কোথাও কেউ নেই ~ হুমায়ূন আহমেদ ৬.

কোথাও কেউ নেই
~ হুমায়ূন আহমেদ

৬.
মামুন বলল কি কেমন দেখছ? বাসা পছন্দ হয়? মুনা এতটা আশা করেনি। সে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল, খুবই সুন্দর। তুমি মোটামুটি বলেছিলে কেন? মামুন হাসতে শুরু করল।
এস পেছনের বারান্দাটা দেখি।
পেছনেও বারান্দা আছে নাকি?
থাকবে না। মানে। এখন বল বাসা কেমন?
চমৎকার! সত্যি চমৎকার।
একটু দূর হয়ে গেল। তাই না?
হোক দূর।
বসবার কোনো ব্যবস্থাই নেই। মামুন পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসল–জিনিসপত্র কিনে ঘরদুয়ার গোছাও এখন। চল আজ ফেরার পথে বড় দেখে একটা খাট কিনে ফেলি।
তোমার মাথায় শুধু খাট ঘুরছে।
তা ঘুরছে। ফোমের একটা গদি কিনিব বুঝলে মুনা। সাড়ে নশ টাকা দাম।
বাজে খরচ করার পয়সা আমাদের নেই।
ঐটা আমি কিনবাই, তুমি যাই বল না কেন। দাঁড়িয়ে আছ কেন বাস।
মামুন হাত ধরে মুনাকে টেনে পাশে বসোল। কেমন নির্জন চারদিক। একটু যেন গা ছমছম করে। মুনা ক্ষীণ স্বরে বলল হাত সরাও প্লিজ।
এ রকম করছ কেন তুমি? আমার ওপর বিশ্বাস নেই তোমার?
মুনা জবাব দিল না। মামুন তাকে কাছে টানল। গাঢ় স্বরে বলল এমন শক্ত হয়ে আছ কেন? কেউ তো দেখছে না।
চল আজ যাই, সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
হোক সন্ধ্যা, তুমি বস তো।
তুমি এ রকম কর, বসতে ভাল লাগে না।
কিচ্ছু করব না তুমি সহজ হয়ে বস।
ওয়ার্ড অব অনার?
হ্যাঁ, ওয়ার্ড অব অনার। শুধু আমার হাত থাকবে তোমার হাতে। নাকি তাতেও আপত্তি?
না তাতে আপত্তি নেই।
মামুন গাঢ় স্বরে বলল চল তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে ফেলি। আর ভাল্লাগছে না। আগে যে রকম কথা ছিল সে রকমই করি। কাজীর অফিসে গিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে দি।
মামা রাজি হবে না। ছোট করে হলেও একটা অনুষ্ঠান করতে হবে। মুনার কথা শেষ হবার আগেই মামুন তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। মুনা কোন বাধা দিল না। তা্রা সন্ধ্যা না মিলানো পর্যন্ত থাকল সেখানে।
রহস্যময় কিছু সময় কাটল তাদের।
মুনা রোজ ভাবে সকাল সকাল ঘুমুতে যাবে কিন্তু রোজই দেরি হয়। আজও দেরি হল। বারোটার সময় বাতি নেভাতে যেতেই বকুল বলল, একটু পরে আপা। আমার পাঁচ পৃষ্ঠা বাকি আছে। মুনা বিরক্ত স্বরে বলল–মশারির ভেতরে বসে গল্পের বই পড়িস। কেন? চোখ নষ্ট হবে। আর প্রতিদিন একটা করে বই জোগাড় করিস কোথেকে?
ফজলু ভাই এনে দেয়।
আমি বারান্দায় বসছি। বই শেষ হলে ডেকে দিস।
আজ গরম নেই। আশ্বিনের শেষাশেষি। শেষ রাতের দিকে ভাল ঠাণ্ডা পড়ে। মুনা ক্যাম্পখাটে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। পাঁচ পৃষ্ঠা বাকি কথাটা মিথ্যা। অনেকখানিই বাকি। মুনাকে ডাকতে কেউ আসে না।
শওকত সাহেবকে বারান্দার দিকে আসতে দেখা গেল। তিনি মুনাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, অন্ধকারে বসে আছিস কেন? সাড়ে বারোটা বাজে।
এমনি বসে আছি। তুমি নিজেও তো অন্ধকারে হাঁটাহাঁটি করছ। কিছু খুঁজছি নাকি?
দড়ি আছে?
দড়ি দিয়ে কি করবে?
মশারি খাটাব।
মশারি তো খাটানোই আছে। আবার নতুন করে খাটাবে কি?
শওকত সাহেব থেমে থেমে বললেন বসার ঘরে বিছানা করেছি। আজ থেকে আলাদা শোব।
কেন?
প্রত্যেক দিন রুগীর সাথে শুয়ে শুয়ে শরীরটাই আমার খারাপ হয়ে গেছে।
শওকত সাহেব বিরক্তির ভঙ্গি করে বসার ঘরের দিকে গেলেন। সেখানে সত্যি সত্যি একটা বিছানা করা হয়েছে। নোংরা একটা মশারি খাটানোর চেষ্টাও হচ্ছে। মশারির তিন কোণ শিথিলভাবে ঝুলছে। দড়ির অভাবে চার নম্বর কোণাটির গতি হচ্ছে না। মুনা বলল দুপুর রাতে দড়ি পাওয়া যাবে না। তুমি একটা কয়েল জ্বালিয়ে শুয়ে থাক।
কয়েল আছে?
আছে, এনে দিচ্ছি। আচ্ছা মামা, সত্যি করে বল তো তোমার কি হয়েছে?
কি আবার হবে? রুগীর সাথে ঘুমাতে চাই না। এর মধ্যে হওয়া-হওযির কি আছে?
এই কথা না। তুমি নাকি প্রতিদিন দুপুরে অফিস-টফিস বাদ দিয়ে ঘরে এসে বসে থাক?
কে বলেছে, লতিফা?
হ্যাঁ। ব্যাপার কি?
ব্যাপার কিছু না। অফিসে একটা ঝামেলা যাচ্ছে।
ঝামেলা গেলে তো সেখানেই বেশিক্ষণ থাকা উচি৩। কি ঝামেলা বল?
শওকত সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, ভ্যাজব ভ্যাজব করিস না। কয়েল জুলিখে দি যে যা। আর দেখা হাতপাখা পাওয়া যায় কি না। বিশ্ৰী গরম।
গরম কোথায়? বেশ তো ঠাণ্ডা।
শওকত সাহেব গুম হয়ে বসে রইল। এখন তিনি আর কথা-টথা বলবেন না। মুনা কযেল। আনতে গেল। মামির ঘবের ড্রয়ারে এক প্যাকেট কযেল আছে।
লতিফা জেগে ছিলেন। মুনা ড্রয়ার খুলতেই তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, তোর মামা আলাদা ঘুমাচ্ছে কেন রে?
এই ঘরে গরম লাগে। বাতাস-টাতাস নেই।
ফ্যান আছে তো।
ফ্যানের বাতাসে তার ঘুম হয় না। একেক জনের একেক স্বভাব।
লতিফা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, এতদিন তো ঘুম হয়েছে। আজ হবে না কেন? বলতে বলতেই তার গলা ভারী হয়ে এল। মুনা এসে বসল বিছানার পাশে। লতিফা বললেন, এক সময় তোেব মামা আমাকে বিয়ে করার জন্যে কত কাণ্ড করেছে।
এই গল্প মুনার জানা। মামির কাছ থেকে অসংখ্যাবার শুনেছে। আজ রাতে আরেকবার হয়ত শুনতে হবে।
মুনা, কি সব পাগলামি কাণ্ড যে সে করেছে। একবার শুনলাম সে বিষ খাবে। এক বোতল র্যাটম না কি যেন জোগাড় করেছে। আমি ভয়ে বাঁচি না। কি কেলেঙ্কারি। কাণ্ড! বাড়িতে সবাই দোয্য দিচ্ছে আমাকে। আমি কি জানি বল? আমার সঙ্গে কোনোদিন তার একটা কথাও হয়নি।
বলতে বলতে শাড়ির আঁচলে লতিফ চোখ মুছলেন। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে মুনা বলল, বকুলের হবু শাশুড়ী নাকি লম্বায় দেড় ফুট? বিয়ের ডেট-ফেট ফেলে দিয়েছ নাকি মামি?
না ডেট হয়নি। বিয়ে নিয়ে কোনো কথাবার্তাই হয়নি।
দুই বেয়ানে কি নিয়ে গল্প করলে?
লতিফা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। সম্ভবত মনে করতে চেষ্টা করছেন। কিছুই মনে করতে পারলেন না। মুনা বলল, শুয়ে থাক মামি। বাতি নিভিয় দেই। লতিফা চাপা স্বরে বললেন, আমি বেশিদিন বাঁচব না রে।
বুঝলে কিভাবে?
কয়েক’দিন আগে স্বপ্নে দেখলাম আমি আর তোর মা দুজনে ভাত খাচ্ছি। স্বপ্নে মরা মানুষদের সঙ্গে খেতে বসা খুব খারাপ। যে দেখে সে আর বাঁচে না।
কি দিয়ে ভাত খাচ্ছিলে?
লতিফা জবাব দিলেন না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। মুনা বাতি নিভিয়ে বের হয়ে এল। বকুলের পাঁচ পৃষ্ঠা এখনো শেষ হয়নি। মুনা কোনো কথা না বলে বাতি নিভিয়ে দিল। বকুল বলল, আর একটা পাতা। আপা, প্লিজ।
কোনো কথা না, ঘুমো।
এই পাতাটা শেষ না করলে আমার ঘুম আসবে না।
ঘুম না এলে জেগে থাক। কথা বলিস না। কি বই এটা?
উপন্যাস।
কার লেখা?
সতীনাথ ভাদুড়ির অচিন রাগিনী। ফজলু ভাই এনে দিয়েছে লাইব্রেরি থেকে।
ভাল নাকি খুব?
মোটামুটি।
মোটামুটি? তুই যেভাবে পড়ছিস তাতে তো মনে হয় রসগোল্লা ধরনের উপন্যাস।
বকুল খিলখিল করে হেসে উঠে জড়িয়ে ধরল। মুনাকে। মুনা বিরক্ত স্বরে বলল, হাত উঠিয়ে নে। গরম লাগছে। বকুল হাত সরাল না। আরো কাছে ঘেঁষে এসে বলল, তুমি এত ভাল কেন মুনা আপা?
জানি না কেন। বিরক্ত করিস না।
ধাকুল মৃদু স্বরে বলল, একটা গল্প বল না আপা।
কি মুশকিল, রাত দেড়টার সময় গল্প কিসের?
একটা বল আপা। তোমার পায়ে পড়ি? ভূতের গল্প। সত্যি সত্যি তোমার পায়ে ধরছি কিন্তু।
আহ কেন সুড়সুড়ি দিচ্ছিস?
আপা প্লিজ, প্লিজ।
মুনাকে গল্প শুরু করতে হল। ওপাশের বিছানা থেকে বাবু ক্ষীণ স্বরে বলল, একটু জোরে বল আপা, আমিও শুনছি। মুনা অবাক হয়ে বলল, এখনো জেগে আছিস?
ই। ঘুম আসছে না, কি করব?
বাবু অস্পষ্ট ভাবে কি যেন বলল। পরিষ্কার বোঝা গেল না। মুনা উঁচু গলায় বলল–কি বলছিস ভাল করে বল। বোবা ধরেছিল?
হ্যাঁ।
কাল সকালে মনে করিাস তোকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
ঠিক আছে।
গল্প শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেল। বকুল বলল, বাথরুমে যেতে হবে তুমি একটু দাঁড়াও। বাবুর ও বাথরুম পেয়ে গেল। বাবু বলল, আজ না ঘুমিয়ে সারারাত গল্প করলে কেমন হয় আপা? মুনা বিরক্ত স্বরে বলল, ফাজলামি করিস না, বাথরুম শেষ করে ঘুমুতে যা। আর একটি কথাও না।
তারা তিনজন দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েই দেখল। শওকত সাহেব উবু হয়ে বারান্দায় বসে আছেন। অন্ধকার বারান্দা। তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট শুধু উঠানামা করছে। মুনা ডাকল মামা! তিনি ফিরে তাকালেন। কোনো উত্তর দিলেন না।
একা একা কি করছ মামা?
কিছু করছি না।
শওকত সাহেব নিঃশব্দে ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। বকুল চাপা স্বরে বলল, বাবার কি হয়েছে মুনা আপা? মুনা বলল, কিছুই হয়নি। ঘুম আসছে না। তাই বসে ছিল বারান্দায়। কেন জানি বকুলের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বাবার বসে থাকার ভঙ্গিটা কেমন দুঃখী দুঃখী। তার মনে হল বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছিল। মানুষের কত রকম গোপন দুঃখ থাকে। তার নিজেরও আছে। প্রায়ই সে এ রকম একা একা কাঁদে। তার মত দুঃখ তো বাবা-মাদেরও থাকতে পারে। ভাবতে ভাবতে বকুলের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। অল্পতেই তার কান্না পায়।

সকাল ন’টার মত বাজে।
বাকের জলিল মিয়ার চায়ের দোকানের সামনে বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। কড়া রোদ বাইরে। বাকেরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। জলিল মিয়া ডাকল–বাকের ভাই, আসেন চা খান। বাকের জবাব দিল না। সব কথার জবাব দেয়া ঠিক না। এতে মানুষের কাছে পাতলা হয়ে যেতে হয়। সে এগিয়ে গিয়ে পান-বিড়ির দোকানটার সামনে দাঁড়াল। বেশ কয়েকজন কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, দোকানদার সবাইকে বাদ দিয়ে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, কি দিব বাকের ভাই?
সিগ্রেট দে।
ফাইভ ফাইভ?
বাকের এমন ভাবে তাকাল যেন সে দারুণ বিরক্ত হয়েছে। তাকে ক্ষমা করে দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, অন্য কোনো সিগ্রেট খাই? দোকানদার জিবে কামড় দিয়ে একটা সিগ্রেট বের করল। বাকের গম্ভীর গলায় বলল, এক প্যাকেট দে। সে একটা চকচকে একশ টাকার নোট ছুড়ে ফেলল।
আজ তার মন নানান কারণে খারাপ হয়ে আছে। গত রাতে খবর পাওয়া গেছে। ইয়াদ চাকরি পেয়েছে। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা ইয়াদের সঙ্গে ওঠাবসা অথচ এই খবরটা ইয়াদ তাকে দেয়নি। অন্যের কাছে জানতে হল। খবরটা যাচাই করবার জনে সে সাত সকালে গিয়েছিল। ইয়াদের বাড়ি। ইয়াদ হাই তুলে বলল, আর কতদিন এমনি এমনি ঘুরব? আর চাকরিটাও খারাপ না। ঘোরাঘুরি আছে। টি এ ডি এ পাওয়া যায়।
কবে থেকে চাকরি?
সামনের মাসের এক তারিখ থেকে। দেরি আছে। চল যাই চা খেয়ে আসি। নাশতা করেছিস?
চা খেতে খেতেই বাকের একবার বলল, আমবা চারজন মিলে যে স্পেয়ার পার্টস-এর দোকান দেব বলেছিলাম তার কি?
আরে দূর এইসব কি আর হয় নাকি? দুইজন তো ভোগেই গেল, বিয়ে-শাদী করে একেবারে গেরস্ত।
তুই আর আমি দুইজনে মিলে করতে পারতাম।
পয়সা কই?
ইয়াদ খানিকক্ষণ পরই গলা নিচু করে বলতে লাগল, বড় ভাই এদিকে আবার ফ্যাচাং বঁধিয়ে ফেলেছে। আই.এ. পাস এক মেয়ের সাথে সম্বন্ধ করে ফেলেছে। মেয়ে কালো কিন্তু সুইট দেখতে। একটু অবশ্যি রোগা।
বাকের একটি কথাও বলল না। গম্ভীর হয়ে রইল। ইয়াদ নিজের মনেই কথা বলে যেতে লাগল–আমি নিজে তো মেট্রিকটা পাস করতে পারলাম না। এদিকে বউ হল গিয়ে এই–এ। শালা কেলেঙ্কারি অবস্থা। এখন বউ যদি বি.এ. পড়তে চায় তাহলে গেছি। বড় ঝঞ্ঝাটের মধ্যে পড়ে গেলাম। ইয়াদের মুখ দেখে মনে হল না ঝঞাটের জন্যে সে বিরক্ত। বরং মনে হল সে সমস্ত ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে।
বাকের চা শেষ না করেই উঠে এল। এটা ঠিক যে পাড়ার সবাই তাকে খাতির করে। কিন্তু দল ভেঙে যাচ্ছে। এ সব লাইনে দল ভেঙে গেলে খাতির থাকে না। দেখতে দেখতে চ্যাংড়ারা উঠে আসবে। গত সপ্তাহেই তার চোখের সামনে মজনু সিগারেট টানতে টানতে রিকশায় উঠল। একটা চড় দিলে দুটো চড়ের জায়গা নেই যার তার এত বড় সাহস।
বাকের জলিল মিয়ার চায়ের স্টলে ঢুকল। জলিল মিয়া নিজেই গলা উঁচিয়ে ডাকল গফফর, গরম পানি দিয়া ভাল কইরা বাকের ভাইরে চা দে। কাপ ধুইয়া দিস। বাকের বসে রইল। উদাস ভঙ্গিতে। এখানে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া এখন আর কোনো কাজ নেই। স্কুলের সময় হয়ে গেছে, পাড়ার মেয়েরা স্কুলে রওনা হয়েছে দল বেঁধে। দেখতে এত ভাল লাগে। বাকের লক্ষ্য করতে লাগল কোনো ছোকরা শিসটিস দেয়। কিনা। টেনে জিব ছিঁড়ে ফেলবে সে। তার পাড়ায় মেয়েছেলের অসম্মান হতে দেবে না।
মুনা ঘর থেকে বেরুল দশটার দিকে। অফিস পৌঁছতে পৌঁছতে নিশ্চয়ই এগারোটা বেজে যাবে। রোজ দেরি হয়। কালও সে ঘর থেকে বের হয়েছে এগারোটায়। বাকের চায়ের সন্টল ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল।
এই যে মুনা অফিসে যাচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ। সকালবেলা আর কোথায় যাব?
মামাকে বলবে কাজের মেয়ে একটা জোগাড় করেছি।
ঠিক আছে বলব।
বাকের সঙ্গে সঙ্গে আসতে শুরু করল। মুনা কিছু বলল না। বাকের হালকা স্বরে বলল, তোমাদের অফিসে যাব এক’দিন। মেয়েছেলেরা কাজ করছে দেখলে ভাল লাগে।
আপনারী কিছু করবেন না, গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াবেন। মেয়েরাও যদি তাই করে তাহলে হবে কিভাবে?
তোমাদের জন্যেই তো কিছু করতে পারি না। মেয়েরা সব কাজকর্ম নিয়ে নেয়। বাংলাদেশ একেবারে নারীমহল হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন অন্দরে ঢুকে রান্নাবান্না করব। হা হা হা।
বাকের রাস্তা কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। নিজের কথা তার নিজেরই খুব মনে ধরেছে। সে বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত গেল। এ সময় রিকশা পাওয়া মুশকিল, কিন্তু সে ছুটোছুটি করে রিকশা নিয়ে এল। রিকশাওয়ালাকে গম্ভীর গলায় বলল, আপামণিকে তুরন্ত নিয়ে যাবি। মুনার ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু-একটা বলা উচিত। কিন্তু সে কিছু বলল না। বাকের বলল মুনা, ভাড়া দিতে হবে না।
কেন? দিতে হবে না কেন?
দিয়ে দিয়েছি।
বাকের উদাস ভঙ্গিতে সিগারেট ধরাল। তার এখন কিছু করার নেই। মোটর পার্টস-এর দোকানে আগে এই সময়টায় আড্ডা দিতে বসন্ত সে আড্ডাটা এখন আর নেই। লোকজন আসে। না। একা একা কতক্ষণ বসে থাকা যায়? সে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগল। কোনো কিছুই তাকে আকর্ষণ করছে না। রাস্তার পাশে রিকশাওয়ালার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে প্যাসেঞ্জারের ঝগড়া বেঁধে গেছে। অন্য সময় হলে প্যাসেঞ্জারের পক্ষ নিয়ে রিকশাওয়ালার গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিত। আজ সে ইচ্ছাও হল না। মুনার সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখার হবার পর তার এ রকম হয়। বেশি কিছু সময় কিছুই ভাল লাগে না।
বাকের গ্রিন ফার্মেসিতে উঁকি দিল। ডাক্তার ছেলেটি এখনো আসেনি। সে এলে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ বসা যেত। বাকের গম্ভীর গলায় বলল ডাক্তার কখন আসবে?
দুপুরের পরে।
দেখি টেলিফোনটা দেখি।
ফার্মেসির নীল শার্ট পরা লোক বিরক্ত স্বরে বলল–ফোন তালা দেয়া। চাবি নেই। এই লোকটি নতুন এসেছে, তাকে বোধ হয় ঠিক চেনে না। বাকের ঠাণ্ডা গলায় বলল, চাবি না থাকলে তালা ভাঙার ব্যবস্থা কর। লোকটি তাকিয়ে আছে সরু চোখে। বাকের থমথমে গলায় বলল, ফাজলামি কথাবার্তা আমার সাথে বলবে না। চড় দিয়ে চাপার দাঁত ফেলে দেব। টেলিফোন তালা দেওয়া! তোমার বাবার টেলিফোন?
লোকটি টেলিফোন বের করল। সত্যি বোধ হয় চাবি নেই। সেফটিপিন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তালা খুলল।
কাকে ফোন করা যায়? মুনাকে করলে কেমন হয়? মাঝে মাঝে সে মুনার সঙ্গে কথা বলে। মুনা ভীষণ বিরক্ত হয়। তবু করে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে টেলিফোনটি বড় সাহেবের ঘরে। মুনাকে ডেকে আনতে হয়। আজও তাই হল। বড় সাহেব তাকে লাইনে থাকতে মুনাকে আনতে খবর পাঠালেন।
হ্যালো, আমি বাকের।
কি ব্যাপার?
রিকশা ভাড়া দাওনি তো? আমি অলরেডি দিয়ে দিয়েছিলাম।
সে তো আপনি আমাকে বলেছিলেন। আবার টেলিফোন কেন? তোমার কাছ থেকে আবার সেকেন্ড টাইম ভাড়া নিল কি না সেটা জানার জন্যে। রিকশাওয়ালারা या হাब्राभि श्श। হা হা হা।
আর কিছু বলবেন?
না। তোমাদের বিয়ের ডেট হয়েছে নাকি?
না। এখনো হয়নি।
হ্যালো মুনা, আমার কানেকশন আছে, আমি হাফ প্রাইসে একটা কমু্যনিটি সেন্টার ভাড়া করে দেব। জাস্ট দশ দিন আগে আমাকে বলতে হবে।
ঠিক আছে বলব। এখন টেলিফোন রাখি?
হ্যালো শোন–তোমাদের ঐ ফ্যানটার কিছু করা গেল না। অসুবিধা নেই, যেটা আছে সেটা ইউজ কর। নো প্রবলেম।
ঠিক আছে, এখন রাখছি। আমার কাজ আছে।
মুনা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। বাকের অলস ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, একটা খুব ঠাণ্ডা দেখে পেপসি নিয়ে আস তো। বলবে, বাকের ভাই চায়।
নীল শার্ট পরা লোকটি পেপসি আনতে গেল! বাকের রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
শওকত সাহেব অফিসে এলেন লাঞ্চের পর। সবাই তখনো লাঞ্চ সেরে ফেরেনি–অফিস ফাঁকা ফাঁকা। শওকত সাহেবের মনে হল সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছে। ডিসপ্যান সেকশনের মল্লিক বাবু তাকে দেখেই যেন হঠাৎ করে ফাইলপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শওকত সাহেব বললেন, ভাল আছেন মল্লিক। বাবু? মল্লিক। বাবু অতিরিক্ত ব্যস্ততার সঙ্গে বললেন, জি ভাল। আপনি ভাল তো?
বড় সাহেব আছেন?
আছেন, অফিসেই আছেন। যান না, দেখা করুন গিয়ে।
শওকত সাহেব বড় সাহেবের কাছে গেলেন না। যাবার সাহস সঞ্চয় করতে তার কিছু সময় লাগবে। ছোকড়া মত একটি ছেলেকে দেখা যাচ্ছে ক্যাশ সেকশনে। নতুন অ্যাপয়েন্টেমেন্ট হয়েছে নাকি? মল্লিক। বাবু বললেন, চা খাবেন?
জি না।
ক্যাশ সেকশনের নতুন ছেলেটি আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। তার খবর শুনেছে বোধ হয়।
জসিম সাহেব ঢুকলেন। খুব ফুর্তিবাজ লোক। রসিকতা না করে এক সেকেন্ডও থাকতে পারেন। না। শওকত সাহেবকে দেখে তিনিও কেমন জানি হকচাকিয়ে গেলেন। শুকনো হাসি হেসে বললেন, কি ভাল?
জি ভালই।
দেখা হয়েছে বড় সাহেবের সঙ্গে?
জি না। দেখা করতে বলেছেন?
না কিছু বলেননি। তবে আমার মনে হয় দেখা করা উচিত। ইনকোয়ারি কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে।
শওকত সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, কি রিপোর্ট?
জসিম সাহেব উত্তর না দিয়ে ড্রয়ার খুলে কি নিয়ে যেন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
বড় সাহেবের কাছে কি এখনই যাব?
যান। এখুনি যান। দি আরলিয়ার দি বেটার।
শওকত সাহেব ভীত স্বরে বললেন, কিছু শুনেছেন রিপোর্ট সম্বন্ধে?
জি না ভাই। কিছু শুনিনি।
তিনি কথাটা মাটির দিকে তাকিয়ে বললেন। তার মানে এটা মিথ্যা। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ মিথ্যা বলতে পারে না। মিথ্যা বলতে হয় অন্যদিকে তাকিয়ে।
বড় সাহেব মানুষটি ছোটখাটো। হাশিখুশি ধরনের। সহজে রাগ করেন না। কড়া ধরনের কথা বলতে পারেন না। কিন্তু তিনিও গভীর। শওকত সাহেবকে দেখে মুখ অন্ধকার করে বললেন, ইনকোয়ারি কমিটির রিপোর্ট ভাল না। শুনেছেন বোধ হয়?
শওকত সাহেব মূর্তির মত বসে রইলেন।
ইনকোয়ারি কমিটির সুপারিশ হচ্ছে, যে টাকার গরমিল দেখা যাচ্ছে সেটা আপনি দশ দিনের ভেতর যদি ফেরত দেন তাহলে আপনার বিরুদ্ধে কোনো পুলিশ অ্যাকশন নেয়া হবে না। আর তা না হলে কেইস পুলিশ হ্যান্ডওভার করা হবে, বুঝতেই পারছেন একটা কেলেংকারি ব্যাপার হবে। আপনি টাকাটা ফেরত দিয়ে দেন।
টাকা আমি কোথায় পাব স্যার?
বড় সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন।
আমি স্যার কিছুই জানি না।
এটা তো শওকত সাহেব ঠিক বললেন না। আপনি না জানা মতে এটা হওয়া সম্ভব না। কাজটা করেছেন কাঁচা। আমি নিজেও ইনকোয়ারি কমিটির একজন মেম্বার এটা ভুলে যাচ্ছেন কেন? থানা-পুলিশ হলে একটা বেইজ্জতী ব্যাপার হবে, তার হাত থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করুন। শুধু শুধু এখানে বসে থেকে সময় নষ্ট করবেন না। হেড ক্লার্কের কাছে ইনকোয়ারি কমিটির রিপোর্টের কপি আছে। সেটা নিয়ে যান। ভাল করে পড়ুন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here