কায়নাত,পর্বঃ৬

কায়নাত,পর্বঃ৬
লেখিকাঃ টিউলিপ রহমান

তাকিয়ে দেখলাম কেও একজন আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। ব্রেন তখনো কাজ করছে না, বাস্তব না স্বপ্ন এর মধ্যে আটকে পরে আছে। আবারও ডাকলো

— কায়া!! আইই কায়া! কি ব্যাপার, এই ভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?

আমি চোখ বড় বড় করে দৃষ্টিশক্তি প্রখর করে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম এটা আর কেও না আমারই ভাইয়া।
কিন্তু ভাইয়া এখানে কেনো?

–কি রে, স্বপ্ন দেখেছিস? এমন করছিস কেনো?

আমি উঠে বসলাম। তারপর বললাম

— হ্যাঁ ভাইয়া একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।কিন্তু ভাইয়া তুমি রুমে এলে কি করে? দরজা না লক করা ছিল?

— না দরজা ভেজানো ছিলো । আমি পড়ছিলাম। পড়তে পড়তে পানির খুব পিপাসা পেলো। টেবিলের পানি শেষ হয়ে যাওয়ায় ডাইনিং এ এসে পানির বোতল হাতে নিয়ে শুনি কেমন একটা শব্দ হচ্ছে। খেয়াল করে শুনি তোর রুম থেকে আসছে। তোর রুমের দরজা ধরতেই দেখি খুলে গেল।কিরে খুব বেশী ভয় পেয়েছিস বুঝি?

আমি কিছু বললাম না।

–তুই মুখ দিয়ে খুব অদ্ভুত শব্দ করছিলি । এই ঠান্ডা আবহাওয়ায়ও দেখি তুই একেবারে ঘেমে গিয়েছিস।তোর কপাল বেয়ে বেয়ে ঘাম পরছে। বোধহয় একটু বেশীই ভয় পেয়েছিস। আচ্ছা একটা কাজ কর, একটু পানি খেয়ে নে ।আর পারলে হাত মুখ টা ধুয়ে আয় দেখবি ভালো লাগবে।রিলাক্স হয়ে শুয়ে পর সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কোনো দরকার হলে আমাকে ডাক দিস। বেশী ভয় পেলে রুমের আলো জ্বালিয়ে শুয়ে পর।

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে হাতে পানির বোতলটা নিলাম।তারপর ভাইয়া চলে গেল। গলাটা ভীষন শুকিয়ে গেছে। বেশ কয়েক ঢোক পানি গিলে খেলাম। খেতে খেতে চোখ গেল দরজার দিকে। আমার মনে আছে, আমি অবশ্যই গেট লক করে ঘুমিয়েছি, তাহলে ভাইয়া আমার রুমে আসলো কি করে! আমি কি তাহলে দরজা লক করতে ভুলে গিয়েছি? নাহ, আমার ঠিক মনে আছে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ভালোভাবে দরজা লক করেছি। তাহলে, কে খুলে দিল? খুবই ভয়ংকর একটা ব্যাপার। আরো ভয়ংকর ব্যাপার হলো কিছুক্ষন আগে আমার সাথে এগুলো কি হলো? কেনো হলো? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? আর ঐ কালো ছায়াটি কি ছিল? জ্বীন! নাহ , এটা কি করে সম্ভব! এগুলো তো শুধু বইয়েই সীমাবদ্ধ। আমি জানি বাস্তবে এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। এগুলো শুধুই আমার কল্পনা। হ্যাঁ ঠিক তাই। মা ঠিকই বলে, ভুতের বই পড়ে পড়ে আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। আজ থেকে আর কোনো ভৌতিক গল্প পড়বো না। আর এসব আলতু ফালতু চিন্তা গুলোও মাথা থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলবো।

কিন্তু তারপরও কতগুলো প্রশ্ন মাথায় খেলে যাচ্ছে। গতকাল থেকে আমার সাথে যা যা হচ্ছে তা মোটেও স্বাভাবিক কোনো ঘটনা না। আমার রুমটাতেও এখন সবসময় কেমন যেনো গুমোট গুমোট একটা ভাব বিরাজ করে। মনে হচ্ছে হাজারো চোখ অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে থাকে। তারপর বারবার আমার নাম ধরে ডাকা। উফফ! আমি পাগল হয়ে যাবো। দৌড়ে রুমের আলো জ্বেলে দিলাম। এভাবে অন্ধকারে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আয়নার সামনে এসে দাড়াতেই চমকে গেলাম। আমার গলায় কেমন আঙ্গুলের ছাপ পরেছে। সেগুলো লাল হয়ে আছে। তাহলে সত্যিই কিছু একটা আমার গলা চেপে ধরেছিল? কেও কি আমাকে মারতে চাচ্ছে ? কিন্তু কে? বিছানার পাশেই একটা চেয়ারে এসে বসলাম। আমার আর সাহস হলো না যে আবার সেই বিছানায় ঘুমাই। যদি এখন বিছানায় ঘুমাই আর ঐ অদ্ভুদ জিনিসটা আবার এসে আমার গলা চেপে ধরে!! তাই ঠিক করলাম সারা রাত বসেই কাটিয়ে দিবো।

এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর মনে হলো একটু ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। কিন্তু ভীষণ ভয় হচ্ছে। উঠে কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে সময় পার হচ্ছে না।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত আড়াইটা বাজে। এত রাতে এভাবে একা বসে থাকতে খুব অসহ্য লাগছে। আবার ভয়ও করছে। একবার ফ্যানের দিকে তাকাচ্ছি একবার জানালার দিকে তাকাচ্ছি। টেবিল থেকে একটা বই নিলাম। না, অবশ্যই আর ভুতের গল্প পড়বো না। দীনা আপু (চাচাতো বোন) লাস্ট জন্মদিনে একটা রোমান্টিক বই গিফ্ট করেছিল। ঐটাই হাতে নিয়ে বসলাম।পড়া শুরু করলাম কিন্তু দুই তিন লাইন পড়েই বই পড়ার ইচ্ছা টা মরে গেল। এতো ভয়ের মধ্যে কি রোমান্টিক গল্পের বই পড়া যায়!যদিও বইটা নিয়েছি মনটা অন্যদিকে নেওয়ার জন্য কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। আমার একা একা ভয়ও করছে।এত রাতে মাকে ডাকা কি ঠিক হবে?

আবার গিয়ে চেয়ারে বসলাম আর বইটা পাশেই টেবিলে রেখে দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর হঠাৎ সেই মিষ্টি সুমধুর গন্ধ টা নাকে এসে লাগল। মনমাতানো এই গন্ধে আমি যেনো কেমন পাগল হয়ে যাই।না জানি কি আকর্ষণ আছে এই গন্ধে! আমি স্পষ্ট তার গায়ের গন্ধ টা পেলাম। মনে হচ্ছে তিনি আশেপাশেই আছে। কিন্তু এত রাতে কোনো পাগলই হবে যে বাড়ির বাহিরে থাকবে। তখন ঘড়িতে রাত ৩ টা বাজে।সে হয়তো কোনো কাজে বের হয়েছেন। জানালাটা খুলে কি দেখবো, সে আছে কি না?যেই চিন্তা সেই কাজ। উঠে জানালার কাছে গিয়ে এক ঝটকায় জানালাটা খুলে ফেললাম। আজ যা আছে কপালে হবে আমি তাকে শুধু এক নজর দেখবো। জানালাটা খোলার সাথে সাথেই একটা হিম শীতল বাতাস আমাকে ছুয়ে গেল। সামনে মাঠ আছে, রাস্তা আছে, কিন্তু সেখানে মানুষ তো দুরের কথা একটা কুকুরকেও দেখতে পেলাম না।
.

চারিদিকটা চোখ বুলিয়ে নিলাম। চাঁদের আলোয় সব কিছু খুব ভালো লাগছে। একটু শীত শীতও করছে। তখনই কানে এলো আযানের ধ্বনি।এই মাঝ রাতে আযান! যেহেতু আমি ফজরের নামাজ পড়ি না তাই আমার আযানের সময় নিয়ে কোনো আইডিয়া নেই।তারপরও মনে মনে খটকা লাগছিল যে ৪ টা ৫ টায় না আযান দেওয়ার কথা! তাহলে বোধহয় হুজুরই ভুল করে আযান দিয়েছে। তার ঘড়িটা মনে হয় নষ্ট।মনে মনেই হাসি পেল। কিন্তু আমার নয়ন যাকে দেখার জন্য অস্হির হয়ে আছে তার দেখা তো পেলাম না ভেবে ভেবে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এই গভীর রাতে উনি কেনো এখানে আসবেন! এগুলো ভাবতে ভাবতেই এসে আবার বিছানায় বসলাম। কিন্তু হঠাৎ করে গলা চেপে ধরার কথা মনে পরে যাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে দাড়িয়ে গেলাম। তখন আয়নায় চোখ গেল আর তাকাতেই মনে হলো আমি ছাদে যে বাচ্চাটিকে দেখেছিলেম সেই বাচ্চাটিকে বিছানার উপর দিয়ে দৌড়ে যেতে দেখলাম।

উফ্! মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাবো। নাহ! এখন আর এসব বিন্দু মাত্রও চিন্তা করবো না। রুমে যা ইচ্ছা দৌড়ে যাক বা লাফালাফি – ফালাফালি করুক আমি এগুলো নিয়ে কোনো রকম ভয় পেতে চাই না। অন্য কিছু চিন্তা করি। আচ্ছা! নওরিনকে উনি যখন বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিলো তখন কি ওরা কথা বলেছিল?নিজেকে নিজেই উত্তর দিলাম –বলতেই পারে এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার না। কিন্তু আমার বাসাটা দুরে হলো না কেনো! তাহলে সে আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারতো আর তার সাথে আমি কিছু সময় কাটাতে পারতাম! খুব মন খারাপ হলো। এগুলো নিয়ে মন খারাপ করতে করতেই কখন যেনো সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছি। সকালে মার দরজায় কড়া নড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো।মা বলল

–বেলা কয়টা হলো? এখনো উঠছিস না কেনো?
— মা রাতে ঘুম আসছিল না। দেরি করে ঘুমিয়েছি।
–গল্পের বই পড়লে ঘুম আসবে কোথা থে‌কে? তোর ফোন এসছে।
— গল্পের বই পড়িনি মা, ভয় করছিল তাই ঘুমোতে দেরি হয়েছে।
— হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি সব বুঝি!
–মা কে ফোন করেছে?
— গিয়ে দেখো কে?
ফোনটা হাতে নিয়ে
–হ্যালো!
— হুম, কিরে, কি করছিস?
–কে নওরিন!
— হুম।
–কি মনে করে এত সকাল সকাল!
— এগারোটা বাজে, সকাল হলো কি করে!
–ভালো হয়েছে বল।ফোন করেছিস কেনো?
–জানিস কাল কি হয়েছিল?
এটা শুনে আমার অন্তরে উথাল পাথাল আরাম্ভ হয়ে গিয়েছে।গতকাল ওদের মধ্যে না জানি কি ঘটনা ঘটেছে। তারপরও সাহস করে বললাম
— আমি কিভাবে জানবো, আমি কি সেখানে ছিলাম না আমার কাছে কোন যন্ত্র আছে যেটা দিয়ে আমি সব ঘটনা বাড়িতে বসে বসে দেখবো? তা কি হয়েছে শুনি?
–ছোকরা টাকে নাম জিজ্ঞেস করেছি আর ও কি বলেছে জানিস?
— আশ্চর্য তো! নাম জিজ্ঞেস করলে অবশ্যই নামই বলবে তাই নয় কি! নাকি তোকে সরাসরি বলবে আমাকে বিয়ে করবো ?
— ওহ! তুই কি যে বলিস না। বিয়ে করবে বললে তো আমি পাগলই হয়ে যেতাম। যাইলোক তোর মুখে ফুল চন্দন। এটাই যেনো হয় বান্ধবী !আর তুই এতো কথায় কথায় ক্ষেপে যাচ্ছিস কেনো?

ওর কথাগুলো শুনে আমার পুরো মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। সকাল সকাল এসব কার ভালো লাগে! রিসিভার হাতে চুপ করে বসে আছি।
— কিরে কিছু বলছিস না কেনো?চুপ করে আছিস কেনো?
— তোর কি কোন দরকারী কথা আছে, থাকলে বলতো আমার আরও কাজ আছে।
— হুম। শোন না! ওর নাম হচ্ছে ” ইবাদত “।আহ!
আমার “” ইবাদত “”।

নামটা শুনে খুব ভালো লাগল। ইবাদত।। খুব সুন্দর নাম। যেমন দেখতে সুন্দর, তেমন সুন্দর নাম। আবার খুব রাগও হলো। আমার সাথেই শুধু ঝগড়া করে আর ওর সাথে করে রসের আলাপ। আবার বাড়িতেও পৌঁছে দেয়। ধ্যাৎ!! উনার কথা আমি আর চিন্তাও করবো না।

–কিরে আবার চুপ করে আছিস কেনো?
— না কিছু না, আমি এখন ফোন রাখবো তোর সাথে আবার পরে কথা বলবো।
বলেই রিসিভার টা রেখে দিলাম। হাত, মুখ ধুয়ে চুপ করে বসে আছি। মা এসে বলল পাশের বিল্ডিংয়ের নীলা আপুর আজ গাঁয়ে হলুদ। হলুদে যাওয়ার জন্য দাওয়াত দিয়ে গিয়েছে। কথাগুলো শুধু শুনলাম। হ্যাঁ , না কিছুই বললাম না।বিকেলে নীলা আপুর মা এসেছে আমাকে আর মাকে নিতে। কিন্তু আমরা যাওয়ার তেমন কোনো প্রিপারেশন নেইনি। মা বলল তৈরী হয়ে নিতে। বাবা বাড়িতে এলেই আমরা যাবো। ফোন করে জেনে নিলাম কি রঙের শাড়ি পড়তে হবে। মার খুব সুন্দর একটা লাল রঙের শাড়ি পরলাম।অফিস থেকে বাবা আসার পর আমরা বের হলাম।

খুব সুন্দর করে বিল্ডিংটা লাইটিং করেছে। বিল্ডিংয়ের সামনে বড় একটা মাঠ আর সেই মাঠেই প্যান্ডেল টানিয়ে হলুদের স্টেজ তৈরী করেছে। মোটামোটি কলোনীর সকলকেই দাওয়াত দিয়েছে। কমবেশি সবাই এসেছে। নওরিনও এসেছে। জানি না কেনো যেনো ওকে দেখেই আমার শরীরটা পুরো জ্বলে যাচ্ছে।অথচ ও আমার ক্লোজ বান্ধবী। যাই হোক পাশে দেখলাম রাইদা, সুবাইতা, তিশা ওরা সবাই এসেছে। ওরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে গল্প করছে। গতকাল রাতে আমার ভালো ঘুম না হওয়ায় এখন কেমন যেনো একটু ঝিমুনির মত হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে ওদের কাছে গেলাম। তখন দেখলাম দূরে দাড়িয়ে একটি ছেলে আমাকে দেখছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম সে আমাদের কোয়ার্টারের এক বড় ভাইয়া। আহনাফ ভাইয়া, কিন্তু সে আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো? আমার খুব লজ্জা লাগছিল। যাক কেও তো আছে আমাকে দেখার জন্য! নাহলে কেও কেও তো পারলে মারামারি শুরু করে আমার সাথে।

অথচ ঐ বেয়াদব ছেলেটাকে দেখার জন্য আমার মনটা কেমন ছটফট করে, সারাক্ষণই অপেক্ষা করি একটু দেখার জন্য। আর সে কিনা পারলে অন্য মেয়েদের গায়ে ঢলে পরে। অন্য সবাইই ওর কাছে ভালো, খালি আমাকেই এত অপছন্দ তার। অন্তর থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো । সবাই খুব মজা করছে। জোরে গান বাজাচ্ছে , কেও কেও নাচছে, গল্প করছে, বাকিরা ছবি তোলায় ব্যস্ত। আমিও গিয়ে ওদের সাথে সামিল হলাম। মা অনুষ্ঠানে কিছুক্ষণ থেকে চলে গেল, কারন বাড়িতে বাবাকে একা রেখে এসেছে। আহনাফ ছেলেটি সবার ছবি তুলে দিচ্ছে। ক্লিক করতে করতে আমারও কতগুলো ছবি তুলল। একটু অস্বস্হি লাগছিল।তবে খারাপ লাগছিল না, সময়টা ভালোই উপভোগ করছিলাম। কিন্তু তখনই ঘটলো সেই অঘটন, যেটার জন্য আমি বিন্দু মাত্র প্রস্তুত ছিলাম না। আর সেটা হলো দুরে দাড়িয়ে থাকা ইবাদত। হ্যাঁ, সত্যিই সেটা ইবাদত।দুরে দাড়িয়ে ও এদিকেই দেখছে। ও এখানে কি করতে এসেছে? নওরিনকে দেখতে? না অন্য কোনো মেয়েকে দেখতে? আসুক, দেখুক তাতে আমার কি! ও তো আর আমাকে পছন্দ করে না! আমি ওর দিকে তাকাবোই না।এখানে আমাকে দেখারও মানুষ আছে।

ওকে দেখে রীতিমতো মেয়েদের মধ্যে একটা হৈচৈ পড়ে গেল। সবাই যে যার মত চুল ঠিক করছে, শাড়ি ঠিক করছে, হাতে ছোট আয়না নিয়ে লিপস্টিক ঠিক করছে যেনো এখনই মডেল শো হবে আর তাতে তারা রেম্প ওয়াক করবে। যত্তসব ঢং! ওকে দেখে এমন করার কি আছে! মেয়েগুলো না এই একটা ছেলের পিছনেই লেগে আছে। দুনিয়ায় কি আর ছেলে নেই? বুঝলাম ইবাদত দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম, গুডলুকিং তাতে কি হয়েছে? কোয়ার্টারে কি আর সুন্দর ছেলে নাই নাকি?

আমিও ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে আহনাফের সাথে কথা বলছিলাম, একটু দুষ্টুমি করছি। এতক্ষণ যেই শূন্যতায় ভুগছিলাম, ওকে দেখে তার ষোল আনাই যেনো পূর্ণ হলো। মনে মনে ভাবলাম ওকে একটু ক্ষেপিয়ে দেই, এইই সুযোগ। আমি আহনাফের একদম পাশেই দাঁড়ালাম। নওরিন পাশ থেকে বলল

— ওহফ! আমার হিরোর এন্ট্রি হয়েছে। আমি থাকবো আর আমার হিরো আসবে না, তা কি হয়!দাড়া আমি ওকে এদিকে ডেকে নিয়ে আসি।

বলে নওরিন ইবাদতকে ডাকতে গেলো। আমি ভাবলাম সে হয়তো এত মেয়ের ভীড়ে আসবে না। তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে ও এদিকেই এগিয়ে আসছে। আর নওরিন কে দেখে মনে হচ্ছে ও যেনো যুদ্ধ জয় করে এসেছে।নওরিন ইবাদতকে নিয়ে সোজা সামনের দিকে হেঁটে গেল। আর আমি হা করে দেখছিলাম। জীবনে কখনো কোনদিন কোনো ছেলের দিকে তাকাইনি, কখনো কারো সাথে কথা বলিনি, প্রেম করিনি কিন্তু এই ছেলেকে দেখে আমার হার্টবিট এমন বেড়ে যায় কেনো? কেনো আমি ওকে অন্য মেয়ের সাথে সহ্য করতে পারি না। তারমানে আমি কি ওকে পছন্দ করি?

আমি বোকার মত এক পাশে দাড়িয়ে রইলাম আর ওরা ওদিকে ইবাদতকে নিয়ে মজা করছে। একাএকা দাড়িয়ে কি করবো তাই ভাবললাম বাসায় চলে যাই। কারন এখানে যেই ঘটনা ঘটছে আর কিছুক্ষণ যদি এখানে থাকি তাহলে হয়তো দু চারটা খুন করে ফেলতে পারি। তাই উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করলাম।পিছন থেকে নওরিন এসে বলছে
–কিরে কোথায় যাচ্ছিস? এদিকে আয়।
বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। একেবারে ইবাদতের সামনে এনে দাড় করালো। তার সাথে চোখাচোখি হলো। যখনি আমার দিকে তাকায় তখনি মনে হয় আমার জানটা মনে হয় এখনই বের হয়ে যাবে। এখনো তাই মনে হচ্ছে। ওর চোখ গুলো খুব সুন্দর। যে কোন মেয়েই ওর চোখ দেখে পটে যাবে। ওরা সবাই কথা বলছে। আমার আবার উনার সাথে চোখাচোখি হলো। এই চোখ দুটোই আমার জান নিয়ে ছাড়বে।তার চোখে চোখ পড়তেই আমার হাত পা কাঁপাকাপি শুরু হয়ে যায়।নওরিন ওর মোবাইল দিয়ে অনেকগুলো ছবি তুলল। এবার আমাকে আর ইবাদতকে পাশাপাশি দাড় করিয়ে বলছে

–তোরা একটু ক্লোজ হয়ে দাড়া তোদের একটা ছবি তুলে দেই।
বলে দু তিনটা ছবি তুলল।আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আমার কি ভালো লাগা উচিৎ নাকি না কারন সে তো আমাকে একটুও পছন্দ করে না। করলে হয়তো আমার সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করতো না।মুখ গোমড়া করেই দাড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ টের পেলাম আমার কানে গরম বাতাস এসে লাগছে। সাথে সাথে আমার শরীরের সব লোম দাড়িয়ে গেল। সে পাশ থেকে আমার কানে বলছে

— কায়নাত, তোমার সাথে আমার খুব জরুরী একটা কথা আছে।একটু এদিকে এসো।

কথাগুলো যখন বলল আমি তার ঠোঁটের স্পর্শ আমার কানে টের পেলাম। এতে আমার সমস্ত শরীর যেনো জমে গেল। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? উনি আমার সাথে কি জরুরি কথা বলবে! তাহলে সে কি আমাকে ভালোবাসে? এ কথাটিই বলবে? সে সেখান থেকে সরে গেল। আমি একা দাড়িয়ে রইলাম। নওরিন দৌড়ে এসে বলল

–কিরে আমার জানু তোকে কানে কানে কি বলে গেল?

আমার মনে হলো আমি স্বপ্ন দেখছিলাম আর নওরিনের ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গল। আমি বললাম
— না কিছু বলেনি তো?
বলে তাকে দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু দেখতে পেলাম না। সে গেলো কোথায়??চারিদিকে একটু খুঁজে নিলাম তাও পেলাম না। সে একেবারে হাওয়া হয়ে গেল! আমি হাঁটতে হাঁটতে নীলা আপুর পাশে গিয়ে বসলাম আর চিন্তা করছিলাম আমায় বলল জরুরী কথা আছে কিন্তু না বলেই চলে গেল! নীলা আপু পাশ থেকে বলছে
— কি ব্যাপার কায়নাত, সেই কখন থেকেই দেখছি তুমি কেমন মন মরা হয়ে আছো, কিছু হয়েছে?
–না আপু, কই কিছু না তো!
— ও , তাহলে তুমি কি আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে?
–জী আপু, কি কাজ?
— আমার লিপস্টিকটা হালকা হয়ে গিয়েছে। তাড়াহুড়োর মধ্যে আমি সঙ্গে আনতে ভুলে গিয়েছি। তুমি কি একটু বাসায় গিয়ে এনে দিতে পারবে?
–জী, অবশ্যই আপু, কোথায় রাখা আছে?
— ড্রেসিং টেবিলের উপর।
–ঠিকাছে, আমি এখন গিয়ে নিয়ে আসছি। বলে আমি আপুর বাসার দিকে রওনা দিলাম।আমি রাস্তা দিয়ে একাই হেঁটে যাচ্ছি। সঙ্গে কাওকে আনি নি। রাস্তা টা একটু নিরিবিলি। যেহেতু সবাই হলুদের অনুষ্ঠানে তাই এই দিকটায় মানুষজন কম। তবে পুরো বিল্ডিংটা আলোকিত হওয়ায় ভয়ের কিছু নেই মনে মনে বললাম। বিল্ডিংটায় যেতে পথে একটা অন্ধকার ঝোপ পরে। সেখান দিয়ে দিনের বেলায় হাঁটতেও কেমন যেনো গা ছমছম করে। যেই মাত্র আমি ঝোপের রাস্তায় পা বাড়ালাম সেই মনে হলো আমার পিছনে কেও হাঁটছে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি কেও নেই। এখন একটু ভয় লাগছে। আবার হাঁটা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর আবার সেই শব্দ শুনলাম। এই জায়গাটা একটু নিরিবিলি তাই কেমন যেনো লাগছিল। এবার আমি থেমে দাড়িয়ে গেলাম। পিছন ফিরে দেখার সাহস আমার হলো না। তাকিয়ে না জানি কিসের সম্মুখীন হই, না জানি কি ভয়ংকর জিনিস দেখে ফেলি।আজ কদিন ধরে আমার সাথে যা যা ঘটছে তাতে এখানেও যে দুর্ঘটনা ঘটবে না তা কিন্তু নয়, এখানে অঘটন ঘটতেও পারে। তাই মনে অনেক সাহস সঞ্চয় করে ধীরে ধীরে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি এবারো কিছুই নেই। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সামনের দিকে তাকাতেই দেখি কেও একজন আমার মুখ চেপে ধরে ঝোপের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল। অন্ধকারে তার চেহারা বুঝতে পারছিলাম না। খুব দৃঢ় হাতের আবদ্বে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। ঝোপঝাড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে যেটুকু আলো আসছিল তার ছিটেফোঁটা তার গায়ের উপর পড়লো এবং আমি যা দেখলাম তাতে আমার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না যে সে ………..

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here