কোথাও_কেউ_নেই
হুমায়ুন আহমেদ
১৯.
মুনা বলল, আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
ভদ্রলোক সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। যেন প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারছেন না। মুনা বলল, আমি অন্য একটা কেইসের ব্যাপারে। আপনার কাছে এসেছিলাম। আমার মামা একটা ঝামেলায় পড়েছিলেন…
ভদ্রলোক মুনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, মনে আছে। ক্রিমিনাল মিস এপ্রোপ্রিয়েশনের মামলা। চারশ তিন ধারা। আপনার মামার নাম শওকত হোসেন কিংবা শওকত আলি।
মুনা যথেষ্ট অবাক হল। এই উকিল ভদ্রলোক অসম্ভব ব্যস্ত। চেম্বারে লোকজন গিজগিজ করছে। তার পক্ষে এতদিন আগের একটা মামলার কথা মনে থাকার কথা নয়। এর রকম স্মৃতিশক্তি মানুষের থাকে?
আপনার নামও মনে আছে। মিস মুনা। এখনো কি মিস আছেন না মিসেস হয়েছেন?
হইনি এখানে।
কেন অসুবিধা কি?
ভদ্রলোক গভীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলেন। যেন সত্যি সত্যি জানতে চান। কত বিচিত্র স্বভাবের মানুষই না থাকে পৃথিবীতে।
অসুবিধাটা কি বলুন।
ব্যক্তিগত অসুবিধা। সেটা এই জায়গায় বলতে চাই না।
আরে এই জায়গা কি দোষ করল? উকিলের চেম্বারে সব কথা বলা যায়। এ টু জেড।
আমি যে সমস্যা নিয়ে এসেছি তার সঙ্গে আমার মিস বা মিসেসের কোনো সম্পর্ক নেই।
ও আচ্ছা।
আমি কি সমস্যাটার কথা বলব?
আজ শুনতে পারব না। আজ ব্যস্ত। আগামী সপ্তাহে আসুন। সোমবার। এ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যান। কাগজপত্র কী আছে?
কিছু কিছু আছে।
সেই সব রেখে যান। আমার এসিসটেন্ট আছে। জুনিয়র দুই উকিল। বুদ্ধিশুদ্ধি মিলিটারিদের মত। মাথার খুলির ভেতরে সাবানের ফেনা ছাড়া আর কিছু নেই। নো ব্রেইন। কিন্তু উপায় কি বলুন? এই শমসের চা দে। ইনারে চা দে।
মুনা বলল, আমি চা খাব না।
কেন খাবেন না?
কারণ কিছুই না। খেতে ইচ্ছে করছে না।
আপনি বললেন। কারণ নেই আবার খেতে ইচ্ছে করছে না। দুরকম কথা বলেন কেন? খেতে ইচ্ছে করছে না। এটাই হচ্ছে কারণ। কথাবার্তা চিন্তা-ভাবনা করে বলা উচিত।
উকিল ভদ্রলোক থু করে একদলা থুথু ফেললেন এ্যাসট্রেতে। চারদিকে এ্যাসট্রের ছাই ছড়িয়ে পড়ল। ভদ্রলোক বিরক্ত হবার বদলে মনে হয় আরো খুশি হলেন। ছাই কি করে উড়ে সেটা পরীক্ষা করবার জন্যে আরেক দফা থুথু ফেললেন।
মিস মুনা।
জি।
ছাই ফেলবার জন্যে সব টেবিলে এ্যাসট্রে থাকে। কিন্তু থুথু ফেলবার জন্যে কিছু থাকে না। কিছু থাকা উচিত। পিকদানি টাইপ কি বলেন?
মুনা কিছু বলল না। উকিল সাহেব হাই তুলে বললেন চলে যান, বসে আছেন কেন? সোমবারে আসবেন। দেখে দেব। আমার ফিস কিন্তু আরো বেড়েছে। জেনে যাবেন। শেষে আমড়াগাছি করবেন। সেটা হবে না। উকিলের চেম্বার কোনো মাছের বাজার না। মুহুরির কাছে সব জেনে-টেনে যান।
জি আচ্ছা।
সোমবারে ফিসের টাকার গোটাটাই নিয়ে আসবেন। খালি হাতে আসবেন না। মুনা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনার কাছে যারা আসেন তাদের সবারই নামধাম কি আপনার মনে থাকে?
হুঁ থাকে। নাম মনে থাকে আর কোনো ধারার কেইস ঐটা মনে থাকে। করে খাচ্ছি। তো এই কারণেই। হা হা হা।
মুনা বের হয়ে গেল। অফিসের সময় হয়ে আসছে। এখান থেকে একটা রিকশা নিলে ঠিক সময় পৌঁছান যাবে। মুনা খানিকক্ষণ ভেবে ঠিক করল। আজ অফিসে যাবে লাঞ্চ টাইমের পর। এই সময়টায় সে চেষ্টা করবে বাকেরের বড় ভাইকে ধরতে। হাসান সাহেব বোধ হয় নাম। আগের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে সাকুলার রোডে বাড়ি নিয়েছেন। সেই ঠিকনা বের করতে মুনার কম ঝামেলা হয়নি।
একটি কাজের লোক মুনাকে বসতে বলে ভেতরে চলে গেল। তারপর আর কারোরই কোন খোঁজ নেই। বাড়ি নিঃশব্দ। ইংরেজিতে এই ধরনের পরিবেশকেই বোধ হয়। পিন ড্রপ সাইলেন্স বলা হয়। মনে হচ্ছে শুধু এই বাড়ি নয় আশপাশের কয়েকটি বাড়িতেও লোকজন নেই।
সুন্দর করে সাজানো বসার ঘর। পর্দা টেনে রাখার জন্যে আধো আলো আধো আঁধার। তবু এর মধ্যেই বোঝা যাচ্ছে এ ঘরে একবিন্দু ধুলো নেই। রোজ দুবেল কিংবা কে জানে হয়ত তিন বেলা এই ঘর ঝাড়পোচ করা হয়। অডিকেলনের গন্ধের মতো মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে নাকে। গন্ধটাও ঘরের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। যেন এটা না থাকলেই মানাত না। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর কাজের লোকটি আবার ঢুকল। তার হাতে চমৎকার একটি ট্রে। ট্রেতে এক কাপ চা অন্য একটি প্লেটে কিছু বিসকিট। রুটিন কাজ। যারা এখানে আসে তাদের সবার জন্যেই বোধ হয় এই ব্যবস্থা। মুনা বলল। উনার কি দেরি হবে? আমার অফিস আছে।
কাজের লোকটি বলল, আসতেছেন। তারপরও আধঘণ্টার মত বসে থাকতে হল।
মানুষকে বসিয়ে রাখার মধ্যে এরা কি কোনো আনন্দ পায়?
হাসান সাহেব ঘরে ঢুকলেন অফিসের পোশাক পরে। ঢুকেই ঘড়ি দেখলেন, এর মানে সময় বেশি দেওয়া যাবে না।
আপনি কি আমার কাছে এসেছেন?
জি।
আপনার সঙ্গে কি আমার পরিচয় আছে?
জি না। তবে আমরা এক পাড়ায় থাকতাম।
ও আচ্ছা। কি ব্যাপার বলুন?
আমি এসেছি আপনার ভাইয়ের ব্যাপারে।
বাকের? নতুন কোনো ঝামেলা বঁধিয়েছে নাকি?
জি না।
হাসান সাহেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। তিনি দ্বিতীয়বার ঘড়ি দেখলেন। কিন্তু বসলেন। ভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে তিনি সমস্ত ব্যাপার মন দিয়ে শুনবেন।
বলুন কি বলবেন?
বাকের ভাই অনেক’দিন ধরে হাজতে পড়ে আছে। কেউ বোধ হয় কিছু করছে না। দেখতে-টেখতেও যাচ্ছে না।
বাকেরের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
সম্পর্ক কিছু নেই। এক পাড়ায় থাকতাম। অনেক সময় আমাদের অনেক উপকার করেছেন।
ও তো গুণ্ডামি করে জানতাম। উপকার ও করে নাকি?
মানুষের চরিত্রের অনেকগুলি দিক থাকে।
তা থাকে। এ ম্যান হ্যাঁজ মেনি ফেসেস। ভালই বলেছেন। বাকেরের ব্যাপারটায় আমি ইচ্ছা! করেই নীরব আছি। এর কারণ আছে। আমার মনে হয় আপনাকে বুঝিয়ে বললে বুঝবেন। আমি মনে প্ৰাণে চাচ্ছি। যাতে ওর একটা শিক্ষা হয়। হাজতে ঢোকা মাত্র বের করে আনলে ঐ শিক্ষাটা হবে না।
আপনি চাচ্ছেন বিচার-টিচার হবার পর বাকের ভাই বেশ কিছু দিনের জন্যে জেলে চলে যাক।
হাসান সাহেব ঘড়ি দেখলেন। কিন্তু তার মধ্যে কোন চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেল না। তিনি সিগারেট বের করলেন এবং কাজের লোকটিকে চা দিতে বললেন। মুনা সহজ স্বরে বলল, আপনি বোধ হয় জানেন না এটা সাজানো মামলা। বাকের ভাইয়ের কাছে অস্ত্রশস্ত্র কিছুই ছিল না।
আপনি কি করে জানেন?
বাকের ভাইয়ের অনেক দোষ আছে কিন্তু সে মিথ্যা কথা বলে না।
হাসান সাহাবে হেসে ফেললেন। মুনা লক্ষ্য করল হাসিটি খুব সুন্দর। সহজ স্বাভাবিক।
আপনার নাম কি?
মুনা।
আমি কি আপনাকে তুমি করে বলতে পারি? বয়সে আমি অনেক বড়।
নিশ্চয় তুমি করে বলবেন।
আমি এখন অফিসে যাব। গাড়ি এসে গেছে বোধ হয়। হর্ন দিচ্ছে। তুমি কোথায় যাবে বল
তোমাকে নামিয়ে দেব।
আমাকে নামিয়ে দিতে হবে না। আমি রিকশা নিয়ে চলে যাব।
রিকশা নিয়ে চলে যাবার কোন দরকার নেই, এস, তুমি। আর শোন, আমি একজন এডভোকেটের সঙ্গে কথা বলছি। ও বাকেরের ব্যাপারটা দেখছে। তুমি হয়ত ভাবিছ আমি ভাই হিসেবে কোন দায়িত্ব পালন করছি না। এটা ঠিক না। দেখছি। আড়াল থেকে দেখছি। তাছাড়া…
তাছাড়া কি?
আফিসে আমার নিজের একটা সমস্যা যাচ্ছে। আমার পায়ের নিচে মাটি নেই। অনেক গল্প। তুমি আরেক’দিন এস, তোমাকে বলব।
হাসান সাহেব মুনাকে শুধু যে অফিসে নামিয়ে দিলেন তাই নয় নিজে গাড়ি থেকে নামলেন। মুনা কোথায় বসে তা দেখলেন। মুনা যখন বলল, এক কাপ চা খাবেন? তিনি বললেন–মন্দ কি।
চা খাওয়া যেতে পারে।
তিনদিন ধরে শওকত সাহেবের জ্বর।
খুব বেশি নয় একশ, একশ এক। তরু বয়সের কারণেই তিনি বেশ কাহিল হয়ে পড়লেন। শারীরিক অসুবিধা ছাড়াও কিছু কিছু মানসিক অসুবিধাও দেখা গেল। পর পর দু’দিন মুনাকে বললেন লতিফাকে তিনি পর্দার ফাঁকি থেকে উঁকি দিতে দেখছেন। মুনা কিছুই বলেনি। ঠোঁট বাকিয়েছে যা থেকে মনে হয় সে বিরক্ত। অথচ এর মধ্যে বিরক্ত হবার কী আছে। তার কথা সে বিশ্বাস না করতে পারে সেটা ভিন্ন কথা কিন্তু বিরক্ত হবে কেন? আগে তো শুনবে তিনি কী বলতে চান তাও শুনেনি। ঠোট বাকিয়ে ঘরের কাজ করতে গেছে। অথচ লতিফাকে তিনি দেখেছেন। নিশি রাতে ঘুম ভেঙে দেখা। তিনি শুয়ে ছিলেন। জানালা দিয়ে রোদ আসছিল বলে জানালা বন্ধ করে দিতেই ঘর খানিকটা অন্ধকার হয়ে গেল! ঠিক তখন ঘরের পর্দা নড়ে উঠল। শুধু শুধু পর্দা নড়বে কেন? তিনি তাকালেন এবং দেখলেন পর্দার নিচে স্যান্ডেল পরা রোগা রোগ দু’টি পা। লতিফার পা। তিনি ডাকলেন–কে লতিফ! লতিফা! পৰ্দা আবার নড়ে উঠল। তিনি বিছানায় উঠে বসতেই পা সরে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে কাউকে দেখলেন না। মুনা অফিসে। ঘর খালি। একটি প্রাণীও নেই। শুধু রান্নাঘরে ইঁদুর খুটাখুটি করছে।
অথচ সেই কথাটি মুনা শুনতেই চাইল না। বিরক্তি দেখিয়ে চলে গেল। সেদিনকার পুচকে মেয়ে অথচ ভাবটা এ রকম যেন পৃথিবীর সব রহস্য তার জানা। মুনার ওপর তিনি গত ক’দিন ধরে বেশ বিরক্ত। সে স্পষ্টতই তাকে অবহেলা করছে। তিন দিন ধরে তার জ্বর যাচ্ছে এই নিয়েও তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। একবার বলল না, ডাক্তার দেখাও। কিংবা নিজে গিয়ে কোনো ওষুধবিষুধ আনল না।
গতকাল সন্ধ্যায় তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুনাকে শুনিয়ে বললেন, বাঁচব না। দিন শেষ। মুনা বলল, খামোেকা আজেবাজে কথা বল কেন?
তিনি দুঃখিত গলায় বললেন, বাঁচব না। এই কথাটা বলছি। এটা কি আজেবাজে কথা?
হ্যাঁ। বাচাবে না সেটা তো সবাই জ্বানে। বারবার বলা দরকার কী?
তিনি চুপ করে গেছেন। মেয়েটা এমন অদ্ভুত একেকবার একেকটা জিনিস নিয়ে এমন বাড়াবাড়ি করে যে রীতিমত রাগ লাগে। এখন যেমন বাকেরের ব্যাপারটা নিয়ে করছে। সেদিন দেখলেন টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার ভরছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, কার জন্যে খাবার নিচ্ছিস?
বাকের ভাইয়ের জন্যে।
কেন?
খাবে সেই জন্যে। আজ ছুটির দিন আছে। কাজেই নিয়ে যাচ্ছি।
তিনি আর কিছুই বলেননি। কিন্তু জানেন কাজটা ভাল হচ্ছে না। লোকের চোখে পড়বে। নানান জনে নানান কথা বলবে। কিন্তু এই সহজ জিনিসগুলি মুনাকে কে বোঝাবে? কিছু বলতে গেলে ফোঁস করে উঠবে। দিন দিন মেয়েটার আকাশ-ছোঁয়া মেজাজ হচ্ছে। এক’দিন কড়া করে ধমক দিতে হবে।
শওকত সাহেব জ্বর গায়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন। ক্ষুধা হচ্ছে। সকালে কিছু খাননি। মুনা যাবার সময় বলে গেছে মিটাসেফে খাবার ঢাকা দিয়ে গেছে। মিটসোফে কয়েকটা রুটি আর কিছু ভাজি ঢাকা দেয়া। সেখানে কয়েকটা তেলাপোকা। ঢাকনির ওপর হাঁটাহাঁটি করছে। শওকত সাহেবের বমি এসে গেল। সেই বমি চাপতে গিয়ে বুকে চাপ ব্যথা। নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। শওকত সাহেব বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন। আলো মরে আসছে, ঘর অন্ধকার। আজও কী লতিফা আসবে নাকি। শূন্য ঘরে তার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। মুনা কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। হয়ত সন্ধ্যা পার করে ফিরবে। ঐ দিন মামুন এসেছিল। একদিনের জন্যে এসেছে। হাতে সময় নেই। তবু সে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে রইল। মুনার দেখা নেই। মুনা এল সন্ধ্যা মিলাবারও আধঘণ্টার পর। মামুন তখনো বসে আছে। মুনা শুকনো হাসি হেসে বলল, কখন এসেছ?
মামুন বলল, অনেকক্ষণ।
কোন কারণে এসেছি, না এমনি।
মামা চিঠিতে লিখেছিলেন একবার আসার জন্যে।
কথা হয়েছে মামার সঙ্গে?
হঁ। তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলবার জন্যে বসে আছি।
আজ না বললে হয় না? প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। দাঁড়াতে পারছি না।
আজ রাতের ট্রেনে চলে যাচ্ছি।
তাহলে এর পরের বার যখন আস তখন কথা হবে।
শওকত সাহেব দেখলেন মামুন শুকনো মুখে চলে যাচ্ছে। একি কাণ্ড! সব বদলে যাচ্ছে। বকুল? বকুলও কী কম বদলেছে! প্রথম প্রথম চিঠি লিখত। এখন তাও লেখে না। যদিও লেখে দুতিন লাইনে সব কথা শেষ বাবু ভাল আছে। মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। বাবুকে নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না। যেন বাবু ছাড়া তার আর কোনো চিন্তা নেই।
শওকত সাহেব শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলেই চমকে উঠলেন। দরজার পর্দা আবার কাঁপছে। তিন ভয়ে ভয়ে নিচের দিকে তাকালেন। রোগা রোগা দু’টি পা দেখা যাচ্ছে। শওকত সাহেবের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। প্রচুর ঘাম হতে লাগল। তিনি মৃদু স্বরে ডাকলেন, কে লতিফা!
টুনটুন করে দুবার কাচের চুড়ির শব্দ হল। লতিফা কাচের চুড়ি পরত। তার হাত ভর্তি ছিল নীল রঙের চুড়ি।
লতিফা। ও লতিফা।
পা দু’টি চট করে সরে গেল। শওকত সাহেব দরজা খুলে বাইরে এসে শুনেন খুব শব্দে বাইরের দরজার কড়া নড়ছে। দরজা খুলতেই দেখলেন মুনা দাঁড়িয়ে আছে। মুনা বিরক্ত হয়ে বলল, কতক্ষণ ধরে কড়া নাড়ছি। দরজা খুলছ না কেন?
শওকত সাহেব কিছু বললেন না।
দরজা খুলছে না দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
কি ভেবেছিলি মরে গিয়েছি?
তা না ভাবলাম অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে গেছ বোধ হয়।
তোর মামলার কি হল?
মামলা তো এখনো শুরু হয়নি। উকিলকে কাগজপত্র দেখতে দিয়েছি।
উকিল কে?
তোমার উকিল। তোমার বেলায় যিনি ছিলেন।
ও আচ্ছা।
হাসান সাহেব আছেন না? উনিও একজনকে বলছেন। মামলা কে চালাবে এখনো ঠিক হয়নি।
তুই এই ব্যপারটা নিয়ে বেশি ছোটোছুটি করছিস। যাদের করার তারা করবে তোর এত কিসের মাথাব্যথা।
মুনা হাসল। শওকত সাহেব বললেন, সামলো-সুমলে চলতে হয়। সমাজ সংসার দেখতে হয়। কঠিন জায়গা।
আমিও তো মামা কঠিন মেয়ে।
শওকত সাহেব কিছু বললেন না। মুনা বলল, তোমাকে কেমন অন্যমনস্ক লাগছে। কী হয়েছে। বল তো?
তিনি ইতস্তত করে বললেন, আজ আবার দেখলাম। এই কিছুক্ষণ আগে। দশ মিনিটও হয়নি।
কি দেখলে?
তোর মামিকে দেখলাম।
তুমি কি পাগল-টাগল হয়ে যাচ্ছ নাকি মামা? কি ধরনের কথাবার্তা যে বল; রাগে গা জ্বলে যায়।
ঘটনাটা না শুনলে তুই…
কোন কিছু আমি শুনতে চাই না।
শওকত সাহেব ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। মুনা বলল, জ্বর কমেছে?
শওকত সাহেব সেই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না। মুনা রাতের খাবার তৈরি করে তাকে খেতে ডাকল। তিনি উঠে এলেন। কিন্তু খেতে পারলেন না। খানিকক্ষণ পরই উঠে গিয়ে একগাদা বমি করলেন। চারদিক কেমন দুলছে। শরীরটাকে অসম্ভব হালকা মনে হচ্ছে। তিনি মৃদু স্বরে ডাকলেন ও লতিফা, লতিফা। মুনা এসে তাঁর পিঠে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলি।
মুখ ধোয়ার পানি দে রে মা।
মুনা পানি নিয়ে এসে দেখল তিনি বিড়বিড় করে নিজের মনে কি সব কথা বলছেন।
মামা কী বলছ?
কিছু বলছি না। পরিষ্কার দেখলাম বুঝলি। মনটা একটু ইয়ে হয়ে আছে।
ইয়ে হয়ে থাকলে তো খারাপ। মনটাকে ঠিক কর। আমার মনে হয় বকুলের কাছ থেকে ঘুরে এলে তোমার সব ঝামেলা মিটে যাবে।
তুই যাবি আমার সঙ্গে?
পাগল হয়েছ? মামলা-মোকদ্দমা ফেলে আমি যাব কোথায়? ঘুম থেকে উঠেই আমাকে যেতে হবে উকিলের কাছে।
শওকত সাহেব শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেললেন।
উকিল সাহেব আজ উদ্ভূত একটা পোশাক পরে এসেছেন। জিনিসটা পাঞ্জাবির মত। কিন্তু শার্টের কলারের মত কলার আছে। ভদ্রলোককে দেখাচ্ছে সার্কাসের ক্লাউনের মতো! মুনাকে দেখেই তিনি বললেন–হবে না।
মুনা বলল, কী হবে না?
এফআইআর দেখলাম। এই মামলায় লাভ নেই।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
কথা তো বাংলাতেই বলছি, বোঝেন না কেন? পুলিশের সাজানো মামলা। কনভিকসন হয়ে যাবে। উকিল-মোক্তার কিছু করতে পাববে না।
মুনা তাকিয়ে রইল। উকিল সাহেব মুখখানা অনেকখানি সরু করে টেনে বললেন, ধরন-ধারণ দেখে মনে হয়। পলিটিক্যাল কেইস। কাউকে দীর্ঘ সময়ের জন্যে আড়ালে সারিয়ে রাখতে হলে এইসব মামলা করা হয়। পুলিশ যদি নিজেরাই কিছু অস্ত্রশস্ত্র জমা দিয়ে বলে এইসব পাওযা গেছে তাহলে কি করার আছে বলুন। এটা কোর্টে প্রমাণ করা মুশকিল যে, অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যায়নি। তাছাড়া আমার ধারণা এই ছেলেটির আগের রেকর্ডও ভাল না। ঠিক না?
জি ঠিক।
আপনার যা করা উচিত তা হচ্ছে বড় কোন নেতা-ফেতার কাছে যাওয়া। আছে তেমন কেউ?
জি না।
খুঁজে বের করুন। বাংলাদেশ ছোট জায়গা। খুঁজলেই কাউকে পাবেন যার আপনি দুলাভাই কিংবা ভায়রা ভাই হচ্ছেন কোনো তালেবর ব্যক্তি। তার মাধ্যমে কাজ করুন। আইন? আইনের হাত বেঁধে ফেলা হচ্ছে। অন্তত চেষ্টা চলছে। বুঝবেন। নিজেই বুঝবেন। হা হা হা! উঠলেন নাকি?
জি উঠছি।
মামলাটা আমি নিচ্ছি না।–কিছু মনে করবেন না। প্রথম দিন যে টাকা দিয়েছিলেন সেটি ফেরত দেয়া উচিত কিন্তু দিচ্ছি না। কারণ আমি কিছু উপদেশ দিয়েছি। প্রফেশনাল এডভাইস। ওর একটা চার্জ আছে। আচ্ছা বিদায়।
বাকেরের চেহারায় আজ বিরাট পরিবর্তন। মাথার চুল কামিয়ে ফেলেছে। চকচক করছে মাথা। বাকের হাসিমুখে বলল, উকুনের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে এই কাণ্ড করেছি। খবু খারাপ লাগছে?
মুনা কিছু বলল না। এই জায়গায় ভাল লাগা খারাপ লাগার কোনো ব্যাপার নেই।
শোন মুনা, সুন্দর দেখে একটা ছেলের নাম দাও তো।
কেন?
ইয়াদ এসেছিল। ওর একটা ছেলে হয়েছে। আমার কাছে নাম চায়।
মুনা বিরক্ত হয়ে বলল প্রথম ছেলে হলে ছেলের বাবার সঙ্গে যার দেখা হয় তার কাছেই নাম চায়। ওটা কোন ব্যাপার না। আপনার কি ধারণা। আপনি নাম দিলেই উনি সেই নাম রাখবেন?
বাকের চুপ করে গেল।
আজ যাই।
এখনই যাবে?
থেকে করবটা কী?
তাও তো ঠিক। আচ্ছা মুনা ঐ মেয়েগুলি আছে কেমন?
কোন মেয়েগুলি?
ঐ যে তিনটা মেয়ে?
কি আশ্চর্য। আমার কি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে নাকি যে বলব কেমন আছে।
তাও তো ঠিক।
আপনার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। উনি চেষ্টা-চরিত্র করবেন। ধৈর্য ধরে থাকুন।
বাকের কিছু বলল না। নিজের চুলশূন্য মাথায় হাত বুলাতে লাগল।
টাকা-পয়সা কিছু লাগবে?
না। মুনা চলে আসবার সময় বাকের বলল, চুলগুলি ফেলে দেওয়ায় একটা অসুবিধা হয়েছে।
আগে একটা টাকা দিলেই মাথা বানিয়ে দিত। খুবই আরামের ব্যাপার। এখন চুল না থাকায় কোনো আরাম পাই না।
চলবে..