তুমি রবে নীরবে পর্ব ১৮,১৯

তুমি রবে নীরবে
পর্ব ১৮,১৯
অপরাজিতা টুয়া
পর্ব ১৮

বাবাই কে খেতে দিয়ে চোখ বন্ধ করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো স্নেহা, লক্ষ করছিলো বাবাই,

কি হলো শরীর খারাপ নাকি? ওই ভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?

স্নেহা ঘাড় নাড়লো নাহ!

বাবাই আর কিছু বললো না,বেরিয়ে গেলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবাই এর চলে যাওয়া দেখলো স্নেহা, নিচে নেমে হাত তুললো বাবাই, এখন এটা মোটামুটি প্রতিদিনের রুটিন ওদের। রাস্তা পেরিয়েই হাত তোলে বাবাই, স্নেহাও হাত তুললো ।

সকাল থেকেই শরীর টা ভালো লাগছিলো না, জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে, বাবাই বেরিয়ে যাবার পরে খাটে এসে শুয়ে পড়লো স্নেহা, আজ আর কিছু করতে ইচ্ছা করছে না, কোনো রকমে বাবাই কে ব্রেকফাস্ট টা বানিয়ে দিয়েছিলো, নিজের টা পড়েই আছে, মুখে কোনো স্বাদ নেই, একটুও খেতে ইচ্ছা করছে না।

ঘরের কোনো কাজ আজ করা হয়নি, রান্না ঘরের সিঙ্ক এ রাতের জমা বাসন পড়ে আছে, কিন্তু একটুও বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না স্নেহার। কি করে করবে এত কাজ, দুপুরের রান্নাও বাকি আছে, এই সব ভাবতে ভাবতেই কখন যেনো চোখ টা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো একটু, বেল বাজার আওয়াজে চমকে উঠে বসলো ও।

দরজা খুলে দেখলো রাজু এসেছে, সঙ্গে একজন মহিলা, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো স্নেহা। রাজু সাধারণত টি ভি দেখতে আসে সন্ধ্যেবেলায়, আর কিছু দেওয়ার থাকলে, নিচে থেকেই ডাকে ব্যাগ ফেলার জন্য। এই অসময়ে রাজুকে দেখে একটু অবাক হলো ও,

দিদি আমার মা,

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো রাজু, আগে কোনোদিনও রাজুর মাকে দেখেনি, তাই অবাক ভাবটা লুকিয়ে রেখেই একটু হাসলো স্নেহা।

আসলে দাদা গিয়েছিলো একটু আগে আমাদের বাড়ি, তখন বললো তোমার শরীর খারাপ, তাই কাউকে দিয়ে তোমার কাজগুলো একটু করিয়ে দিতে, তো মা বললো আমিই করে দি চল, মা তোমাকে আগে দেখেনি তো, তাই দেখতে চাইছিলো একটু, হেসে বললো রাজু।

দাদা তোদের বাড়ি গিয়েছিলো? কি করে চিনলো তোদের বাড়ি? অবাক হয়ে গেলো স্নেহা।

ওমা! সেতো কবে থেকেই চেনে, আজ প্রথম নাকি! আমরা তো শরীর খারাপ হলে ওই হসপিটালেই যাই গো। দাদাবাবুরা তো কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের ওখানে যায় মাঝে মাঝেই, ওষুধপত্র দিয়ে আসে গিয়ে, ওই যে কিসব এন জি , নাকি বলে না তাই, পাশ থেকে বলে উঠলো রাজুর মা।

চলো দিদি, কি করতে হবে দেখিয়ে দাও, আগে তোমার কাজ করে দিয়ে অন্য বাড়িতে ঢুকবো তারপর।

রাজুর মা কে নিয়ে ভেতরে ঢুকে এলো স্নেহা, সব বুঝিয়ে দিয়ে খাটে এসে বসলো, ভাগ্যিস এলো, নাহলে ও যে আজ কিছুই পারতোনা, বুঝতেই পারছিলো সেটা।

দিদি আমি এখন রোজ আসবো কদিন তোমার শরীর খারাপ ঠিক না হওয়া পর্যন্ত, তুমি সব রেখে দেবে কেমন? দাদা বলে দিয়েছে, কাজ শেষ করে যাবার আগে বললো রাজুর মা।

দিদি একটা নতুন সিনেমা দেখতে আসবো কিন্তু, দারুন হয়েছে বললো সবাই, এখন না তুমি ঠিক হয়ে গেলে তারপর, দরজা বন্ধ করে দাও দিদি, যাবার আগে বললো রাজু।

রাজুর মা কাজ করে চলে যাবার পর, খাটে এসে শুয়ে ছিলো স্নেহা, অবাক লাগছে ওর, বাবাই যে রাজু কে চিনতো ও তাই জানতো না, তার মানে রাজু এখানে আসে সেটা জানতো ও, আর স্নেহা মিছিমিছি ভয় পেত বাবাই জানলে বিরক্ত হবে ভেবে।

সকালে মুখে না বললেও ওকে দেখেই নিশ্চয়ই বুঝেছিলো বাবাই, তাই রাজুকে ডেকে বলে গেছে কাজের জন্য। ওর খুব আনন্দ হচ্ছে, একবার ফোন করে বাবাই কে বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু এখন ও খুব ব্যস্ত থাকবে, তাই নিজেকে সংযত করলো স্নেহা, থাক!! দুপুরে খেতে এলেই বলবে না হয়!!

কিন্তু কাজ না হয় রাজুর মা করে গিয়েছে, রান্নার কোন কিছুই হয়নি এখনও, আপাতত সেটুকু তো করতেই হবে, তাই কষ্ট হলেও উঠে বসলো ও, আর শুয়ে থাকলে দেরি হয়ে যাবে এবার, বাবাই ফিরে আসার মধ্যেই সব টা শেষ করতে হবে ওকে।

সবে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো ও, এর মধ্যেই ফোনটা বেজে উঠলো, তাকিয়ে দেখলো বাবাই,

দুপুরের খাবার আমি নিয়ে আসবো ক্যান্টিন থেকে, তুমি রেস্ট নাও, রাজু এসেছিলো?
জানতে চাইলো বাবাই,

স্নেহা উত্তরোত্তর অবাক হচ্ছিলো, বাবাই যে এত কেয়ারিং হতে পারে ওর কল্পনাতেও ছিলনা বোধহয়। যাক! আজ আর কিছুই করতে হবেনা, সত্যিই ওর রেস্টের দরকার, খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লো ও।

স্নেহা খুব অবাক হয়েছে নিশ্চয়ই, ওর গলা শুনেই মনে হচ্ছিলো, ফোনটা রেখে দিয়ে ভাবছিলো বাবাই। সকালে টেবিলে খেতে খেতেই স্নেহার এক্সপ্রেশন দেখে শরীর খারাপ বলে বুঝতে পেরেছিলো ও, কিন্তু জিজ্ঞেস করলে তো বলবেনা, তাও জিজ্ঞেস করলো একবার। স্নেহার উত্তর যে না হবেই সেটা তো জানাই ছিলো, যদি হ্যাঁ বলতো তাহলেই বাবাই অবাক হতো হয়তো। তখনই ঠিক করেই নিয়েছিলো স্নেহা বলুক বা না বলুক ও রাজুকে বলেই যাবে, যাবার আগে। এখন স্নেহার না বলা কথাগুলো বুঝে নিতে অসুবিধা হয়না আর।

স্নেহার শরীর টা ভালো নেই বলে আজ দুপুরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লো বাবাই, ক্যান্টিন থেকে খাবার নিয়ে যেতে হবে। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেটের দিকে যাচ্ছিলো, পকেটের ফোন টা বেজে উঠলো, হাতে নিয়ে দেখলো, সায়ন্তি, সেদিনের ঘটনার পর থেকে প্রায় দিন দশেক হয়ে গেছে, ওদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি।

রাতে করা মেসেজের উত্তর ইচ্ছে করেই আর দেয়নি বাবাই, সেই থেকেই বোধহয় রেগে ছিলো, তাই আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি এতদিন। বাবাই ও আর ফোন করেনি, নিজেকে আস্তে আস্তে সরিয়ে নিচ্ছে ও। খুব বিরক্ত হয়ে আছে মন টা সেই থেকেই, আর মুখোমুখি বসে কথা বলবে না কোনোদিনও ঠিক করেই নিয়েছে এবার। ও তো ভালো ভাবেই বোঝাতে চেয়েছিলো কিন্ত সায়ন্তি নিজেই ঝগড়া করতে চাইছিলো যেনো। বারবার শুধু ওকে রাগানোর চেষ্টাই করছিলো সারাক্ষন, তাই আর কোনো শান্তিপূর্ন আলোচনার দরকার নেই।

সেদিন কথা বলতে গিয়েও বলা হয়ে উঠলো না নিজের বোকামির জন্য, ও যেনো দিন দিন বড্ড অল্পেই রেগে যাচ্ছে, একটুও নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা। মুখোমুখি বসে সব টা মিটিয়ে নেওয়ার সহজ একটা সুযোগ হারালো নিজের রাগের জন্য।

কিন্তু ওর ব্যাবহারে নিশ্চয়ই ও বুঝে গিয়েছে সবটাই, মেসেজের উত্তর না দেওয়ায় আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে ওর কাছে বাবাই এর মনের কথা, তাই আর বেশি কিছু বোঝাতে হবে না ওকে, কিন্তু ফোনে একবার বলে দিতে হবে পরিষ্কার করে, যাতে আর ফোন না করে ও, মনে মনে ভেবে নিলো বাবাই।

যাইহোক, ও যখন নিজেই করেছে তখন, এটা এক্ষুনি, সায়ন্তি কে জানিয়ে দেবে ভেবেই ফোন টা ধরার সিদ্ধান্ত নিলো ও, ফোন ধরতেই কেঁদে ফেললো সায়ন্তি,

বাবা খুব অসুস্থ, একটু হেল্প করতে পারবি? একটু থমকে গেলো ও, নাহ! এই সময় এইসব বলা উচিত নয়, ওর আরও খারাপ লাগবে,

কোথায় তুই?

গেটের কাছে আছি,

আচ্ছা দাঁড়া আসছি

বলেই গেটের দিকে এগিয়ে গেলো বাবাই। স্নেহাকে খাবার টা দিয়েই ও সায়ন্তির সঙ্গে যাবে ওর বাবার কাছে মনে মনে স্থির করলো। গিয়ে শুনলো নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছে ওর বাবা, বাবাই কে ওর সঙ্গে যাবার জন্য বললো না একবারও শুধু একটু ডিউটি টা অ্যাডজাস্ট করে নিতে চায় ও, যাকগে ও যখন নিজে থেকে বললো না , তখন ও আর মাথা ঘামাতে চাইলোনা বেশি, এমনিতেই স্নেহার শরীরটা ভালো নেই, ওর ফিরতে পারলেই সুবিধা।

বাড়িতে ফিরে প্রায় বার তিনেক বেল দেবার পরে দরজা খুললো স্নেহা, এত দেরি তো করেনা কোনো দিনও চিন্তা করছিলো বাবাই। দরজা খুলে দিয়েই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল ও, বাবাই বাথরুম থেকে বেরিয়েই দেখলো জ্বর বেশ অনেক টাই বেশি।

তুমি বেরিয়ে গেছো বাথরুম থেকে আমি খেয়াল করিনি একদম, এসো খেতে দিচ্ছি,

স্নেহা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। খাবারগুলো বক্স থেকে বার করে থালায় রাখছিল, বাবাই চেয়ার টেনে বসে পড়লো।

ক্যান্টিনের খাবারের টেস্ট টা জঘন্য, মুখে দিয়েই মুখটা বিকৃত করলো বাবাই। স্নেহার রান্নার হাত খুব ভালো, তার পাশে এই খাবার টা এতটাই খারাপ খেতে, ও তাও সেই কবে থেকেই এই খাবারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে অনেকটাই, কিন্তু স্নেহা কি করে খাবে এই জ্বর মুখে সেটাই ভাবছিলো ও।

খুব বাজে খেতে তাইনা?

না, অতটাও খারাপ নয়,
হেসে ফেললো স্নেহা,

নিজেকে করতে হয়নি এটাই তো অনেক, তবে সেদিন রাতে যেটা তুমি নিয়ে এসেছিলে সেটা খুব ভালো ছিলো, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে, তাই আর বলা হয়নি তখন।

তোমার ভালো লেগেছিলো? ওটার ভেতরের পরিবেশটাও খুব ভালো, ওখানে গিয়ে বসে খেতে আরও ভালো লাগে, তোমাকে নিয়ে যাবো একদিন,

খেতে খেতে মাথাটা নিচু রেখেই বললো বাবাই, ও জানে স্নেহা চমকে যাবে এই কথায়, স্নেহার চমকে ওঠা মুখটার দিকে তাকিয়ে ওর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও লজ্জায় ফেলতে ইচ্ছা হলনা আর।

তুমি রাজু কে চিনতে বলোনি নি তো কোনোদিনও,

তুমি চিনতে সেটা বলেছিলে? তুমিও তো বলোনি রাজু টি ভি দেখতে আসে,

এবার হেসে ফেললো দুজনেই।

চলবে

তুমি রবে নীরবে
পর্ব ১৯

আজ স্নেহার জন্মদিন, এই দিনটা কিন্তু ওর জীবনের একটা বিশেষ দিন হলেও কোনো মাতামাতি কোনো দিনই ছিলো না। তার পেছনে একটা খুব অদ্ভুত কারণ আছে, ওর দিদার সব সময় মনে হতো যে কারোর জন্মদিন পালন করে হইচই করলে নাকি যমরাজের মনে পড়ে যে পৃথিবীতে সেই মানুষটির আয়ু আরেক বছর কমে গেলো। এমনিতে উনি নাকি যথেষ্ট ব্যস্ত থাকেন বিভিন্ন বিষয়ে, তাই সবার খাতা খুলে দেখার সময় পান না, তাই অহেতুক হৈ চৈ করে জন্মদিন পালন করে তাঁকে আর নতুন করে মনে করিয়ে দেবার দরকার নেই।

সেই থিওরি মেনেই মা এবং মামনি দুজনেই ওদের সবার জন্মদিনেই শুধু মাত্র একটু পায়েস বানানো ছাড়া আর খুব বেশি কিছু করেনি কোনো দিনও।

বাবাই যেহেতু হোস্টেলেই কাটিয়েছে, তাই এই সমস্যার মুখোমুখি খুব বেশি হয়নি কোনো দিনও, কিন্তু স্নেহা আর টুয়ার কাছে এটা মোটামুটি উঁচু ক্লাসে ওঠা থেকেই একটা বড়ো সমস্যা ছিলো, বন্ধুরা যখন জন্মদিন পালন করতো আর ওদের ইনভাইট করতো, তখন ওরা খুব লজ্জায় পড়তো, কারণ এর পরেই ওদের জন্মদিনেও বন্ধুদের ডাকতে হবে ভেবে।

তাই কলেজে ওঠার পর ওরা মোটামুটি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো যে বাড়িতে কিছু না করলেও বন্ধুদের কে ট্রিট দিতে দিতেই হবে ওদের। সেটা শেষ পর্যন্ত বাড়িতে মেনে নিয়েছিল এই শর্তে, যে সেটাকে জন্মদিনের ট্রিট বলা যাবে না, সেটা তাই সেই ভাবেই হয়ে আসছিলো এত বছর।

আজ ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সেই কথা গুলোই মনে পড়ছিলো ওর। আজ বাড়িতে সবাইকেই ফোন করতে হবে, নাহলেই অভিমান হয় সবার। আর মায়ের শরীর খারাপের পর থেকেই ও ঠিক করেই নিয়েছে কোনো মান অভিমান রাখবে না আর, সবারই বয়স হয়েছে, কখন কি হয়ে যায়। ফেসবুক খুললেই বন্ধুদের একটার পর একটা শুভেচ্ছা বার্তা আসবে ও জানে, কিন্তু বাবাই বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওর ব্যস্ততা কমেনা। সকালের দিকে ফেসবুক খুলে দেখার মত সময় ওর কাছে নেই।

বাবাই বেরিয়ে যাবার পর মা আর মামনি কে ফোন করলো ও, টুয়ার ফোন ও এলো তার পরেই। সব কাজ মিটতে মিটতেই বাবাই আবার ফিরেও এলো বাড়িতে। সেদিনের পর থেকেই একসঙ্গেই বসে খায় ওরা, যদিও স্নেহা ভয়ে কথা বলেনা খুব বেশি, কোনো ভাবেই বাবাই এর বিরক্তির কারণ হতে চায়না ও, এই যে মোটামুটি ভালই ব্যবহার করে বাবাই, কোনো ভাবেই এই শান্তিপূর্ন সহাবস্থান টাকে নষ্ট হতে দিতে চায়না স্নেহা। খেয়ে উঠে সোফায় বসেছিলো ও, বাবাই খাটে বিশ্রাম নিচ্ছিলো, ও না বেরোনো পর্যন্ত শুতে যেতে পারা যাবেনা।

কিছুক্ষন পরে উঠে এলো বাবাই।
তুমি ঘুমাতে চাইলে চলে যাও, আজ আমি বেরোবো না আর, বলেই টি ভি র রিমোট হাতে সোফায় বসে পড়লো।

স্নেহা একটু অবাক হলেও কিছু জিজ্ঞেস করে না কোনো দিনও। দুপুরে শোয়া ওর একটা বদ অভ্যাস, না হলেই বিকেলে কেমন যেনো মাথা টা ধরে থাকে একটু। ঘুম থেকে উঠে বাবাই কে চা করে দিয়ে ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে ছিলো ও,হলুদ গোলাপের টবের ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকলেই মন টা খারাপ হয়ে যায়।

হলুদের থেকে লাল গোলাপ আমার বেশি ভালো লাগে, মনে আছে, তুমি একবার একটা লতানো লাল গোলাপ নিয়ে এসেছিলে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে, ওই রংটা খুব সুন্দর ছিলো,

স্নেহা চমকে উঠে দেখলো, চায়ের কাপ নিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বাবাই, বোধহয় ওর তাকিয়ে থাকা টা লক্ষ করেছে।

কি করবে এখন তুমি?

কিছু না, ঘাড় নাড়লো স্নেহা।

চলো তাহলে ঘুরে আসি একটু,

বাবাই ওকে ঘুরতে যেতে বলছে! নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না ওর।

ভীষণ ভালো লাগছিলো ওর, এই প্রথম ও বাবাই এর সঙ্গে কোথাও বেরোচ্ছে একসাথে, হোক না সেটা কাছাকাছিই, তবু বেড়ানো তো! একটু সাজতে ইচ্ছে হলো আজ অনেকদিন পরে, বিয়েতে পাওয়া শাড়িগুলো তো ধরাই ছিলো এতদিন, আজ পরলো একটা।

নিচে নেমেই একটা ক্যাব ডাকলো বাবাই, স্নেহা অবাক হচ্ছিলো, ও ভেবেছিলো ওরা কাছাকাছিই যাচ্ছে কোথাও, কিন্তু কিছু জানতে চায় না ও, আজ বাবাই ওকে যেখানেই নিয়ে যাক না কেনো ও যেতে চায় চোখ বন্ধ করে, এই একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো যত দীর্ঘায়িত হয় ততই ভালো। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে নামলো ওরা।

এখানের কথাই বলেছিলাম তোমাকে, আগের বার তোমার খেয়ে ভালো লেগেছিলো বলেছিলে না, এসো, পরিবেশটা খুব সুন্দর।

সত্যিই সুন্দর, মুগ্ধ হচ্ছিলো স্নেহা, পরিবেশ আর বাবাই এর ব্যবহার দুটোই একদম অন্যরকম, ও নিয়ে আসবে বলেছিলো যখন, তখন এটা কে কথার কথা বলেই মনে হয়েছিলো স্নেহার, কিন্তু আজ এখানে যে ও সত্যি আসবে ওকে নিয়ে , এটা ভাবেনি কখনো।

ডিনার করে বাড়ি ফিরে ক্যাব থেকে নেমেই ওকে বাড়ি চলে যেতে বললো বাবাই, ও ঘুরে আসবে একটু, স্নেহা আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না, আজ বাবাই ওকে যা সময় দিয়েছে, সেটাই ওর জন্যে যথেষ্ট, এত কিছু ওর এক্সপেক্টেশন এর বাইরে ছিলো।

ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসেছিলো স্নেহা, সন্ধ্যের স্মৃতি রোমন্থনেই এখন কয়েকদিন কেটে যাবে ওর, বেল বাজার আওয়াজে ছুটে গেলো, বাবাই ফিরেছে নিশ্চয়ই,

দরজা খুলেই চমকে গেলো একদম, সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বাবাই, হাতে ধরা একটা টবে লাগানো গোলাপ গাছ, তাতে ফুটে আছে দুটো লাল টকটকে গোলাপ

ফুল তো শুকিয়ে যায়, তাই এই গাছ, হলুদ আমার পছন্দ নয় তাই লালই আনলাম, যত্ন নিও কিন্তু , শুকিয়ে না যায় কোনোদিনও, ওই ভাঙা টবের জায়গাটা খালি লাগছে খুব, মা পছন্দ করেনা বলে কেক টা আনলাম না আর, ও বলাই তো হয়নি, হ্যাপি বার্থডে।

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো স্নেহা, চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে, নাহ! কিছুতেই এই গাছ টা কে শুকিয়ে যেতে ও দেবেনা কোনো দিনও, এটা ওকে দেওয়া বাবাই এর প্রথম উপহার যে।

তোমার চা এনেছি

স্নেহার ডাকে ঘুম ভাঙলো বাবাই এর, চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো চায়ের কাপ হাতে সামনে দাড়িয়ে আছে স্নেহা। বেশ বেলা হয়ে গেছে,বাইরের রোদ বেশ চড়া, চট করে উঠে দাঁড়ালো ,

তোমার চা কই? নিয়ে এসো এখানে

বলেই বাথরুমে ঢুকে গেলো ও, স্নেহা খুশি মুখে দৌড়ে গেলো রান্নাঘরে, বাথরুম থেকে আড়চোখে দেখলো বাবাই।

কালকে রাতের পর থেকেই মন টা খুব ভালো হয়ে আছে ওর, ছুটে যাওয়ার মধ্যেই সেটা লক্ষ করলো বাবাই, স্নেহা একটুও গোলাপ গাছ টা এক্সপেক্ট করেনি, ওর খুশি ও ঢেকে রাখতে পারছিলো না, এই প্রথম ওকে ওর এর সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখেছে বাবাই, এর আগে ও যত অপমানই করুক না কেনো সব সময় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে যে মেয়ে, সে যে কাল রাতে একটা সামান্য উপহার পেয়ে এইভাবে কেঁদে ফেলবে একটুও ভাবতে পারেনি ও, খুব খারাপ লাগছিলো স্নেহার জন্য তখন, ইচ্ছা করছিলো ওকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু কিছুতেই নিজেরই তৈরি করা গাম্ভীর্যের খোলস ছেড়ে বেরোতে পারলোনা একটুও।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে খাটে বসে চায়ের কাপ টা টেনে নিলো বাবাই। আজ আর বেশিক্ষণ বসে থাকার সময় নেই, কাল বিকেলে যায়নি,আজও যথেষ্ট বেলা হয়ে গেছে,

ব্রেকফাস্ট তৈরি করে ফেলেছ?

না, এক্ষুনি করতে যাবো চা খেয়েই।

তাহলে আজ ছেড়ে দাও, কাল অনেক রিচ খাওয়া হয়েছে, আজ আর কিছু খেয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না, আমি বরং একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ি।

বাবাই বেরিয়ে যাবার পর সোফায় এসে বসলো স্নেহা, ওর ও আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছিলো না, কাল সত্যিই খুব বেশি খাওয়া দাওয়া হয়েছে। টুয়া, একটু পরেই ফোন করবে, ওকে কালকের কথা গুলো বলতে ইচ্ছে করছে খুব, এইরকম জন্মদিন যে ওর জীবনে কখনো আসবে, সেটা ওর ধারণা ছিলো না।

কাল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ও শুধু অবাকই হয়েছে, বাবাই যে ওর জন্য বিকেলে হসপিটালে যাবেনা বা ঐরকম কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াবে ওকে, কোনো দিনও ভাবেনি ও।

গোলাপ গাছটা দেখে তো ও একদম চমকেই গিয়েছিলো, চোখের জল আটকে রাখতে পারেনি আর।খারাপ ব্যবহার মানুষকে শক্ত করে, বাবাই এর আজ পর্যন্ত করা প্রতিটা খারাপ ব্যবহার, ও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে, একফোঁটা চোখের জল ও পড়তে দেয়নি বাবাই এর সামনে কোনো দিনও, কিন্তু আজকের বাবাই এর নরম ব্যবহার, আর ছোট্ট উপহার ওর চোখের জল কে কিছুতেই বাইরে আসা থেকে আটকাতে পারলোনা।

দৌড়ে বারান্দায় বেরোলো স্নেহা, গাছ টা ঠিক আছে তো? কালকে বিকেলেই বাবাই বলেছিলো লাল গোলাপ ওর পছন্দ, এই লাল গোলাপ টা কে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে ওকে, এর মধ্যেই ওর ভালোবাসা লুকিয়ে আছে।

নিজের রুমে বসেছিলো বাবাই, দারোয়ান একটি ছেলে কে নিয়ে ওর কাছে এগিয়ে এলো।

স্যার, ইনি সায়ন্তি ম্যাডামের ভাই, একটু দেখা করতে চাইছিলেন ওনার সঙ্গে।

ছেলেটি নমস্কার করলো, আসলে দিদির ফোন টা সুইচড অফ বলছে তাই,

আচ্ছা, বসুন এখানে, আমি ডেকে দিচ্ছি, বলেই বাবাই দারোয়ান কে দিয়ে খবর পাঠালো।

বাবা এখন কেমন আছেন? জানতে চাইলো ও।

হ্যাঁ, এমনি ভালো আছে, কিন্তু দিদির পক্ষে বারবার বাড়ি যাওয়া অসুবিধা হয় তো তাই এখন থেকে এখানেই রাখবো ঠিক করেছি। সেই জন্যই আরও আসতে হলো, আসলে দিদির ফ্ল্যাটে নিয়ে যাব তো বাবা কে, সঙ্গে মা কেও নিয়ে এসেছি, দিদির কাছ থেকে ফ্ল্যাটের চাবি টা নিতে হবে।

সায়ন্তি ফ্ল্যাট কিনেছে? কবে? ও তো কিছুই জানতে পারেনি, মনে মনে চমকে গেলেও মুখে কিছু প্রকাশ করলো না আর।

ওর ভাবনার মধ্যেই ঢুকে এলো সায়ন্তি,

তোর ফোন বন্ধ ছিলো বলে এখানে এসেছে, সায়ন্তির দিকে তাকিয়ে বললো বাবাই।

সায়ন্তি যেনো একটু অস্বস্তির মধ্যে আছে ওর মুখ দেখেই মনে হলো বাবাই এর, কোনো কথা না বলেই ভাই কে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো ও। সেই ঘটনার পর থেকে আজ প্রায় মাস তিনেক হতে চললো, একদিন বাবার অসুখের জন্য ডিউটি অ্যাডজাস্ট করতে বলা ছাড়া আর কথাও বলেনি ও। এতদিন কথা না বলার জন্য আজকাল কথা বলতেও অস্বস্তি হয় বাবাই এর। আজ ওর ভাই না এলে বোধহয় এটুকুও বলার দরকার পড়তো না।

সায়ন্তি এত দিন ধরে ভাড়া বাড়িতে থাকে বলেই জানে ও, আজ রীতিমত অবাক লাগছিলো, ফ্ল্যাট কেনার কথাটা ওকে জানাতে কি অসুবিধা ছিলো কিছুতেই বুঝতে পারছে না বাবাই।

একবার মনে হলো সরাসরি জিজ্ঞেস করি, তারপর নিজেরই আর ইচ্ছা করলো না, বলেনি যখন, তখন নিশ্চয়ই বলতে চায়না, তাহলে নিজে থেকে জিজ্ঞেস করে ওকে লজ্জায় ফেলতে ইচ্ছা হলো না আর।

কিন্তু ওর ফ্ল্যাট কেনার খবরে তো বাবাই খুশি হবে এটা ওর অজানা নয়, তাহলে ও লুকিয়ে রাখতে চাইছে কেনো ? খুব খারাপ লাগছিলো বাবাই এর, ও তো কোনোদিনও কিছু লুকিয়ে রাখেনি ওর নিজের সম্পর্কে, ক্রমশ সায়ন্তির ওপর একটা ক্ষোভ জন্মাচ্ছে। বিয়ে না হলেই বা, বাবাই তো ওকে বন্ধু ভেবেও এসেছে এতদিন।

বন্ধুত্ব টাও নষ্ট হচ্ছে আস্তে আস্তে, এই মুহূর্তে সত্যি ওর বিশ্বাস জন্মাচ্ছে যে ও শুধুই ইউজড হয়েছে এতদিন। যার ফ্ল্যাট কেনার ক্ষমতা আছে,সেই কয়েক মাস আগে টাকা শোধ দিতে না পারার জন্য হেল্প চাইলো ওর কাছে। ও তো নিজেই এত বছরে ফ্ল্যাট কিনে উঠতে পারেনি, সায়ন্তি কি ভাবে পারলো!! অবাক হচ্ছিলো বাবাই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here