করোনা কালের বাসরঘর

গল্প -করোনা কালের বাসরঘর
মেহরুমা নূর
হাস্য বিনোদন

বাসর ঘরের দরজা খুলতেই কেউ আমার কপালে কিছু একটা ঠেকালো। ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম আমি। ভয়ও পেলাম খানিক। ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছি সেই কবে। দুই হাত হ্যান্ডসআপ করে ভীতু স্বরে বললাম।
–আমাকে গুলি কইরেন না প্লিজ। আমি কিছু করিনাই। মা কসম সত্যিই বলছি। আমিতো বাসর ঘরে আসছিলাম ভুলে হয়তো অন্য কোথাও চলে এসেছি।আপনি হয়তো আরামে চুরি করছিলেন আমি এসে আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম। কিন্তু আমি ইচ্ছে করে করিনি। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। আপনি যা চাইবেন তাই দিবো। তবুও ছেড়ে দিন প্লিজ। আজ এতো বছর পরে আমার বিয়ে হলো। বাসর করার আগেই মরে গেলে আমার অতৃপ্ত আত্মা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াবে। প্লিজ আমার বাসর টা পুরো করতে দিন।

আমার কাকুতি মিনতির ভেতরেই কেও মেয়েলী কন্ঠে বললো।
–চুপ করুন। কিসব আবোল তাবোল বলছেন তখন থেকে। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন আর আমাকে আমার কাজ করতে দিন।

মেয়েলী কন্ঠ শুনে আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। ছোটবেলায় দাদী বলেছিল সুন্দর পুরুষ দের ওপর নাকি পরীদের নজর থাকে। তাদের কোন সুন্দর পুরুষকে পছন্দ হলে তারা নাকি সেই পুরুষকে নিজের সাথে নিয়ে চলে যায়। তাহলে কি আমার ওপরও পরীর নজর পরেছে? তাই সে আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে? হায় আল্লাহ এখন কি হবে আমার? আমাকে কেন এতো সুন্দর বানালে? আর বানালে বানালে এই পরীর নজরেই কেন ফেললে? এখন আমার বাসর করার কি হবে? কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, পরী আবার বন্দুক কই পেল? আজকাল কি পরীরাও গান ইউজ করে? করতেই পারে। আজকাল সবকিছু যখন ডিজিটাল হয়ে গেছে তাহলে পরীরা কেন পিছিয়ে থাকবে?

আমার এতসব মহান ভাবনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে আবারও মেয়েলী কন্ঠ শোনা গেল। মেয়েলী কন্ঠে কেও বললো।
–কি হলো চোখ খুলুন। আপনার স্ক্যানিং শেষ।

স্ক্যানিং? কিসের স্ক্যানিং? কৌতূহল মেটাতে চোখ দুটো ধীরে ধীরে খুলে তাকালাম। চোখ খুলে তাকাতেই আরেক দফা তব্দা খেয়ে গেলাম। হসপিটালের পিপি পরে আমার সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তার স্ক্যানিং মেশিন। হয়তো এই মেশিনই কপালে ঠেকিয়েছিল তখন। কিন্তু এই মনুষ্যটি কে? আমি কি সত্যিই ভুল কোথাও চলে এসেছি? রুমে একটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলাম। বেডের ওপর ফুলের সাজ আর দেয়ালে টানানো আমার দাঁত কেলানো ছবি দেখে বুঝলাম যে এটা আমারই রুম। তাহলে উনি কে? আর আমার বউ কই গেল? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আশায় শেষমেশ মুখ খুলে বললাম।
–জ্বি বলছিলাম যে এটাতো মনে হচ্ছে আমার বাসর ঘর। তো আপনি কে? আর আমার বউ কই?

সামনের পিপি পরা মনুষ্যটি বলে উঠলো।
–কি বলছেন এসব? আমাকে কি আপনার চোখে পরছেনা? আমিই তো আপনার বউ।

তাজ্জব বনে গেলাম এবার। চোখ চড়কগাছ করে বললাম।
–আপনি? মানে তুমি আমার বউ?

–হ্যাঁ আমিই আপনার বউ নিসা।

এবার একটু ভালো করে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত স্ক্যানিং করে বললাম।
–তো এটা কি পড়ে আছ? আজকাল কি বাসর ঘরে এসব পড়ার নতুন ট্রেন্ড চলছে নাকি?

–এমন কিছুই না। এটা সেফটির জন্য পড়েছি। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আমি একজন ডক্টর। আর একজন ডক্টরের জন্য সেফটি কামস ফাস্ট। বাকিসব পরে।

নিসার কথা হজম হতে মনে হচ্ছে চারপাঁচ টা হজমি বড়ি খেতে হবে। কিন্তু এখন হজমি কই পাবো? যাইহোক আপাতত হজমি ছাড়াই কথাগুলো গিলে নিলাম। যেহেতু এখন কনফার্ম হয়ে গেল যে এটা আমারই রুম আর বউটাও আমার তাই একটু নিশ্চিত হয়ে ভেতরের দিকে পা বাড়ালাম। তবে ভেতরে ঢুকার আগেই নিসা ছিটকে একটু সরে গিয়ে বলে উঠলো।
–এই এই কি করছেন?

–কি করছি মানে? ভেতরে আসছি। সারারাত কি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবো?

–ভেতরে ঢোকার আগে আরেকটা কাজ আছে। আপনি দাঁড়ান আমি এখুনি আসছি।
কথাটা বলেই নিসা ভেতরের দিকে চলে গেল।

আর আমি অবলা প্রাণী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, এখন আবার কি করবে নিসা? সেকি আমাকে কোন স্পেশাল ভাবে বরণ করে ভেতরে ঢোকাবে? ওয়াও, খুশিতে গদগদ হয়ে গেলাম। একটু পরেই নিসা আবার এসে বললো।
–আপনার দুই হাত বাড়ান।

আমিও গদগদ হয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাত দুটো সামনে মেলে ধরলাম। তবে আমার আশায় এক বালতি নালার পানি ঢেলে দিয়ে, নিসা আমার হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার লাগিয়ে দিয়ে বললো।
–এবার হাত ভালো করে স্যানিটাইজ করুন।

আমিও আবালের মতো তার কথা মেনে হাত ঘষে নিলাম। তারপর নিসা বললো।
–আপনার জুতো খুলে পায়েও স্যানিটাইজ করুন।

আমি তাও করলাম। অতঃপর এতসব ক্রিয়াকর্মের পর আমি ভেতরে ঢোকার পারমিশন পেলাম শেষমেশ। ভেতরে ঢুকে দরজা টা লাগিয়ে দিয়ে নিসার সামনে গিয়ে বললাম।
–এখনতো সব হয়ে গেছে। এবার তো এসব খোল। তোমার সুন্দর মুখ খানার দর্শনের সৌভাগ্য দাও।

নিসা বলে উঠলো।
–তার আগে আপনি আপনার কাপড়চোপড় খুলুন।

বাহ্ বউতো দেখছি খুব ফাস্ট। প্রথমেই মেইন পয়েন্টে চলে এসেছে। তাহলে আর আমি দেরি করবো কেন? কথাটা ভেবেই আমি আমার পাঞ্জাবি খুলতে লাগলাম। তখনই নিসা বলে উঠলো।
–আরে আরে কি করছেন ?এখানেই কেন জামাকাপড় খুলছেন?

–কেন তুমিই তো খুলতে বললে।

–আরে খুলতে বলেছি মানে ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে আসতে বলেছি। আপনার কাপড়চোপড়ে বাইরের জার্মস থাকতে পারে। তাই কাপড়চোপড় চেঞ্জ করে আসতে বলেছি।

আবারও আশাহত হলাম আমি। ডাক্তার বউ বিয়ে করার যা সাইড ইফেক্ট হয় আরকি।আগে জানলে কাশ্মিন কালেও ডাক্তার বউ বিয়ে করতাম না। কি আর করার রুপের মোহে আন্ধা হয়ে গেছিলাম। অথচ এখন পর্যন্ত সেই রুপের কানি কোনারও দর্শণ হলোনা। যাইহোক নিসার কথামতো কাপড়চোপড় নিয়ে চেঞ্জ করতে চলে গেলাম।
দশমিনিট পর আমি চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখলাম নিসা এতক্ষণে তার পিপি নামক খোলোশ টা খুলে ফেলেছে। বেডের ওপর বিয়ের শাড়ীতে ঘোমটা টেনে বসে আছে। যাক বাবা বাঁচা গেল। এবার তাহলে বউয়ের মুখদর্শন হবে।এখন শুরু হবে আসল বাসর। ইশশ মনে কেমন কাতুকুতু লাগছে।

খুশি খুশি প্রফুল্লিত মনে ধীরে ধীরে নিসার কাছে গিয়ে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে বসলাম। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে। প্রথম প্রথম বাসর করছিতো। কিন্তু আমাকে লজ্জা পেলে হবে না। আমাকে তো লজ্জা ভাঙতে হবে। বন্ধুরা বলেছে, “তুই টাইগার। আজ রাতেই শিকার করবি। যা বিজয়ী ভব। বাসর ঘরেই বিড়াল মারবি।” কিন্তু কথা হলো বিড়াল কই পাবো এখন? আমার বাসায় তো কোন বিড়ালও নেই। আর আমারতো বিড়ালে এলার্জি আছে। থাক আপাতত বিড়াল মারা স্কিপ করি। শুধু শুধু নিরাপরাধী বিড়াল কে মেরে কি হবে? সেও তো কারোর না ছেলে বা মেয়ে। তারচেয়ে বরং বউয়ের ওপর কন্সেন্ট্রেট করি। সেটাই ভালো হবে।

সবকিছু মনস্থির করে কিছু বলার উদ্দেশ্যে হা করতেই নিসা হাত দেখিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো।
–থামেন আগে মুখে মাউথ ফ্রেশনার স্প্রে করেন। আপনার মুখেও জার্মস থাকতে পারে।

এবার সত্যিই রাগ লাগছে। লাইক সিরিয়াসলি? এরচেয়ে ভালো পেট কেটে নাড়ীভুঁড়ি গুলাও বের করে ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে নেই। থাক রাগলে চলবে না। বাসর ঘর বলে কথা। তাই রাগটা আপাতত বিনা পানিতে গিলে খেয়ে ফেললাম। নিসার কথামতো মুখে মাউথ ফ্রেশনার স্প্রে করার জন্য মাউথ ফ্রেশনার টা হাত নিয়ে স্প্রে করতেই কিছু স্প্রে আমার নাকে লাগলো। আর নাকে লাগতেই কেমন হাঁচি আসতে লাগলো আমার। অতপর এক বিশাল হাঁচি মেরেই বসলাম। তবে এখানেই আরেক অঘটন ঘটলো।

আমার হাঁচি দেওয়ার সাথেই নিসা ছিটকে সরে গিয়ে গগনবিদারী এক চিল্লানী দিয়ে উঠলো।
—নাআআ আআআ

আমার পরাণ পাখি বোধহয় ফুরুত করে উড়ে যাওয়ার উপক্রম। আমি আমার বুকে হাত দিয়ে বললাম।
–আয় হায় কি হলো? এমন চিল্লাচ্ছ কেন? আমিতো এখনো কিছু করলামই না।

নিসা তখন বললো।
–আপনি কি আমাকে বাসর ঘরেই মেরে ফেলার ধান্দায় আছেন?

–কি বলো? আমি কেন তোমাকে মারবো? মাত্রই তো বিয়ে করলাম। আগে কয়েক বছর যাক তারপরে না মাথায় এসব চিন্তা ভাবনা আসবে।

–হোয়াট???

–আরে মজা করছিলাম। কিন্তু আমি তোমাকে কেন মারতে যাবো?

–তো এভাবে হাঁচি দিয়ে আমার ওপরে জার্মস ছড়াচ্ছেন কেন? আমার যদি করোনা হয়ে যায়?

লেও ঠেলা। তো এই ম্যাডাম সামান্য হাঁচির জন্য আমাকে খুনের আসামী বানিয়ে ফেললো? আমি কি এই দুনিয়ায় আছি নাকি মঙ্গলগ্রহে পৌঁছে গেছি? যাক তবুও নিজেকে টেনেটুনে পৃথিবীর বর্তমান অস্থানে নিয়ে আসলাম। আপাতত বাসর ইজ মোস্ট ইম্পরট্যান্ট। মঙ্গলগ্রহে নাহয় অন্যদিন যাবো। তাই নিসার ভয় দূর করার জন্য বললাম।
–ওকে ওকে সরি। আমি আবারও সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসি কেমন।
কথাটা বলে আমি আবার ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে এলাম।

রুমে এসে বেডের কাছে গিয়ে এবার একটু নিসার কাছাকাছি বসতে গেলেই নিসা আবারও হাত দেখিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো।
–এই এই এতো কাছে আসবেন না। দূরত্ব বজায় রেখে বসুন। সোশ্যাল ডিস্টেন্স মেইনটেইন করবেন।

এবার আমার হার্ট খানা এক্সামে জিরো পেয়ে ফেইল করলো। কি বলে এই মেয়ে? বাসর ঘরে আবার সোশ্যাল ডিস্টেন্স? লাইক সিরিয়াসলি? তাহলে আমার বাসরের কি হবে? নেহিইইইইই এটা হতে পারে না, পারে না, পারে না। বলে দাও এটা মিথ্যে।

কতো আশা আমার এই বাসর নিয়ে। এই আটাশ বছরের জীবনে কখনো কোন মেয়ের সাথে ইটিশ পিটিশ, ডেটিং, রুম ডেটিং তো দূরের কথা। জীবনে কোন মেয়ের হাতটাও কখনো ধরিনি। দাদী বলেছিল বিয়ের আগে পর নারীদের সাথে সম্পর্ক করা নাকি পাপ। তাই আমিও বাধ্য ছেলের মতো কখনো কোন মেয়ের দিকে কু নজর দেয়নি। কতো কষ্ট করে নিজের যৌবন বাঁচিয়ে রেখেছি। নিজের সব রোমাঞ্চ জমিয়ে রেখেছি নিজের বউয়ের জন্য। আজ আমার সেই ধৈর্যের সুফল পাওয়ার দিন। আর এই মেয়ে বলছে কিনা সোশ্যাল ডিস্টেন্স। খ্যাতা পুরি তোর সোশ্যাল ডিস্টেন্স এর।

আমি জোরপূর্বক হেসে বললাম।
–ইউ কিডিং?মজা করছ তাইনা?

–একদম না। আমি সিরিয়াসলি বলছি।

–দেখ তুমি আমার সাথে এতবড় না ইনসাফি করতে পারো না। তুমি চাইলে আমি চারপাঁচ টা সাবান একসাথে ঘষে গোসল করে আসবো। দরকার পড়লে স্যানিটাইজার ঢেলে খেয়ে ফেলবো। তবুও এমন অলক্ষুণে কথা বলোনা প্লিজ।

–দেখুন আমি কোন রিস্ক নিতে পারবোনা। চৌদ্দ দিন পর্যন্ত আমাদের সোশ্যাল ডিস্টেন্স মেইনটেইন করতে হবে। তারপর যদি কোনো সমস্যা না হয় তাহলে নরমাল হাসব্যান্ড ওয়াইফের মতো থাকতে পারবো।

–কিন্তু তাহলে আমাদের বাসরের কি হবে? ওটা কিভাবে হবে?

–ওটা? ওটা কোনটা?

–আরে ওইটা। যেটা করে সবাই।

–হুম বুঝতে পেরেছি। দেখুন আমরা যা করার দূর থেকেই করবো।

–যাহ কি বলো? দূর থেকে এসব হয় নাকি?

–হ্যাঁ হয়তো এইযে দেখুন এভাবে।
কথাটা বলে নিসা আমার দিকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিল।

আমি বললাম,
–এটা কেমন বাসর?

–এটা করোনা কালের বাসর। নিন আপনিও শুরু করুন।

আমি অবলা প্রাণী আর কি করতাম। নিসার কথামতো আমিও ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিলাম। ব্যাস এভাবেই হলো আমাদের করোনা কালের বাসরঘর।
যাওয়ার আগে এই অভাগার নামটা শুনে যান। আমার নাম বাপ্পারাজ। যে কিনা বাসর ঘরেও ছ্যাঁকা খায়।😩

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here