কায়নাত,পর্বঃ৭
লেখিকাঃ টিউলিপ রহমান
সে আর অন্য কেও নয় স্বয়ং ইবাদত। কিন্তু ও এভাবে আমার মুখ চেপে ধরেছে কেনো? এই প্রথম ওর স্পর্শ আমি আমার ঠোঁটে অনুভব করলাম। হিম শীতল ঠান্ডা ওর হাত। ভালোই লাগছিল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে ক্ষোভটাও কাজ করছিল। তাই না চাওয়া স্বত্ত্বেও এক ঝটকায় ওর হাত সরিয়ে বললাম
— এভাবে আমাকে নির্জনে টেনে এনেছেন কেনো? আপনার মতলব কি? বলুনতো আমার সাথে কি করতে চান?
ও শুধু এটুকুই বলল
–কিছু না।তোমাকে আমি কিছুই করতে চাই না।
— তাহলে এখানে আমাকে এনেছেন কেনো?( আমি)
–তোমার অনেক বিপদ। এক্ষুনি যদি সাবধান না হও তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
— তাই না! তা কি বিপদ? শুনি কি এমন সর্বনাশ হবে?
–এই যেমন ধরো তোমাকে কেও মেরে ফেলতে পারে বা তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারে বা তোমার সাথে অন্য কিছুও করতে পারে। (ইবাদত)
— অন্য কিছু করতে পারে মানে কি?
–আছে, তুমি নিজে নিজে বুঝে নাও, বড় তো আর কম হওনি।
— তা হঠাৎ আমার এত ভালো চাচ্ছেন কেনো? যান না! ওসব মেয়েদের গায়ে গিয়ে ঢলে পড়েন, যেমনটি তারা পছন্দ করে!!আমাকে বাঁচাতে কেনো এসেছেন?
— ওহ! তোমাকে আমি কি করে বোঝাবো? দেখো কায়নাত তোমার জীবন নাশের সম্ভাবনা আছে। এই কথাটা বলার জন্যই আমি এখানে এসেছি।
— হুম, আপনি বললেন আর আমি বিশ্বাস করবো। এখন তো আমার আপনাকেই সন্ধেহ হচ্ছে। আপনিই না জানি কি করেন বসেন আমার সাথে!
তখনই মনে হলো কেও এদিকেই আসছে। যেই আমি কিছু বলতে যাবো আর ওমনি সে এসে আবার আমার মুখ চেপে ধরলো। তারপর বলল
–ধীরে কথা বলো।ধীরে!
আমরা কিছুক্ষণ এইভাবেই নিরবতা পালন করলাম। একজন আরেক জনের চোখের দিকে চেয়ে রইলাম । তার সেই ভুবন ভোলানো চেহারা দেখে আমার অন্তরে কেমন একটা ঝড় বয়ে গেল । খুব অবাক লাগে একটা ছেলে এত সুন্দর হয় কি করে!! বেশ কিছুক্ষণ আমরা এই ভাবেই ছিলাম। এক পর্যায়ে সে আমার একেবারে সামনে এসে দাড়ালো। এখন আমি খুব নিকটে তার শ্বাস প্রশ্বাস অনুভব করতে পারছি। সে আমার দিকে আরো এগিয়ে আসলো। এত সামনে থেকে তাকে দেখে আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম।সে আমার আরো কাছে আসতে চাইলো কিন্তু আমার মনের ভিতর যেনো কেমন করছিল। কোনো ছেলেকে এই প্রথম আমার এত কাছে আসতে অনুমতি দিয়েছি। তার ঠোঁট আমার ঠোঁট কে যেই স্পর্শ করতে যাবে ঠিক তখনই তাকে আমি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসলাম। সে ও হয়তো আমার পিছন পিছন আসছিল। আমি ডানবাম না দেখে দৌড়ে নীলা আপুর বাসায় চলে আসলাম। খুব হাপাচ্ছি। এক তলায় আপুর বাসা। বাসায় একজন মহিলা ছিল। আমি তাকে আগে কখনো দেখিনি।
.
আমাকে বলল
— কে তুমি?
–জী আমি এই কলোনিতেই থাকি। আমর নাম কায়নাত।
— এই মেয়ে এত হাপাচ্ছ কেনো? দুর থেকে এসেছো?
আমি একটু চমকে গেলাম, সঙ্গে একটু লজ্জাও পেলাম।মনে মনে ভাবলাম যদি সেখান থেকে পালিয়ে না আসতাম তাহলে না জানি আজ কোন অঘটন ঘটে যেতো।আমি তাকে বললাম
–জী মাঠ থেকে এসেছি, নীলা আপু পাঠিয়েছে, দৌড়ে এসেছি তাই হাপাচ্ছি।
— ও, কিছু লাগবে??
–জী, লিপস্টিক নিতে বলেছে।
–আচ্ছা, ঐ দিকের রুমে আছে, যেয়ে নিয়ে আসো।
আমি সোজা হেঁটে আপুর রুমে চলে গেলাম। ড্রেসিং টেবিলের উপর খুজলাম পেলাম না। পাশে একটি টেবিলের উপর রাখা ছিল। ওটা হাতে নিতেই পাশের স্টিলের আলমারি টা কেমন নড়ে উঠলো। একটু ভয় পেলাম। ভাবলাম ভুমিকম্প হচ্ছে। অন্যদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম আসলেই কি ভুমিকম্প হচ্ছে কি না! ফ্যান, পানির বোতল সব স্বাভাবিক ই আছে। তাহলে শুধু আলমারিই কেনো একা নড়বে?? আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ঠিক তখন আলমারিটা নড়তে নড়তে আমার গায়ের উপর পড়তে যাচ্ছিল আর পাশ থেকে একটা হাত এসে আলমারিটা ধরে ফেলল। খুব অবাক হলাম সঙ্গে ভয়ও পেলাম।
— পাশে সরে দাড়াও প্লিজ!
আমি তাড়াতাড়ি পিছনে সরে আসলাম এবং হা করে তাকিয়ে ছিলাম। উনি আলমারিটাকে ধরে সোজা দাড় করিয়ে রাখলেন।তারপর আবার বলল
— কিছুক্ষণ আগে তোমাকে না বললাম তোমার অনেক বিপদ? তাহলে কেনো এখানে একা এলে?
–কিন্তু তুমি? তুমি এখানে কি করে এলে? তোমাকে তো আমি পিছনে দেখলাম না!
— আমি জানতাম কিছু একটা হবে তাই তোমার পিছন পিছন এলাম এবং আমার সন্দেহই সঠিক।
–পিছন পিছন এলেন আমি দেখলাম না কেনো? কি আশ্চর্য!
পিছন থেকে ঐ বাসার ভদ্র মহিলা এসে বলছেন
–এখানে কিসের শব্দ হলো? ওমা তুমি কে? এই ছেলে তুমি এখানে কিভাবে এলে?(ভদ্রমহিলা)
–জী আমি ইবাদত, কায়নাতের পিছনেই তো এলাম। কেনো আপনি আমাকে খেয়াল করেন নি?
— কই না তো? দেখলাম না তো?তা এখানে কিসের শব্দ হলো?( মহিলা )
–কিছু না, চেয়ারে আমি ধাক্কা খেয়ে পরে যেতে নিয়েছিলাম। এই জন্যই এমন শব্দ হয়েছে।
— আচ্ছা আচ্ছা, তোমরা এখন বিদায় হও তো দেখি বাপু, আমার কাজ আছে।( মহিলা )
আমি আমার জান মাল নিয়ে কোনো রকম সেই বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম।রাস্তায় তাকে ধরলাম
–বলুনতো কি ঘটনা! আলমারি টা কিভাবে পরে গেল। আপনি ফেলেছেন?
–তুমি যে কি বলো না আমি ফেলে আমিই কি আবার তুলে দিবো?
— হ্যাঁ, আমার সামনে হিরো সাজার জন্য! দেখাতে চান আপনার হিরোগীরি, আমাকে ইমপ্রেস করতে চান।
উনি একটি মুচকি হেসে বললেন
–হিরোগীরি দেখাতে চাইলে আমি অন্যভাবেও দেখাতে পারি আর ওটা দেখে তুমি সহ্য করতে পারবে না, সেন্সলেস হয়ে যাবে।
— কি এমন দেখাবেন যে আমি সেন্সলেস হয়ে পড়বো?
–যাই হোক বাদ দেও এসব কথা কিছুক্ষণ আগে আমি তোমাকে যে কথাগুলো বললাম সেগুলো তুমি একটু আমলে নাও।
— কোনটা মুখ চেপে ধরে যেটা করতে চাইলেন সেটা?
–ওহ! আমি খুবই দুঃখিত সেটার জন্য। তখন আমি একটু অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
— হুম, এখন অন্য মনস্ক হয়ে পরেন নি? । আচ্ছা ভালো কথা আপনি আমার নাম জানলেন কি করে? আমার মনে হয় না আমি আপনাকে আমার নামটা বলেছি।
–আমি শুধু তোমার নাম না, তোমার সব কিছুই জানি। যে জন্য আমার তোমার কাছে আসা সেটা আমি তোমাকে আবারও বলছি, প্লিজ এখন বাসায় চলে যাও আর একটু সাবধানে থাকো। দেখলেই তো কিছুক্ষণ আগে কি ঘটলো? আমি যদি সময় মত না আসতাম তাহলা তুমি ঐ আলমারির নিচে চাপা পড়ে থেঁতলে যেতে!
— আমি আপনার কথার আগা গোড়া মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু খুলে বলেন।
–ওহ হো! তুমি না একটা বোকা মেয়ে। আচ্ছা বলছি। আগে গিয়ে যার জিনিস তাকে সেটা দিয়ে তোমার বাসার ছাদে আসো, আমি সেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
— আপনিও চলুন আমার সাথে, আমার তো এখন ভয় করছে।
–না, তুমি একাই যাও, আমি গেলে সমস্যা হবে।তাছাড়া সবাই তোমাকে বকছে, তুমি তাড়াতাড়ি যাও।
–এখন কি সমস্যা? কিছুক্ষণ আগেই তো গিয়েছিলেন সেখানে! এখন আবার কি হলো?আর হ্যাঁ, কি বলছেন ? আমাকে বকছে আপনি জানলেন কি করে? আর আমাকে বকবে কেনো?
–হুম, আমি সব শুনতে পাই, দুর থেকে সবই দেখতে পাই।সেই ক্ষমতা আমার আছে। আর এখন যদি আমি ওখানে যাই তাহলে তোমার বান্ধবী আমাকে কাঁচা গিলে খাবে। সেসময় কোনো রকমে আমি পালিয়ে এসেছি।তোমার ভয়ের কিছু নেই আমি এখান থেকে সব দেখছি। আল্লাহ ভরসা। আল্লাহর জিকির করতে করতে যাও, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
বলে ও দাড়িয়ে রইল। আমি সামনে হেঁটে এগিয়ে গেলাম। একসময় হলুদের অনুষ্ঠানে পৌঁছে গেলাম। এতক্ষণ কি নিরিবিলির মধ্যে ছিলাম আর এখন কত হট্টগোল!
আমি আপুর কাছে গিয়ে তার লিপস্টিক দিয়ে আসছিলাম আর নওরিন এসে বলল
— কি রে তুই কোথায় ছিলি? আমি তোকে পুরো মাঠে খুঁজছিলাম?
–আপুর বাসায় গিয়েছিলাম একটা কাজে।
— আপুর বাসা তো কাছেই তা এতক্ষণ লাগলো কেনো?
আমতা আমতা করে বললাম
— একটা জিনিস খুঁজে পেলাম তো, সেটাই অনেক যত্ন করে রাখছিলাম তাই দেরী হলো।
–ঠিকাছে ঠিকাছে চল, ওদিকে কাজ আছে ছেলের পক্ষরা চলে আসছে আর মেহেদিও দিতে হবে, চল!
— না শোন, আমার একটু তাড়া আছে, আমি এখন বাসায় চলে যাবো আগামীকাল তো বিয়ে তখন অনেক মজা করবো।
–না, না, বাসায় এখন যাওয়া যাবে না, এদিকে আয় তোর সাথে একজন কথা বলবে।
— কে?
–গেলেই বুঝবি। কিন্তু আমার জানুটা কই গেলো! দেখছি না কেনো? যখন থেকে তুই উধাও সেও উধাও। কি আশ্চর্য ব্যাপার! আচ্ছা বাদ দে, ওকে আমি ঠিকই খুঁজে বের করে নিবো।
নওরিনের কথা শুনে আমার খুব হাসি পেলো। ইবাদত ঠিকই বলেছিল যে আমার বান্ধবী ওকে পেলে কাঁচা গিলে খাবে। বেচারা।
নওরিন আমাকে টেনে নিয়ে আহনাফের সামনে এনে দাড় করালো। আমি কিছুই বুঝলাম না। নওরিন আমাদের দুজনকে উদ্দেশ্য বলল
— তোরা কথা বল আমি একটু আসছি। আর আহনাফ ভাই আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি। এখন আপনি বলেছিলেন আমাকে গিফ্ট দিবেন তা সেটা কখন পাবো?
আহনাফ বলল
–অবশ্যই তুমি তোমার গিফ্ট পাবে তবে আগামীকাল।
— ওকে, ভাইয়া, তাহলে আপনারা কথা বলুন আমি আসছি।
বলে যেতে নিবে তখন আমি ওর হাত ধরে থামিয়ে ফিসফিস করে বলছি
–আমাকে এখানে এনেছিস কেনো? তোকে না বললাম আমার জরুরী কাজ আছে আমি বাসায় যাবো?
–আরে কথা বলে দেখ, ভালো ছেলে। তোকে মনে হয় পছন্দ করে। তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে বাসায় যা। যত তাড়াতাড়ি কথা শুরু করবি তত তাড়াতাড়ি ছাড়া পাবি।আমি যাচ্ছি।
বলে ও আমাদের দুজনকে রেখে চলে গেল। আমি মনে মনে ভাবছিলাম কি যন্ত্রনায় পরলাম ! ওদিকে একজন ছাদে আমার জন্য অপেক্ষা করছে আর এদিকে একজন আমার সাথে জরুরী কথা বলবে! আহনাফকে আমি আগে থেকেই চিনি। কোয়ার্টারের চকলেট বয় বলেই সবাই চিনে। কত মেয়ে যে ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে কে জানে! ওর সাথে কথা বলাও ভাগ্যের ব্যাপার। আর সে এখন আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। আল্লাহ জানে কি বলবে। যদি বলে ” আমি তোমাকে ভালোবাসি! “” তাহলে আমি কি উত্তর দিবো? খুব চিন্তার বিষয়। ওদিকে ইবাদত কে আমি চিনি না। সেদিনই ওকে প্রথম দেখলাম। কোথায় থাকে, কি করে, কিছুই জানি না। এগুলো চিন্তা করছিলাম আর পিছন থেকে বলল
— কি ব্যাপার, তোমার সাথে এভাবে কথা বলতে চাইছি তাই তুমি কি রাগ করেছো??
–না না, রাগ করবো কেনো? কি বলবেন, একটু যদি তাড়াতাড়ি বলতেন কারন আমার একটা জরুরি কাজ আছে।
— না মানে কথা হচ্ছে যে তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।
আমি একদম লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। তারপর বললাম
— জী, ধন্যবাদ।
মুচকি হেসে সে বলল
— দেখো আমি কখনো চিন্তা করিনি যে এই কথাগুলো কোনো মেয়েকে এভাবে বলবো। কেনো জানি আজ তোমাকে দেখেই খুব ভালো লেগে গেল। হতে পারে আমাকে তোমার ভালো নাও লাগতে পারে। আমি তোমাকে কোনো রকম জোর করতে চাই না।আমি বলতে চাচ্ছি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি।
তার কথা শুনে আমি থ মেরে গেলাম। আজ এগুলো কি হচ্ছে আমার সাথে! আমি কি করবো মানে তাকে আমি কি উত্তর দিবো। আল্লাহ কোন বিপদে ফেললেন আমাকে? আমি চুপ করে রইলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।তারপর বলল
–আচ্ছা ঠিকাছে তুমি না হয় চিন্তা করো। ভালোভাবে চিন্তা করে আমাকে পরে জানাও। আমি তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
বলে উনি চলে গেলো। আমার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এই পরিস্থিতিতে আমার কি করা উচিৎ জানি না। তবে ইবাদত কে আমি মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছি আর আহনাফকে আমার খুব ভালো লাগে।দুইতিন বছর আগেও বাসা থেকে ওকে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। কিন্তু কখনো ওভাবে চিন্তা করিনি। শুধুমাত্র ভালো লাগা থেকেই দেখতাম। আচ্ছা যাই হোক ওদিকে ইবাদত ছাদে আমার জন্য অপেক্ষা করছে, আমার বোধহয় সেখানে যাওয়া উচিত।
(চলবে)