তোর_মনের_অরণ্যে,২৬,২৭

তোর_মনের_অরণ্যে,২৬,২৭
সাবিয়া_সাবু_সুলতানা
২৬.
সোহা রুমের মধ্যে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছে। সম্পূর্ণ এক আলাদা রূপে। সব সময়ের ড্রেস জিন্স প্যান্ট ছাড়াও তাকে এই প্রথম অন্য কোনো ড্রেসে দেখলো আমন। আনারকলি ড্রেস পরে আছে মাথা থেকে শরীরে একটা ওড়না দিয়ে আবৃত্ত করে রেখেছে। রুমের মধ্যে নীল রঙের ড্রিম লাইট জ্বলছে আর এই আলোয় স্পষ্ট ভাবে সোহাকে দেখা যাচ্ছে

আমন সোহার এই রূপ দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে আছে । তার পা থমকে গেছিলো সোহাকে এই ভাবে দেখে। তার চোখ স্থির হয়ে আছে রুমের মধ্যে নামাজে দাঁড়ানো সোহার উপর। তার নিজেরই চোখকে যেনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এই দৃশ্য দেখে। এটা কিকরে ঘটতে পারে। সোহা নামাজ পড়ছে এটা কিভাবে সম্ভব? এটাই যেনো আমনের মাথায় ঢুকছে না। আমন এক দৃষ্টিতে সোহার দিকে তাকিয়ে আছে। গভীর দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে সোহাকে। একদম নিখুঁত ভাবে নামাজ পড়ে যাচ্ছে তার মধ্যে না আছে কোনো জড়তা আর না কোনো সংকোচ। তাকে মনে হচ্ছে খুব ভালোবেসে মন দিয়ে তার এই কাজ টা সম্পূর্ণ করছে।

আমনের মাথায় শুধু এটাই ঘুরছে সোহা আর নামাজ দুটো একসাথে কিভাবে মিললো। সোহা হিন্দু পরিবার থেকে মানে সে নিজেও তাই হওয়া উচিত। তাহলে সে নামাজ কিভাবে পড়ছে? আর সোহার নামাজ পড়া দেখে আমনের একদমই মনে হচ্ছে না সে এই পথে নতুন। সোহাকে এই ভাবে দেখে সত্যি বিভ্রান্ত হয়ে গেছে তার মাথা কাজ করা পুরো বন্ধ করে দিয়েছে। আমন সোহাকে দেখে সে তার মত নামাজ পড়ে যাচ্ছে। তার অন্য দিকে কোনো ধ্যান নেই। আমন এক পলক দেখে নিয়ে দরজা টেনে দিয়ে দ্রুত পায়ে আবার চলে যায় নিজের রুমের দিকে।

আমন রুমে ঢুকে ভাবতে বসে সে একটু আগে যা দেখেছে সেটা কি আদেও সত্যি ছিল নাকি? কিন্তু সেতো তার এই চোখ দুটো দিয়ে দেখেছে আর এতক্ষণ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছে না সে ভুল হতে পারে না। কিন্তু এটা সম্ভব কিকরে সেটাই তো ভেবে পাচ্ছে না। হিন্দু একজন মেয়ে হয়ে এত দক্ষতার সাথে নামাজ আদায় করা শিখলো কিকরে? আর তাছাড়া একটা হিন্দু মেয়ে কিভাবে নামাজ পড়তে পারে সেটাইতো আমনের মাথায় আসছে না। সোহার এই একটা কাজ আমনকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছে। শত শত প্রশ্ন এসে মাথায় কিলবিল করছে। কিকরে হতে পারে এটা। আমন এবার সোহার সাথে তার প্রথম দেখা হওয়া থেকে এই পর্যন্ত পুরোটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবতে থাকে। না সে এর আগে সোহাকে কোনো অসঙ্গত কিছু করতে দেখেনি তাহলে। পুরোটা সময়ে ভাবতে ভাবতেই এসে থেমে যায় তাদের বাড়িতে সোহার আসার প্রথম দিন মনে গতকাল এর ঘটনা গুলো। যখন মণিকা সোহাকে জিজ্ঞেস করেছিলো সেই হিন্দু কিনা। কিন্তু আমনের যতদূর মনে পড়ে সেতো অন্য কথা বলেছিল।

-“সোহাতো নিজের মুখে বলেনি সেই হিন্দু। সে শুধু বলেছিলো তার পরিবার হিন্দু।” মণিকার কথার উত্তর সে ঘুরিয়ে দিয়েছে হ্যাঁ এটাই একটা পয়েন্ট সোহাতো এটা বলতে পারতো সে হিন্দু তাহলে পরিবারের কথা কেনো বললো? তারমানে সোহার পরিবার হিন্দু হলেও সোহা হিন্দু নয়। আর তাই সে নামাজ পড়ছে তারমানে সোহা মুসলিম কিন্তু এটা কিকরে সম্ভব হতে পারে? তাহলে কি সোহা জৈন পরিবারের অংশ নয়? আর তারা সোহার আসল মা বাবা নয়? তাহলে কি এর মধ্যে বড় কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে? কিন্তু কি রহস্য থাকতে পারে এর মধ্যে? উফ মাথা কাজ করছে না আমার। আমন মাথায় হাত চেপে বসে নিজের মনে বিড়বিড়িয়ে ওঠে ।

-“না এইভাবে হবে না। আমাকে এই রহস্যের শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। আমাকে জানতেই হবে সোহার আসল পরিচয় কি ও যদি সত্যি হিন্দু হয় তাহলে ও নামাজ কি করে পড়ছে? আমন রুমের মধ্যে পায়চারি করছে আর বিড়বিড়িয়ে বলে যাচ্ছে।

-” আচ্ছা এটাতো হতে পারে যে আসলেই সোহা জৈন পরিবারের মেয়ে সে আসলেই হিন্দু ছিল। হয়তো কোনো ভাবে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছে। হ্যাঁ এটা হতে পারে। সোহারতো বলতে গেলে প্রায় বেশির ভাগ সময় বাইরে বাইরে কেটে যায় তার মিশনের জন্য সেখানেই হয়তো কোনো কারণ বসত হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছে। হ্যাঁ এটাই হতে পারে। সে আসলেই তার ধর্ম ছেড়ে মুসলিম ধর্ম গ্রহন করেছে। এটাই একমাত্র উপায় হতে পারে। আমন নিজের মনে ভেবে চলেছে।

আমন রুমের মধ্যে ঘুরে ঘুরে একে একে কারণ খুঁজে যাচ্ছে সে কিছু একটা ভেবেই তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ টা হাতে তুলে নেয় ।

-“সোহা এই মুহূর্তে নামাজ পড়ছে আমি ওর ল্যাপটপ হ্যাক করলে কোনো না কোনো তথ্য পেতে পারি সব সময়ে তো সার্টিফিকেট নিয়ে ঘোরা সম্ভব নয়। ফটো কপি তো থাকতেই পারে। আমন ল্যাপটপ চালাতে চালাতে বলে ওঠে।

আমন দ্রুততার সাথে সাথে সোহার ল্যাপটপ হ্যাক করে ফেলে। এর আগেও তারা একসাথে কাজ করেছে আর সোহার ল্যাপটপ নিয়ে সে কাজও করেছে। তাই তার জানা আছে সোহার কম্পিউটার সিস্টেম ডিটেইলস। আমন দ্রুত সোহার ল্যাপটপ দেখতে থাকে প্রত্যেকটা ডকুমেন্ট ডিটেইলসে দেখতে থাকে। হটাৎ একটা ফোল্ডারে এসে থেমে যায়। “এস” এর লোগো দেওয়া আমন দ্রুত ওপেন করে ফেলে। হ্যাঁ এখানেই সব ডকুমেন্ট আছে সোহার। একের পর এক চেক করে বাবা মায়ের জায়গায় শ্রেতা জৈন ও ধীরাজ জৈন। বার্থ সার্টিফিকেট দেখেই আমন থমকে যায় না তার ক্যালকুলেশন ঠিক আছে দেখছে। সোহার জন্ম লন্ডন সিটি হসপিটালে হয়েছে তারমানে সোহার জন্ম লন্ডনে হয়েছিলো।

না আমন এবার সিউর হয়ে গেছে যে সোহা জৈন পরিবারের মেয়ে সে হিন্দু ছিল কিন্তু কোনো কারণে হয়তো মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছে। হ্যাঁ এটাই হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে কি কারণ আছে সেটা আমাকে জানতে হবে। আমন আবারো সোহার ল্যাপটপের সিস্টেম ঠিক করে দেয় যাতে সোহা কোনো ভাবেই বুঝতে না পারে। এবার শুধু তার কাজ হলো সোহার এই মুসলিম হওয়ার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে সেটাই জানার।
আর আজকের আরহান আর সোহার দৃষ্টিও কিছু আলাদা ছিল ওদের হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছিলো তারা একে অপরকে চেনে। কিন্তু এটা কিভাবে হতে পারে তারা একে অপরকে কিভাবে চিনতে পারে? তাদের মধ্যে তো কোনো সম্পর্ক থাকতেই পারে না। তাহলে কি ভাবে চিনতে পারে? আমাকে সব প্রশ্নের উত্তর পেতেই হবে।

————

আরহান রুমের মধ্যে তার বিছানার উপর চারিদিকে ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে আর তার মাঝে বসে আছে সে। প্রত্যেকটা ছবি সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যাচ্ছে। না তার মধ্যে আর কোনো সন্দেহ নেই। তার আত্মার সাথে যে সোহার কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে সেটা আজকেই সে কর্নফার্ম হয়ে গেছে সোহা কে দেখার পর। আজকে চৌধুরী বাড়িতে যাওয়ার পর সোহাকে গভীর ভাবে সে পর্যবেক্ষণ করেছে। সে যখন সোহাকে গভীর ভাবে দেখছিল তখন সোহাও তার দিকে তাকিয়ে হেসেছে সোহাকে দেখে তার মনে হলো সোহা তাকে চেনে। তাহলে এটা বোঝা যায় তাদের মধ্যে কোনো কানেকশন আছে। আরহান আজকে সোহাকে পর্যবেক্ষণ করে এটা সে বুঝে গেছে। না সে এবার তাকে এই রহস্য সমাধান করতেই হবে।

-“আচ্ছা বাপি তো কালকে চৌধুরী বাড়িতে গেছিলো তাহলে বাপি কি সোহাকে দেখেছে? তাই কি বাপি বাড়িতে আসার পর অমন অস্থির হয়ে ছিল। বাপিকে দেখে মনে হলো যে বাপি ভয় পেয়ে আছে। কিন্তু চৌধুরী বাড়িতে বাপির ভয় পাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। তবে? তাহলে কি সোহা কে দেখেই বাপি এমন ভয় পেয়েছিলো? হ্যাঁ এটাই হবে কারণ সোহাকে দেখতে পুরো আমার আত্মার মতো। তাই বাপি সোহাকে ভয় পেয়েছে। কিন্তু ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই সোহাকে আত্মার মতো দেখতে তাহলে তো বাপির খুশি হওয়ার কথা ছিল। তাহলে কি বাপির ভয়ের পিছনে অন্য কোনো কারণ আছে। আমাকে সব কিছুর কারণ খুঁজে বের করতেই হবে। আরহান নিজের মনে বলে ওঠে।

চলবে….. ❣️

#তোর_মনের_অরণ্যে
#সাবিয়া_সাবু_সুলতানা
২৭.
রাতের আধার কেটে চারিদিকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এখন ব্যাঙ্গালোর এর ওয়েদার কিছুটা ঠান্ডা সাথে বৃষ্টি তো লেগেই থাকে। ভোরের এই সুন্দর আবহাওয়া আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছে সোহা। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশে চোখ রেখে আছে। পূর্ব আকাশ থেকে সূর্য উঠতে শুরু করেছে। চারিদিকে তার হলুদাভ আভা ছড়িয়ে পড়ছে ।ভোরের এই মোহনীয় দৃশ্য মুগ্ধ করার মতো । সোহা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে এই সৌন্দর্য।

হঠাৎ দুটো হাত পিছন দিকে থেকে জড়িয়ে ধরতে সোহা চমকে ওঠে। এতক্ষণ ভোরের এই প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার মাঝে ডুবে থাকার জন্য বুঝতে পারিনি কারোর উপস্থিতি। তবে তাকে হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরতে চমকে গেলেও তার বুঝতে বাকি নেই যে কে আছে তার পিছনে আছে। এই স্পর্শ সোহা চেনে। এটা আমনের স্পর্শ তার আর চিনতে বাকি নেই। আমনই তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে রেখেছে। আমনের এই হঠাৎ হটাৎ তাকে জড়িয়ে ধরতে বেশ চমকে দেয় তাকে। আগে বাইকে বসলে তাকে জড়িয়ে ধরত ঠিক আছে কিন্তু এত তাকে এখন জড়িয়ে রেখেছে।

-“আপনি কি এখন বাইকে চড়ছেন নাকি মিস্টার চৌধুরী? সোহা বলে ওঠে।

-” তুমি কি করে বুঝলে যে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি। তাহলে কি এটা ধরে নেবো তুমি আমার স্পর্শ চেনো? আমন দুষ্টু হেসে বলে ওঠে।

-“আপনার স্পর্শ চিনতে আমার বয়ে গেছে। এই রকম হুট হাট কাজ আপনি ছাড়া কেউ করতে পারে না। সোহা মুখ বাঁকা করে বলে ওঠে।

-“বাহ তুমি দেখছি আমাকে ভালো করে চিনে গেছ আমার কাজ দেখছি তোমার মুখস্ত হয়ে গেছে। আমন একই ভাবে বলে ওঠে।

-“আপনি এখন এখানে কি করছেন শুনি? সোহা আমনের কথা এড়িয়ে বলে ওঠে।

-“এই তুমি যে কাজ করছো আমিও তাই করছি তবে তার সাথেও তোমার সঙ্গ নিচ্ছি। আমন তার থুতনি সোহার মাথায় ঠেকিয়ে বলে ওঠে।

-“তো ভালো তার জন্য আমাকে কেনো এভাবে হারিয়ে রেখেছেন? এখানেও কি আপনার ভয় করছে?

-“আসলে ভয় ঠিক নয়। কি বলোতো আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই আমি তো চাইবো তোমার সাথে সব সময়ে এই ভাবে থাকতে তাইনা। আর তাছাড়া তুমি এত ধারে দাঁড়িয়ে আছো যদি পড়ে যাও তাই ধরে রেখেছি। আমন বলে ওঠে ।

-” উম বড় এসেছে আমাকে ধরে রাখতে আমি যেনো জানি না এইসব আপনার ফন্দি। যেমন বাইকে বসার সময়ে বাহানা করেন ঠিক তেমন। সোহা নিজের মনে মনে বলে ওঠে।

-” তবে ভেবনা আমি তোমাকে আমার কাছে আসতে দিচ্ছি বলে এই নয় আমি এখনই তোমাকে ধরা দিয়ে দিচ্ছি তোমার জন্য আমার মনেও অনুভূতি আছে। এখনও অনেক সময় বাকি চাদু। সোহা নিজের মনে বলে ওঠে।

-” এই ছাড়ুনতো আমি নিচে যাবো। বলেই সোহা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমন এক পলক দেখে নিয়ে নিচের দিকে পা বাড়ায়।

-” তুমি নিজের অজান্তেই আমার কাছে ধরা দিয়ে দিচ্ছ ধানী লঙ্কা। তোমার এখনকার প্রত্যেকটা চালচলন তোমার মনের কথা গুলো বুঝিয়ে দিচ্ছে যেটা তুমি বুঝতেই পারছনা। এই যে আমার তোমার কাছে আসা টাও তুমি বুঝতে পারছ এটার থেকে প্রমাণ হয় তোমার মনে অবশ্যই আমার জন্য অনুভূতি জমা হয়ে আছে। আর সেটা তুমিও বলবে আমায় সেদিন আসতে বেশি বাকি নেই। আমন মুচকি হেসে বলে ওঠে নিজেও নিচের চলে যায়।

————-

মাঝ রাস্তায় ছুটে চলেছে সোহা হাতে গান নিয়ে। ব্যস্ত রাস্তায় দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে তাদের মতো করে। আর তার মধ্যে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে সোহা। মাঝে মাঝে গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে যাচ্ছে বা লাফিয়ে যাচ্ছে। সোহার ছুটে চলার জন্য গাড়ি কিছু থামিয়ে দিচ্ছে তো কেউ বিভিন্ন কথা বলছে তবে সোহার হাতে গান দেখে বেশি কেউ বলতে পারছে না। সোহাকে চেনার উপায় নেই। ব্ল্যাক ক্যাট তার প্রফেশন আর আজ নিজেও পুরো ব্ল্যাকে জড়িয়ে নিয়েছে নিজেকে। ব্ল্যাক জিন্স ব্ল্যাক টপ তার উপরে ব্ল্যাক জ্যাকেট চুল গুলো কে হাই পনিটেইল করে রাখা আর মুখে রয়েছে ব্ল্যাক মাস্ক ফুল ব্ল্যাক ক্যাট ফর্মে আছে আজ সোহা। তাই সহজেই তাকে কেউ চিনতে পারবে না।

সোহার সামনে একজন লোক ছুটে চলেছে আঁকা বাঁকা হয়ে যাতে তাকে সহজে ধরতে না পারে বা গুলি চললেও তার যেনো লাগে আর সহজেই চোখের আড়াল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তার এই ভাবে ছুটে ও কোনও লাভ হচ্ছে না সোহা ঠিক তার পিছন পিছন আসছে। সোহা আজ তার মিশন এর কাজে এক গোডাউনে গেছিলো সেখানে সবাই কে ধরে ফেললেও শেষে এই পালিয়ে গেছে। আর সেখান থেকেই এর পিছু করে যাচ্ছে। গাড়ি নিলে এতক্ষণে হয়তো ওই লোকটা হাত ফসকে পালিয়ে যেতো জ্যাম এর কারণে। তাই সোহাও তার পিছু ছুটে যাচ্ছে। যাতে তার চোখ এড়িয়ে পালিয়ে যেতে না পারে।

সোহা সমানে তাকিয়ে দেখে সামনে থেকে একটা বড় ট্রাক তার দিকে এগিয়ে আসছে আর সামনের লোকটা তার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সোহা একবার পিছন আর একবার সমানে দেখে নিয়ে। গান উচিয়ে লক্ষ স্থির করে সামনের লোকটার পা বরাবর গুলি চালিয়ে দেয় দুটো। ততক্ষণে ট্রাক টা সোহার একদম কাছাকাছি চলে এসেছে এই মুহূর্তে না সরে গেলেই কোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। সোহা নড়ার আগেই পাশের থেকে একটা হাত তাকে টেনে সরিয়ে নেয়। জোরে টেনে নেওয়ার ফলে ব্যালেন্স হারিয়ে রাস্তার সাইটে পড়ে যায় সোহা। মাথায় কিছুটা আঘাত পায়।

-“এই তুমি ঠিক আছো?

হঠাৎ কারোর আওয়াজ পেয়ে সোহা মাথাটা হালকা উঁচু করে তাকায়। সামনের ব্যাক্তির মুখ তার চোখে পড়তে মুখে হাসি খেলে যায়। মাথায় হাত দিয়ে আসতে আসতে উঠে দাড়ায় সোহা। তার সামনে আরহান দাঁড়িয়ে আছে ।

-” আরে তোমার কপাল থেকে তো রক্ত পড়ছে? আরহান হন্তদন্ত হয়ে বলে ওঠে।

-” ওহ কিছু না হালকা একটু চোট লেগেছে। এইরকম হামেসা হয়েই থাকে। সোহা কিছুটা হেসে বলে ওঠে।

-“রক্ত পড়ছে আর তুমি বলছো কিছুই হয়নি। আরহান ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে।

-” এইসব আমি অভ্যস্ত। হাসি মুখে বলে সোহা সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

আরহান অবাক চোখে সোহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে আর বলে কিনা কিছুই হয়নি সে এতে অভ্যস্ত। আজ যদি সে ঠিক সময়ে টেনে না নিতো তাহলে তো এতক্ষণে উপরে চলে যেতো। আরহান নিজের অফিসের দিকে যাচ্ছিলো আর মাঝ রাস্তায় সোহাকে এমন দৌড়াতে দেখে গাড়ি সাইট করে নেমে পড়ে। ততক্ষণে সোহা দাঁড়িয়ে গিয়ে গুলি চালাচ্ছিলো। সোহার মুখে মাস্ক থাকলেও আরহান এর চিনে নিতে কোনো অসুবিধা হয়নি যে এটা সোহা। আর গাড়িটা যখন একদম সোহার সামনাসামনি এসে গেছিলো তখন যেনো তার বুকের মধ্যে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছিলো হটাৎ করেই এক ঝাঁক ভয় ও কিছু হারানোর ভয় পেয়ে বসেছিল তাকে। তার শুধু মনে হচ্ছিলো এই মেয়ে টাকে তাকে বাচাতে হবে। এই মেয়ে কে কিছু হতে দেওয়া যাবেনা তাহলে সে আবার তার সব কিছু হারিয়ে ফেলবে। আরহান সোহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সেও সেই দিকে এগিয়ে যায়।

সোহা এগিয়ে যায় লোকটার দিকে ততক্ষণ সেখানে অ্যাস নীহার আকাশ সানি ও চলে আসে। তারা গাড়িতে ছিল তাই পৌঁছাতে একটু দেরি হয়ে যায় তাদের। সোহা গিয়ে লোকটার পাশে এক হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। লোকটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে সোহা তার দুই পায়ে গুলি করেছে তাই আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি সেই ভাবেই রাস্তার এক পাশে পড়ে আছে। সোহা লোকটার চুলের মুঠি ধরে মুখটা উঁচু করে তোলে।

-“খুব ছুটে নিয়েছিস এবার একটু বিশ্রাম কর একটু পরেই তোর খাতিরদারি শুরু হবে চাপ নেই।

বলেই আবারো দুম করে মাথাটা ছেড়ে দেয় সাথে সাথে মুখটা গিয়ে আবারো রাস্তার উপরে পড়ে সাথে সাথে মুখ দিয়েই একটা মৃদু চিৎকার বেরিয়ে আসে। সোহা ছেড়ে দিতেই আকাশ সানি ওকে টেনে গাড়িতে তুলে নেয়। সোহা উঠে দাঁড়িয়ে যেতেই দেখে তার পাশে আরহান এসে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ।

-“তোরা চল আসছি আমি। সোহা বাকিদের উদ্দেশে বলে ওঠে।

আকাশ সানি নীহার অ্যাস চলে যেতেই সোহা আরহানের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। মুখে এখনও মাস্ক লাগানো তাই মুখের হাসিটা বোঝা যাচ্ছে না তবে সোহার চোখ দুটো যে হাসছে সেটা বোঝা যাচ্ছে।

-” থ্যাঙ্কস আমাকে সেভ করার জন্য ভাইয়া। সোহা বলে ওঠে।

“ভাইয়া”শব্দটা উচ্চারণ করার সময়ে সোহার গলাটা কেমন কেঁপে উঠেছিল সাথে এই ডাকের সাথে জুড়ে ছিল অনেকটা আবেগ আর ভালোবাসা। যেটা সামনে দাঁড়ানো আরহান ও উপলব্ধি করতে পেরেছে।

-” আবারো দেখা হবে। আসি এখন। বলে সামনে পা বাড়ায়।

-” কোথায় যাবে আমি তোমাকে ছেড়ে দেই? আরহান বলে ওঠে।

-“কিন্তু আমার মনে হয় আপনি কোনো কাজে যাচ্ছিলেন আপনার দেরি হয়ে যেতে পারে। সোহা বলে ওঠে।

-” আরে কোনো ব্যাপার না এসো। আরহান হেসে বলে ওঠে।

সোহা এক পলক আরহান এর মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে পা বাড়ায় আরহানের গাড়ির দিকে। আজ আরহানের জায়গায় অন্য কেউ হলে সে এক কথায় নাকচ করে দিয়ে চলে যেতো। আর আজ সে আরহান এক কথায় তার সাথে যেতে রাজি হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে সোহাকে দেখলে মনে হবে সে আবেগে আপ্লুত হয়ে আছে। তার জীবনের না পাওয়া কোনো কিছু সহজেই পেয়ে যাচ্ছে। অনেক না পাওয়া কিছু পেতে চলেছে। গাড়িতে উঠে বসে সোহা মুখের থেকে মাস্ক খুলে ফেলে। আরহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সোহার দিকে। কপালের কেটে যাওয়া জায়গায় চোখ পড়তে তাড়াতাড়ি করে গাড়ির সামনের ডেস্ক থেকে ফার্স্ট এড বক্স বের করে সোহার কপালে মেডিসিন লাগিয়ে দিতে থাকে। সোহা কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরহানের দিকে। আজ সে পুরো তার চরিত্রের বিপরীতে চলে গেছে। তার আচরণ আজকে বদলে গেছে। এই মুহূর্তে যদি তার চারজন বন্ধু থাকতো তাহলেই তারা অজ্ঞান হয়ে যেতো সোহার এই রূপ দেখে। সোহার চোখের কোন ভিজে এসেছে। পানিরা ভিড় করে এসেছে তার চোখে। একরাশ আবেগ ভালোলাগা নিয়ে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে আরহানের দিকে। আরহান চোখ তুলে সোহার মুখের দিকে তাকাতে থমকে যায়। সোহার এইরকম প্রতিক্রিয়া দেখে আরহান তাকিয়ে থাকে। তার মনে থাকা প্রশ্নরা যেনো এখনই ডানা মেলে বের হয়ে আসতে চাইছে। তার মনে হচ্ছে সে আজ জানতে পারে সোহার সাথে তার কোনো কানেকশন আছে কিনা। ততক্ষণে মেডিসিন লাগানো হয়ে গেছে। সোহা সোজা হয়ে বসে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। আর আরহান সে এখনও তাকিয়ে আছে সোহার মুখের দিকে।

-“তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো উত্তর দেবে? আরহান ইতস্তত করে বলে ওঠে।

আরহানের গলা শুনে সোহা কিছুটা চমকে যায়। সোজা হয়ে বসে আরহানের দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা নাড়া দেয়। সাথে সাথে আরহান তার পকেট থেকে একটা ছবি বের করে সোহার দিকে এগিয়ে দেয়। সোহা হাসি মুখে ছবিটা হাতে তুলে নেয়। কিন্তু সাথে সাথে তার প্রতিক্রিয়া পাল্টে যায় ছবিটা দেখে।

-“তুমি বলতে পারবে কি কানেকশন এই ছবির সাথে তোমার? কে তুমি? আরহান একরাশ উৎকন্ঠা নিয়েই প্রশ্ন করে ওঠে।

সোহা কোনো কথা না বলে ছবি টা হাতে নিয়ে অন্য হাত দিয়ে ছবিটার উপর হাত আঙুল দিয়ে বুলিয়ে যাচ্ছে। চোখে পানি ভরে উপচে পড়ছে গাল বেয়ে দু চোখে যেনো আজকে সোহার বন্যা শুরু হয়েছে। আরহানের ও চোখ শুষ্ক নেই সোহার প্রতিক্রিয়া এমনিতেই তাকে ইমোশনাল করে দিয়েছিলো আর এখন সোহার চোখের পানি দেখেই আরহান বোঝে এই ছবির সাথে খুব গভীর সম্পর্ক সোহার। তারমানে সে ঠিক ছিল। সে আজ তার প্রশ্নের উত্তর পেতে চলেছে এতদিন পরে।

-“কি হলো বলো তুমি কিছু জানো কিনা? আরহান কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে ওঠে।

-” মাম ।

অস্পষ্ট ভাবে সোহার মুখ দিয়েই বেরিয়ে আসে এই শব্দটা। আরহানের কানে কথাটা যেতেই থমকে যায়। তার সারা শরীর যেনো বরফের ন্যায় জমে গেছে। সে কি ঠিক শুনেছে সোহা যা বললো? না কিসে ভুল শুনলো? আরহান আর কোনো কিছু প্রতিক্রিয়া করার অবস্থায় নেই সে পাথরের মত চুপ করে সোহার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানির ফোটা।

চলবে…… ❣️

ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন…। নিজেদের মতামত জানাবেন ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here