কায়নাত,পর্বঃ৮

কায়নাত,পর্বঃ৮
লেখিকাঃ টিউলিপ রহমান

খুব চিন্তিত মনে ছাদে এসে উপস্থিত হলাম।কিন্তু কাউকেই খুঁজে পেলাম না। মনে মনে ভাবলাম ইবাদত আমার সঙ্গে এমন করতে পারলো! এভাবে ও আমাকে ধোকা দিতে পারলো! আর ওদিকে আহনাফ কত ভদ্র একটা ছেলে ! আমি ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আর পিছন থেকে ইবাদত এসে বলল

— কায়া? কোথায় যাচ্ছ?
আমি চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখি ও বসে আছে। বললাম
— আপনি এখানে কোথা থেকে এলেন? আগে তো এখানে দেখলাম না? আমি এত খুজলাম পেলাম না কেনো? কই লুকিয়ে ছিলেন?
–এখানেই তো বসে ছিলাম, কেনো তুমি দেখোনি?
— একদম মিথ্যা কথা। আপনি প্রচুর মিথ্যা বলেন।আপনি এখানে ছিলেন না। পুরো ছাদ খালি ছিল। আমি সব জায়গায় দেখেছি।
–নাহ, আমি আজ পর্যন্ত কখনো মিথ্যা বলিনি, ভবিষ্যতেও বলবো না। ইনশাআল্লাহ।

সে আমার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় আমি খুব লজ্জা পেলাম। এই ভাবে কেও কারো দিকে তাকায়! এভাবে সে তাকিয়ে বোধহয় আমার জানটাই নিয়ে নিবে। তারপর বললাম

— এখন বলুন কি দরকারী কথা তাড়াতাড়ি বলুন, আমাকে বাসায় যেতে হবে। মা বকবে।
–যদি তোমাকে না যেতে দেই, তাহলে কি হবে? যদি আমার সঙ্গে তোমাকে আমার রাজ্যে নিয়ে যাই, তখন??তখন কি করবে?
— কি আবোলতাবোল বলছেন,আপনার মাথা ঠিক আছে তো?এভাবে দুষ্টুমি করবেন না প্লিজ!
–আগে বলো ঐ ছেলেটা একটু আগে তোমাকে কি বলছিল?
— ও, তাহলে লুকিয়ে লুকিয়ে এগুলো দেখছিলেন? বলেছে কিছু একটা আপনাকে বলা যাবে না।

–তুমি না বললেও আমি জানি, তোমরা তখন কি কথা বলছিলে!
— কিভাবে? আপনি তো সেখানে ছিলেন ই না তাহলে?
–কায়নাত তুমি কি জানো তোমার জন্য আমার জীবন টা অন্য রকম হয়ে গিয়েছে? শুধু মাত্র তোমার একটা ভুলের জন্য?

আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম, তারপর বললাম
–আমি কি করেছি? কি যা তা বলছেন?আপনি তাড়াতাড়ি বলুনতো আপনার জরুরী কথা, তা না হলে আমি এক্ষুনি চলে যাবো।
–আচ্ছা একটা কথা বলো তো। কয়েকদিন ধরে তুমি কি উল্টো পাল্টা স্বপ্ন দেখছো বা তোমার জীবনে ভয়ংকর কোন ঘটনা ঘটছে যা তোমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে?
— হ্যাঁ! কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?
–এরকম কি হচ্ছে যে কেও তোমাকে গলা টিপে মারতে চাচ্ছে বা কেও তোমার নাম ধরে বারবার ডাকছে?
— হ্যাঁ! কিন্তু আপনি এগুলো কিভাবে জানেন, আমি তো কাউকেই বলিনি।

ইবাদত একটু হেসে বলল
–তোমার জীবনে এই ঘটনাগুলো যে ঘটবে তা আমি আগে থেকেই জানি।
— কিন্তু কিভাবে জানলেন? ( আশ্চর্য হয়ে)

— এগুলো কে করছে জানো? আজ যদি আমি সময় মত এসে না তোমাকে না বাঁচাতাম তাহলে হয়তো আমি চিরজীবনের জন্য তোমাকে হারিয়ে ফেলতাম।
–প্লিজ একটু পরিষ্কার করে বলুন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
— কায়নাত! আমি জ্বীন!

কায়নাত ফিক করে হেসে দিল। ও হাসতে হাসতে ছাদে একটা বসার চেয়ার আছে সেটাতে বসে পড়ল। অনবরত হেসেই যাচ্ছে। হাসতে হাসতে ওর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।তারপর বলল
–দেখুন ফাজলামি করার একটা সীমা থাকে, প্লিজ সীমা লঙ্ঘন করবেন না।
— আমি সত্যি বলছি। আমি একজন জ্বীন। আর তোমার সাথে ফাজলামো করার মুড আমার একদমই নেই।
–ও তাই না! তাহলে একটু উড়ে দেখান তো! একটু দেখি। শুনেছি জ্বীনেরা উড়তে পারে!
— তুমি মজা করছো! দাড়াও!

বলেই ইবাদত একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।কায়নাত খুব অবাক হলো। ও ওর হাতে চিমটি কাটলো এটা দেখার জন্য যে স্বপ্ন দেখছে কি না! কিন্তু চিমটি কাটার সাথে সাথে যখন ও ব্যাথা পেলো তখন ও সেখানেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন ওর সেন্স আসলো দেখলো ইবাদতের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। এটা দেখে ও নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে যেতে নিচ্ছিলো আর তখন টের পেলো যে ওর শাড়ির আঁচল টেনে ধরেছে। কায়নাত থেমে বলল

–দেখুন আমার এইসব একদমই ভালো লাগে না। শাড়ির আঁচল ছেড়ে দিন। আমি বাড়ি যাবো।
— আমি ধরি নি, চেয়ে দেখো!

তাকিয়ে দেখি আসলেই উনি ধরেননি, উনার জামার বোতামে আমার শাড়ির আঁচল আটকে আছে। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইছিলাম কিন্তু পারছিলাম না। উনাকে আমার ভীষণ ভয় করছে। তারপর বললাম

–দেখুন আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই, আমাকে দয়া করে কিছু করবেন না। আমি যদি কোনো ভুল আরে থাকি তাহলে আমাকে মাফ করে দিবেন।

আমি অনবরত আমার শাড়ির আঁচল ছাড়িয়ে নিচ্ছিলাম কিন্তু বিফল চেষ্টা করছি। ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছে যদিও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে জ্বীন! কারন আমার মনে হচ্ছিলো সে কোনো জাদুকর।তারপর তিনি বললেন

— তোমাকে এই কথাগুলো বলার জন্যই আমি এখানে এসেছি। তোমার অনেক বিপদ। কতগুলো খারাপ জ্বীন তোমার পিছু নিয়েছে। তোমাকে হয়তো হত্যা করবে নয়তো শারীরিক সম্পর্ক করে পাগল বানিয়ে ছাড়বে।
বেশ কয়েকদিন ধরেই তারা চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু আমার জন্য পেরে উঠতে পারছে না। এখন তোমার প্রশ্ন এটা হতেই পারে ওরা জ্বীন হয়ে ক্ষতি করতে চাইলে আমি কেনো তোমাকে বাঁচাচ্ছি। এর একটা যথাযথ কারন অবশ্যই আছে। আর সেটা হলো তোমার বাবা।

–আমার বাবা! কিভাবে??
— বলছি আগে তুমি একটু স্বাভাবিক হও।

–সামনে জ্বীন নিয়ে একজন মানুষ কিভাবে স্বাভাবিক থাকবে! তবে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
— এখনো না?

–না। বইয়ে পড়েছি জ্বীন দেখতে কুৎসিত হয়। মানুষ তাদের দেখলেই ভয় পায়। কিন্তু আপনি তো দেখতে মানুষের মত। আর বেশ স্মার্ট ও! তাহলে কিভাবে কি!!

ইবাদত খিলখিল করে হেসে দিল। আচ্ছা তুমি একটু দাঁড়াও আমি আসছি। বলেই কিভাবে যেনো উড়ে গেল। তখনই আমি বললাম

— না প্লিজ আমাকে একা রেখে যাবেন না আমি ভয় পাই!

কিন্তু এটা বলার আগেই ইবাদত উড়ে চলে গেলো। আর আমি তাকে উড়তে দেখে হা করে তাকিয়ে রইলাম যেনো কোনো মুভির ট্রেইলার দেখছি। কি অদ্ভুত!
চোখের পলকেই তিনি আবার ফিরে এলেন। হাতে এক বাটি গরম গরম কতগুলো রসগোল্লা নিয়ে। তারপর বলল

–এই নাও, খেয়ে দেখো বেশ স্বাদ। একবার খেলেই এর স্বাদ চিরজীবন মুখে লেগে থাকবে।

আমি অবাক হয়ে গিয়েছি। আসলে অবাকের উপরে যদি আরো কোনো কিছু থাকে তাহলে সেইটা হয়েছি।ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। তিনি তুড়ি বাজিয়ে বলল

— মিস জাগ্রত ঘুমপরী, জেগে ওঠো।রসগোল্লা খাও। এই কয়েকটাই আনতে পেরেছি।
–মানে আপনি কোথা থেকে এগুলো আনলেন?
— কেনো তোমার এলাকার মিষ্টির দোকান থেকে!
–এমনেই এনেছেন নাকি টাকা দিয়ে?

— অবশ্যই টাকা দিয়ে! এবার বিশ্বাস হলো তো আমি জ্বীন! এখন আর আমাকে এগুলো বলে বিব্রত করো না, প্লিজ । তোমাকে যেটা বলছি সেটা শুনো, তুমি বাড়ির বাহিরে বের হবে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, শরীর বন্ধ করে রাখবে আর পবিত্র থাখবে। তাহলে ইনশাআল্লাহ ওরা তোমার কাছে আসতে পারবে না।
আর হ্যাঁ আজ এখনই তোমার ছাদে শেষ আসা। এরপর আর কখনো তুমি একা ছাদে আসবে না, মনে থাকবে?

— কিন্তু আমার যদি বাহিরে কাজ থাকে তাহলে কি যাবো না?

–অবশ্যই যাবে তবে একা একা নয়। কাওকে সঙ্গে নিয়ে নিবে।

— কিন্তু আমি তো নামাজ পড়ি না, মানে অভ্যাস নেই। তাহলে কিভাবে পড়বো?

–অভ্যাস নেই, অভ্যাস গড়ে তোলো, এতে তোমারই উপকার হবে। আর ভালো জিনিসের অভ্যাস থাকাটা জরুরী।

— আচ্ছা অভ্যাস করবো। এখন কি মিষ্টিগুলো একটু চেখে দেখতে পারি? খুব লোভনীয় লাগছে। আপনি আবার এগুলোতে কিছু মেশান নি তো??

–কি অবাক কান্ড! আমি আবার কি মেশাবো? তোমরা মেয়ে মানুষ না, শুধু শুধু সন্দেহ করো।

— না এই ধরুন ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন! হতে পারে না এমন?

–না হতে পারে না। কারন আমি মানুষ না জ্বীন।ভালো জ্বীন কখনো ছলনা করে না।

আমি মিষ্টিগুলো গুনে দেখলাম সেখানে দশটা বড় বড় সাইজের মিষ্টি আছে। একটা হাতে নিয়ে খেয়ে দেখি সেই রকম স্বাদ। এত নরম আর তুলতুলে মিষ্টি আমি আগে কখনো খাইনি। খেয়ে বললাম

— খুব মজা তো। আপনি কি বিরিয়ানি এনে দিতে পারবেন? খুব খিদে লেগেছে।

–তুমি তো ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করলে। একটু পর বলইে শাড়ি, গহনা টাকা পয়সা এনে দিতে! আমি ওগুলো আনতে পারবো না। আলাদীনের চেরাগ ওয়ালা জ্বীন আমি নই। খুবই সিদাসাদা জ্বীন আমি।

— ওওও, সরি আসলে মনে করে ছিলাম ওগুলো চাইবো। মিষ্টি এনেছেন ভেবেছি হয়তো ওগুলোও এনে দিবেন।

–খুব বেশী খিদে পেলে বাড়িতে গিয়ে খাবে। কিন্তু আমার কথাগুলো মনে আছে তো?
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। তারপর বললাম

— কিন্তু আপনি তো বললেন না আমি ঐ বদজ্বীনদের কি এমন ক্ষতি করেছি যাতে ওরা আমাকে এই রকম ভয় দেখাচ্ছে, মারতে চাচ্ছে?

–হুম, আসলে আমাদের জ্বীন জাতিদের চলা ফিরার রাস্তা থাকে, তাতে যদি মানুষ বাঁধা দেয় তাহলে ওরা ক্ষেপে যায়। আর তুমি ওদের সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে ওদের একজনের বাচ্চাকে পাঁয়ে পিষে মেরে ফেলেছো। তাই তারা ক্ষ্রিপ্ত হয়ে তোমাকে মারতে চাচ্ছে।

— কিন্তু আমি এই কাজ কখন করলাম? আমি তো ওদের দেখিই নি? তাহলে কিভাবে কি ?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here