তুমি রবে নীরবে
পর্ব ১৬,১৭
অপরাজিতা টুয়া
পর্ব ১৬
সকাল থেকে খুব তাড়াহুড়ো করেছে স্নেহা আজ, কাল রাতে বাড়ি থেকে এসেই বলেছে বাবাই, অনেক দিন পরে আজ হসপিটালে যাওয়া, তাই ও তাড়াতাড়ি বেরোতে চায় সকালে।
ব্রেকফাস্ট সেরে বাবাই এর বেরিয়ে যাওয়ার সময় রোজকার মতোই দূরে রান্না ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ও। ল্যাচের নব ঘুরিয়ে দরজা খুলেই ঘুরে তাকালো বাবাই,
দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যাও,
ধড়াস করে উঠলো স্নেহার বুকের ভেতরটা, বাবাই ওকে দরজা বন্ধ করতে ডাকছে!
দৌড়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালো ও, নিজের বুকের ভেতরের শব্দটা ও নিজেই শুনতে পাচ্ছে, বাবাইও পাচ্ছে কি? আসছি, বলেই লিফটের বোতামে হাত দিলো বাবাই, যতক্ষণ না লিফটের দরজাটা বন্ধ হলো, ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো স্নেহা, ওই ছোট্ট “আসছি” শব্দটার রেশ থেকে বেরোতে পারছে না আর।
লিফট টা নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়ে ব্যালকনি তে বেরোলো আজ, বাবাই নামবে এক্ষুনি, আজ কিছু অন্যরকম হবে কি, ও কি তাকাবে একবারও ওপরের দিকে, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলো স্নেহা।
গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তা টা ক্রস করেই ওপরের দিকে তাকালো বাবাই, চোখা চোখি হলো দুজনের, তারপরেই মাথা নামিয়ে দ্রুত হেঁটে গেলো ও, ব্যালকনির লোহার গ্রিল টা ধরে একদৃষ্টিতে বাবাই এর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো স্নেহা, যতদূর পর্যন্ত দেখা যায়, গাল বেয়ে নেমে আসা চোখের জল টা কে আজ আর আটকাতে চাইছে না ও।
রোগীর ভিড় কমে এসেছে এখন, খুব ক্লান্ত লাগছে, টেবিলের ওপর মাথাটা নামালো বাবাই। মনটা এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে আছে আজ সকাল থেকে, স্নেহার খুশিতে ভরা মুখটা চোখের সামনে থেকে সরছে না এক মুহূর্তের জন্য, সামান্য দরজা বন্ধ করতে ডাকায়, এত খুশি হবে ও, কল্পনাতেও ভাবেনি বাবাই।
ঠিক আছে, স্নেহার ভালো লাগার জন্যে এইটুকু তো করতেই পারে ও, কোনোদিনও তো ও কিছু চায়না বাবাই এর কাছে, এই ছোটো খাটো ভালো লাগা গুলো পূরণ করবে বলে তো ও ঠিক করেই নিয়েছিলো, তবে লিফট থেকে নেমে ওপরের দিকে তাকাবে এটা ভাবেনি, কিন্তু তাও তাকিয়ে ফেললো কিভাবে কে জানে, শুধুই স্নেহার ভালো লাগার জন্যই তো এত কিছু, নিজেকেই যেনো প্রবোধ দিচ্ছে বাবাই।
শুধুই স্নেহার জন্য, নিজের? ওর ও কি ভালো লাগছে না এই চাওয়া গুলো পূরণ করতে? একটুও খারাপ ব্যবহার করতে পারছে না ও, সব টাই স্নেহার কথা ভেবে?
ভুলেই তো গেছিস মনে হচ্ছে আমাকে, এতদিন পরে হসপিটালে এসেও একবারও দেখা করলি না? কি ভাবছিস এত?
চমকে তাকালো বাবাই, সামনে দাঁড়িয়ে সায়ন্তি। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো ও,
এই তো কিছুনা , তুই কেমন আছিস?
ভালো থাকার কথা ছিলো বুঝি? তোর মনে হয় আমি তোকে ছাড়া ভালো থাকি একটুও, চেয়ার টেনে বাবাই এর মুখোমুখি বসলো ও।
চল একসঙ্গে লাঞ্চ করবো আজ, তোকে ডাকতে এলাম।
স্নেহার মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে, না ও এখন যেতে পারবে না কিছুতেই, সকালের ভালোলাগা গুলো এতো তাড়াতাড়ি খারাপ লাগায় বদলে যাক একটুও চায়না ও।
শোন না, এখন হবে না রে, তুই লাঞ্চ করে নে, অনেকদিন পরে এসেছি তো, চাপ আছে আজ, বরং ডিনার করবো এক সঙ্গে,
একটু তাকিয়ে থেকে রাজি হয়ে গেলো সায়ন্তি।
সায়ন্তির সঙ্গে একবার নিজেই বসতে চায় ও মুখোমুখি, অনেক কথা বলার আছে, যেগুলো ফোনে বলা যাবেনা, তাই ডিনারের প্রস্তাব টা লুফে নিলো ও। আজ যে ও সায়ন্তির সঙ্গে ডিনারে যাবে সেটা স্নেহা কে বলা যাবেনা, ওর মন টা খারাপ হয়ে যাবে খুব। এমনিতেও সদ্য মায়ের কাছ থেকে এসে মন খারাপ হয়েই আছে।
গত কয়েকদিন স্নেহার কাছ থেকে দূরে থেকে ও বুঝেছে, ওর পক্ষে স্নেহা কে ডিভোর্স করা আর কোনো দিনও সম্ভব নয়, অথচ, এই যে প্রায় দিনই এখন সায়ন্তি ফোন করে ওকে, এটা স্নেহার সামনে খুব অস্বস্তিতে ফেলে, মুখে কিছু না বললেও ওর যে খারাপ লাগে সেটা বোঝে বাবাই।
আজ যদি ও স্নেহার জায়গায় হতো, এগুলো মেনে নিতে পারতো কি! নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছে অনেকবার। তাই এবার একদিন সায়ন্তির সঙ্গে সব কথা বলে মিটিয়ে নিতে হবে, মনে মনে বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলো ও, সেই সুযোগ টা এত সহজে এসে যাবে ও নিজেই ভাবেনি।
সন্ধ্যেবেলায় দেখা হচ্ছে,
হাত নেড়ে বেরিয়ে গেলো ও। রাস্তা ক্রস করেই দেখলো আজ ব্যালকনিতেই দাঁড়িয়ে আছে স্নেহা, ও জানতোই এইরকমই হবে আজ। ভাগ্যিস, লাঞ্চ করতে চলে যাই নি, খুব খারাপ লাগতো বেচারার, কিন্তু ঠিক কিভাবে রাতের কথাগুলো বলবে গুছিয়ে নিচ্ছিলো মনে মনে।
দুজনে খেতে বসেছিলো একসঙ্গে, খেতে খেতে চারদিকে তাকিয়ে দেখলো বাবাই, এর মধ্যেই বাড়ি টা বেশ পরিস্কার করে ফেলেছে স্নেহা।
খুব ক্লান্ত হয়ে গেছ না? বাবাই এর প্রশ্নে চমকে উঠলো স্নেহা,
আসলে খুব নোংরা হয়ে ছিলো তো বাড়ি টা, তাই পরিষ্কার করতে সময় লেগেছে অনেক।
হ্যাঁ, দেখেই মনে হচ্ছে, আমি চলে যাওয়ার পর থেকেই এগুলোই করেছো বোধ হয়, একটুও রেস্ট নাওনি আর, সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো বাবাই।
বাবাই লক্ষ করেছে ওর পরিষ্কার করা, মনটা আনন্দে ভরে উঠলো স্নেহার।
আজ রাতে আমার বন্ধুদের সঙ্গে ডিনার করার প্ল্যান হয়েছে, তোমার খাবার নিয়ে আসবো আসার সময়, আজ আর কিছু করতে হবে না,রেস্ট নাও একটু, ওর দিকে তাকিয়ে বললো বাবাই।
স্নেহা খুশি হলো, সত্যিই খুব পরিশ্রম গেছে আজ, এতদিন তো নিজেই খেয়ে আসতো, আজ ওর কথা ভেবে খাবার নিয়ে আসবে বলেছে, এটাই ওর পরম পাওয়া।
স্নেহা জানে সায়ন্তির সঙ্গে ডিনারে যাবে ও, তবু না বোঝার ভান করেই থাকে, যে ছেলে ওকে ফুল শয্যার দিন সব বলতে পেরে ছিলো, সে আজ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে সত্যি টা বলতে পারেনা জানে ও।
ও লজ্জায় ফেলতে চায়না বাবাই কে, স্নেহা কে মিথ্যে বলতে ওর খারাপ লাগে বোঝে স্নেহা এখন, এই কড়া সত্যিটা বলতে না পারাটাই যে পরিবর্তনের প্রথম ধাপ, সেটা বোঝে ও, তাই হাসি মুখে সব কথা বিশ্বাস করার অভিনয় করে রোজ, অপেক্ষা কবে এই দুজনের অভিনয়টাই একদিন সত্যি হয়ে উঠবে ওদের জীবনে, আশা রাখে স্নেহা মায়ের কথায়, সময় কে সময় দিতে হয়, তাই দেয় স্নেহা, নিশ্চয়ই সময় একদিন ঘুরিয়ে দেবে ওর জীবনের মোড়।
বাবাই খেতে খেতে মাথা নিচু রেখেই লক্ষ্য করছিলো স্নেহার এক্সপ্রেশন, ও কি কিছু বুঝলো!! কিন্তু ও তো স্নেহাকে কষ্ট না দেবার জন্যই সত্যি টা লুকাতে চাইছে, আর তো মাত্র একবার, শুধু এই বার টা, আর ভবিষ্যতে কোনোদিনও মিথ্যে কথা গুলো বলার দরকার পড়বে না আর। ও যা করছে সব টাই তো স্নেহার জন্যই, নিশ্চয়ই স্নেহা সেটা বুঝবে একদিন, নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দিলো ও।
তুমি কি খেতে ভালোবাসো? বলো কি আনবো তোমার জন্য? পরিস্থিতি টা সহজ করার চেষ্টা করলো বাবাই।
তোমার যা ইচ্ছা, সেটাই এনো।
স্নেহার গলাটা কি গম্ভীর লাগলো একটু!! ও বুঝতে চেষ্টা করছিলো। স্নেহা এত চুপচাপ যে মাঝে মাঝে ওর মনের কথা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা বাবাই। সদ্য সদ্য মন টা ভালো হয়েছিলো স্নেহার, আবার আগের মতই কথাও বলছিলো দুজনে, এর মধ্যেই এই ডিনারে যাওয়া টা নতুন করে কোনো বিপত্তি ডেকে আনবে নাতো! বেশ টেনশন হচ্ছে ওর। কিন্তু ওরও তো কোনো উপায় নেই, সবকিছু মিটিয়ে নেবার এই সুযোগ আর তো ও কখনো পাবেনা।
বাবাই শুধুই থালায় আঁকিবুকি কাটছে অন্যমনস্কভাবে, লক্ষ্য করলো স্নেহা, ও খুব অস্বস্তিতে আছে, দেখেই বুঝতে পারছিলো ও। কথাটা একদম ঘুরিয়ে দিতে চাইলো ও,
খুব ব্যস্ত ছিলে নাকি আজ? অনেকদিন পরে গেলে তো।
হ্যাঁ, সেতো ছিলামই, একদম সময় পাইনি, কাল থেকে ঠিক হয়ে যাবে আবার,
প্রসঙ্গ বদলে যেতে যেনো শান্তি পেলো বাবাই, যাক বাবা! স্নেহা রাগ করেনি তাহলে!!
বাবাই আবার খাওয়ায় মন দিয়েছে দেখে খুশি হলো স্নেহাও, এখন আর কোনো মন কষাকষি রাখতে চায়না ও।
চলবে
তুমি রবে নীরবে
পর্ব ১৭
স্নেহা কে দরজা বন্ধ করে দিতে বলে নিচে নেমে এলো বাবাই, হসপিটালে ঢুকে দেখলো সায়ন্তি আজ খুব সেজে গুজে এসেছে, ওকে দেখেই বললো,
আমি কিন্তু একেবারেই রেডী হয়ে এসেছি, আর বাড়ি যাবনা, হয়ে গেলেই বেরিয়ে পড়বো কেমন,
হ্যাঁ, বলে মাথা নেড়ে নিজের রুমে ঢুকে গেলো বাবাই।
কিরে তোর হয়নি এখনো, চল, সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে তো, ঘরে ঢুকে এলো সায়ন্তি।
হ্যাঁ, চল হয়ে গেছে,
বেরিয়ে পড়লো দুজনে, আজ আর কোথাও যাবেনা, একদম রেস্টুরেন্টে ঢুকবে, স্নেহার খাবার নিয়ে আসবে বলেছে ও, অন্য কোথাও গেলে দেরি হয়ে যাবে মনে মনে ভেবেই নিয়েছে বাবাই।
ট্যাক্সি তে উঠেই বললো পার্ক স্ট্রিট,
কেনো আজ বসবি না গঙ্গার ধারে?
না রে, খুব ক্লান্ত হয়ে আছি, কাল ট্রেন জার্নি করেছি তো, অন্য একদিন যাবো, আজ সোজা খেতেই চল,
আর কিছু বললো না সায়ন্তি।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে চারদিকে তাকালো বাবাই, একদম কোণের একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো, আজ অনেক কথা আছে, একদম ফাঁকা জায়গা চাই ওর।
মন টা এখন একদম শান্ত হয়ে গেছে, আর কোনো দোলাচল নেই মনের মধ্যে, স্নেহা ওর জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে এখন, ওকে বাদ দিয়ে আর কোনো কিছু করা সম্ভবপর হবে না বাকি জীবনটায়, এটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত সংশয় কাটিয়ে উঠেছে ও।
কিন্তু সায়ন্তির সঙ্গে কোনরকম খারাপ সম্পর্ক হয়ে যাক এটাও চাইছে না বাবাই। ওকে ভালো করে শান্ত মাথায় বুঝিয়ে দিতে চায় ও, বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাক এরকম কিছু করতে চায়না একদম।
বল কেমন আছিস? শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলি তো, শাশুড়ি কে সুস্থ করে এলি? চেয়ারে বসেই বললো সায়ন্তি।
প্রশ্ন টার মধ্যে যে বিদ্রুপটা লুকিয়ে ছিলো, সেটা বুঝতে পারলো বাবাই, শুনেই বিরক্তি লাগলো একটু, কিন্তু আজ ওকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে যে করেই হোক, বাড়ি থেকে ভেবেই এসেছে ও, তাই নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলো,
তুই তো জানিসই, উনি শুধু আমার শাশুড়ি নন, আগে আমার মা ই, ওনার কাছেই বড় হয়েছি আমি, আর শুধু শ্বশুরবাড়ি যাইনি, আমার নিজের বাড়িও তো ওখানেই।
তোর বাড়ির সবাই কেমন আছে, কাকুর শরীর ভালো আছে তো এখন?
প্রসঙ্গ টা ঘুরিয়ে দিতে চাইলো বাবাই, মিছিমিছি কোনো বিতর্ক তৈরি হোক, ও চায়না সেটা, এমনিতেই আজ ও যা বলতে চলেছে, সেটা সায়ন্তির কাছে যে একটা বড় ধাক্কা হবে, সেটা জানে ও।
ওর বিয়ে হয়ে গেলেও, এতকাল সায়ন্তি সেটা কে গুরুত্ব দেয়নি কোনোদিনও, ওর কল্পনাতেও আসবেনা, বাবাই এই রকম কোনো ডিসিশন নেওয়ার কথা ভাবতে পারে, বিয়ে হয়ে গেলেও বাবাই ওকে এখনও ভালোবাসে, এটা ও ভেবেই নিয়েছে মনে মনে। আজ সবটা জানার পর ও কি করতে, বা বলতে পারে সেটা নিয়ে এমনিতেই একটু টেনশন হচ্ছে বাবাই এর।
বাবা আছে মোটামুটি, তোর বাবা কেমন আছে? ছেলে ওনার কথামতো বিয়ে করেছে যখন, তখন তো ওনার আর কোনো সমস্যা নেই তাইনা? এখন তো উনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন নিশ্চয়ই!!
আজ যেনো ও ঝগড়া করবে ভেবেই এসেছে বাবাই এর সঙ্গে, কিছুতেই আর সম্ভবপর হবে না কোনরকম শান্তিপূর্ণ আলোচনা, ক্রমশই ধৈর্য্য হারাচ্ছে বাবাই।
হ্যাঁ, ভালো আছেন এখন, তুই মেনু পছন্দ কর,
আর কোনো কথা সায়ন্তি কে বলার সুযোগ না দিয়েই ওয়েটার কে হাত নেড়ে ডাকলো ও।
টেবিলে বসে মেনু পছন্দ করছিলো সায়ন্তি, উল্টোদিকে বসে দেখছিলো ও। হটাৎ মনে হলো, আজ তো রাত হবে ফিরতে, স্নেহা একা থাকবে বাড়িতে, ওকে একটা ফোন করা উচিত। ফোন টা বার করে ডায়াল করলো বাবাই,
স্নেহা ফোন টা ধরার সঙ্গে সঙ্গেই বললো বাবাই,
ঠিক আছো তো? রেস্ট নিয়েছো একটু?কোলাপসিবল গেটটা বন্ধ করে রাখো, আমি তাড়াতাড়িই ফিরবো,
ফোন রেখেই তাকিয়ে দেখলো, ওর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সায়ন্তি,
তুই ওই মেয়েটা কে আবার নিয়ে এসেছিস সঙ্গে করে, আমি তো ভাবলাম, রেখে এসেছিস ওখানে, এই সুযোগেই তো রেখে আসতে পারতিস!
কোনো উত্তর দিলো না বাবাই। মাথা টা ঝট করে গরম হয়ে গেলো, কিন্তু না, আজ কোনরকম বিতর্কে জড়াতে চায়না, সব কিছু ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে হবে সায়ন্তি কে, তাই চুপ করেই থাকলো ও। মেনু পছন্দ করে ওয়েটার কে ডাকলো সায়ন্তি,
যা এখানে দেবেন, সেগুলোই প্যাকিং হবে একটা,
সায়ন্তি অর্ডার দেওয়ার পর ওয়েটার কে বললো বাবাই।
তুই কি এবার খাবারও নিয়ে যাবি, ওই মেয়েটার জন্য, অবাক গলা সায়ন্তির।
“ওই মেয়েটা” নয় ওর নাম স্নেহা, একটু ভদ্রভাবে বল, তুই আমার স্ত্রীর সম্বন্ধে কথা বলছিস, নিজের কড়া গলার আওয়াজে নিজেই চমকে গেলো বাবাই।
সায়ন্তি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, পলক পড়ছে না ওর, এরপরে আর ভালো করে কথা বলতে পারলোনা কেউই, কোথাও যেনো তাল কেটে গেছে বুঝতে পারছিল দুজনেই। যা ভয় পাচ্ছিলো তাই হলো শেষ পর্যন্ত, আর ঠান্ডা মাথায় কথা বলার কোনো সুযোগ থাকলো না। কোনো রকমে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লো, ফেরার পথে ট্যাক্সি তে একটাও কথা বললো না সায়ন্তি, ওকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়েই বেরিয়ে গেলো বাবাই, সায়ন্তি তাকিয়ে ছিলো, ও হয়ত আশা করেছিলো বাবাই কিছু বলবে, কিন্তু ও নিজেই এই মুহূর্তে বলার মত জায়গায় নেই বুঝতেই পারছিলো বাবাই।
মন টা আনন্দে ভরে আছে আজ স্নেহার, বাবাই ওকে ফোন করে গেট বন্ধ করতে বলবে, স্বপ্নেও ভাবেনি ও, এত টা দায়িত্ববোধ কখন তৈরি হলো ওর স্নেহার প্রতি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলো স্নেহা।
এর আগেও তো কতদিন রাত করে ফিরেছে বিয়ের পর প্রথম প্রথম, কখনো তো ভাবেনি এই ভাবে ও স্নেহার কথা, তাহলে আজ কি হলো হটাৎ, ভাবতে ভাবতেই বাবাই কে আসতে দেখলো ও। লিফটের দরজা খুলে বেরোনোর আগেই ঘরের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলো স্নেহা, বাবাই ওর দিকে প্যাকেট টা এগিয়ে দিয়ে বললো,
ঠান্ডা হয়ে যাবে, খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।
স্নেহা খেতে খেতেই শুয়ে পড়ে ছিলো বাবাই, সায়ন্তিকে কথাগুলো বলার জন্য একটুও খারাপ লাগছে না ওর, ফোন টা বন্ধ করার জন্য হাতে নিতেই মেসেজ দেখলো সায়ন্তির,
তুই বদলে গেছিস অনেক, আমার জন্য সময় নেই তোর আর,
কোনো উত্তর না দিয়েই ফোন টা বন্ধ করে দিলো ও। খুব ক্লান্ত লাগছে সারাদিনের পর, কি করতে গেলো আর কি হয়ে গেলো, নিজের রাগের ওপর কন্ট্রোল না করতে পারার জন্য আফসোস হচ্ছে এখন, কিন্তু যা বলেছে ভুল তো বলেনি কিছই, প্রথম থেকেই আজ ঝগড়া করার মুডেই ছিলো যেনো সায়ন্তি, যা হবে কাল হসপিটালে গিয়ে দেখা যাবে, চোখ বন্ধ করলো বাবাই।
খাওয়া দাওয়ার পরে ব্যালকনি তে একা দাঁড়িয়ে ছিলো স্নেহা, বাবাই ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষন, মায়াবী জ্যোৎস্নায় ভরে আছে আকাশ, নিস্তব্ধ হয়ে এসেছে চারপাশ, সেই ছোট বেলার সময় টায় ফিরে যাচ্ছিলো ও, ওদের দুই বাড়ির বেড়াতে গিয়ে বাবাই, টুয়া আর ওর একসঙ্গে কাটানো সময় গুলো কত ভালো ছিলো তখন।
ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে সেই সময় টা কে, অনেকদিন আগের এরকমই এক রাতে সিমলা র এক হোটেলের বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে ছিলো ওরা তিনজনে, জ্যোৎস্নায় সাদা হয়ে ছিলো সামনের বরফ ঢাকা পাহাড়গুলো, দূর থেকে ভেসে আসছিলো পাহাড়িয়া গানের সুর, ক্রমশ ভাবনায় ডুবে যাচ্ছিলো স্নেহা, চোখ বন্ধ করে নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো সেই সময় টায় যেখানে ওদের দুজনের মধ্যে কোথাও ছিলনা সায়ন্তি।
চলবে