দৃষ্টির অগোচরে,১৫ তম_পর্ব,১৬ তম_পর্ব

দৃষ্টির অগোচরে,১৫ তম_পর্ব,১৬ তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
১৫ তম_পর্ব

এই খোঁজখবর নেবার একটা সময় একজন একটা পাথরে কাগজ মুড়ে ছুড়ে মারে তৌহিদ কে। কাগজটা গায়ে লাগতেই তৌহিদ মাটি থেকে তুলে নেয় কাগজটা। কাগজটি খুলতেই দেখে সেখানে লেখা,
” স্নিগ্ধের সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে পুকুরের দিকে আসুন। প্রতিটা মূহুর্ত খুব মূল্যবান। বলা তো যায় না কখন কি হয়! তাই সন্ধ্যার আগেই পুকুরের কোনায় আসুন।”

গোটা গোটা হাতের লেখা। তৌহিদের মনে হলো কোনো বাচ্চা হয়তো লিখেছে। কাগজটা পেতেই তৌহিদ নুশরাতকে ইশারা করলো। নুশরাত চিরকুটটা পড়ে উগ্রিব কন্ঠে বলে,
– আমাদের পুকুরের কাছে খুব দ্রুত যেতে হবে। হয়তো কোনো ক্লু পাবো!

কথাটা বলেই নুশরাত হাটতে আরম্ভ করলে তৌহিদ তার হাত টেনে ধরে। নুশরাত অবাক চোখে তার দিকে তাকালে সে বলে,
– ওই জায়গাটা এখন নীরব থাকবে। সন্ধ্যা হবে হবে ভাব। এখন কলেজ ফাঁকা হচ্ছে। সাধারণত এই সময়ে ওখানে নেশা টেশা করে ছেলেপেলে। তাই আমার মনে হয় তোমার এখানে থাকাটাই বেশি জরুরি৷ আমি একাই যাবো!
– মানেটা কি? আমরা এখানে ইনভেস্টিগেশনে এসেছি। হতেই পারে এই চিরকুটের মানুষটির কাছে অনেক ইম্পোর্টেন্ট ক্লু রয়েছে যা কেসটাকে একটা দিশা দিবে৷ আমার ও সেখানে যাওয়াটা একই ভাবে জরুরি।
– নুশরাত জিদ করো না।
– আমি জিদ করছি না। আমি লিগ্যাল কথা বলছি। এখন প্রতিটি সুতো আমাদের জন্য ইম্পোর্টেন্ট। আর এমন তো নয় আমি কখনোই বিপদজনক কোনো কাজ করি নি! তাহলে এখন কি এমন মহাভারত উদ্ধার হয়ে গেলো?

তীব্র কন্ঠে প্রতিবাদতা করল নুশরাত। তৌহিদের চোয়াল ক্রমশ শক্ত হয়ে এলো। তৌহিদ এবার নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলো না। নুশরাতকে একটানে নিজের কাজে নিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– তুমি কখনোই তোমার এই জিদ টা কমাবে না তাই না? সব কিছুতে বাড়াবাড়ি, সব কিছুতে বাড়াবাড়ি। তোমার এই বাড়াবাড়ির জন্য একবার পগারপার হতে গিয়েছিলে। সেদিন যদি একমিনিট এদিক ওদিক হতো তাহলে আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে এত পটপট করার সুযোগ পেতে না। কে না কে চিরকুট টা পাঠিয়েছে! তার মতলব খারাপ ও হতে পারে। বলছি ওখানে আমার বিপদের আশঙ্কা হচ্ছে। তবুও তোমার কাছে তোমার জিদটাই প্রধান। কি হবে তুমি না গেলে! কি হবে আমার কথাটা একবার শুনলে! আমাকে তোনার মানুষ মনে হয় না তাই না!

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো তৌহিদ। তৌহিদের চোখে অভিযোগ এবং অভিমানের সংমিশ্রণ লক্ষ করলো নুশরাত। অন্য কেউ হলে হয়তো আরোও দু কথা শুনিয়ে দিতো কিন্তু তার সামনে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটি অন্য কেউ নয় বরং তৌহিদ। তৌহিদের একটি কথাও ভুল নয়। তৌহিদের সাথে তার সম্পর্কের ফাটলের কারণ ও তার এই জিদ। সেদিন যদি তৌহিদের কথা শুনে জিদটা না করতো তাহলে তাদের জীবনের সূন্দর মূহুর্তগুলো এতো ধোয়াশা হয়ে যেতো না। নুশরাত তৌহিদের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। নিচু গলায় বললো,
– আমি এখানে অপেক্ষা করছি। আপনি ওখানে যেতে পারেন।

তৌহিদের স্বম্বিত ফিরলো। হুট করে রাগ উঠাটা খুব বাজে স্বভাবে রুপান্তিত হয়েছে তৌহিদের। হুটহাট মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। নুশরাতের উপর রাগার ইচ্ছে তার ছিলো না কিন্তু হুট করেই মেজাজটা বিগড়ে গেলো। তৌহিদের আর নুশরাতের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছে হলো না। দ্রুত পায়ে পুকুরের দিকে রওনা দিলো৷ নুশরাতের উগ্রীব চোখজোড়া তৌহিদের যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো_________

পুকুরের কোনায় দাঁড়িয়ে রপ্যেছে তৌহিদ। কিছু ছেলেপেলে জোড়ো হয়ে সিগারেট, গাঁজা টানছে। যান্ত্রিক জীবনের আক্ষেপগুলো ধোঁয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। এখনো সূর্য অস্ত যায় নি, আকাশটা লাল হয়ে এসেছে। অথচ এই পাশটা একদম নীরব, গাছপালার ছায়ায় বেশ অন্ধকার লাগছে। এখনো চিরকুটের ব্যাক্তিটি এসে পৌছায় নি। তৌহিদ ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বিশ মিনিট হতে চললো তৌহিদ এখানে অপেক্ষ করছে। আযানের ধ্বনি কানে আসছে। হঠাৎ একটা কন্ঠ ভেসে উঠলো তৌহিদের কানে। পেছনে ফিরতেই বেশ চমকে যায় তৌহিদ। একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তৌহিদ আপাদমস্তক মেয়েটিকে দেখে নিলো। মেয়েটি একটি কালো সালোয়ার কামিজ পড়ে রয়েছে, মাথায় হিজাব পড়া। গোলগাল শ্যামবর্ণের চেহারা। বয়স স্নিগ্ধের মতো। তৌহিদের প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিলো এই মেয়েটি ই তাকে এখানে ডেকেছে। কারণ জায়গাটা এতোটাই নীরব যে কোনো মেয়ে এখানে এই সময়ে আসবে না। কিন্তু তার ধারণা ভুল করে মেয়েটি বলে উঠলো,
– আপনি স্নিগ্ধের সম্পর্কে জানতে এসেছেন, তাই না?
– হ্যা, তুমি চেনো ওকে?
– হ্যা, সবচেয়ে ভালো করে চিনি। আপনার যা জানার আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
– প্রথমে আমাকে এই প্রশ্নের উত্তর দাও এখানে ডাকলে কেনো আমাকে? তুমি তো সবার মাঝেই আমার সাথে কথা বলতে পারতে।
– পারতাম না, কারণ আমি চাই না আমার এবং স্নিগ্ধের সম্পর্ক কেউ জানুক।
– কেনো?
– আমি স্নিগ্ধকে ভালোবাসি। কিন্তু ওরা এটা জানতে পারলে আমাদের শান্তিতে থাকতে দিবে না। আমার সাথে একই কাজ করবে, স্নিগ্ধ সেটা চায় না।
– কে তোমাদের শান্তি দিবে না?
– তা আপনার না জানলেও হবে। স্নিগ্ধ খুনটা করে নি। বেচারা নিজেই প্রতিনিয়ত জীবন যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। একটা ছেলে যে কিনা প্রতিনিয়ত নিজের পরিচয় গড়ার চেষ্টায় রয়েছে সে অন্তত খুন করে নিজের জীবনটা নষ্ট করে দিবে না। ওইদিন ওর খুব অসুস্থ লাগছিলো। তাই বেচারা পড়াতেও যায় নি। ক্লাস করেই বাসার দিকে রওনা দিয়েছিলো। আমাকে বলেছিলো আজ নাকি সে স্যালারি পেয়েছে। খুব খুশি ও ছিলো। বাসায় টাকা পাঠাতে পারবে বলে। আপনার মনে হয় ছেলেটা খুন করবে?
– আমরা ইমোশনাল ওয়ে তে চিন্তা করি না। লজিক্যালি চিন্তা করি।
– এতোগুলো সাক্ষী পেয়েও আপনার লজিক লাগবে? এতোটা উন্নত হয়ে গেলো আইন। যেখানে রেপের প্রমাণ থাকলেও রেপিস্টরা বেঁচে যায়। সেখানে একটা ছেলে নির্দোষ তবুও তার নির্দোষিতার প্রমাণ ও রয়েছে তবুও আপনাদের হচ্ছে না!

রোবটের মতো কথাটা বললো মেয়েটা। মেয়েটা দেখতে ভয়ানক নয়, কিন্তু তৌহিদের গায়ে কেমন যেনো কাঁটা দিচ্ছে। মেয়েটির চাহনী একেবারেই ঠান্ডা। সে কথাগুলো যন্ত্রের মতো বলছে। তৌহিদ বিদ্রুপের স্বরে বললো,
– যদি স্নিগ্ধ নির্দোষ ই থাকে তবে তার আইডিটা ওখানে কি করছে?
– ওটা হারিয়ে গিয়েছিলো। ও কমপ্লেইন ও করেছিলো এডমিনিস্ট্রেশন অফিসে। আর কিছু?
– স্নিগ্ধের একজন বন্ধু ছিলো যে প্রায় রাতে থাকতো ওর মেসে। চেনো তাকে?
– স্নিগ্ধের কোনো বন্ধু নেই। এরা আমাদের তাদের সমপর্যায়ে ফেলে না। তাই আমাদের সাথে মিশতে চায় না তারা। আপনার আর কিছু জানতে ইচ্ছে করছে?
– নাহ
– তাহলে আমি আসছি। আমার সাথে কন্ট্যাক্ট করার চেষ্টা করবেন না। আমি কারোর সামনে আসতে চাই না।

বলেই মেয়েটা হনহন করে হাটা শুরু করলো। তৌহিদের দিকে ফিরে চাইলো না। তৌহিদ মেয়েটির নামটুকু জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলো। তার শরীরটা গুলোচ্ছে। কেনো এতোটা খারাপ লাগছে জানে না। হয়তো দুপুরে পেটে কিছু পড়ে নি তাই। তৌহিদ খুব কষ্ট করে নুশরাতের কাছে পৌছালো। খুব কষ্টে বললো,
– আলিফকে ফোন দাও

তারপর ই জ্ঞান হারালো তৌহিদ। তৌহিদের অবস্থা দেখে………

চলবে

দৃষ্টির অগোচরে
১৬ তম_পর্ব

– তাহলে আমি আসছি। আমার সাথে কন্ট্যাক্ট করার চেষ্টা করবেন না। আমি কারোর সামনে আসতে চাই না।

বলেই মেয়েটা হনহন করে হাটা শুরু করলো। তৌহিদের দিকে ফিরে চাইলো না। তৌহিদ মেয়েটির নামটুকু জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলো। তার শরীরটা গুলোচ্ছে। কেনো এতোটা খারাপ লাগছে জানে না। হয়তো দুপুরে পেটে কিছু পড়ে নি তাই। তৌহিদ খুব কষ্ট করে নুশরাতের কাছে পৌছালো। খুব কষ্টে বললো,
– আলিফকে ফোন দাও

তারপর ই জ্ঞান হারালো তৌহিদ। তৌহিদের অবস্থা দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায় নুশরাত। কিছুক্ষণ আগেও লোকটা সুস্থ ছিলো। নুশরাত পাগলের মতো তৌহিদকে ডাকছে কিন্তু তৌহিদের কোনো সাড়া পেলো না। রাতের আধার গাঢ় হচ্ছে। তৌহিদের নিস্তেজ শরীরটা নুশরাতের কোলে পড়ে মাথা রেখে পড়ে রয়েছে। অজান্তেই নুশরাতের চোখ থেকে পানি পড়ছে, এটা ভয় নাকি চাঁপা চিন্তার বহিঃপ্রকাশ তা সে জানে না______

রাত ৯টা,
পিটপিট করে চোখ খুলে তৌহিদ। মাথাটা ঝিম ধরে রয়েছে। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভূত হচ্ছে। নাকে ফিনাইলের তীব্র গন্ধ পাচ্ছে সে। সাদা দেয়ালে ঘেরা একটি রুমটির ঠিক এক কর্ণারে একটা সাদা বিছানায় শুয়ে রয়েছে তৌহিদ। মাথাটা হালকা তুলে আশেপাশে ভালো করে দেখে নিলো সে। এটা হাসপাতাল, তার মতো আরো ৫-৬ জন রোগী রয়েছে। হঠাৎ খেয়াল করলো, তার ঠিক পাশে নুশরাত হাতের উপর মাথা রেখে চোখ বুজে বসে রয়েছে। তৌহিদ এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নুশরাতের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মেয়েটির উপর ধকল গিয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই তৌহিদের। সারাটাদিন একটা অভিযান ছিলো। অনিশ্চিত কর্মকান্ডের ভেতর তাদের সারাদিন গিয়েছে, শেষের তৌহিদের জ্ঞান হারানোটা যেনো ষোল কলা পূর্ণ করে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্নটা হলো কেনো এমন হঠাৎ করেই অজ্ঞান হয়ে গেলো তৌহিদ! আর সেই মেয়েটি! কে ছিলো সেই মেয়েটি! স্নিগ্ধের সাথে তার সম্পর্কটা কতোটা গভীর! প্রশ্নগুলোর উত্তর সম্পূর্ণ অজানা তৌহিদের। এখন সেগুলো নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শুধু নুশরাতকে দেখতে ইচ্ছে করছে। বারোটা বছর, জীবনটাকে কতই না পালটে ফেলেছে এই বারোটা বছর। মুচকি হেসে নুশরাতের মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে তৌহিদের। নুশরাতের ক্লান্ত চেহারাটা তার মনমন্দিরে শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। কিন্তু তৌহিদের সেই অধিকার নেই। তখন যদি মেয়েটার হাতটা না ছেড়ে দিতো, তবে আজ এই অধিকারটা কেবল এবং কেবল তার ই থাকতো। স্মৃতির পাতাগুলো উলটাতে শুরু করলে কিছু সুখময় মূহুর্তের সাথে সাথে কিছু কন্টকময় মূহুর্তও হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। বুকের ঘাগুলো তাজা করে দেয়। তৌহিদ হাতটা সংযত করে নেয়। দৃষ্টি সরিয়ে নেয় নুশরাতের থেকে। এই মায়ায় আর জড়াতে চায় না সে। থাকুক না কিছু স্মৃতি মনের ভেতরেই তালাবদ্ধ। কি দরকার সেই তালা ভাঙ্গার!

মিনিট দশেকের মাঝেই ফোনটা বেজে উঠে নুশরাতের। তন্দ্রা থেকে উঠে বসে নুশরাত। সাথে সাথে চোখ বুজে নেয় তৌহিদ। তৌহিদকে ঘুমাতে দেখে ফোনে দৃষ্টিপাত করে সে। রবিনের নামটি উজ্জ্বল বর্ণে দেখা যাচ্ছে। নুশরাত ফোনটা রিসিভ করতেই তীব্র কন্ঠে রবিন বলে উঠে,
– এই কই তুই? আমি তোকে খুজতে খুজতে পাগলপ্রায় হয়ে গেছি। ডুব দিয়েছিস তো দিয়েছিস! বলে তো যাবি নাকি! এদিকে স্নিগ্ধের কেসের ডেট পড়েছে, ৫ তারিখ। আর তুই নাকে তেল লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। কি হলো কথা বল!
– তোর বলা শেষ হয়েছে?
– কেনো?
– কারণ আমি যা বলবো তা শোনার জন্য আগে তোকে স্থির হতে হবে। নয়তো আমি বলবো না।

এবার একটু ঠান্ডা হলো রবিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হিনহিনে কন্ঠে বললো,
– হু বল, শুনছি।
– আচ্ছা আগে বল, ওই রেস্টুরেন্টটাতে গিয়েছিলি?
– হু, গিয়েছিলাম। সেখানে সত্যি কারো বার্থদে পার্টি ছিলো। বাচ্চা একটা মেয়ের।
– আমি জানতাম, কারণ স্নিগ্ধ খুনটা করেনি। খুনটা যে করেছে তা এখনো অজানা। তবে কিছু ক্লু হাতে এসেছে। তুই ওর এলিবাইগুলো রেডি করতে থাক। আমিও কয়েকটা প্রমান পেয়েছি।
– তুই প্রমাণ পেয়েছিস?

বেশ অবাক কন্ঠে প্রশ্নটা করে রবিন। রবিনের কন্ঠে উগ্রীবতা দমাতে নুশরাত বলে উঠে,
– হ্যা, পেয়েছি। তুই নিশ্চিত থাক। এই কেসটা আমি জিতবো।
– এখন কোথায় আছিস তুই?
– আমি! আমি এখন হসপিটালে আছি।
– হসপিটালে কেনো?
– আসলে….

নুশরাত রবিনকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলে৷ রবিন শুধু শুনে যায়, কোনো পালটা প্রশ্ন করে না। নুশরাতের বলা শেষ হলে রবিন বলে,
– তুই একটু সাবধানে থাকিস! মানুষের মন একটা গোলকধাঁধা। একবার সেই গোলকধাঁধায় পা দিলেই সব এলোমেলো হয়ে যায়।

বলেই ফোনটা রেখে দিলো রবিন। রবিনের কথার সারমর্ম নুশরাত বুঝে নি। মাঝে মাঝে রবিনের কথাগুলো নুশরাতের মাথার উপরে প্রজেক্টাইলের মতো যায়৷ আজ ও তার ব্যাতিক্রম হল না। নুশরাত মাথা ঝাকিয়ে চিন্তার ঝুড়ি থেকে নিজেকে বার করে আনলো। তৌহিদের দিকে তাকাতেই দেখলো তৌহিদের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। বিনয়ী কন্ঠে বললো,
– আমার ফোনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো কি আপনার? এখন কেমন লাগছে? এখনো মাথা ঘুরছে?
– নাহ, আমি ঠিক আছি। রবিন কি বললো?
– স্নিগ্ধের কেসের ডেট পড়েছে সেটাই জানালো।
– আমি ঠিক আছি, চলো তোমাকে বাসায় ড্রপ করে দেই।
– যতক্ষন না এই স্যালাইনের বোতল শেষ হচ্ছে এভাবেই থাকবেন আপনি।

বেশ হুকুমের সাথে কথাটা বললো নুশরাত। ডাক্তারের ভাষ্য অনুযায়ী, তৌহিদের ব্লাড প্রেসার নেমে গিয়েছিলো৷ তাই জ্ঞান হারিয়েছে৷ স্যালাইনের বোতল শেষ না হওয়া অবধি ডাক্তার থাকতে বলেছেন কিন্তু তৌহিদ তো তৌহিদ। সুন্দর উঠে বসে হাতের ক্যানোলাটা খুলে ফেললো। স্যালাইনের বোতল শেষ হয় নি এখনো। তৌহিদের কর্মকান্ড দেখে হা হয়ে যায় নুশরাত। চোখ রাঙ্গিয়ে তীব্র কন্ঠে বলে,
– এটা কি হচ্ছে?
– কিছু হচ্ছে না, বাসায় যাবো আর এই ফিন্যাইলের গন্ধ নিতে পারছি না। তুমি কি বসেই থাকবে নাকি যাবে?

বলেই হাটা দিলো তৌহিদ। নুশরাত বাধ্য হয়ে ফুসতে ফুসতে তার পিছু পিছু হাসপাতাল থেকে বের হলো। কিন্তু তাতে তৌহিদের কিছু যায় আসে না। সে নির্বিকার চিত্তে হাটছে। তৌহিদের মোটরসাইকেল আলিফ থানায় নিয়ে গেছে। তাই একটা সিএনজি ঠিক করলো তৌহিদ। সিএনজি চলছে, নুশরাত চুপ করে তৌহিদের পাশে বসে রয়েছে। নুশরাতকে চুপ থাকতে দেখে তৌহিদ বললো,
– রেগে আছো নাকি?
– আমি রাগ করতে যাবো কেনো? আপনার শরীর, আপনার ইচ্ছে। আমার কি?
– শুয়ে থাকার অভ্যেসটা আমার নেই। এটা তো তোমার অজানা নয় তাই না? আমাকে যেখানে জ্বর কাবু করতে পারে না সেখানে প্রেসার লো হয়ে মাথা ঘুরানো রোগ হবার কোনো চান্স ই নেই আমার।
– তাহলে কেনো জ্ঞান হারালেন? বলুন! উত্তর দেন! জানেন কতটা ভয় পেয়েছিলাম আমি। কোনোমতে আলিফকে ফোন করেছি। তারপর থানা থেকে গাড়ি এসেছে। যদি তখন থানা থেকে লোক না আসতো কি হতো আপনার?

নুশরাত তীব্র কন্ঠে কথাগুলো বলে। তার চাঁপা ক্ষোভ তার কথায় স্পষ্ট। তৌহিদ মুচকি হেসে বললো,
– আমি নিজেও জানি না কেনো জ্ঞান হারিয়েছিলাম। তুমি জানো চিরকুটটা কে পাঠিয়েছিলো?
– কে?
– স্নিগ্ধের প্রেমিকা
– স্নিগ্ধের প্রেমিকাও আছে?
– হু, মেয়েটা খুব অদ্ভুত। মেয়েটার চাহনী দেখে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিলো। কেনো যেনো ভয় করছিলো আমার। এই রহস্যের সমাধান আমার কাছে নেই।
– নাম কি মেয়েটার?
– জানি না, আমার ওর সাথে কথা বলতেই ইচ্ছে হচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো কখন সেখান থেকে পালিয়ে যাবো!
– কি বললো সে?
– একই যা সবাই বলছিলো। তবে তার কন্ঠে কথাগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিলো। যেনো আমার মাথায় কিথাগুলো বসাতে চাইছে মেয়েটা। আরেকটা কথাও বলেছে, তাদের সম্পর্কটা কেউ জানে না। মেয়েটার সাথে কিথা বলে আমি এটুকু শিওর কেউ স্নিগ্ধকে ফাঁসাতে চাচ্ছে।
– বুঝলাম। আচ্ছা শুনুন স্নেহার সম্পর্কে একটু খোঁজ নিতে হবে। বিশ্বস্ত কাউকে তার চব্বিশ ঘন্টা নজরে রাখতে বলুন। ওর ইচ এন্ড এভ্রি ডিটেইলস আমাদের চাই কিন্তু।
– ঠিক আছে আমার লেডি এসিপি। এবার চলুন আপনাকে বাসায় ড্রপ করে দেই।

নুশরাত কিছু বললো না। শুধু মুচকি হাসি দিলো। তৌহিদের কথায় তার খটকা লাগছে। কেনো যেনো মনে খারাপ কিছুর আশঙ্কা হচ্ছে! আবারো কোনো বিপদ আসছে না তো!

দুইদিন পর,
স্নিগ্ধের সামনে বসে রয়েছে নুশরাত। কেসের জন্য জন্য নিজেকে তৈরি করছে নুশরাত। স্নিগ্ধের অবস্থা এখন কিছুটা নরমাল। তাকে আর পেটানো হয় নি। তার বেইল ম্যানেজ করা না গেলেও কোনো মানসিক অথবা শারীরিক কষ্ট দেওয়া হয় নি। শরীরটা বেশ দূর্বল স্নিগ্ধের। অসহায় কন্ঠে নুশরাতকে বলে,
– আমার জেল বা ফাঁসি হবে না তো ম্যাডাম?
– আরে ধূর, নিশ্চিন্ত থাকো। তোমার কিছু হবে না। এতো চিন্তা কেনো করো? প্রথমে তৌহিদ স্যার যদিও বিশ্বাস করছিলেন না। কিন্তু এমন এমন প্রমাণ পেয়েছি উনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছেন। এর উপরে তোমার গার্ল্ফ্রেন্ড যা ভয় টা দেখিয়েছে তাকে! বেচারা বেহুশ হয়ে গেছে।
– আমার তো কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই! কার কথা বলছেন আপনি?

নির্লিপ্তভাবেই কথাটা বলে স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধ অবাক দৃষ্টিতে নুশরাতের দিকে চেয়ে আছে। নুশরাত স্নিগ্ধের মুখে প্রশ্নটা শোনামাত্র কিছুটা চমকে উঠে। তাহলে মেয়েটা কে………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here