ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি,পর্ব-৭,৮

#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি,পর্ব-৭,৮
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব-৭

“তুই আমার কাছে ভীষণ প্রিয়। কারন তোকে দেওয়া মানুষটা যে আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান। তাই তোকেও ঠিক ততটাই যত্নে রাখবো যতটা আমার সেই মেয়েটিকে রাখা যায়।”

তার পরের পেইজে লেখা.

আজ একটা মিষ্টি মেয়ের গল্প বলবো তোকে। মেয়েটার প্রজাপতি খুব পছন্দের। তাই তোর নাম দিলাম প্রজাপতি। জানিস প্রজাপতি, আজ থেকে ১৩বছর পূর্বে একটি ছোট পুতুল এসেছিল এই ধরনীতে। তার ছোট ছোট কোমল হাত, তুলতুলে গাল, তুলার মতো নরম শরীর। তাকে একটি ছুলেই রক্তজবার মতো লাল হয়ে যেত। মনে হত শরীর থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। অথচ ওই ছোট পুতুলটা ছিল আমার খেলার সঙ্গিনী।

এতটুকু পড়ে থমকে যাই আমি। এটা আমাকে নিয়ে লেখা। প্রজাপতি খুবই প্রিয় আমার। আর সেই প্রজাপতি নামই রেখেছে ডায়েরির। একপলক প্রিয়কের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও পড়ায় মন দেয়।
“পুতুলটার যখন দুমাস। তখন অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করতো সে। যা কেউ বুঝত কিনা জানিনা আমি। কিন্তু আমি আমার মত করে বুঝে নিতাম। ওর একটু কান্না সহ্য হতো না আমার। খাবারের জন্য কান্না করলে পুতুলটার মাকে বারবার বিরক্ত করতাম। তার মা বলতো পুতুলটা এমনিই কান্না করছে। এরকমটা নাকি সবাই করে। তবুও স্থির থাকতে পারতাম না আমি।”

আর পড়তে পারি না আমি। ডায়েরীটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখি। বুকের মাঝটা কেমন যেন ভার ভার লাগে। যে আমাকে নিয়ে এভাবে ভাবতে পারে সে কখনই আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কিছুতেই না। কিছুটা ধাতস্থ হতেই আবারও পড়া শুরু করি। কিন্তু পরের পেইজ পড়তে নিলেই তীব্র আলোক রশ্মি চোখে পড়ে। হকচকিয়ে পাশে তাকাতেই দেখি প্রিয়ক দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি আমার হাতে যেতেই ডায়েরিটা নিয়ে নেই। কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
“এসব কি প্রিয়তা? তুই কবে থেকে অন্যের জিনিসে না বলে হাত দিতে শুরু করলি?”
প্রিয়কের এই কথায় কিছুটা নয়, অনেকটা অবাক হই আমি। তার কোনো জিনিসে হাত দিতে হলে আমাকে অনুমতি নিতে হবে তা ভাবতেই কেমন জানি লাগছে। কেন জানি চোখের কোণে জমা হয় কিছু নোনা তরল। আর তা প্রিয়কের দৃষ্টিতে ধরা দিল কিনা জানা নেই আমার। তবে সে ওই সময় আমার দিকে আর একবারও না তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। আর আমি! সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ভাবতে থাকি এরকমটা করার কারন কী? কিন্তু কোনো উত্তর পায় না। এমনিতেও এভাবে আর কতদিন! যত সময় যাচ্ছে প্রশ্নেরা তাদের ডালপালা মেলে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। আর এত এত প্রশ্নের ভীরে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। তাই বাধ্য হয়েই আমিও বের হয়ে আসি। চারপাশ নিরবতায় ছেয়ে আছে। এর মাঝে সামান্য নিঃশ্বাসের আওয়াজ ও যেন কম্পন তুলছে৷ আশপাশে দেখে বুঝতে পারলাম প্রিয়ক ছাদে গিয়েছে। আমিও উঠে যায় সেদিকে। ছাদের সিঁড়ি ঘরে প্রবেশ করতেই কিছুটা আওয়াজ করেই একটা শব্দ হলো। তাড়াতাড়ি সেদিকে যেতেই দেখলাম প্রিয়ক তার হাত মুঠো করে অনবরত দেয়ালে আঘাত করছে। ছুটে গিয়ে ভাইয়ার হাত ধরতেই আমার হাত থেকে এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে নেয়। দুহাতে আমার কাঁধ ধরে ঝাকিয়ে রাগী কন্ঠে বলে,
“এখানে কেন এসেছিস? হ্যা কেন এসেছিস?”
বলেই ছুড়ে ফেলে আমাকে। কিছুটা হেলে পড়ি আমি৷ ততক্ষণে প্রিয়ক নিজের মাথা নিজেই চেপে ধরে রেখেছে। হুট করেই অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলে,
“আমার কাছে তোর অনেক প্রশ্ন আছে, তাই না? জানতে চাস কেন করেছি আমি? ”
“হুম জানতে চাই। কেন করেছিলে সেদিন ওই করম? কেন ভাইয়া? কেন কলঙ্কিত করেছিলে আমাকে? তুমি তো জানতে আমি তোমার সাথেই ছিলাম। তাহলে মিথ্যা কেন বললে? ”
“জানিস প্রিয়তা। তোর যখন বিয়ে ঠিক হয় আমি জানতাম ও না। অথচ এই বাড়ির সব কিছুতে আমাকে রাখা হতো। ছোট বড় সবকিছুতে আমার মতামতের গুরুত্ব ছিল। অথচ সবচেয়ে বড় ব্যাপারটাই কেউ আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ পর্যন্ত করলো না। মানে তোর বিয়ের কথা হচ্ছে। এমনকি তা ফাইনাল পর্যন্ত হয়ে গেছে তবুও আমি জানতাম না। কবে জেনেছিলাম জানিস? তোর দ্বিতীয় পরীক্ষার দিন। সেদিন এখানে আসি সবাইকে আমার জবের খবর দিতে। যখন জবের কথা বললাম তখন বড় মামা কি বলেছিল জানিস? ”
আমি শুধু চুপ করে শুনে যাচ্ছি ভাইয়ার কথা। আমার কিছু বলার আগেই আবারও একটু থেমে ভাইয়া আবারও বলতে লাগল।
“বলেছিল ” এটা তো খুবই ভালো খবর। একসাথে দুই দুইটা ভালোখবর এলো তাহলে। ”
আমি অবাক হয়ে মামা কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘আরেকটা কি মামা? ‘ মামা হাসতে হাসতে বলেছিল আরে সামনেই তো প্রিয়র বিয়ে। কেন তুই জানিস না?’ বিশ্বাস কর। এ কথাটা বারবার বুকের মাঝে আঘাত করছিল। আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তোর বিয়ে! আমার প্রিয়তার বিয়ে! যে পুতুলটাকে নিজ হাতে বড় করলাম, সবসময় যাকে সামলে রাখলাম সেই পুতুলটার নাকি বিয়ে! ভাবতে পারছিস তোকে ছাড়া থাকতাম কিভাবে আমি? তুই যে আমার কাছে কি? তা আর কেউ জানুক বা না জানুক আমি তো জানি। পারতাম নারে তোকে ছাড়া থাকতে। কারন আমি যে তোকে..”
এতটুকু বলে প্রিয়ক থেমে যায়। ততক্ষণে প্রিয়কের গলা ধরে আসে। কণ্ঠস্বর আগের থেকেও ক্ষীণ হয়ে যায়। কান্না চেপে রেখেছে সেটাও বুঝতে পারছি। কেন জানি সেই মুহুর্তে প্রিয়কের উপর যত রাগ অভিমান ছিল সব হাওয়ায় মিশে যাচ্ছিল। প্রিয়ক জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্থির করে আবারও বলতে শুরু করলো,
“তবুও নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম জানিস। বুঝিয়েছিলাম আমিও তো বাইরে যাচ্ছি ২বছরের জন্য। এমনিতেও তোকে ছাড়া থাকতে হবে সেখানে। তাই সবকিছু মেনে নিয়ে তোর বিয়ের যাবতীয় কাজে সাহায্য করছিলাম। এরই মাঝে একদিন জানালো জবের জন্য তিনদিনের মধ্যে যেতে হবে। তখন মনে হলো সব ঠিক আছে কিন্তু ছেলেটার ব্যাপারে তো খোজ খবর নিলাম না। ১দিনের মধ্যে সব খোজ নিলাম। আর তারপরই জানতে পারি ছেলেটা ভালোছিল না রে। আমার প্রিয়তার যোগ্য সে ছিল না। সে তোর যোগ্য ছিল না রে প্রিয়তা। ছিল না। তারপর অনেক চেষ্ঠা করেছি বাট বিয়ে ভাঙতে পারিনি। মামাদেরকেও বলেছিলাম কেউ শোনেনি আমার কথা। আর দুদিন পরই আমার ফ্লাইট ছিল। কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তোকে আমার যাওয়ার কথা আমিই জামাতে মানা করেছিলাম। তুই ভেঙে পড়তিস তাতে। তাই বাধ্য হয়েছিলাম ওই রকম করতে। বিশ্বাস কর আমি শুধু বিয়েটা ভাঙতে চেয়েছিলাম। তোকে কলঙ্কিত করতে নয়। ”
“তাই বলে এভাবে? একটা বিয়ে ভাঙতে গিয়ে তুমি আমার জীবনটাই শেষ করে দিয়েছো ভাইয়া। আমি আর তুমি সত্যিটা জানলেও এই সমাজ প্রতিনিয়ত মিথ্যের আড়ালে থেকে আমাকে আঘাত করে গেছে। বারবার নিজের মৃত্যু কামনা করেছি আমি। ”
“চুপ কর প্রিয়তা। তোর আগে যেন আমার মৃত্যু হয়। তোকে হারালে বাঁচতে পারবো না আমি। তাই নিজের মৃত্যুর সাথে আমার মৃত্যুর জন্য ও দোয়া করিস।”

বলার মতো আর কিছু খুজে পেলাম না আমি৷ তবে বুঝতে পারলাম না আমার মনে কি চলছে? প্রিয়ক আবারও বলল,
“আবীরকে বড্ড ভালোবাসিস, তাই না?”
প্রিয়কের এই কথায় তার দিকে তাকাই আমি। সে করুন চাহনীতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি সেসময় কিছুই বলতে পারলাম না। তন্নির বলা কথাগুলো মাথায় আসে হুট করেই। এলোমেলো হয়ে যায় এতো দিনের ভালোবাসি ভেবে আসাটা। চুপ হয়ে যাই আমি। প্রিয়ক আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলল,
“পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস প্রিয়তা।”
“ক্ষমা করতে পারি এক শর্তে। যদি আমার ২টা কথা মেনে নাও। ”
“রাজি আমি। বল কি করতে হবে? ”
“বাড়ির সবাইকে সব সত্যিটা জানাবে তুমি। ”
আমার এই কথায় প্রিয়ক আমার দিকে তাকিয়ে হালকাভাবে হাসলো। সেটা কষ্টের হাসি নাকি সুখের বুঝতে পারলাম না।

“এই প্রিয়তা, এভাবে ভিজছিস কেন? জ্বর আসবে তোর। ”
কারো ভাবী কন্ঠের আওয়াজে ঘোর ভাঙে আমার। সামনে তাকিয়ে দেখি প্রিয়ক দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভিজছি কেন জিজ্ঞাসা করলেও নিজেও যে ভিজে যাচ্ছে তা হয়তো বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষণ ভেজার কারনে মাথা ভার ভার লাগে। একসময় ঢলে পড়ি আমি প্রিয়কের বুকে। প্রিয়ক আমাকে ধরে পাগলের মত করছে তাও বুঝতে পারছিলাম। পুরোপুরি জ্ঞান না হারালেও দূর্বল ছিলাম আমি। প্রিয়ক আমাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে নিয়ে আসে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাকে ডাকতে গেলে আমি হাত ধরে নেই প্রিয়কের। তার অদ্ভুত চাহনিকে অগ্রাহ্য করে তাকে বিছানায় ফেলে তার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকি আমি। নিজের শরীরের উষ্ণতা কখন যে প্রিয়কের মাঝেও ছড়িয়ে গেল তা আর বোঝা হলো না আমাদের কারোরই।

পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে চোখ মেলে তাকাই আমি৷ সকাল হয়ে গিয়েছে। উঠে বসতে নিলেই বুঝতে পারলাম কারো শক্ত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ আমি। তার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসতে নিলেই নিজের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠি আমি। কাল সন্ধ্যার পরের মুহুর্তটা ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে। এমনটা হওয়ার কি খুব দরকার ছিল। এমনটা তো না হলেও পারত। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কিছু নোনা তরল। ততক্ষণে প্রিয়ক ও উঠে যায়। আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে অস্থির হয়ে বলে,
“এই প্রিয়, কাঁদছিস কেন? খারাপ লাগছে? কি হয়েছে বল না?”
আমি বিস্মিত হয়ে চেয়ে থাকি তার পানে। এতবড় ঘটনা হওয়ার পরও কিভাবে এ কথা বলছে মানুষটা। আবারও ঘৃণা জন্ম নিতে শুরু করে। প্রিয়ক ও হয়তো ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে কেন কাঁদছি আমি। প্রিয়ক আমাকে ওর বুকের মাঝে নিয়ে বলল, এই পাগলি, কাদছিস কেন? তুই যেরকমটা ভাবছিস সেরকম কিছুই হয়নি। প্লিজ কান্না করিস না। ”
আমি সেভাবেই ফুফিয়ে বললাম,
“তাহলে এসব কি?”
“মামি চেঞ্জ করে দিয়ে গেছে। ভেজা থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়তি। এমনিতেই কাল জ্বর ছিল। তাই মামিকে ডেকেছিলাম। আমি কিচ্ছু করিনি। শান্ত হ। ”
কিছুটা শান্ত হতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম তার বাহুডোর থেকে। তবে এবার খুব লজ্জা লাগছিল। কি ভাবছিলাম আমি! তাড়াতাড়ি নেমে বাইরে চলে আসি আমি। পিছন থেকে প্রিয়কের মৃদু হাসির আওয়াজ হৃদমাঝারে আঘাত হানে।

সকালের নাশতার পর্ব একটু আগেই শেষ হয়েছে। এখন আয়োজন চলছে আর এক অতিথিদের আপ্যায়নের। আমার বড় চাচ্চুর মেয়ে রিক্তা আপু আর তার স্বামী তুহিন ভাইয়া আসছে তাদের ছোট পরী রিহিকে নিয়ে। আমরা এসেছি শুনেই তাদের আগমন। তাদের।জন্য চলছে আয়োজন। দুপুর না হতেই আগমন ঘটে তাদের। রিক্তা আপু আমাকে দেখে জরিয়ে ধরে। সেই সাথে প্রিয়ককেও। রিক্তা আপু আমার ২বছরের বড়। এক বছর আগেই বিয়ে হয়েছে আপুর। প্রিয়ক ও আপুকে ভীষণ ভালোবাসে। কোনোরুপ বিপদ আমাদের ছুতে দেয় নি। তাদের ছোট পরীটা ও হাসছে। কোনো কিছু না বুঝলেও হাসিতে মেতে থাকে। তুহিন ভাইয়া আর প্রিয়ক যেন এক নতুন সম্পর্কের বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছে। আর সেটা আমার সাথে প্রিয়কের বিয়ের কারনেই হয়েছে। কিন্তু এতো সব আনন্দ যেন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই যেমন প্রকৃতি কালো আঁধারে ঢাকা পড়তে থাকে ঠিক তেমনি কালো আঁধারে ঢেকে গেল সবকিছু। আর সবকিছুর মূলে অপরাধী একজন। সে হলো প্রিয়ক!
.
.
চলবে…???

#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব-৮
.
সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে রাতটুকুই থাকে একটু শান্তির জন্য। একটু আরামের জন্য ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায়। অথচ আজ! ঘুম নেই কারো চোখে। প্রতিটি মানুষ রাত জেগে বসে আছে। এর মাঝে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়ক। বাবা চাচ্চুরা অনেক বেশিই রেগে আছে প্রিয়কের উপর। মামনি আর ফুফাকেও ডাকা হয়েছে। এখানের সবাই নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছে। প্রিয়ক একবার দৃষ্টি তুলে আমার দিকে চাইতেই তার চোখের কোনে জল জমা দেখতে পেলাম। আমি মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছি৷ এর মাঝে হঠাৎ কান্নায় চমকে উঠে সকলে। নিরবতা ভেঙে কান্নার আওয়াজ আসতেই রিক্তা আপু সেদিকে চলে যায়। চাচ্চু তখন বলেন,
“সবাই যে যার ঘরে যাও। চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ো সকলে। বাকি কথা কাল হবে। ”
বড়চাচ্চুর এ কথার পর কারও কথা বলার সাহস হবে না। তাই সবাই চুপচাপ সে জায়গা প্রস্থান করে। সেই সাথে আমিও। আসার আগে আরো একবার প্রিয়কের দিকে তাকালাম। মানুষটা কি রাত এখানেই কাটাবে? ভাবতেই কষ্ট লগছে। আম্মু আমাকে রুমে দিয়ে নিজেও নিজের রুমে চলে যায়। বিছানায় শুয়ে থাকলেও ঘুম নামে না দুচোখে। বড্ড অস্থির লাগছে। হঠাৎ করেই খুব কান্না পেয়ে গেল। বার বার প্রিয়কের গালে পড়া বড় চাচ্চুর চড়ের আওয়াজ কানের মাঝে বাজছে। সবটা শুনার পরপরই বড় চাচ্চু খুব জোরে আঘাত করে প্রিয়ককে। যে ভাগ্নের গায়ে সামান্য ফুলের টোকা লাগতে দেয়নি কখনও। সেই ভাগ্নের গায়ে এমন আঘাত সবার জন্যই অকল্পনীয়। ভেবেছিলাম সবাই রাগ করবে প্রিয়কের উপর। কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেল।

গেইট খোলার আওয়াজে চুপ করে রইলাম। ঘুমের ভ্যান করে থাকি৷ একটুপরই বুঝত পারি প্রিয়ক এসে শুয়েছে আমার পাশে। একসময় আমাকে তার বুকের মাঝে টেনে নিয়ে শক্ত করে জরিয়ে ধরে। কেন জানি আজ নিজেকে ছাড়ানোর কোনো ইচ্চাই হলে না। চুপচাপ সেভাবেই রইলাম। প্রিয়ককে বলতে শুনলাম,
“এতো অবুঝ কেন রে তুই? কেন বুঝতে পারলি না? এখনতো ছোট না তুই। তবুও কেন বুঝছিস না।”

প্রিয়ক কাঁদছে। না দেখেও বুঝতে পারছিলাম। জানিনা কাল কি সিদ্ধান্ত নেবে সবাই মিলে। তবুও ভয় হচ্ছে। প্রিয়ক আবারও বলল,
“এত চিন্তা করিস না। যা হবে ভালোই হবে। যত যাই হোক অন্যায় তো করেছি আমি। শাস্তি তো পেতেই হবে। তাই এসব না ভেবে ঘুমিয়ে পড়।”
বলা শেষ হতেই আমার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল। আর আমি ভাবছি প্রিয়ক বুঝলো কি করে আমি ঘুমাই নি? ভাবছিলাম আমি? এসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি আমি। তবে আমার মন বলছিল সারারাতে দুচোখের পাতা এক করেনি প্রিয়ক।

পরদিন সকাল বেলা। হালকা পাতলা নাস্তা করেই সবাই বসেছে আমাদের ঘরের বারান্দায়। ফুফা আর মামনি ও এসে গিয়েছে ততক্ষণে। সবটা শুনে মামনি প্রিয়কের গালে এলোপাতাড়ি কতগুলো চড় বসালেন। প্রিয়ক একটু টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। প্রায় ঘন্টাখানেক চলল সেই বিচার। যেবিচারে ভিক্টিম হলাম আমি আর অপরাধী প্রিয়ক। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আমাদের বিয়ে ভেঙে ফেলে হবে৷ অর্থাৎ ডিভোর্স। বাবা যখন এ কথা বলছিল তখন প্রিয়ক বাবার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ছিল। হয়তো শাস্তি চেয়েছিল তবে এরকম নয়। তার সেই করুন দৃষ্টি একবার আমার দিকেও পড়েছিল। হুট করেই আমার কি হলো জানি না। সবার মাঝে বলে বসলাম,
“আমি ডিভোর্স চাই না। ”
আমার কথায় প্রিয়কের ঠোটের কোণে একচিলতে হাসি দেখেছিলাম। কিন্তু বাব আমার কথা শুনে রেগে গেলেন। রাগী গলায় আম্মিকে বললেন,
“আয়রা, তোমার মেয়েকে সামলাও। বেশি বুঝতে যেন না যায়। আমরা যা বলবো তাই করতে হবে ওকে।”

মামনি হয়তো আমার কথায় একটু ভরসা পেয়েছিল। মামনি বলল,
“দেখ ভাই, যা হয়েছে হয়েছে। মানছি ছেলেটা অনেক বড় ভুল করেছে। কিন্তু তাই বলে ডিভোর্স! ভাই একটা সম্পর্ক ভাঙা যত সহজ, গড়া কিন্তু তার থেকেও কঠিন। আর একবার ভেবে দেখ। আমি জানি আমার ছেলে কেমন। প্রিয়তার কোনো ক্ষতি হবে তা কখনই চাইবে না ও। প্রিয়তা ভালো থাকবে ওর কাছে। বিশ্বাস কর। ”
“তোর উপর বিশ্বাস আছে আমার। যেখানে তুই আছিস সেখানে প্রিয়তাকে নিয়ে একটুও চিন্তিত নয় আমি। প্রিয়ককে নিয়েও ছিলাম না। অথচ ওই আমাদের সবচেয়ে বড় আঘাতটা দিলো। সমাজের কাছে বদনাম হলাম আমরা। তারপর কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। ”

বাবার কথা শেষ হতেই মামনিও চুপ করে রইলো। হয়তো আর কোন কথা খুজে পেল না। তবে এই পুরো সময়টা প্রিয়ক নিবর ছিল৷ যেন একজন জীবন্ত লাশ দাঁড়িয়ে আছে এখানে। সবসময়ের চঞ্চল আর নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রাখা মানুষটার এমন নিস্তেজ হয়ে পড়া যেন মেনে নিতে পারছিলাম না। একছুটে নিজের রুমে চলে আসি আমি। ফোন হাতে নিয়ে তন্নিকে ফোন দেয়। তন্নি ফোন রিসিভ করতেই ওকে সবটা খুলে বলি। সব শুনে ও বলে,
“আগে নিজে শান্ত হ, প্রিয়। এরকম হুট করেই কোনো ডিসিশন নিবি না। এখন সবাই রেগে আছে প্রিয়ক ভাইয়ার উপর। এই মুহূর্তে তোর কোনো কথায় তাদের কাছে ঠিক মনে হবে না। তাই দুইটা দিন সময় দে সবাইকে সবটা বুঝে নিতে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তখন তুই তোর ডিসিশন জানাবি। বিয়ে কোনো পুতুল খেলা নয় রে প্রিয়। যে এই জুরলাম ভালো লাগলো না, ভেঙে ফেললাম। আর আমার মনে হয় তোর আগে এই ব্যাপারে প্রিয়ক ভাইয়ার সাথে কথা বলা উচিত। উনি কি চায় সেটা জানতে হবে তোকে। তারপর দুজনে মিলে ঠিক করবি কি করবি? সারাটা জীবন একসাথে থাকবি নাকি ডিভোর্স নিবি। আর আমার কি মনে হয় জানিস?”
“কি?”
“প্রিয়ক ভাইয়া তোকে ভালোবাসে। একটু বেশিই ভালোবাসে তোকে। ”
“এরকম কিছুই না। ”
“আমার মনে হওয়াটা তোকে বললাম। বাকিটা তুই বুঝে নিস।”

সূর্যের উত্তাপ কিছুটা কমে আসতেই প্রিয়ক চলে যায় এ বাড়ি থেকে। চলে যায় বললে ভুল হবে। অনেকটা বের করে দেওয়া হয়েছে। চলে যাওয়ার আগে অবশ্য একবার এসেছিল আমার কাছে। তবে কিছু বলে নি। নিরব চাহনিতে তাকিয়ে ছিল শুধু। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল বারবার। মনে হচ্ছিল সবাইকে সত্যিটা জানালেও পারতাম। কিন্তু নিজের উপর এই মিথ্যা অপবাদ যে আর সহ্য হচ্ছিল না। এক দিকে এই মিথ্যা অপবাদ থেকে মুক্তি অপট দিকে প্রিয়কের এমন অবস্থা। কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। আব্বু আর চাচ্চুরা আমাকে প্রিয়কের সাথে যেতে দেয় নি। শুধু যে তা তাও ও নয়। আব্বু এই প্রথম আমার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছিল। আব্বুর এই নত মাথা ও ছিল আমাকে অপরাধী করার আরেক কারন। সবকিছু বিরক্ত লাগছিল আমার কাছে। মামনি যাওয়ার সময় আমাকে বুকে জরিয়ে ধরে বলল,
“মারে মাফ করে দিস তোর মামনিকে। তোর এই মা টা তোর খেয়াল রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রিয়ককে তুই মাফ করবি কি না সেটা তোর ইচ্ছা। তবে ওকে মাফ করতে পারব না আমি। আজ ওর জন্য ভাইয়াদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হলো।
তোর এত বড় ক্ষতিটা হলো। ওর জন্য এতদিন এক মিথ্যা বদনাম বয়ে বেরিয়েছিস তুই। এখন আবার আরেক বদনাম জুড়বে তোর নামের সাথে। সেটাও ওরই জন্য। কখনই ক্ষমা করতে পারব না। যে জন্যই করুক না কেন এই কাজ।কাজটা ঠিক করে নি ও। আমার সাথে কথা বলতে পারত একবার। তাও করে নি। আজ ওর জন্য সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। এতকিছু হওয়ার পর কোনোভাবেই ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়। সেই সাথে প্রিয়ক তোরও যোগ্য নয়।”

কথায় আছে সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সে নিজের মত বয়ে চলে। ঠিক তেমনি আমাদের সময়ও বয়ে চলেছে নিরন্তর। প্রায় ২সপ্তাহ হতে চলল সেই ঘটনার। আমি এখন আমাদের বাড়িতেই আছি। ওবাড়িতে যাওয়া হয় নি আমার। হয়নি বলতে যেতে দেওয়া হয়নি আমাকে। কলেজে নিয়মিতই যাচ্ছি আমি। তন্নি, মুনি, হাসি, রিমন ওদেরও সাথেও দেখা হচ্ছে প্রতিটা দিন। আমাকে খুশি রাখতে ব্যস্ত থাকে ওরা। সবকিছু থাকলেও কোথাও একটা শূন্যতা অনুভব করতে থাকি আমি। প্রিয়কের সাথে এর মাঝে আর দেখা হয়নি আমার। জানিনা মানুষটা কেমন আছে? সবার কাঠিন্যরুপ ঠিক কতটা সহনীয় তার জন্য জানতে ইচ্ছা হয় খুব। তবুও কোথাও থাকা একটা কিন্তু সবকিছু আটকে দেয়। আবিরের সাথে মাঝে মাঝে কথা হলেও তেমন একটা ভালোলাগা কাজ করে না। আগে যেমানুষটার মাঝে নিজের জন্য সবসময় ভালোবাসা দেখতাম সেই মানুষটার সবকিছু সেরকম থাকলেও মনে হয় কিছুই নেই। হয়তো তন্নির কথায় ঠিক। তবে এর মাঝে আবিরের পাগলামি আগের থেকেও বেড়ে গেছে। যেদিন শুনেছে বাসার সবাই আমাদের ডিভোর্সের কথা ভাবছে সেদিন থেকে আবিরও উঠে পড়ে লেগেছে আমি যেন ডিভোর্স দেয়। ওভালোবাসে আমাকে। আমিও জানি তা৷ তবুও কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না।
আজ ক্লাস শেষ করে বাইরে আসতেই অনাকাঙ্ক্ষিত একটি মানুষকে দেখতে পেলাম। গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই দৃষ্টিতে কাউকে এক পলক দেখার তৃষ্ণা যেন। তার দৃষ্টি আমাতে পড়তেই এক পলকের জন্য তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়ে আমার। সে এগিয়ে আসে আমার দিকে। যত কাছে আসছে বুকের মাঝে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে আমার। সে কাছে আসতেই হাসি, মুনি ওরা তাকে সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে। সেই মলিন হাসি দিয়ে তার জবাব দেয়। তন্নি আমাকে কিছু কথা বলে বিদায় নেয়। ওরা চলে যেতেই মানুষটা ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমার সাথে একটু আসতে পারবি? কিছু কথা ছিল। ”
আমি নিরবে সম্মতি দিতেই সে আমার হাত ধরে সাবধানে রোড ক্রস করে গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে নিজেও উঠে পড়ে। গাড়ি চলতে থাকলে তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাই আমি। চোখ দুটো ফুলে আছে তার। চোখের নিচে কালি জমেছে। সেই সাথে চেহারাটাও মলিন। নিজের যত্ন নেওয়ার কথা হয়তো ভুলেই গেছে মানুষটা। সব সময় পরিপাটি থাকা পুরুষটা আজ একদম এলোমেলো।
“এভাবে দেখার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।”
হঠাৎ আওয়াজে চমকে উঠি আমি। তার দিকে তাকিয়ে অন্যত্র দৃষ্টি সরিয়ে নেই। কিছুটা রাগী গলায় বলি,
“দেখতেই পারছি কতটা ঠিক আছো?”
আমার কথায় হালকা হাসি ফুটে ওঠে মানুষটার গালে৷ সেই হাসি বজায় রেখেই বলল,
“বউয়ের মতো অধিকার দেখিয়ে কথা বলছিস। ভালোই লাগছে।”

বউ! আসলেই কি তাই! মানুষটার বউ আমি। আমাদের বিয়ে হয়েছে ২সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। এর মাঝে কখনই এমন ভাবে কথা বলা হয়নি। আজ তার মুখে বউ ডাকটা শুনতেই লজ্জায় লজ্জাবতী গাছের মত মিইয়ে গেলাম। আর কোন প্রতিত্তোর না করে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।
.
.
চলবে..??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here