ডাকিনি বউ,৫ম পর্ব

ডাকিনি বউ,৫ম পর্ব
লেখক:মাসুদ রানা

সাধু বাবার মুখে এই কথাগুলো শুনে আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম! কি বলছেন এসব সাধু বাবা! তার মানে ইয়েজেরিন কোন ডাকিনী না?! সে একটা অশরীরী আত্মা ! কিন্তু সে তাহলে আমার সাথে কেনো ছলনা করলো?! আর সেদিন ডাকিনী মন্ত্র পড়ার পরেই বা কি করে সে আসলো?! আর এতগুলো খুনই বা কেনো করালো আমাকে দিয়ে। তার আসল পরিচয়টাই বা কি?! এর উত্তরগুলো আমাকে জানতেই হবে! কিন্তু কিভাবে জানবো?! এরপর সেই সাধু বাবাকেই আবার প্রশ্ন করলাম:
-কিন্তু কোন অশরীরী কেনো আমার কাছে আসবে?! আর সে যদি ডাকিনী না হয়েই থাকে তাহলে সে এতোগুলো মানুষের রক্ত মাংস কি করে খেলো?! আর অশরীরী আত্মাদেরতো কোন শরীরই থাকে না! তাহলে সে কি করে এতোটা সৌন্দর্যের অধিকারী হলো?? আর তার অভিশাপেই বা আমি কি করে নেকড়ে মানবে পরিণত হলাম?! (আমি)
-এইসব প্রশ্নের উত্তর সেই অশরীরীই তোকে দিতে পারবে! আমি যা সত্য তাই তোকে বললাম। এখন বিশ্বাস অবিশ্বাস তোর একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার। (সাধু)
-আমি আপনাকে বিশ্বাস করি বাবা। কিন্তু এখন আমি কি করবো বলুন! আমাকে একমাত্র আপনিই সাহায্য করতে পারবেন!
-হুম আমি তোর সমস্যা বুঝতে পারছি! হয়তো সেই অশরীরী আত্মাটা তার কোন অসমাপ্ত কাজ করতে আবার এই পৃথিবীতে এসেছে! হয়তো কোন প্রতিশোধ নিতে এসেছে! হয়তো সে কোনো অতৃপ্ত অশরীরী আত্মা। আমি ডাকিনী দেবীর কাছে তোর জন্য সাহায্য চাইবো। দেখি তিনি কি সাহায্য করেন!
-আর বাবা! সেই বাকি দুইটা বই অর্থাৎ “ডাকিনী বিদ্যার নিয়ম” আর “ডাকিনী বিদ্যার সমাধান” বই গুলো কোথায় পাবো!!? এই বইগুলোর মাধ্যমে কি এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব!!?
-ধুর বোকা!! এই পর্যন্ত এই রকম কোনো বই এর নামই আমি শুনিনি!!
তোর সাথে যে মেয়েটা আছে সে যদি কোনো ডাকিনী হতো তাহলে হয়তো এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতাম। যেহেতু সে কোনো ডাকিনী না। একটা অশরীরী। তাই এই বইগুলো এই রহস্য সমাধানের জন্য মূল্যহীন!! তাই এইগুলোর তোর প্রয়োজন নেই!!
-ঠিক আছে বাবা! কিন্তু একটা জিনিস আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না।আপনি এখানে রাতের বেলায় লুকিয়ে ডাকিনী পূজো করেন কেনো?! দিনের বেলায়তো আমি যখন এসেছিলাম তখন এই ঘরটা তালা দেওয়া ছিলো। আর তখন এখানে আমি আর কিছু দেখতে পাইনি!
-এটা একটা বিশাল গল্প। তুই এখন যেই বনে দাঁড়িয়ে আছিস এটা কোন সাধারণ বন বা জঙ্গল না! এটা একটা কালো যাদু আর অলৌকিক শক্তিতে ঘেরা বন ছিলো। এখানে পিশাচ ও ডাকিনী দেবীদের পুজো করা হতো। প্রতিদিন শত শত তাজা প্রাণের বলি দিয়ে তুষ্ট করা হতো দেবীদের। এখানে বসবাস ছিলো হাজারো অশরীরী আত্মাদের। রোজ নতুন নতুন তান্ত্রীক আর সাধুরা ধ্যানে বসতো এখানে! আশেপাশের গ্রামগুলোর মানুষেরা কোন সমস্যায় পড়লেই সাথে সাথে এই জঙ্গলে ডাকিনী দেবীর কাছে এসে সাহায্য চাইতো। ডাকিনী দেবীও কাউকেই ফিরিয়ে দিতো না। এরপর ডাকিনী দেবির প্রতি সবার বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে। অনেকেরই সন্তান না হলে এই বনে ডাকিনী দেবীর কাছে সন্তান ভিক্ষা চাইতো। আশেপাশের গ্রামের অনেক মহিলারাই ইশ্বরপুজো বা ইশ্বরে বিশ্বাস বাদ দিয়ে ডাকিনী পুজো শুরু করেন। তাই ইশ্বরের এক ভয়ংকর অভিশাপে এই বনের সকল সাধু,তান্ত্রীক এবং পুজারীদের মৃত্যু ঘটে। ধ্বংস হয় এখানের সব অলৌকিক শক্তি। আমার বাবাও এই বনে ডাকিনী পুজা করতো এবং সেই অভিশাপে আমার বাবাও মারা যায়। এরপর থেকে এই বনে কালো যাদু চর্চা নিষিদ্ধ হয় এবং সাধারণ মানুষের প্রবেশ করা শুরু হয়। আমার যখন ২১ বছর বয়স ছিলো তখন আমি আমার বাবার ঘরে ডাকিনী বিদ্যার কিছু বই দেখতে পাই। সেই বইগুলো পড়ে ডাকিনী দেবীর প্রতি আমারো বিশ্বাস
জন্মাতে শুরু করে। সেখান থেকে আমি ডাকিনী পুজোর নিয়ম জানতে পারি এবং ডাকিনী পুজো করা শুরু করে দেই। এই ৪৩ বছর ধরে পুজো করে আমি নানানভাবে ডাকিনী দেবীকে তুষ্ট করার চেষ্টা করি। যদিও এখন পর্যন্ত ডাকিনী দেবী আমার সামনে দেখা দেননি। কিন্তু আমার প্রায় সব ইচ্ছাই তিনি পুরণ করেন! আমি ডাকিনী পুজো দিনের বেলায় করিনা কারণ এটা পুজোর জন্য সঠিক সময় না এবং দিনের বেলায় অনেক সাধারণ মানুষ এই জঙ্গলের ভেতর আসে। তারা যদি এই ডাকিনী মূর্তি দেখে তাহলে এটা চুরি করে নিয়ে যাবে। তাই আমি দিনের বেলা অদৃশ্যমান থাকি এবং ঘরটা তালা অবস্হায় থাকে। আর রাত হতেই এখানে ডাকিনী পুজো শুরু করি!
-হুম বাবা বুঝলাম! কিন্তু এখন আমি কি করবো এই অশরীরী আত্মাটাকে নিয়ে। আমি যতদ্রুত সম্ভব এই আত্মাটাকে আমার জীবন থেকে সড়াতে চাই!
-তুই চিন্তা করিস না। এর সমাধান আমি করে দিবো! তোর আর এই বনে আসার প্রয়োজন নেই। এখানে রাতে অনেক অশরীরীরা ঘুরে বেড়ায়। তাই তোর বিপদ হতে পারে। যখন সময় হবে তখন আমিই তোর কাছে সাহায্য করতে যাবো! তুই এখন চলে যা।
-ঠিক আছে বাবা। কিন্তু এতোরাতে এই রাস্তা দিয়ে আবার আমি বাড়ি যাবো কিভাবে?! এখন আমার খুব ভয় করছে!
-ভয় পাস নে। এই ডাকিনীর মুর্তির পায়ের কাছে দেখ কতগুলো পাথর পড়ে রয়েছে। এগুলোর ভেতর একটা পাথর সঙ্গে রাখ।
এই পাথর তোর সাথে থাকলে কোন অশরীরী তোর কাছে আসতে পারবে না।
.
.
সাধু বাবার সাথে কথা বলার পর ডাকিনী মুর্তির পায়ের কাছ থেকে একটা পাথর তুলে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলাম। আসার সময় সাধু বাবা একটা মশালে আগুন ধরিয়ে সেটা আমায় দিয়েছিলো যাতে অন্ধকারে পথ চলতে আমার কষ্ট না হয়। আসার আগে শেষবারের মতো সেই ডাকিনী মুর্তিটাকে একবার ভালো করে দেখে নিলাম। কি ভয়ংকর রুপ হয় ডাকিনী দেবীর!! মনে হলে পৃথিবীর সকল অপবিত্রতা আর ভয়ংকরতা যেনো তার শরীরেই দৃশ্যমান! এরপর সেই বনের পথ ধরেই হাঁটছিলাম আর সাধু বাবার বলা কথাগুলো ভাবছিলাম। আসলেই কি ইয়েজেরিন কোন ডাকিনী না! সে একজন ছলনাময়ী অশরীরী! কিন্তু এসব যদি সত্যিই হয় তাহলে ইয়েজেরিন আমার জীবনে কেনো আসলো?! আর সে আমার সাথেই বা কেনো এতোদিন ধরে রয়েছে?! এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কিছুতেই মাথায় আসছিলো না। আবার ইয়েজেরিনকে গিয়ে যে এই প্রশ্নগুলো করবো তার সাধ্যও নেই আমার। ইয়েজেরিনকে এই প্রশ্নগুলো করলে সে বুঝে যাবে যে আমি তাকে ধ্বংস করার উপায় খুজতেই এইখানে এসেছি! তখন আমার বিপদ আরো বেড়ে যাবে। অন্যদিকে সাধু বাবার কথাগুলোও কিন্তু বেশ যৌক্তিক ছিলো। তাই তাকে অবিশ্বাস করার কোন কারণ খুজে পেলাম না। এইসব ভাবতে ভাবতেই সেই বন থেকে বেরিয়ে আসলাম। আসলেই সেই পাথরটার গুনে আর কোন অশরীরীর মুখোমুখি হতে হয়নি আমায়। এরপর সেই রাস্তা ধরেই বাড়ি ফিরলাম।
বাড়িতে ফিরেই বেশ অবাক হলাম। সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর তার ছেলে ও ছেলের বউ এখনো ঘুমায়নি। তারা উঠানে আমার আসার অপেক্ষায় রাত জেগে বসেছিলো। আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই বৃদ্ধ লোকটি চমকে উঠে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসলেন। আর আমাকে প্রশ্ন করলেন:
-কোথায় গিয়েছিলে তুমি বাবা?! রাত এগাড়োটা বেজে গেছে এখনো ফিরোনি তাই আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম কোন বিপদ হলো নাকি! আমার ছেলেকেও কয়েকবার পাঠিয়েছিলাম রাস্তায় কিন্তু সে তোমায় খুজে পায়নি!
.
লোকটার কথা শুনে আমিও কিছুটা অবাক হলাম এই ভেবে যে, মাত্র এগাড়োটা বাজে! আমার কাছে মনে হয়েছিলো পুরো একটা রাত কাটিয়ে এসেছি বনের ভেতরে! তাও ভালো এতো দ্রুত বাড়িতে ফিরতে পেরেছি। নাহলে হয়তো তাদেরকে কারণটা বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হতো। আর ইয়েজেরিনো আমায় সন্দেহ করতো। বৃদ্ধ লোকটার প্রশ্নের ঠিক উত্তরটা দিতে আমি অপারক। তাই আবার সেই মিথ্যার আশ্রয় নিলাম। লোকটাকে বললাম যে, হঠাৎ বাড়ি ফিরতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম তাই একটু দেরি হলো আর কি! লোকটাও তার পরিবার আমার কথাটা বিশ্বাস করলো। আমি জানতাম যে ইয়েজেরিন এখন দু’তালার ঘরে ঘুমাচ্ছে। তাও প্রশঙ্গটা ঘুরাতে আবার প্রশ্ন করলাম:
-আচ্ছা! ইয়েজেরিন কোথায়? সে কি এখনো ঘুমাচ্ছে?
-না। ১ ঘন্টা হলো আমার নাতিন মুশকান দুই তালায় তোমার স্ত্রীর কাছে গিয়েছে। হয়তো দুজনে মিলে গল্প করছে!
(বৃদ্ধ লোকটি)
.
লোকটার মুখে কথাটা শুনে আমি কিছুক্ষনের জন্য থমকে গেলাম! মুশকান ১ ঘন্টা ধরে উপরে রয়েছে! মুশকান মেয়েটা কোনটা?! সেই ৮-৯ বছরের বাচ্চা মেয়েটা নয়তো!! সে আবার কেনো
ইয়েজেরিনের কাছে যেতে গেলো?! যে ইয়েজেরিন ১টা রক্ত মাংসের টিকটিকি বা ইঁদুর দেখলে তাকেই জীবিত অবস্থায় ছাড়ে না! তার কাছে এখন একটা তাজা রক্ত মাংসের বাচ্চা মেয়ে গিয়েছে!! ভাবলাম হয়তো রাতে রক্ত তৃষ্ণায় ইয়েজেরিনের ঘুম ভেঙে গিয়েছে। আর এখন যদি তার সামন সে একটা বাচ্চা মেয়েকে পায় তাহলেতো তাকে ছিড়েই খেয়ে ফেলবে! তার মানে এই ১ ঘন্টায়তো মনে হয় ইয়েজেরিন সেই বাচ্চা মেয়েটাকে খুন করে খেয়েও ফেলেছে! আমার মনে একটা অজানা ভয় কাজ করতে শুরু করলো! আমি মনে হয় আবার বিপদে পড়ে গেলাম। এখন যদি এই লোকগুলো ইয়েজেরিনের এই ভয়ংকর রুপটা বুঝতে পারে তাহলেতো আমাদের এখানে থাকাটাও বিপদজনক হবে! এরপর ভয় আর কৌতুহলতা নিয়েই দ্রুত দৌড়ে গেলাম বাড়ির দুতালায় ইয়েজেরিনের ঘরের সামনে। দেখলাম দরোজাটা ভেতর থেকেই চাপিয়ে দেওয়া ছিলো। এরপর ভয়ে ভয়ে দরোজাটা আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে খুললাম। এরপর যা দেখলাম তাতে আমিতো পুরোই অবাক হয়ে গেলাম!
ইয়েজেরিন বিছানায় চুপচাপ শুয়েছিলো। আর সেই বাচ্চা মেয়েটা অর্থাৎ মুশকান ইয়েজেরিনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিলো। আর ইয়েজেরিন বাচ্চা মেয়েটার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিলো। আমি ইয়েজেরিনকে এইরকম দেখে পুরোই চমকে উঠলাম!! ইয়েজেরিন একটা বাচ্চা মেয়েকে খুন না করে তাকে আদোর করছে?! ইয়েজেরিন এতোটা বদলে গেলো কিভাবে!! আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই সেই বাচ্চা মেয়েটা বিছানা থেকে নেমে চলে গেলো। এরপর আমি দরোজা আটকে যেই ইয়েজেরিনের দিকে তাকালাম দেখলাম যে, ইয়েজেরিন কোন একটা কিছুর যন্ত্রনায় ছটফট করছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম! ইয়েজেরিনের আবার কি হলো?! একটু আগেইতো ঠিক ছিলো!! এরপর যেই ইয়েজেরিনের কাছে যেতে চাইলাম ঠিক তখনি ইয়েজেরিন চিৎকার করে আমায় বলতে লাগলো:
-আমার থেকে দুরে সড়ে যাও! খবরদার! কাছে আসবে না বলছি! আমি কিন্তু তোমায় খুন করে ফেলবো! তোমার সাথে করে এটা কি নিয়ে এসেছো?! আমার খুব যন্ত্রনা হচ্ছে! তুমি ওটা ফেলে দাও।
.
আমি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না! ইয়েজেরিন হঠাৎ এমন করছে কেনো?! আমি কি এমন জিনিস সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি?! এরপর হঠাৎ আমার মনে পড়লো! আরে ইয়েজেরিন সেই পাথরটার কথা বলছে নাতো?! যেটা আমাকে সেই সাধু বাবা দিয়েছিলো! সাধুতো বলেছিলো এইটা সাথে থাকলে কোন অশরীরী কাছে আসবে না! তার মানে কি ইয়েজেরিন
আসলেই একটা অশরীরী অতৃপ্ত আত্মা! হয়তো এর জন্যই পাথরটা আমার সাথে আছে বলে সে যন্ত্রনায় ছটফট করছে! কিন্তু ইয়েজেরিনকে কিছুতেই বোঝানো চলবে না যে আমি জেনে গেছি সে কোন ডাকিনী না, সে একটা অশরীরী আত্মা। আর তাকে আমি ধ্বংসের চেষ্টা করছি! তাই ইয়েজেরিন বলার সাথে সাথেই আমি পাথরটা ছুরে জানালা দিয়ে বাহিরে ফেলে দিলাম! এরপর ইয়েজেরিনের যন্ত্রনা কমলো। সে ছটফট করা বন্ধ করে দিয়ে চুপচাপ বিছানায় বসে পড়লো। আমি বিছানার অন্য পাশে বসে ছিলাম। এরপর ইয়েজেরিন ঠিক আমার পাশে এসে বসলো। আর আমার হাতটা আলতো করে ধরে করুন কন্ঠে আমায় বললো:
-আমি জানি,তুমি চাও না যে আমি আর এই পৃথিবীতে থাকি! তাই না? তুমি আমাকে এই পৃথিবী থেকে তাড়িয়ে দিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছো! কিন্তু বিশ্বাস করো আমি এই পৃথিবীকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি আর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাই না!
.
ইয়েজেরিনের এই কথাগুলো শুনে আমি কিছুটা ঘাবড়ে যাই। এরপর তাকে বলি:
-এসব কি বলছো?! তোমাকে তাড়াতে চাইবো কেনো? আমিও যে তোমায় ভালোবাসি। আর বিশ্বাস করো এই পাথরটা সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না! রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম!
-মিথ্যা বলো না! আমি জানি যে তুমি সেই বনে গিয়েছিলে!
.
এই কথাটা শুনে আমি আবার চমকে উঠি! এটা ইয়েজেরিন
জানলো কিভাবে?! হয়তো তার এই শক্তিটা রয়েছে! এবার কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে ইয়েজেরিনকে আমি উত্তর দিলাম:
-আমি কি করবো ইয়েজেরিন? তুমিই বলো! তুমি নিজেও জানো যে তুমি এই দুনিয়ার কেউ না! তোমার ঠিকানা অন্য দুনিয়ায়। তুমি এই দুনিয়ায় অনিয়ম এবং অস্বাভাবিকতার মধ্যে রয়েছো। তুমি একের পর এক নিরোপরাধ মানুষকে খুন করো এবং তাদের রক্ত মাংসে নিজের ক্ষুধা মেটাও। তুমি কি জানো যে এটা পৃথিবীর নিয়মের বাহিরে! এই পাপ আর আমি বেশিদিন হতে দিতে পারি না।
.
এরপর ইয়েজেরিন কাঁদতে কাঁদতে আমার পায়ের কাছে এসে আমায় বললো:
-বিশ্বাস করো। আমি আমার অভ্যাস বদলাতে সক্ষম। আমি আজকের পর থেকে একটা সাধারণ মেয়ে মানুষের মতো বেঁচে থাকবো। আর একটা প্রাণেরো ক্ষতি করবো না! আমি রক্ত আর মাংসের নেশা বদলে ফেলবো। আমি আর পৃথিবীর অনিয়মের দিকে যাবো না। তোমার পায়ে পড়ি তুমি আমায় এই পৃথিবী থেকে তাড়িয়ে দিও না! আমি শুধু তোমায় ভালোবেসে এই পৃথিবীতে থাকবো!!
.
.
ইয়েজেরিন কাঁদছিলো। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তার চোখে-মুখে আমি বিন্দুমাত্রও ছলনা দেখতে পেলাম না। তাকে বিশ্বাস করা ছাড়া আমার আর কোন উপায়ো ছিলো না। আর সাধু বাবাও তো বলেছিলো যে সময় হলে সেই আমায় সাহায্য করবে। আমাকে আর সেই বনে যেতে
হবে না! তাই আমিও ইয়েজেরিনকে পায়ের কাছ থেকে তুলে বলি যে, আমি আর তার কোন ক্ষতি করতে চাই না। এরপর আমরা একে অপরের হাত ধরে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আসলেই ইয়েজেরিন অনেক বদলে গিয়েছিলো। পরবর্তী ৩ দিন সে একজন সাধারণ মেয়ে মানুষের মতোই বেঁচে ছিলো। আর কোন রক্ত বা মাংস তৃষ্ণার কথা সে আমায় বলেনি। দিনের বেশির ভাগ সময়ই সে মুশকানের সাথে এটা সেটা কাজ করে কাটিয়ে দিতো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ইয়েজেরিন সেই বাচ্চা মেয়েটাকে মায়ের মতো ভালোবেসে ফেলেছে। সবকিছুই স্বাভাবিক ভাবে চলছিলো। কিন্তু বিপদটা ঘটলো ৪র্থ দিন সকাল বেলা।
.
সেদিন আমার সকাল সকালই ঘুমটা ভেঙে যায়। আসলে ঘুমটা ভাঙে ঘরের বাহিরে প্রচুর মানুষের চেচামেচির শব্দে। বিছানার পাশে তাকিয়ে দেখলাম ইয়েজেরিন তখনো ঘুমাচ্ছিলো! আমি একাই তাই দরোজাটা খুলে ঘরের বাহিরে যাই কিসের শব্দ এটা দেখতে! ঘর থেকে বের হতেই দেখলাম উঠানে অনেগুলো মানুষ ভীর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে! এরপর ভীর ঠেলে সামনে গিয়ে যা দেখলাম তাতে ভয়ে আমার চোখ প্রায় কপালে উঠে গেলো! বাড়ির উঠানে আমাদের বাড়ির সেই বৃদ্ধ লোকটার ভয়ংকর মৃত দেহ পড়েছিলো। লোকটার লাশ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো লোকটাকে খুব ভয়ংকর এবং নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। লোকটার চোখ দুটো উপরে
ফেলা হয়েছে। তার শরীরের সাথে তার হাতগুলো ছিলো না। মনে হচ্ছিলো তার দুটো হাত কেউ টেনে ছিড়ে নিয়ে গেছে! সকাল সকাল তার এই লাশটা দেখে ভয়ে আৎকে উঠলাম আমি! ভাবতে লাগলাম এতোটা নির্মমভাবে লোকটাকে কে খুন করতে পারে?! তাহলে কি ইয়েজেরিনের ভেতর পৈশাচিকতা আবার জেগে উঠেছে?! কিন্তু সে যদি খুন করতোই তাহলে রাতে অন্তত আমি একবার হলেও ঘরে তার অনুপস্হিতি বুঝতে পারতাম। কারণ সারারাত আমরা একে অন্যের হাত ধরে শুয়ে ছিলাম! আর ইয়েজেরিন যদি লোকটাকে খুনই করতো তাহলে তার লাশটা সে এইভাবে এখানে ফেলে রাখতো না। সে এতোক্ষনে লাশটার রক্ত আর মাংস খেয়েই ফেলতো। আর লোকটার মৃত লাশটা দেখে মনে হচ্ছিলো যে লোকটার উপর কেউ তার বহুদিনের ক্ষোভ আর রাগ ঝেড়েছে। হয়তো কোন পুরনো প্রতিশোধ নিয়েছে! কিন্তু ইয়েজেরিনেরতো আর এই বৃদ্ধের উপর কোন ক্ষোভ ছিলো না! তাহলে লোকটাকে কে খুন করেছে?! তাহলে কি এই বাড়িতে ইয়েজেরিনের চেয়েও ভয়ংকর আর নির্মম কেউ রয়েছে?! কিন্তু কে সে?! আর কি চায় এখানে?!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here