমার রিপোর্ট নিয়ে ঝামেলা হইছে। নয়তো একজন পুরুষ হয়ে আমি কীভাবে প্রেগন্যান্ট হবো বলেন?”
ডক্টর আদিত্য একমুহূর্ত কিছু একটা ভেবে বললেন,
-” আপনি বসুন৷ আমি আপনার আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করানোর ব্যবস্থা করছি।”
.
নতুন বাসায় উঠার কয়েকদিন পর থেকে নেহালের পেটে অত্যন্ত ব্যথা। সকাল সকাল, অথবা বিকালের পর ব্যথা টা যেন হঠাৎই বাড়তো। নেহাল প্রথমে ভেবেছিল গ্যাস্ট্রিক। ওষুধ নিতো নিয়ম করে। কিন্তু ব্যথার পরিবর্তন হলো না। চন্দ্রিকা চাল পোড়া পানি পর্যন্ত খাইয়েছিল ব্যথা গায়েব করার জন্য। তার মতে,তাদের গ্রামে এই টোটকা ওষুধ পেটের যেকোনো ব্যথা সমাধানের জন্য একেবারে খাটি! অথচ সেটাতেও যখন কাজ না হয়ে উল্টো ব্যথা দিনকে দিন বাড়ছিল, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নেহাল তখন চলে আসে হাসপাতালে। ডাক্তার দেখাতে…অথচ এরা! কি বলছে?
.
আল্ট্রাসোনোগ্রাফির ব্যবস্থা করা হলো। এবার ডক্টর আদিত্যর সাথে ডক্টর সাকিবও যোগ দিলেন। চিন্তিত ভাবে বেডের উপর শুয়ে থাকে নেহাল। তার পেটে কিছু ওষুধ মাখানো হয়। তারপর একটা মাউসের মতো মেশিন ঘোরানো হলো…
ডক্টর দুজন,নেহাল,চন্দ্রিকা… সকলেই শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় কম্পিউটার মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ…একটা কিছু ভেসে উঠে মনিটরে। হালকা হালকা নড়ছে জিনিস টা। ডক্টর আদিত্য আর সাকিব একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। নেহাল আংতক নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” ওটা কি আমার পেটে?”
-” আপনার বাচ্চা মিঃ নেহাল। যার বয়স ২ মাস! অথচ…অথচ কতটা বড় হয়ে গেছে মাত্র দুমাসেই..!!”

চন্দ্রিকার চোখে পানি টলমল করে। এ কোন মুসিবতে পড়লো তারা! আর নেহাল বিষ্ময়ে হতবাক। ডক্টর সাকিব বলল,
-” কেস টা জটিল। আপনারা বাড়ি ফিরে যান। আমরা বোর্ড মিটিং বসাবো এব্যাপারে।”

.

দরজার তালা খুলে গুটিগুটি পায়ে ঘরে ঢোকে দম্পতি। নেহাল কোনোমতে হেটে এসে ডায়নিং টেবিলে ধপ করে বসে পড়ে। গ্লাসে পানি ঢেলে এক নিশ্বাসে খেয়ে ফেলে তা….চন্দ্রিকা পাশের চেয়ারে বসে নিঃশব্দে কাঁদছে। অনেক ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা। নেহাল নিজেও কি কম ভয় পেয়েছে নাকি!

চন্দ্রিকার একহাতের উপর হাত রেখে নেহাল আশ্বতের গলায় বলল,
-” চন্দ্রি…চন্দ্রি কাঁদে না প্লীজ। আমরা কাল অন্য হাসপাতালে যাবো। হতে পারে মেশিন টাই খারাপ ছিল!! সব ঠিক হয়ে যাবে। প্লিজ কাঁদে না।”

চন্দ্রি সেসব কথার পাত্তা দিলো না। কান্নারত অবস্থায় বলল,
-” আমি আগেই বলেছিলাম তোমায়। এই বাড়িটায় কোনো সমস্যা আছে। কিন্তু তুমি শুনো নাই। এখন বুঝো!! কোথা থেকে কি হয়ে গেলো…!”

নেহাল শুকনো মুখে রুমটায় চোখ বুলায়। এখন তো তারও মনে হচ্ছে এই বাসাটাই যত গন্ডগলের মূল…..
.
৩ মাস আগে….
নেহালের অফিস আর তার বাসার দূরত্ব অত্যন্ত বেশি!! যারফলে প্রতিদিন অফিস যেতে তার দেড়ি হয়। আর ফলাফল বসের ঝারি,বেতন থেকে টাকা মাইনাস। তাই বাসা খুঁজতে নেমে পড়ে নেহাল। পেয়েও যায়। তার অফিস থেকে মাত্র বিশ মিনিটের দূরত্বেই একটা বাড়ি। বাড়িটা একতলা। চারটে রুম। দুটো তালা মারা,আর দুটো রুম খোলা। বাড়িটার সামনে বিছানো ছোট একটা বাগান। পেছনে একটা পুকুর,তাতে বাধানো সিড়ি। আর সারি সারি নারিকেল গাছ! নেহালের অনেক মনে ধরে বাড়িটা। পরেরদিনই গাট্টি বোস্তা নিয়ে হাজির হয় বাড়িতে। চন্দ্রিকারও পছন্দ হয় ভীষণ। এরকম একটা নির্জন নিরিবিলি বাড়িই সে খুঁজছিল এতদিন যাবত। এরকম বাড়িতে লেখালেখি করে শান্তি আছে। ফেসবুকে টুকটাক লেখালেখি করে চন্দ্রিকা। তবে সামনের বইমেলায় তার বই আসবে…

ভ্যান ওয়ালা এবং নেহাল মিলে ঘরে আসবাবপত্র আনছে। গোছাচ্ছে। চন্দ্রিকার কোনো কাজ নেই তাই সে হেটে হেটে চলে আসে বাড়ির পেছনটায়…পুকুরের কাছে। পুকুরের পানিটা স্পষ্ট নীল। যেন কেউ নীল রং ঘঁষে ঘঁষে লাগিয়ে রেখেছে। চন্দ্রিকা ধীর কণ্ঠে বিড়বিড় করে,
-” হোয়াও! এত সুন্দর পুকুর!!”
একটা প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে সে। হেটে হেটে পুকুরের আরো সামনে যায়। সিড়ি বেয়ে নামতে থাকে নিচে। এমন সময় পেছন থেকে চেঁচিয়ে ডাকে নেহাল,
-” চন্দ্রি….এই চন্দ্রি।”
চন্দ্রিকার সম্মোহন ছুটে যায়। সে তাড়াহুড়ো করে উঠে আসে উপরে। নেহাল ঘামে ভেজা কর্কশ কণ্ঠে বলে,
-” একটু কাজে হাত তো লাগাও! এখন থেকে তো এখানেই থাকবা। ঘুরেঘুরে দেখার সময় পাবা অনেক….”
চন্দ্রিকা সেসব কথা আমলে না নিয়ে পাল্টা বলল,
-” দেখো না। পুকুর টা কি জোস! পুরাই নীল। আমি আমার লাইফে এত নীল পুকুর দেখি নাই।”
নেহাল তাকায় পুকুরের দিকে। সে খেয়ালই করেনি এতক্ষণ। আসলেই তো! পুকুর টা অনেক নীল! নেহাল সেদিকে কতক্ষণ চেয়ে থেকে শক্ত গলায় চন্দ্রিকাকে বলল,
-” একদম পুকুরের ধারে কাছে যাবা না। বুঝছো?”
চন্দ্রিকা মুখ বাকায়।
-” কেনো? কেনো যাবো না?”
-” বিষের রং ও কিন্তু নীল হয় চন্দ্রি। আমার কাছে পুকুরের এই রং একেবারেই সুবিধার লাগছে না। তুমি বরং এর আশেপাশে যেও না৷ কেমন?”
চন্দ্রিকা হাসলো।
-” তুমি বলতে চাইছো এটা একটা বিষাক্ত পুকুর?”
-” বলতে চাইছি না। বলছিই…”
-” ধুরো! পুকুর আবার বিষাক্ত হয় নাকি!”
-” হয় হয়। এবার৷ কথা বাদ দিয়ে ভেতরে আসবেন মহারাণী? একটু কাজে হাত লাগান। আমার দুপুরের মধ্যে সব গুছিয়ে অফিস যেতে হবে। খুব জরুরি একটা মিটিং আছে।”
-” হুম হুম। লাগাচ্ছি হাত…”
.
সকল আসবাবপত্র জায়গামতো সেট করে,টুকটাক ঘরের কাজে হাত লাগিয়ে নেহাল অফিসের উদ্দেশ্যে চলে যায়। ফিরতে সন্ধ্যা হবে তার…

চন্দ্রিকার ক্লান্ত লাগছিল ভীষণ। তাই আগে ঢোকে বাথরুমে। গোসল করার জন্য। বাথরুম টাও আদিকালের ডিজাইনের তবে বেশ বড়। পাক্কা তিরিশ মিনিট সময় নিয়ে স্নান সাড়ে। ভিজে চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে আসে রান্নাঘরে। রান্না করার জন্য….
গরম ভাত, ঝাল আলু ভর্তা, ভেন্ডি ভাজি আর বেগুন ভাজা। শর্টকাটে রান্না শেষ করে। দুপুর গড়িয়ে পড়ন্ত বিকেল সময়টা…শরীর নুইয়ে যাচ্ছে বারে বার। চন্দ্রিকা বিছানায় এসে শুতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।
.
ম্লান আলো আসছে ভেতর থেকে। চন্দ্রিকা কাঁপা কাঁপা পায়ে সেদিকে আগায়। ভেতর থেকে একটা মেয়ের তীব্র গোঙানি স্পষ্ট। চন্দ্রিকার পায়ের সাথে সাথে এবার হৃদয়টাও কাঁপতে শুরু করে। ধকধক ধকধক করছে বুকের ভেতরটা। রুমের ভেতরে ঢুকতেই দেখে একটা মেয়ে,তার হাত পা বিছানার সাথে বেধে ফেলে রেখেছে। শরীরে একটা সুতো পর্যন্ত নেই…আর দুইটা ছেলে,মেয়েটার জরায়ুমুখে কিছু একটা ঢুকিয়ে ভেতর টা ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে। চন্দ্রিকার শরীর টা ভয়ে কেঁপে উঠে থরথর করে। চেঁচিয়ে বলে,
-” প্লীজ স্টপ ইট…”
ছেলে দুটো কিন্তু থামে না। তাদের কাজ তারা চালিয়ে যায়….
চন্দ্রিকা পেছন ফিরে দৌঁড় লাগায়। অথচ রাস্তা আর ফুরায় না!
.
বুকটা হাপড়ের মতো উঠানামা করছে। ঘুম ছুটে যায়। চন্দ্রিকা ধড়ফড় করে উঠে বসে। বাহিরে ভরা সন্ধ্যা। আকাশের আলো নিভে যাচ্ছে ধীরে ধীরে…পশ্চিমে কেউ লাল কমলাটে রং ঘঁষে দিয়েছে যত্ন সহকারে…

চন্দ্রিকা ডায়নিং রুমে এসে পানি খায়৷ ক্ষিদেই পেট চো চো করছে তার। রান্নাঘরে আসে। একটা প্লেটে ভাত বাড়ে। একটু আলু ভর্তা তুলে নেয় পাতে…বেগুন ভাজা যেই বাটিতে রেখেছিল সেটার ঝাপ খুলতেই দেখে একটা বেগুনও নেই। সব হাওয়া….
একটা শীতল ঘাম ফোঁটা চন্দ্রিকার শিরদাঁড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। বাসায় শুধুমাত্র সে একা। তবে কে খেল? তন্নতন্ন করে সব বাটি,পেয়ালা,পাতিলে খুঁজতে থাকে কিন্তু বেগুন ভাজা হাওয়া মানে একেবারেই হাওয়া…..

দূর আকাশে স্পষ্ট আল্লাহর আজান ভেসে আসে। চন্দ্রিকা মাথায় কাপড় তুলে নেয়। ভয়ে বুকটা ধড়ফড় করছে আবারো। এমন সময় বাজে কলিংবেল…চন্দ্রিকা দৌড়ে এসে দরজা খুলে। নেহাল দাঁড়িয়ে। চন্দ্রিকা এক সেকেন্ড সময় নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষের বুকটায়….

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here