তুমি রবে নীরবে পর্ব ৩

তুমি রবে নীরবে
পর্ব ৩

ভোর বেলা ঘুম ভেঙে গেলো স্নেহার, বাবাই পাশেই ঘুমিয়ে আছে অন্য দিকে ফিরে, এই একটা সমস্যা এখানে, যেহেতু এটা সিঙ্গেল রুমের ফ্ল্যাট, ইচ্ছে থাকলেও অন্য আলাদা ঘরে শুতে পারেনা ও, কিন্তু একটুও এই ঘরে বাবাই এর সঙ্গে থাকতে ইচ্ছা করেনা, বাবাই এরও করেনা সেটা ও জানে, কিন্তু আর কোনো অপশন নেই তাই এই ব্যবস্থা। যে স্বামী ফুলশয্যার দিনই স্ত্রী কে বলে, অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তার, স্ত্রী কে তার জায়গা দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয় সে,তার সঙ্গে থাকতে কোন মেয়েরই বা ভালো লাগে,এর থেকে কোনো স্ত্রীর জন্য অপমানকর আর কিই বা আছে। কিন্তু স্নেহা ফিরে যেতেও চায়না বাবা, মায়ের কাছে, কারণ যে বাবা , মা সবটা জেনেও মেয়ের বিয়ে দেয় এই ছেলের সঙ্গে তাদের কাছে আর কিছু আশা করেনা ও। মা বলেছিলো বাবাই নিজেই পরে এই বিয়েটা করতে চেয়েছিলো, তাই রাজি হয়েছিলো স্নেহা, কিন্তু এখন ওর মনে হয় মা বোধহয় ঠিক কথা টা জানায়নি ওকে, নাকি মা নিজেও জানেনা সবটা, বুঝতে পারেনা ও।

মাঝে মাঝে ওর মনে হয় মা বোধহয় ওর থেকেও বাবাইকে বেশি ভালোবাসে। তাই বাবাই এর এইসব কথা জানার পরেও মায়ের মনে হয়েছিল, এগুলো সাময়িক, বিয়ের পরে সব ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে, ঘি আর আগুন পাশা পাশি থাকলে গলতে বাধ্য। এটা শুধু মা নয় মামনির ও কথা ছিল, কিন্তু মামনির না হয় স্বার্থ ছিলো নিজের ছেলে বলে, কিন্তু মা তো ওর নিজের সেও কিন্তু বান্ধবীর সুরেই সুর মিলিয়েছিল তখন। আসলে মা আর মামনি সেই ছোটো বেলার বন্ধু, বিয়েও হয়েছে দুই বন্ধুর সঙ্গেই, স্নেহার মায়ের বিয়েতে বরযাত্রী গিয়েই নাকি বাবাই এর দাদু নিজের ছেলের জন্য মামনি কে পছন্দ করেছিলেন। বাপি আর স্নেহার বাবাও অভিন্ন হৃদয় বন্ধু সেই স্কুল জীবন থেকেই। সেই জন্যই ওদের দু বাড়ির বন্ডিং এত বেশি। সেই বন্ডিং টাই আত্মীয়তায় বদলাতে চেয়েছিলো দুই বাড়িই, এসব গল্প শুনে শুনেই স্নেহা বড়ো হয়েছে এতদিন।

বাবাই এর বোন টুয়া আবার স্নেহার ক্লাস মেট, শুধু ক্লাসে নয় এমনিতেও ওদের গলায় গলায় বন্ধুত্ব সেই ছোটো বেলা থেকেই। ওরা সবাই ছোটো থেকেই স্নেহার বাবা, মা কে বাবা মা, আর বাবাই এর নিজের বাবা মা কে বাপি, মামনি ডাকতে অভ্যস্ত। এমন কি টুয়া ও তাই ডাকে। এই ডাক টা র পেছনে একটা কারণ আছে, সেই কারণ টা প্রায় সবাই জানতে চায়, কারণ সবারই খুব অদ্ভুত লাগে এরকম শুনতে তাই। আর ওদেরও বলে বলে মুখস্থ হয়ে গেছে একদম। স্নেহার মা আর ওর শাশুড়ি মানে বাবাই এর মা একসঙ্গেই কনসিভ করেছিল প্রায়। দুজনেরই ছেলে হয়ে ছিলো, কিন্তু স্নেহার মায়ের সেই ছেলেটি জন্মের পর পরই মারা যায়, সেই থেকে একটা ডিপ্রেসনে ভুগছিল ওর মা। তখন মামনি বাবাই কে তুলে দিয়েছিলেন বান্ধবীর হাতে। বাবাই তাই স্নেহার মায়ের কাছেই মানুষ, ওনাকেই মা ডাকতে অভ্যস্ত ও, তাই নিজের সুবিধার জন্যই নিজের মা কে মামনি ডাকে বাবাই। সেই ডাক শুনে শুনেই টুয়া আর স্নেহাও ডেকে এসেছে এতদিন।

সেই জন্যই স্নেহার মা, বাবাই এর স্নেহে অন্ধ একদম, ওর কোনো দোষ আছে বলেই মনে করে না, আর বাবাই স্নেহার সঙ্গে এরকম করলেও মা কে আর মামনি কে রাতে ফিরে ফোন করতে ভোলে না কখনও। আস্তে আস্তে অভিমান জন্মে গেছে এখন, নিজের বাড়ি ফিরতে চায়না স্নেহা আর, মা ও খালি অ্যাডজাস্ট করার কথাই বলে, বাবাই আসলে যে স্নেহার সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করে সেটা বিশ্বাস করেনা একদম। প্রথম প্রথম বলতে চেষ্টা করতো স্নেহা, ক্রমশ সহানুভূতির বদলে অ্যাডজাস্ট করার পরামর্শ শুনে শুনে এখন আর কিছু বলেনা কাউকে, বাড়িতে কয়েকদিন ছাড়া একটা নিয়ম মাফিক ফোন করে শুধু।

একমাত্র টুয়া বোঝে ওকে, জানে সেটা, ওই একমাত্র আপত্তি জানিয়েছিল বিয়ের সময়। জানিস তো সারাজীবন আমি চেয়েছিলাম তুই আমার বৌদি হবি, আমরা কোনো দিনও আলাদা হবো না আর, কিন্তু বিশ্বাস কর, দাদাভাইয়ের এই ঘটনা জানার পর তোকে দাদাভাই কে বিয়ে করতে বলতে একটুও ইচ্ছা হচ্ছেনা আমার। কিন্তু টুয়া র মতামতের খুব বেশি গুরুত্ব ছিলো না , আর স্নেহা নিজেও তো বাবাই ছাড়া অন্য কাউকে স্বামীর জায়গায় বসায়নি কোনো দিনও, তাই খুব বেশি আপত্তি তো ও নিজেও জানায়নি সেদিন। দুটো পরিবারই এই বিয়েটা দিয়ে নিজেদের বন্ধুত্ব কে আরো শক্ত করতে চেয়েছিল বোঝে স্নেহা, আর মা কিছুতেই চায়নি, বাবাই আর অন্য কাউকে মা বলে ডাকুক কোনোদিনও, তাই বোধহয়,নিজের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাবাই কে সত্যিই নিজের ছেলে করে নিতে চেয়েছিল। যে মা ডাকটা মিথ্যে ছিলো এতদিন, সেই ডাক টা কে সত্যি করে নেবার ইচ্ছে টা পূরণ করে নিয়েছিল স্নেহার মা।

একমাত্র বাবাই বেরিয়ে গেলে স্নেহা নিয়ম করে কথা বলে শুধু টুয়া র সঙ্গে, এই একটা জায়গা যেখানে নিজের জমানো সব কষ্ট গুলো কে বার করে দিতে পারে ও, টুয়া চুপ করে ধৈর্য ধরে শোনে, বন্ধুর বলা কথা গুলো দিয়ে, ওর না দেখা কষ্ট গুলো যেনো ওকেও আঘাত করে ভীষণ, দাদার ওপর রাগ টা আরো বেড়ে যেতে থাকে, সেই সঙ্গেই নিজের বাবা মায়ের ওপরেও ক্ষোভ জন্মায়। এইসব কথা টুয়া একমাত্র বলে জয় দাকে, জয় দা ওর হবু স্বামী, বাবাই এরই বন্ধু, ছোটবেলা থেকেই প্রেম, বাপি অনেক আপত্তি করেছিলো একসময়, এখন অবশ্য মেনে নিয়েছে, রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে ওদের, তাই জয় দা এখন আসা যাওয়া করে বাড়িতে।

চুপ করে শুয়ে ছিলো স্নেহা, কালকের সমস্ত রান্না রয়ে গেছে, আজ আর কিছুই করার নেই। বাবাই উঠলে চা করবে, কাল রাতে অনেকক্ষন ছট ফট করার পর ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিল বাবাই, দেখেছিল, তাই চা করে আর ডাকবেনা ঠিক করলো, উঠুক, তখন চা করে দেবে ও। মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে গাছে জল দিচ্ছিলো, এইটা ওর খুব প্রিয় জায়গা, বেশ অনেক গুলো গাছ লাগিয়েছে, সেগুলোর পরিচর্যায় ওর অনেক টা সময় কেটে যায়। গাছ অনেক টা সন্তানের মতো, নতুন কচি পাতা গুলো কি সবুজ, আলতো করে হাত বোলালো পাতা গুলোয়। হলুদ গোলাপ টা পাশের নার্সারি থেকে এনেছিল কিছুদিন আগেই, কালই কুঁড়ি টা দেখতে পেয়েছিল, আজ দেখলো আরও একটু বড়ো হয়েছে যেনো, কবে ফুটবি রে, নিজের মনেই বললো স্নেহা। এগুলোই এখন ওর নিজের, গাছ, ফুল, বারান্দায় উড়ে এসে বসা পাখি এরাই ওর একা থাকার সঙ্গী। এদের সঙ্গে সময় কাটাতে খুব ভালো লাগে ওর, এরা ওকে অপমান করেনা, ওর ভালোবাসা কে নিজেদের মত করেই ফিরিয়ে দেয়, কুঁড়ি থেকে গোলাপ হয়ে ফুটে ওঠার প্রতিটা ধাপ নিজের চোখে দেখতে দেখতে কখন যেনো একটা মনের গোপন কোনায় লুকিয়ে রাখা সুখী সংসারের স্বপ্ন দেখে স্নেহা, সেই সংসার টা শুধু ওরই, শুধুই ওর।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here