দৃষ্টির অগোচরে,২৭তম_পর্ব

দৃষ্টির অগোচরে,২৭তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

নুশরাত কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার কেনো যেনো ছবিটা চেনা চেনা লাগছে। কারো কারো চেহারাই এমন থাকে, যে দেখলেই মনে হয় সে অনেক আগ থেকেই পরিচিত। তানজীমের চেহারাটাও ঠিক তেমন। তৌহিদ তখন বললো,
– স্নিগ্ধ আমাদের কাছে তাশের এক্কা। খুনি যদি জানতে পারে ও আমাদের কাছে বন্দি, কোনো না কোনো একটা হুড়োহুড়ি করবেই।

তৌহিদের কথা শেষ না হতেই নুশরাতের ফোনটি বেজে উঠে। নুশরাত ফোনটি নিয়ে একটু দূরে চলে যায়। মিনিট পাঁচেক পর হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসে সে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
– খুনি আবারো পারফিউমের অর্ডার করেছে।

কথাটা শোনা মাত্র তৌহিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
– নুশরাত তুমি বাসায় যাও। আমি বাকিটুকু সামলে নিচ্ছি।
– মানে টা কি? আপনি কি কোনোভাবে আমাকে এই কেস থেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছেন?
– যদি তোমার তাই মনে হয় তবে তাই। আমি চাই না তুমি এই কেসে আর থাকো।
– কিন্তু কেনো? তৌহিদ ভাই কেসের প্রথম থেকে আমি ছিলাম। এই কেসের প্রতিটা জায়গায় আমি জড়িত ছিলাম। এভাবে আমাকে আলাদা করে দিতে পারেন না আপনি। আমি আপনাকে হেল্প করতে চাই৷ তৌহিদ ভাই খুনিকে ধরাটা আপনার জন্য যতোটা ইমপোর্টেন্ট আমার জন্য ও ততোটাই ইমপোর্টেন্ট৷ আমি দশ দিন জেলে ছিলাম ওই লোকটার জন্য। আমিও জানতে চাই খুনি কে। আপনাকে হেল্প করতে চাই। আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমি যাবো না। আপনি যদি আমাকে এভাবে বিনা নোটিসে কিকাউট করলে আমি আমার মতো কেসে ইনভোলভ হবো।

নুশরাতের কথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে নি তৌহিদ। তীব্র কন্ঠে বলে উঠে,
– নুশরাত তুমি বুঝছো না খুনি কতোটা রিস্কি। একটা মানুষ এতোটা ঠান্ডা মাথায় এতোগুলো খুন করেছে সে কতোটা ডেঞ্জারাস তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। ওর কাছে এটা ইম্পোর্টেন্ট নয় যে এরা শাস্তি পেলো কিনা ওর কাছে প্রতিশোধটা ইম্পোর্টেন্ট। ও স্নিগ্ধকেও এতোটা সুন্দরভাবে ম্যানুপুলেট করেছে তুমি কি একবার ও ভাবছো না এটা। আমি তোমার জীবন রিস্কে ফেলতে চাই না। আমি যেভাবে প্লান করছি, তাতে খুনি নিজে আমাদের জালে ধরা দিবে। সো প্লিজ তুমি এই প্লান থেকে যত দূরে থাকবে ততই তোমার জন্য ভালো। বারো বছর আগের ভুল আবার করো না প্লিজ। বারোটা বছর গ্লানির বোঝায় থেকেছি আমি। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কতোটা কষ্টের ব্যাপারটা৷
– কষ্ট কি একা আপনি পেয়েছেন তৌহিদ ভাই? আমি পাই নি? সম্পর্কটা আমাদের ছিলো, আপনার একার নয়। যতোটা কষ্ট আপনি পেয়েছিলেন আমিও ঠিক ততটাই কষ্ট পেয়েছি। ভালোবাসাটা তখন একপাক্ষিক ছিলো না। কিন্তু আপনি আজও সেই ঘটনার জন্য আমাকেই দোষারোপ করবেন। বেশ, তবে তাই হোক।

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় নুশরাত। নুশরাতের কন্ঠ কাঁপছিলো। তৌহিদ সজোরো টেবিলে আঘাত করে। হাতে চিনচিন ব্যাথা করছে কিন্তু ব্যাথাটা মনের ব্যাথার কাছে কিছুই নয়। না চাইতেও আবার নুশরাতকে আঘাত দিয়েছে সে। অপরাধবোধ হচ্ছে, কিন্তু মেয়েটাকে বিপদে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কারণ আজও সে এই জেদি, বেপরোয়া মেয়েটাকেই ভালোবাসে_________

দু দিন পর,
বিকেল ৫টা,
পুরান ঢাকার একটা পুরোনো বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে নুশরাত এবং রবিন। তৌহিদ তাকে কেস থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছে। তাই কোনো প্লান ও শেয়ার করে নি। শুধু তাই নয়, নাহিদুল ইসলাম যে কিনা তানজীমের হত্যার মূল দোষী তাকে পর্যন্ত পুরোপুরি সুরক্ষা প্রদান করছে। ব্যাপারটা একেবারেই ভালো লাগে নি নুশরাতের। নুশরাত তানজীমের কেসটা রি ওপেন করবে। অন্ততঃ যারা বেঁচে আছে শামীম এবং নাহিদ তারা যেনো কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি পায় সেটাই নুশরাতের চেষ্টা। নাহিদুল ইসলাম এখন একটা বড় কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার। তাই আইন, আদালত তার পকেটে থাকে। শুধু তাই নয় তানজীমের মৃত্যুর আজ এগারো বছর হয়ে গিয়েছে। এখন এগারো বছর পর শুধুমাত্র শামীমের স্বীকারোক্তিতে নাহিদকে শাস্তি দেওয়াটা অসম্ভব। তাই এই দুদিন ধরে তানজীমের পরিবারের খোঁজ নিয়েছে নুশরাত এবং রবিন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার তানজীমের পরিবারের একটা মানুষের খোঁজ পায় নি নুশরাত। তারা যেনো হায়ায় মিলিয়ে গেছে। অবশেষে অনেক কষ্টে ইশানীর খোঁজ পেয়েছে তারা। ইশানী তানজীমের কেসের একজন সাক্ষী ছিলো। শুধু তাই নয় ইশানী সেই মেয়ে যার জন্য এতোকিছু হয়েছে। ইশানীর বাসার বাহিরে বিগত বিশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রবিন এবং নুশরাত। মিনিট বিশেক পর একটা মেয়ে দরজা খুলে। সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– কাকে চাই?
– ইশানী?
– জ্বী, আপনারা।
– আমি এডভোকেট নুশরাত, উনি এডভোকেট রবিন। আসলে আমরা তানজীম হত্যা কেসটা রিওপেন করতে চাচ্ছি।
– আমার কাছে কি চাই?
– আসলে আপনি ওই কেসের সাক্ষী ছিলেন।
– মিথ্যে কথা, আমি কোনো সাক্ষী টাক্ষী ছিলাম না। আসতে পারেন আপনারা

বলেই দরজা আটকাতে গেলে নুশরাত হাতটা দিয়ে দরজাটা আটকানো থেকে ঠেকায়, তারপর বলে,
– রাজীব, ইশান, আলতাফ, দিহান এবং মাহিরের খুন হয়েছে। এটুকু তো জানেন ই, কারণ আলতাফ খুনে স্নিগ্ধকে বাঁচাতে ওসি স্যারের সাথে আপনি ই পুকুর পাড়ে দেখা করেছিলেন। তাই না?
– ওদের খুনি কে সেটা জানতে চান তাই বলেন, শুধু ভনিতা করছিলেন কেনো?
– আপনি খুনি কে সেটা জানেন?
– নাহ! আর চিনলেও আপনাদের কোনো সাহায্য আমি করবো না।
– কেনো?
– কারণ তারা মৃত্যুর যোগ্য। ওসব কেস রিওপেন করে কিছুই হবে না। প্রমাণ ই করতে পারবেন না কিছু। তাই আমার এবং নিজের সময় নষ্ট করবেন না। আসতে পারেন।

বলেই মুখের উপর দরজাটা আটকে দিলো ইশানী। নুশরাতের শেষ আশাটাও মাটিতে মিশে গেলো। নুশরাতের উদাস মুখখানি দেখে রবিন বলে,
– তুই মন খারাপ করিস না, একটা ওয়ে এই সপ্তাহের মধ্যে ঠিক বেড়িয়ে আসবে।
– কিভাবে হবে দোস্ত? পুলিশ কি করছে সত্যি বুঝছি না। কেনো নাহিদকে প্রটেকশন দিচ্ছে? কেনো এরেস্ট ওয়ারেন্ট বের করছে না? নাহিদ এবং অনিককে গ্রেফতার করা হলে খুনি শান্ত হয়ে যাবে?
– তুই এতো শিওর কিভাবে?
– কারণ খুনিদের মধ্যে শুধু নাহিদ ই বাহিরে রয়েছে। স্নিগ্ধ তো কাস্টেডিতে।
– স্নিগ্ধ এই খুনের সাথে জড়িত?
– হ্যা, ও এবং অনিক খুব মাইনর দুজন ব্যাক্তি। অনিক তানজীমকে খুন করে নি কিন্তু সে সব জানতো, সে তার বন্ধুত্বের জন্য মুখ খুলে নি। আর স্নিগ্ধ নাহিদকে তানজীম এবং ইশানীর সম্পর্কে জানিয়েছিলো। পরে লাশের প্রমাণ মেটানো থেকে সব কিছুতে ওই ওদের সাহায্য করেছিলো। ও যদি আজ সাক্ষী দিতো তবে ওরা এগারো বছর আগেই শাস্তি পেতো।
– ইশ! ও বন্ধু হয়ে নিজের বন্ধুকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিলো? এই ছেলেটা এতটা ধূর্ত? বাদ দে, বাসায় চল। এক কাপ গরম কফির সাথে ভাববো কেসটা নিয়ে। মা ও বলছিলো তোকে অনেকদিন দেখে না।
– যাওয়া যায় অবশ্য। যদি তুই নিজ হাতে কফিটা বানিয়ে খাওয়াস৷
– চল চল। বেশি বকিস না।

বলেই একটা সিএনজি ঠিক করে রবিন। নুশরাত ও রবিনের সাথে তার বাসায় যাবার জন্য রওনা হয়। এই ঝামেলা থেকে একটু আলাদা সময় বের করলে হয়তো মনটা ফ্রেশ হয়ে যাবে তার৷ হয়তো কেসটা নতুন করে ওপেন করার একটা সুযোগ ও পাবে তারা।

এক সপ্তাহ পর,
রাত নয়টা,
কফি হাতে বসে রয়েছে নুশরাত। মাথায় অনেককিছু চলছে তার। খুনি তক্কে তক্কে রয়েছে, হয়তো নাহিদকে খুন করার প্লান ও রেডি। এদিকে ইশানী মেয়েটাকে দেখে একবারের জন্য ও নুশরাতের মনে হয় নি সে খুনি। তবে সে জানে খুনগুলো কে করছে। কিছু একটা ভেবে টিভি চ্যানেলটা অন করে নুশরাত। শিরোনামটি দেখে হতবাক হয়ে যায় নুশরাত। শিরোনামে লেখা রয়েছে,
” এগারো বছর পূর্বের হত্যাকান্ড ফাঁশ। হত্যাকান্ডের মুল আসামী নাহিদুল ইসলাম পুলিশ হাজত থেকে নিখোঁজ …..

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here