তুলি_কোথায়,১ম_পর্ব

#তুলি_কোথায়,১ম_পর্ব
#Misk_Al_Maruf

ছোটবোন ফোন দিয়ে ভয়ার্ত স্বরে বললো,
“ভাইয়া তুলি আপুকে পাওয়া যাচ্ছে না। আজকে সকাল থেকে পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করেও খুঁজেও কেউ পায়নি। মনে হয় ঐ ভূতটাই তুলি আপুকে তুলে নিয়ে গেছে।”
মিলার কথা শুনে মুহূর্তেই আমার বুকের মধ্যখানটা ছ্যাঁত করে উঠলো। একসপ্তাহ পরেই তুলির সাথে আমার বিয়ে আর এই মুহূর্তে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কখনোই কাম্য নয়।

তুলি সম্পর্কে আমার চাচাতো বোন। ছোটবেলাতেই আমার বাবা এবং চাচা ঠিক করে রেখেছিলেন যে বড় হলে আমার সাথে ওকে বিয়ে দিবেন। আর আমারও ছোটবেলা থেকেই ওকে বিয়ে করতে কোনো দ্বিমত ছিল না। কারণ মেয়েটি যেমনি সুন্দরী তেমনি বহু গুণে গুণান্বিত।
পাকিস্তান আমলে আমার দাদা এক হিন্দু জমিদারের বংশধর থেকে একটি বিশাল বাংলো কিনেছিলেন আর সেখানেই আমরা সহ আমার ছোট চাচার পরিবার যৌথভাবে বাস করে এসেছি। কিন্তু ইদানীং কালে প্রায়শই আমার মা ফোন দিয়ে বলতেন বাড়ির আশেপাশের বাগান দিয়ে নাকি রাতের বেলা মাঝেমধ্যেই সাদা কাপড় পরিহিত কেউ হেঁটে বেড়ায়। যদিও এর সত্যতা কতটুকু তা আমার জানা নেই কিন্তু এক এক করে যখন বাড়ির অনেকেই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে থাকে তখনি আমার মনে এক অজানা চিন্তার ভাঁজ উঁকিঝুঁকি দেয়।

মিলার কথার প্রতিউত্তরে আমি উৎকণ্ঠা নিয়ে বলি,
“কি বলিস এসব! আর ভূত আসবে কই থেকে? তুই মা’কে ফোনটা দে তাড়াতাড়ি।”
আমার কথা শুনে মিলা সাথে সাথে মায়ের কাছে ফোন দিতেই তিনি কান্নামিশ্রিত স্বরে বললেন,
“মারুফ! তুলিকে সেই সকাল থেকে পাচ্ছি না। তোর চাচী বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। হঠাৎ করে মেয়েটা কোথায় গেলো বুঝতে পারছি না।”
“কোন সময় গেছে, তোমরা আলাপ পেয়েছো? তুলির সাথেতো মিলা রাতে একত্রে ঘুমায় তাহলে ও বুঝতে পারেনি যে তুলি কোথায় গেছে?”
“ও আর কি বুঝবে? ঘুমালে কি কিছু হুঁশ থাকে? ছোট মানুষ তাই হয়তো বুঝতে পারেনি। আমার মনে হয় ঐ জ্বীনেরই কোনো কাজ হবে। কি ভেবে যে আমাদের উপরেই কুনজর দিলো বুঝতে পারছি না। তোর বাপকে হাজারবার বলছি বাড়িটা যেন কবিরাজ এনে বন্ধ করে যাতে জ্বীনের কুনজর না পরে। কিন্তু সেতো শুনলোই না আমার কথা, আর আজকে তার ফল!”
মায়ের কথা শুনে অন্য সময় হলে আমি ঠিকই এসব নিয়ে তর্কে জড়াতাম কিন্তু এমুহূর্তে কেনো যেনো তর্কে জড়ানোটা সমীচীন মনে করলাম না। নিজেকে যথেষ্ট সান্ত্বনা দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলি,
“আচ্ছা আমি বিকালেই রওনা দিয়ে আসতেছি। তুমি আব্বুকে আর চাচাকে বলো ভালো ভাবে খোঁজ নিতে।”
আমার কথা শুনে মা ভাঙ্গা গলায় বললেন,
“তারা কোনো জায়গায় খোঁজ করা বাদ রাখেনি। তোর ছোটভাইও ওর বান্ধবীদের বাসায় খোঁজ করেছে কিন্তু সবাই বললো ওদের বাসায় নাকি তুলি যায়নি।”
মায়ের কথা শুনে আমার হৃদয় গহীনে তুলির জন্য কিঞ্চিত ব্যাথা অনুভূত হলো বটে পরক্ষণেই আমি কোনোরকম সান্ত্বনা দিয়ে মাকে বিদায় জানালাম।

দাদা দাদী বেঁচে থাকা হতে আজ অবধি আমরা দুই পরিবার কোনো ঝগড়াঝাটি ছাড়াই বাস করে এসেছি। লোকে বলে দুই ভাই একত্রে থাকলে নাকি কোনো কোনো না কোনোদিন ঝগড়া লাগবেই। কিন্তু আমার মা কিংবা চাচী উভয়েই ছিলেন শান্ত প্রকৃতির মানুষ তাই আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে ঝগড়া লাগা তো দূরে থাক এখন পর্যন্ত কেউ আলাদা বসে খাবার খেয়েছে কিনা সন্দেহ। পড়ালেখা শেষ করার সাথে সাথেই যখন আমার সরকারী চাকুরীটা হয়ে গেলো তখন আমার পরিবারের থেকেও আমার চাচী ছিলেন সবচেয়ে বেশি খুশি। কারণ তিনি কখনো আমাকে অন্য চোখে দেখেননি বরং সবসময় ছেলের চোখে দেখেছেন। তাছাড়া আমি যে তার ভবিষ্যৎ মেয়ে জামাই হবো সেই হিসেবে তিনি আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন। অপরদিকে তুলির কথা যদি বলতে হয়, মেয়েটি বেশ চুপচাপ স্বভাবের। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত আমার সাথে দু’মিনিট বসে কথা বলেছে কিনা সন্দেহ। আমি ভাবতাম হয়তো লজ্জা পেয়েই কথা বলে না, কিন্তু অন্য কারণ থাকলেও থাকতে পারে। তবে মেয়েদের মন বোঝার সাধ্য আমার নেই।

কোনোরকম চারদিনের ছুটি নিয়ে অফিস ত্যাগ করে মেসে চলে আসলাম। সরকারী চাকুরিজীবীদের ছুটি পাওয়াটা যে চারটে খানি কথা নয় সেটা হয়তো অনেকেরই জানা। মেসে প্রবেশ করতেই আমার মোবাইলে রিং বেজে উঠলো, তখনি আর দেরী না করে পকেট থেকে ফোনটি বের করেই দেখলাম আমার বাবা কল দিয়েছে। কলটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উৎকণ্ঠা নিয়ে তিনি বললেন,
“হ্যালো! তুলিরতো এখনো কোনো খোঁজ পাইনি। তোর চাচা কিছুক্ষণ আগে একজন কবিরাজ নিয়ে আসছিল বাড়িতে। কবিরাজ বলছে যে তুলিকে নাকি এক জ্বীনে ধরে নিয়ে গেছে, বহুদিন ধরেই নাকি ওর প্রতি জ্বীনের নজর ছিল।”
আমি কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করি,
“সেটা বুঝলাম কিন্তু ওকে কিভাবে নিয়ে আসা যায় সেসব ব্যপারে কিছু বলেনি?”
বাবা চিন্তিত মুখে বললেন,
“হুম কিন্তু এই কবিরাজকে কেমন যেন আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ও বললো তুলিকে ফিরিয়ে আনা যাবে কিন্তু তাতে নাকি অনেক টাকা খরচ হবে। আমারতো মনে হয় এই ব্যাটা পুরাই ধান্দা বাজি করতে এসেছে এখানে। নাহলে প্রথমেই কেনো টাকার কথা তুলবে?”
বহুদিন পর বাবার এমন বুদ্ধিদীপ্ত কথা শুনে আমি বেশ খুশি হলাম বটে পরক্ষণেই বললাম,
“আচ্ছা বুঝেছি! তোমরা ওকে ভুলেও টাকা দিও না। আমি আসার পর যা করার করবো। একটু পরেই রওনা দিচ্ছি।”
বাবা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ঠিক আছে তাড়াতাড়ি চলে আয়! মেয়েটিকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে। পুলিশকে জানাবো কিনা ভাবতেছি।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি,
“তোমরা এখনো বিষয়টা পুলিশকে জানাওনি? কি করছো তোমরা ওখানে বসে?”
আমার রাগমাখা কথা শুনে তিনি বলেন,
“ঠিক আছে আমি এখনি যাচ্ছি। তুইও তাড়াতাড়ি চলে আয়।”
এই বলেই আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি কলটি কেটে দিলেন।

বাড়িতে পৌঁছেছি সন্ধ্যার দিকে। কিন্তু আসার পর কোনোভাবেই নিজের মন কে সান্ত্বনা দিতে পারছি না। ওদিকে পরিবারের সবাই মেয়ে হারানোর শোকে পাগলপ্রায় অবস্থা। ছোটবোন মিলা এবং আমার ছোটভাই মুনিম আমার সাথে বসে আছে। মুনিম আর তুলি প্রায় সমবয়সী, যখন দুজনের বয়স একবছর তখন আমি সবে ক্লাস ফোরে পড়ি। আমি নিজে তখন বেশ ছোট হলেও তুলি আর মুনিম দুজনকে দুই কোলে নিয়ে হাঁটতাম। সেসব দৃশ্য মনে আসতেই আমার মনটা মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেলো। নিরবতা ঠেলে মুনিম বলে ওঠে,
“ভাইয়া! আমার মনে হয় এটা সত্যিই কোনো ভৌতিক কাজ। পুলিশকে আব্বু জানিয়েছিল কিন্তু কোনো লাভ হবে কিনা জানিনা। তারা হয়তো দুই-একদিন ঘুরে ফিরে যেইসেই।”
পাশ থেকে মিলা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে আমার হাত ধরে বললো,
“ভাইয়া তুমি যেভাবেই হোক তুলি আপুকে এনে দাও। আমি আপুকে ছাড়া ঘুমাতে পারিনা।”
আমি তখনো নিশ্চুপ হয়ে স্বস্থানেই বসে আছি। কিছুক্ষণ নিরবতার পর আমি মুনিম কে জিজ্ঞেস করলাম,
“আচ্ছা রাতে যে বাড়ির আশেপাশে সাদা কাপড় পরে কেউ ঘুরে বেড়ায় সেটা কি তোরা দেখছিস?”
মুনিম উৎফুল্ল স্বরে বললো,
“ভাইয়া আমি কালকে রাতেও দেখছি। দোতলার জানালা দিয়ে যখন বাহিরে তাকাই তখন দেখি ঘাঁটের ঐদিকটায় কেউ একজন হাঁটাহাঁটি করছে। পূর্ণিমার আলোতে স্পষ্ট দেখেছিলাম সাদা কাপড় পরা। পাঁচমিনিট যখন একনজরে তাকিয়ে ছিলাম তখনি সেটি দূর থেকে জানালার দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখেই কেমন ভাবে যেনো চলে গেলো।”
আমি কৌতূহল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“দেখতে কেমন? মানে বাচ্চা নাকি মধ্যবয়সী?”
“বাচ্চা না তবে মধ্য বয়সীদের মতোই ছিল। ছোট চাচাও নাকি দেখেছে, আর উনি একটু ভীতু টাইপের সেটাতো জানোই। কিন্তু আব্বু একদিনও দেখেনি এমনকি দুই একদিন মধ্যরাতে বাহিরে মহড়া চালিয়েও কাউকে পায়নি। আর তুলি যেহেতু রাতেই গায়েব হয়েছে আমার মনে হয় সম্ভবত ঐ জ্বীনই কিছু করেছে।”
আমি ধমক দিয়ে বললাম,
“ধুর! কি বলিস! আচ্ছা ধরলাম জ্বীনই তাহলে তুলিতো ছিল বাসার মধ্যে, তারমানে ওকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে, এটা হয় নাকি?”
আমার কথা শুনে মুনিম সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,
“ভাইয়া তুমিতো কিছুই জানো না। কয়দিন আগেও আমার এক বন্ধুর মা’কে বাসা থেকে জ্বীনেরা তুলে নিয়ে গিয়ে ক্ষেতের মধ্যে গেড়ে রাখছিল। জ্বীনদের ক্ষমতা অনেক, ওদের ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার পুরোপুরি ধারণা নেই।”
“আচ্ছা বাদ দে। আজকে আমিও পুরো বাড়ি মহড়া দিবো দেখি কোন জ্বীন বাড়িতে ঘোরাঘুরি করে। তোরা এখন যা। আমাকে একা থাকতে দে।”
আমার কথা শুনে ওরাও অনেকটা মন খারাপ করে চলে গেলো।

রাত এখন একটা…
তুলির চিন্তায় কিছুতেই চোখের পাতা এক করতে পারছি না। শুধু আমি না, বরং বাড়ির কেউই এখনো হয়তো ঘুমায়নি। রাতে এসে মা জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমার জন্য কি রান্না করবেন? আমি সাফ সাফ বলে দিয়েছি যে,
“এই মুহূর্তে খাওয়ার একদমই ইচ্ছে নেই।”
মা হয়তো আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছেন তাই আর কিছু বলেননি। রাতে দুটো বিস্কুট খেয়ে তিনঘন্টা যাবৎ বিছানায় শুয়ে আছি, কিন্তু চোখের পাতা এক করতে পারিনি।
হঠাৎই বাড়ির উঠানে কারো হাঁটার শব্দ পেয়ে আমার চেতনা জেগে উঠলো। সাধারণত অন্যদের তুলনায় আমার শ্রবণশক্তি অনেকটাই বেশি তাই কোনো কিছুর সামান্য শব্দেও আমার কানে তীক্ষ্ণভাবে আঘাত করে। কৌতূহল বসত জানালা দিয়ে তাকাতেই খেয়াল করি ঘাঁটপারের আশপাশ দিয়ে কেউ হাঁটাচলা করছে। কিন্তু আকাশ মেঘলা হওয়াতে চাঁদের আলোটা পরিপূর্ণভাবে সেখানে পরছে না, তাই সেটাকে দেখতেও পারছিনা। আমি আর একমুহূর্ত দেরী না করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলাম। অন্ধকারের প্রকোপ তেমন একটা না হওয়ায় কোনোরকম টর্চ লাইটের আলো ছাড়াই আস্তে আস্তে সেখানে এগিয়ে যাচ্ছি। যতই এগোচ্ছি ততোই শুকনো পাতার উপর দিয়ে হাঁটার শব্দের তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যখনি ঘাঁটের খুব কাছাকাছি চলে আসলাম তখন আচমকাই হাঁটার শব্দটি থেমে গেলো। ঠিক তার পরক্ষণেই পেছন থেকে একটি শীতল হাত আমার কাঁধে স্পর্শ করতেই সমস্ত শরীর জুড়ে এক অন্যরকম শিহরণ বয়ে গেলো। পিছনে তাকানোর আগেই অজানা এক শক্তি আমার মুখের পাশ দিয়ে রুমাল জাতীয় কিছু একটির ছোঁয়া দিলো। আমি সেই সত্ত্বাকে দেখার আগেই মূর্ছা গেলাম। এরপর আর কিছু মনে নেই।

[To be continued]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here