তুমি রবে নীরবে পর্ব ৪

তুমি রবে নীরবে
পর্ব ৪

ঘুম থেকে উঠেই দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে চোখ গেল বাবাই এর, অনেক টা দেরি হয়ে গেছে আজ অন্য দিনের তুলনায়, হসপিটালে বেরোতে দেরি হয়ে যাবে, কাল মাথা ব্যথায় ঘুম আসতে অনেক দেরি হয়েছিলো, এখনও যেনো একটু ধরে আছে, কপালের দুদিকে আঙ্গুল টিপে ধরলো ও।

কিন্তু স্নেহা গেলো কোথায়, অন্যদিন তো চায়ের কাপ নিয়ে এসে ডাকে ও, আজ কোনো সাড়াশব্দ নেই কেনো, ঘুম থেকে উঠেই চা না পেলে আরো মাথা টা ধরে যায় যেনো। বড্ড খারাপ অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে, এতকাল তো বাইরে বেরিয়ে মোড়ের মাথায় গিয়ে চা খেয়ে আসতো সেই হোস্টেল লাইফ থেকেই, গত এক মাসে স্নেহা আসার পর ওর রুটিন গুলো বদলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। এখন ঘুম থেকে উঠেই হাতের সামনে চায়ের কাপের অভ্যাস হয়ে গেছে ওর, মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলো বাবাই।

বাথরুমে ঢোকার সময় দেখলো স্নেহা ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে জল দিচ্ছে গাছে, চা চাইবে কিনা ভেবেও না চেয়েই বাথরুমে ঢুকে গেলো ও। বেরিয়ে এসে দেখলো বিছানার পাশের টেবিলে চায়ের কাপ রাখা আছে, এর মধ্যেই চা করে রেখে গেছে, তার মানে ওকে বাথরুমে ঢুকতে দেখেছে স্নেহা, বড্ড বেশি কেয়ারিং যেনো। যাইহোক এই মুহূর্তে চা টা সত্যিই খুব দরকার ছিল, মনে মনেই ধন্যবাদ জানালো স্নেহা কে।

আজ পর্যন্ত বিয়ের পর থেকে ও স্নেহার সঙ্গে কত গুলো কথা বলেছে গুনে বলতে পারবে, যা বলেছে সবই বিয়ের আগে, তখন যে ওর স্নেহা কে খুব একটা খারাপ লাগতো তা নয়, বরং ছোটো থেকে বিয়ের কথা জানা ছিল বলেই একটু অন্যরকম ভালোলাগাও ছিলো তখন। তারপরে কি যে হলো, হোস্টেলে আসার পর থেকেই বাড়ি যাওয়াটা কমছিল, তার পর মেডিক্যালে চান্স পাবার পর সায়ন্তির সাথে আলাপ হয়ে আরও বাড়ি যাওয়া কমিয়ে দিলো ও, স্নেহার জায়গাটা যে কখন সায়ন্তি নিয়ে নিলো নিজেই বোঝেনি বাবাই।

প্রথম দিকটা ও সায়ন্তি কে আটকাতে চেষ্টা করেছিল খুব, সেকেন্ড ইয়ারে যেদিন ওকে প্রপোজ করেছিলো সায়ন্তি, সোজা না বলে দিয়েছিলো বাবাই, মনের মধ্যে স্নেহার মুখটা ভেসে উঠেছিল। কিন্তু একসঙ্গে থাকতে থাকতে যে কি ভাবে জড়িয়ে পড়লো ক্রমশ, মাঝে মাঝেই নিজেও ভাবে সেটা। আসলে হোস্টেলের একাকীত্ব, স্নেহার সঙ্গে দেখা হওয়া কমে যাওয়া, আর বার বার করে সায়ন্তির কান্নাকাটি যে কখন ওকে দুর্বল করে ফেললো ও নিজেই বোঝেনি। একটু দুস্থ ফ্যামিলি সায়ন্তির, তাই অনেকটাই চাপে থাকে ও, বাবাই ওর সাধ্যমতো ফিনান্সিয়াল হেল্প করে ওকে, তবুও সায়ন্তি কিছুতেই যেনো বাড়ির চাপ পূরণ করতে পারেনা। সেই চাপেই বিয়ের রিস্ক নিতে চায়নি ও,

কোনো অসুবিধা হবেনা, যেরকম হেল্প করি সেইরকম ই করবো, তুই চিন্তা করিস না,

অনেক বুঝিয়ে ছিলো বাবাই। একমাত্র রেজিস্ট্রি করাটাই যে বিয়ে টা ঠেকানোর উপায়, বার বার করে বলেছিলো সায়ন্তি কে। শেষে এই কথাও বলেছিলো,

তাহলে আমাকে বিয়ে করে ফেলতে হবে, কিছু করার থাকবে না কিন্তু, তখন তোর সঙ্গে আর সেই রকম সম্পর্ক রাখতে পারবো না আমি, জানিস তো তখন আমাদের রিলেশন টা কে অবৈধ বলবে লোকে।

সব জানি, কিন্তু কিছু করার নেই, বাবার শরীর খারাপ, ভাইয়ের পড়াশুনা অনেক দায়িত্ব রে আমার, তুই বিয়ে করে ফ্যাল, শুধু প্রয়োজনে পাশে থাকিস তাহলেই হবে,

আর কিছু করার ছিলনা বাবাই এর। সায়ন্তির কিন্তু একটাই প্রয়োজন টাকা, এটা ছাড়া আর খুব বেশি বাবাই কে ডাকেনা ও, যখনই ফোন করে বাবাই জানে কিছু সাহায্য প্রয়োজন, সাধ্য মত চেষ্টা করে ও। কোনো কোনো সময় খুব খারাপ লাগে, তখন নিজেকে কেমন টাকার মেশিন মনে হয় বাবাই এর।
এমনি তে তো ডাকিস না কোনো দিনও,
অভিযোগ করেছে ও অনেক বার,

তোর ফ্যামিলি লাইফ এ ঢুকতে চাইনি তাই,
উত্তর দেয় সায়ন্তি।

ফ্যামিলি লাইফ কি সত্যিই আছে কিছু ওর, নিজেই বুঝে উঠতে পারেনা বাবাই।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঝট পট উঠে পড়ল এবার, স্নান করতে ঢুকতে হবে না হলে দেরি হয়ে যাবে, মাথা ব্যাথাটা কমে গিয়েছে চা খেয়ে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ড্রেস করতে করতে দেখলো, ব্রেকফাস্ট রেখে দিয়েছে স্নেহা টেবিলে, তাড়াতাড়ি খেতে বসে গেলো ও। রুটি, তরকারির সঙ্গে পাশে রাখা পায়েসের বাটি টা দেখে বুঝলো, সম্ভবত কাল ওর জন্মদিনের জন্য বানিয়েছিল এটা, কালকের থালা ছুঁড়ে ফেলার কথা টা মনে হতেই নিজেকে সংযত করল, নাহ! আজ আর সিন ক্রিয়েট করবেনা, সকাল বেলায় অশান্তি ভালো লাগছে না, কোনো কথা না বলে বাটিটা টেনে নিলো বাবাই।

পায়েস টা সত্যিই খুব ভালো হয়েছে, এক চামচ মুখে দিয়েই বুঝলো, স্নেহা বোধহয় কিছু একটা অশান্তির আশঙ্কায় হাতের মুঠি শক্ত করে দাঁড়িয়েছিলো, বাবাই এর মুখের এক্সপ্রেশান দেখে আলগা করলো মুঠিটা, লক্ষ্য করলো ও। স্নেহার জন্যে খারাপ লাগলো একটু, বেচারা ছোটো থেকেই বড্ড শান্ত গোছের, বাবাই এর এই সব কাণ্ড কারখানায় কেমন যেনো সিঁটিয়ে থাকে সব সময়।

কোনো কথা আর না বলে খেয়ে উঠে গেলো বাবাই, আজ সকালেই আবার নতুন করে আঘাত দিতে ইচ্ছা করছেনা, কাল মনে হয় রাত্রে খায়নি ও। হয়ত বাবাই এর কাছ থেকে, পায়েসের কোনো প্রশংসা আশা করেছিল, কিন্তু মুখে কিছু বলবে না ঠিক করে নিলো বাবাই, একদিন প্রশংসা করা মানেই ওকে কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দেওয়া, সেটা কিছুতেই করতে পারবেনা ও। এই টাই হয়ত শুরু হবে কথা বলার, সেটা একদম চায় না ও, সায়ন্তি র মুখটা মনে করে নিজের ঠোঁটের সামনে উঠে আসা প্রশংসা সূচক শব্দ গুলো কে গিলে নিলো ভেতরে।

চট করে রেডী হয়ে ফ্ল্যাটের দরজা টা টেনে দিয়ে লিফটে করে নিচে নেমে এলো, দরজা বন্ধ করতে ও কোনো দিনও ডাকেনা, ও চায় না স্নেহা ওর বেরোনোর সময় দরজার কাছে থাকুক, প্রথম দিনই বলে দিয়েছিলো, সেটা মেনেই চলে স্নেহা, অনেক টা দূরে রান্না ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ও। নিচে নেমে একবারও ওপরের দিকে তাকালোনা বাবাই, কারণ ও জানেই ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে আছে স্নেহা, এই অপমান গুলো করে একটা অদ্ভুত শান্তি পায় ও, নিজের ভেতরের চেপে রাখা জ্বালা টা যেনো কিছুটা হলেও কমে বলে মনে হয়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here