তরঙ্গিনী পর্ব-১৪ #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী পর্ব-১৪

#আরশিয়া_জান্নাত

হ্যালো নূর? ও ভাই তুই এতো নিষ্ঠুর এতোদিনে মনে পড়ছে আমার কথা?

না রে তোর কথা প্রায়ই মনে পড়ে, কিন্তু কল করা হয় না। কেমন আছিস?

ভালো আর থাকমু কেমনে বল, দুইটা ফাজিল পোলামাইয়া যার আছে সে ভালো থাকতে পারে? দুইটাই জন্মের ব্রিটিশ। একটু চোখের আড়াল হইলেই সব নষ্ট করে ফেলে। আমার কথা ছাড় তোর খবর বল, সুখবর পামু কবে?

জানি না।

ওমা জানিস না মানে কি? বাচ্চা নিবি না? বছর তো হয়ে আসছে। তোর এক্স তো পোলার বাপ হয়ে নাচতেছে, তুই ক্যান পিছাই আছোস? তোর তো উচিত দুইটা জন্ম দিয়ে আগাই থাকা। দেখ ব্যাটা আমিও দুই বাচ্চার মা হইছি!

বাচ্চা দেখিয়ে লাভ?

তোর জামাই তোরে আদরে সোহাগে রাখছে এটাই তো প্রমাণ! যত বেশি বাচ্চা তত বেশি প্রমাণ।

ধুরর তুইও না যা তা।

নয়তো কি? দেখ তোর বর তোরে কত ভালোবাসে এটা দেখানোর আর কোনো উপায় আছে বেবি ছাড়া?

বাচ্চা হওয়া মানেই অনেক ভালো আছি বা ভালোবাসে বুঝায় তোরে কে বলল? বিয়ের পরপরই তো বেবি নিয়ে ফেলে কিন্তু ভালোবাসা নাই। সাথীর কথা মনে নাই তোর? ও তো ঠিকঠাক চিনবারো সুযোগ পায়নাই। বিয়ে হইছে কনসিভের খবর পাওয়ার আগেই বর বিদেশ চলে গেল,,,,

শোন নূর, আগুনের আশেপাশে থাকলে মোম গলে যাবেই। ছেলেরা বৌরে পছন্দ করুক আর নাই করুক ধৈর্য ধরে সর্বোচ্চ তিনদিন থাকবে। এরপর ঠিকই ম্যাচ শুরু। এখানে ভালোবাসার অপেক্ষা করা মানে বহুত লম্বা টাইম ওয়েট করা। আর আমরা মেয়েরা তো এমন ধাচে গড়া কেউ একটু আদর করে কথা বললেই গদগদ হয়ে যাই, সেখানে সবচেয়ে বড় সুখটা পেয়ে কি হাল হয় চিন্তা কর? ভালোবাসা হবে তারপর সব হবে এমন ভাবনায় থাকলে এই জীবন শেষ,,,তাই বিয়ের পর শরীর দিয়েই মন ছোঁয়া হয়। এটাতে দোষের কিছু নাই। যাকে ধর্মমতে বিয়ে করেছি তারই তো সব। তুই নিজেই বল আমার ভালোবাসার জন্য যদি তোর ভাই অপেক্ষা করতো এই দুইটা দুনিয়াতে আসতো? প্রথম বাচ্চা হবার পরে তার প্রতি ভালোবাসা জন্মাইছে আমার। সে এতো যত্ন করবে আমিতো ভাবিই নাই।

আচ্ছা মিথি শারীরিক সম্পর্ক কি খুব জরুরী? মানে ধর তুই তাকে অনেক ভালোবাসিস কিন্তু তুই অপেক্ষা করছিস সে তোকে ভালোবেসে কাছে না টানা অবধি যাবিনা। তবে এটা কি পুরুষের জন্য কঠিন হবে?

কঠিন মানে? অনেক কঠিন হবে। সে আর মানুষ পর্যায়ে নেই আপার লেভেলে চলে গেছে।‌ এই নূর বলিস না তোদের মধ্যে এখনো কিছু হয় নাই! ওহ মাই গড।।।

আমি চুপ করে রইলাম, এই কথার পিঠে কি বলবো আমি? মিথি কিছুক্ষণ হা‌হুতাশ করে বলল, নূর তুই মাথা নষ্ট করা সৌন্দর্যের অধিকারী। তোকে যে মানুষটা এতোদিন সময় দিয়েছে তাকে আর অগ্নিপরীক্ষায় রাখিস না বোন। এটা ওদের জন্য অনেক টাফ। তোকে সৃষ্টিকর্তা তার জন্যই সৃষ্টি করেছেন, বায়োলজিক্যাল নিডস পূরণ করা তোর কর্তব্য। তোর উচিত ছিল আরো আগেই,,,

আমি বলেছিলাম উনাকে কিন্তু উনি বললেন আপনার মন জয় না করে শরীর চাই না,,

তুই অনেক লাকি রে নূর! এমন মানুষ সবাই পায় না। উনার খুব যত্ন করিস। পাপী হইস না।
স্বামীর চাহিদা পূরণ করা আমাদের উপর ফরজ। কি বলেছি বুজতে পারছিস? আমার সেদিনই বোঝানো উচিত ছিল তোকে। উফ তুইও না এতো চাপা কিছুই বলিস না কাউকে।

আমি এখন কি করবো? সত্যিই অনেক পাপ হয়ে গেছে?

যা হবার হয়ে গেছে, এটাকে আর বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি যা যা বলছি মন দিয়ে শোন,,,,

মিথির ফোন রেখে আমি কপালের ঘাম মুছতে লাগলাম। নাহ আমি আসলেই অনেক বড় বোকা। আজকে বুঝলাম কেন তিনি সবসময় বলতেন আমি একটু একটু বুদ্ধিমতি হচ্ছি!! আমিও তো বলি আমাকে তার বোকা মনে হতো কেন,,,,

লতাকে বললাম মালীনিকে বলে গোলাপ আনতে। আর অনলাইনে বেশকিছু জিনিস অর্ডার করলাম। আজকে আমি আরাফকে অনেক বড় সারপ্রাইজ দিবো।।


দোতলার দখিন দিকের ঘরটা আমি অনেক সুন্দর করে সাজালাম। লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে বিছানায় হার্টশেইপ করলাম। সুগন্ধি মোমবাতি দিয়ে পুরো ঘর সাজালাম। বলতে গেলে একদম আমাদের বিয়ের রাতের মতোই সাজালাম ঘরটা, উনার পছন্দসই করে। সব সাজানো শেষে দরজাটা লক করে আমাদের ঘরে এসে ভাবছি কোন শাড়িটা পড়া যায়। সবকয়টাই উনার পছন্দ করা। তাই বিশেষ কোনোটাই সিলেক্ট করতে পারছিনা। বহু ভেবে ঠিক করলাম লাল শাড়িটা পড়বো।
আরাফ আসার আগেই আমি রহিম চাচা আর তাহেরা ছুটি দিয়ে ফেললাম। আরাফের জন্য রান্না শেষ করে শাওয়ার নিলাম। তারপর অনেক যত্নে সাজতে শুরু করলাম।
আরাফের গাড়ির শব্দ শুনতেই বুকটা ধুকপুক করতে লাগলো। উনি আমায় এমন সেজেগুজে থাকতে দেখলে কি ভাববেন?! লজ্জায় মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমি কি সব সরিয়ে ফেলব? হঠাৎ মনে পড়লো মিথির বলা কথাগুলো। না না উনি আমার স্বামী, উনিই আমার হকদার। উনাকে লজ্জা পাওয়ার কি আছে?
মুখে এসব বললেও আমার হাত পা অসম্ভবভাবে কাঁপতে লাগলো। ওহ আল্লাহ আমাকে শক্তি দাও। আমি অনেক পাপ করে ফেলেছি, আমায় মার্জনা করো।

কি ব্যাপার বলুন তো রেবা?রহিম চাচা তাহেরা কেউই দেখি নেই। দারোয়ান বলল সবাই নাকি চলে গেছে, আপনি একা ভয় পাচ্ছেন‌না তো?

আমি তার দিকে না ফিরেই বললাম, আমিই উনাদের চলে যেতে বলেছি।

ওহ! তা এমন মুখ লুকিয়ে রেখেছেন কেন কি হয়েছে?

কিছু হয় নি। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি খাবার পরিবেশন করছি।

এতো তাড়াতাড়ি?

কয়টা বাজে? ওহ মাত্র নয়টা!

আপনি ঠিক আছেন রেবা? কিছু কি হয়েছে? এমন অদ্ভুত বিহেভ করছেন কেন?

আরাফ আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেললাম।
আরাফ আমার হাত সরিয়ে বলল, মাশাআল্লাহ!

আমি ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখি আরাফ মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে।

এই ব্যাপার তাহলে?

কোন ব্যাপার?

আমার জন্য সেজেগুজে বসে আছেন তাই না?

না মানে ঐ আর কি।

আরাফ আমার চিবুক তুলে বলল,রেবা আপনি আমার চক্ষুশীতলকারিণী। আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেল আপনাকে দেখে।

আপনার সঙ্গে আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।

বলুন?

এখানে না। আমার সঙ্গে আসুন।

আরাফ জিজ্ঞাসু নেত্রে আমার সঙ্গে এলো। দরজা খুলতেই সে অবাকে চরম শিখরে পৌঁছে বলল, এসব আপনি করেছেন? সিরিয়াসলি!

আমি তার সামনে হাটু ভাঁজ করে বসে পড়লাম,
আরাফ বললো আয়হায় কি করছেন আপনি উঠুন।

প্লিজ আরাফ আমি যা করছি করতে দিন। আরাফ আপনাকে আজকে আমি কিছু কথা কনফেস করবো। আমি যখন বিয়ে করে আপনার বাড়িতে পা রাখি এর আগ অবধি আপনার সম্পর্কে জানার কোনো বিশেষ আগ্রহ আমি দেখাইনি। এমনকি কাবিনে সাইন করার সময়ও দেখিনি বরের নামটা কি। বলতে পারেন একদম অচেনা একটা মানুষের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে আমি আপনার বাড়িতে এসেছিলাম। আমি ভাগ্যবতী বলেই আপনার আর আপনার পরিবারের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি। আপনি আমার প্রতি অনেক যত্নশীল, আমার সবকিছু আপনার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু।
আরাফ আমি ব্রোকেন হার্টেড গার্ল। আমার অতীত আছে, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি অসতী নই। কোনো মেয়েই তার বরকে অতীতের কথা বলতে চাইবেনা, কিন্তু আপনি আমার বিশ্বস্তের জায়গাটা এমনভাবেই অর্জন করেছেন আমি আপনাকে বলতে ভয় পাচ্ছিনা। আরাফ আমি জানি আপনি আমায় বুঝবেন, আমার অতীত আপনাকে বদলাবে না।
আমি আপনার সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করতে চাই, তাই এসব কথা আপনাকে জানাচ্ছি।

আরাফ আপনি আমার চোখে অনেক সম্মানীয় ব্যক্তি। আপনার স্থান আমার মনের কোথায় আমি হয়তো কখনোই বলে বোঝাতে পারবো না। আমি ভেবেছিলাম আমার দ্বারা আর কোনোদিন ভালোবাসা হবে না। আপনি আমার ধারণা বদলে দিয়েছেন। আমি নতুন করে আবার প্রেমে পড়েছি। পরিপক্ক আমিটা চাইছি আপনাকে পরিপূর্ণভাবে ভালোবাসতে। আপনি যেমন করে আমায় ভালোবাসেন ঠিক তেমন করেই আপনাকে ভালোবাসতে। আপনার সঙ্গে আমি অনেক অন্যায় করেছি, আমি রোজ ভাবতাম স্ত্রীর দায়িত্ব আমি ঠিকঠাক পালন করছি। অথচ আমার আসল দায়িত্বটাই এড়িয়ে গেছি। আপনি আমায় কতভাবে বুঝিয়েছেন, আমি ওসবের আসল অর্থ বুঝিনি। আপনি বারবার বলেছেন আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আসবেন না, আমার যে আগ বাড়িয়ে আসার দরকার ছিল আমি বুঝিনি। আপনাকে তো ভালোবেসেছি বহু আগেই তবু কেন এতোদিন দূরে সরেছিলাম জানিনা! আমায় আপনি ক্ষমা করুন আরাফ। আমার জন্য আপনি যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা উপলব্ধি করার মতো জ্ঞান আমার ছিল না। এই নির্বোধকে ক্ষমা করে গ্রহণ করুন প্লিজ।

আরাফ আমার মুখোমুখি বসে বললো, রেবা আপনাকে আমি নিষেধ করেছিলাম কাঁদতে। আপনি তারপরও কাঁদছেন?

আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আপনি ভীষণ ভালো আরাফ, আমি আপনাকে কোথায় তুলে রাখি বলুন তো? আমার যে বড্ড ভয় হয় আপনার যত্ন আমি করতে পারবো কি না,

হুসস। এতো কথা বলতে পারেন আপনি! সবসময় এমন করে ভাবেন কেন শুনি?

আমি তার শরীরে ভার ছেড়ে দিয়ে বললাম, আমার একদম ভালো লাগছে না, একদম না। আমায় তুলে ধরুন তো। আমার মন ভালো করে দিন।

আরাফ আমায় কোলে তুলে বলল, এখুনি মিইয়ে পড়লে তো চলবে না, আমার দশ মাসের উপোস ছুটবে, বুঝতে পারছেন তো?

আমি লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢাকলাম। আরাফ হাতের উপরেই চুমু খেয়ে বললো, রেবা আপনি চোখ জলসানো সুন্দর। আমার না যেন আজ‌ জ্বর উঠে যায়!

আমি হাত সরিয়ে চোখ বড় বড় করে বললাম, জ্বর আসবে কেন!

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমার অধরজোড়া দখল করে নিলো।

রেবা আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি, সত্যিই অনেক ভালোবাসি। আপনি জানেন না আপনাকে পেয়ে আমি কতোটা সুখ অনুভব করছি। আমার তরঙ্গিনীর মাঝে ডুব দেওয়ার সৌভাগ্য আমার হলো অবশেষে।

আমি তার গালে গভীর করে চুমু খেয়ে তার কান্না মুছে বললাম,আমি ও আপনাকে অনেক ভালোবাসি। আমায় অনেক আদর করুন না। আপনার উষ্ণ ভালোবাসায় সিক্ত করুন না প্লিজ,,,

আরাফ তার সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে গভীর স্পর্শ ছড়িয়ে দিতে লাগলো তার প্রিয়তমার প্রতিটি অঙ্গে,,,

চলবে,,,,

(ছুটির দিনে একটু শান্তিমতো ঘুমানোর জো নেই বাপু! একটা দিন একটু বিকেল করে গল্প দেওয়ায় ইনবক্স+কমেন্টবক্সে যেভাবে হামলে পড়লেন সবাই! আরাফের মতো ধৈর্যশীল হতে পারেন না হুম?নিন এখুনি দিয়ে দিলাম। ভোররাতে জেগে পড়ুন। বাই দ্য ওয়ে ভালো আছেন তো?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here