ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি,পর্ব ৫,৬

#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি,পর্ব ৫,৬
মারিয়া মীম
পর্ব ৫

আমি তোমাকে ছাড়তে পারবো না। খুব ভালোবাসি যে তোমাকে।”

আবির আমার দুহাত ওর হাতের মাঝে নিয়ে বলল। আবিরের শেষ কথা শুনে হালকা হাসলাম আমি। সত্যি পাগল ছেলেটা। আবির আমাকে হাসতে দেখে বলল,
“হাসছো যে। হাসির কি বললাম?”
“কিছু না। এমনিতেই হাসি পেলো।”
” বাট এভাবে হেসো না গো প্রিয়। তোমার হাসিটা যে বুকে আঘাত করে। মাতোয়ারা হয়ে যাই আমি।”

আমি হালকা লজ্জা পেলাম আবিরের কথায়৷
“এতো কেন ভালোবাসো আমাকে? ”
” কোনো কারনে তো ভালোবাসি নি। ভালোবাসাটা হয়ে গিয়েছিল৷ আর সারাজীবন ভালোবেসে যেতে চাই তোমায়, প্রিয়।”

আবিরের কথায় হৃদয়মাঝে একটু কষ্ট অনূভুতি হলো। আদো কোনো ভবিষ্যত আছে কি আমাদের? হুট করেই তখন প্রিয়কের কথা মনে এলো৷ কেন করলো আমার সাথে এমন? কেনই বা আবার বিয়ে নামক সম্পর্কে জড়ালো আমাকে? এত এত কেন? অথচ উত্তর দেওয়ার মানুষটা নিশ্চুপ। কিন্তু কতদিন! আমাকে অন্যমনস্ক হয়ে থাকতে দেখে আবির হাতের তুবড়ি বাজিয়ে নিজের দিকে মনোযোগ নিয়ে এলো।
“কী, কোথায় হারালে?”
“ভাবছিলাম, আবির।”
“কী ভাবছ?”
“আগে কি হবে?
” এত চিন্তা করো না। যা হবে ভালোই হবে।”
“হুম। ”
“চলো তোমাকে ড্রপ করে দিয়ে আসি৷ ”
“তার দরকার নেই। হাসি, মুনি ওরা হয়তো অপেক্ষা করছে। ”
“ঠিক আছে সাবধানে যেও। আর নিজের খেয়াল রেখো। ভেঙে পড়ো না। বি স্ট্রং।”

আবিরের কথার বিনিময়ে হালকাভাবে হাসলাম শুধু। তারপর ওখান থেকে এসে আবার ক্যাম্পাসের সামনে আসলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। হাসি, মুনি, রিয়ন আর তন্নি অপেক্ষা করছে। আমাকে দেখেই ওরা দৌড়ে আসল আমার কাছে। হাসি মুনি আর তন্নি আমাকে জরিয়ে ধরে। রিয়ন ওদের ধমকে বলে,
“আরে ছাড় ওরে। যেমনে ধরছিস এখনি না অক্কা পায়।”
রিয়নের কথায় ওরা আমাকে ছেড়ে রিয়নকে মারতে থাকে। পাঁচ বন্ধু আমরা। আমি, মুনিয়া, হাসি, তন্নি আর রিয়ন৷ আমাদের মধ্যে সবচেয়ে চঞ্চল মুনিয়া। সবকিছুতেই ওর চঞ্চলতা বিরাজমান। নিজের নাম হাসি সে কারনেই কি জানি না, সবাইকে হাসিতে মাতিয়ে রাখে যে মেয়েটি, সে হলো হাসি। কষ্টের মাঝেও এমন কিছু বলে বসবে যা অন্যদের হাসতে বাধ্য করে। তন্নি আবার এসবের বিপরীত। সবকিছুতেই গভীর ভাবনা ওর। কোনো কিছু শুনলে বা হুট করে কিছু ঘটে গেলে তৎক্ষনাৎ কোনোরুপ প্রতিক্রিয়া দেখায় না মেয়েটা। আগে সবকিছু নিয়ে ভাববে তারপর বুঝে শুনে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। তবে ওর এই স্বভাবের জন্য বেশ কয়েকবার আমরা বাকিরা অনেক সমস্যা সহজেই সমাধান করতে পেরেছি। আর রিয়ন! আমাদের কাছে ও হলো সংগীত শিল্পী। আমাদের রকস্টার। যার গান আমরা ব্যতীত আর একটা মেয়ে শুনেছে। মেয়েটির নাম নয়না। ভারী মিষ্টি মেয়ে। মনে মনে রিয়ন নয়নাকে পছন্দ করলেও নয়না করে কিনা জানা নেই আমাদের কারোরই।
“এই প্রিয় কই হারালি?”
মুনির কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বের হয় আমি৷ মাথা নাড়িয়ে কোথাও না বুঝাতেই তন্নি বলল,
“হ্যারে প্রিয়, তার মানে সত্যি সত্যিই কি প্রিয়ক ভাইয়া আর তোর বিয়ে হয়ে গিয়েছে?”
“হুম।”
“বাট কিভাবে?”
ওদেরকে সবটা খুলে বলতেই মুনি মলিন মুখে বলল,
“তাহলে আবির ভাইয়ার কি হবে? ”
“কিছু ভাবতে পারছি না আমি। কি করবো তোরাই বল।”
“আবিরকে ভুলে যা, প্রিয়।”

তন্নির কথায় আমরা সবাই ওর দিকে তাকালাম। ও নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে আছে। আমাদের এভাবে তাকাতে দেখে বলল,
“কী এভাবে কী দেখছিস? ভুল কি বলেছি আমি?”
হাসি বলল,
“দেখ তন্নি, আমরা সবাই জানি প্রিয়ক ভাইয়া কী করেছে প্রিয়র সাথে। তারপর কিভাবে প্রিয়ক ভাইয়াকে মেনে নেবে বলতো? তার থেকে বড় কথা, প্রিয় আবিরকে ভালোবাসে। আর আবির ও।”
“সবটাই জানি আমি। কিন্তু এখন কি কিছু করার আছে? বিয়ে না হলে হয়তো কিছু করা যেত। কিন্তু এখন! আর তোর আর আবিরের ভালোবাসা! এখন যদি তুই বলিস তুই আবিরকে ভালোবাসিস তাহলে সেটা ভালোবাসা না অন্যায় হবে। বিয়ের পরে অন্য কাউকে ভালোবাসলে তাকে ভালোবাসা না, পরকীয়া বলে। ভেবে দেখিস।”
“কিন্তু ওরা তো বিয়ের আগে থেকেই ভালোবাসে একে অপরকে। প্রিয়ক ভাইয়ায় সব নষ্টের মূল। ”

মুনির কথায় তন্নি আমার দিকে দৃঢ় দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বলল,
“আবিরের প্রতি তোর অনুভূতি টা আসলেই ভালোবাসা নাকি শুধুই ভালোলাগা? ভেবে দেখিস তো প্রিয়।”

আমরা আর কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। কথা বলতে বলতে যে কখন গেইটের বাইরে এসে পড়েছি তা বুঝতে পারলাম গাড়ির হর্ণের আওয়াজে। সামনে তাকাতেই দেখলাম প্রিয়ক গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আমাদের দিকেই। সবার দৃষ্টি প্রিয়কের দিকে পড়তেই ওরা আমাকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে তন্নি আবারও বলল,
“যা বললাম ভেবে দেখিস প্রিয়। আর প্রিয়ক ভাইয়ার প্রতি, উনার ব্যবহারের প্রতি ও খেয়াল করিস। হয়তো অন্য কিছু ফিল করতে পারবি। বাই। সাবধানে যাস।”

ওরা চলে যেতেই প্রিয়ক এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে আসে। নিজেই গেট খুলে দেয়। সকালের মত এখনও কোনো কিছু না বলেই গাড়িতে উঠে বসি। প্রিয়ক গাড়ির ডোরলক করে নিজেও বসে ড্রাইভিং করতে থাকে। পুরো রাস্তায় কোনো কথা বলি না আমি। বার দুয়েক প্রিয়ক কথা বললেও আমি তার প্রতিত্তর করিনি। তাই প্রিয়ক ও আর কোনো কথা বলে নি। তবে আমার মাথায় ঘুরছে তন্নির বলা কথাগুলো। আসলেই কি আবিরের প্রতি আমার ফিলিং ভালোলাগার? সত্যিই কি ভালোবাসি না আমি আবিরকে? প্রিয়কের দিকে কি নজর দিবো? নজর দিয়ে কি পাবো? প্রিয়কের কথা ভাবতে ভাবতেই ওর দিকে একবার দৃষ্টি চলে যায়। তার চোখে আবারও কষ্ট দেখতে পেলাম। বাট কিসের জন্য? উফফ পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। এমনিতেই এত এত প্রশ্ন তার মধ্যে আবার আরেক প্রশ্ন এসে জমা হলো। এত প্রশ্নের উত্তর কোথায়!

দুপুরের সূর্যের তেজ কিছুটা কমে আসলে সবকিছু গোছগাছ করতে শুরু করি। মামনিও হেল্প করে তাতে। যদিও গোছানোর তেমন কিছুই নেই, তবুও সময় লাগছে। বিকালের পরপরই বের হবো আমরা। আমরা বলতে আমি আর প্রিয়ক। সাথে আমাদের ছোট বার্ডটা। গন্তব্য আমাদের বাড়ি। আমার মায়ের কাছে। দুদিন সেখানেই থাকবো আমরা। সবকিছু গোছগাছ করা হলে কিছুটা সময় রেস্ট নিয়ে নেই সবাই। আর পুনম! ওতো পাখির মত উড়তে ব্যস্ত। মামাবাড়ি যাবে সেই আনন্দে আত্মহারা। এর মাঝেই চারবার জামা পাল্টানো হয়ে গিয়েছে ওর। একেকবার একেক জামা পরে এসে দেখাচ্ছে আমাদের। আমরা যতই বলি সুন্দর লাগছে ততই যেন ওর কাছে সেটা খারাপ লাগছে। “নো। ইট’স লুকিং ব্যাড” বলে আবারও অন্য একটা ড্রেস নিয়ে আসছে। প্রতিবার একই কাজ করছে। তবুও যেন নেই কোনো বিরক্তি। আর ওর কান্ডে আমি আর মামনি হেঁসে যাচ্ছি। হাসির মাঝেই আমার দৃষ্টি যেয়ে আটকায় দরজার দিকে। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়ক। হুট করেই তন্নির বলা কথা মনে পড়ল। সাথে সাথেই গভীর দৃষ্টি দিয়ে তাকালাম প্রিয়কের দিকে। তার ঠোটের কোণে মৃদুু হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। আর তার দৃষ্টিতে বন্দি হয়ে আছি আমি। তবে আমাকে তাকাতে দেখে সে তার দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেয়। আমি ও আগের মত বসে থাকি। প্রিয়ক ভিতরে এসে বলল,
“হলো তোমাদের? বের হতে হবে তো। ”
“হ্যাঁ হ্যা হয়ে গিয়েছে। বাট তুই তোর এই পাজি বোনের ব্যবস্থা কর। দেখ সেই থেকে কি শুরু করেছে। ”
মামনি বলল প্রিয়কে। প্রিয়ক মামনির কথা শেষ হতেই পুনমকে কোলে তুলে নেয়। নাক টেনে বলল,
“কি হলো আমার ফ্লাওয়ারের? ”
“লুক ভাইয়া। আই আম লুকিং ব্যাড।” বলেই মুখ বানালো পুনম। পুনম ওকে টেবিলের উপর বসিয়ে বলল,
“ইউ নো? ইউ আর অ্যা ফ্লাওয়ার। আর ফ্লাওয়ার অলয়েজ লুকিং প্রীটি। ”
“ইয়েয়ে… আই ম লুকিং প্রীটি।”

বলে নেচে উঠল পুনম। প্রিয়কের দিকে ভালে করে তাকালাম আমি। তার ঠোঁটের কোণের হাসিটা আগের দিকে চওড়া হয়েছে। ভিতর থেকেই যেন হাসছে। এই হাসি মুখের মানুষটা আমার সাথে এত বড় অন্যায় করবে? ভাবতে পারছি না। না কিছুতেই করতে পারে না। খুব বড় কোন কারন আছে এমনটা করার পিছনে। যা আজই জানতে হবে আমাকে। হ্যা আজি।
.
.
চলবে..?

#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ৬

বিকালের মৃদু রোদ গায়ে মেখে এগিয়ে চলেছি আমরা। আমি, প্রিয়ক আর আমাদের ছোট বার্ডটা। পুনম আশপাশ দেখছে আর হৈ-হুল্লোড় করছে। আমার কোলেই বসেছে ও। কতবার পিছনে বসতে বললেও শোনে নি। তাই বাধ্য হয়েই বসেছি৷ আমাদের আর মামনিদের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। মামনিদের বাড়ি শহরের ভিতর পড়লেও আমাদের বাড়ি পুরো গ্রামীন পরিবেশে পড়েছে। আর দূরত্বটা মাত্র ১ঘন্টার৷ প্রযুক্তির ছোয়ায় আর আধুনিক বাংলাদেশ তৈরীর কল্যানে আমাদের গ্রামের মেঠো পথ আর এখন নেই। কাঁচা পাকা মেঠো পথের পরিবর্তে তৈরী হয়েছে কনক্রিটের পাকা রাস্তা। তবুও বছর বা ঘুরতেই রুপ নিয়েছে এবড়োখেবড়ো রোডে। আশপাশে মোটামুটি ভালো আকারেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দোকানপাট৷ ক্রেতা বিক্রেতার জমে উঠেছে সেই পরিবেশ। হুট করেই গাড়িতে ব্রেক কষতেই সামনের দিকে হেলে পড়ি৷ আঘাত পাওয়ার আগেই প্রিয়ক তার হাত দিয়ে আমাদের দুজনকে ঠেকিয়ে নেয়। নয়তো ভালোই আঘাত লাগত আমাদের। প্রিয়কের দিকে তাকাতেই দেখলাম কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এ দৃষ্টির মানে বুঝতে ব্যর্থ আমি। শুধু এখন নয়, কলেজ থেকে আশার পর থেকেই তার দৃষ্টি আমার অচেনা লাগছে৷

“নেমে এসো, প্রিয়তা।”
হঠাৎ ডাকে ঘোর কাটে আমার। প্রিয়কের কথায় আশে পাশে তাকালাম। না এখনও তো আসিনি আমরা। তাহলে এখানে কেন নামবো? প্রিয়ক আবারও নামতে বললে নেমে আসি আমি আর পুনম। প্রিয়ক পুনমকে একটা চকলেট আইসক্রিম কিনে দিয়ে হাঁটতে থাকে। একটা দোকানের সামনে এসে থামতেই সামনে তাকাই আমি। একটা ফোনের দোকান। আমাকে নিয়ে ভিতরে যেতে চাইলে বাঁধা দিয়ে গাড়িতে চলে আসি আমি। প্রিয়ক আমার দিকে নিরব দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভিতরে ঢুকে যায়। সেই সাথে পুনম ও। প্রায় ১৫মিনিট পর এসে আমার হাতে ফোন দিয়ে নিজেও গাড়িতে উঠে বসে। আর পুনমকেও বসায়। গাড়ি চলতে শুরু করে।

“প্রিয়তা’স ড্রিম” লেখা বাড়িটার সামনে নামতেই মনটা কেমন করে উঠল। মনে হচ্ছে বহুবছর পর এসেছি আমি এখানে। অথচ মাত্র আড়াই দিন হয়েছে আমার এখান থেকে যাওয়ার। তাও সেখানে যেখানে আমার রোজ আশা যাওয়া হয়। তবুও মনে হচ্ছে একটা শূন্যতা যেন পূরন হচ্ছে খুব গোপনীয় ভাবে। মা, চাচী আম্মু, ছোট চাচ্চু আর বড় চাচ্চু এগিয়ে আসে আমাদের দিকে৷ মাকে দেখেই তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ি। যেন কতদিনের অভুক্ত আমি৷ চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়ে কিছু তরল পদার্থ। মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। একসময় চাচি আম্মুও আমাকে বোঝালেন। মা বললেন,
“পাগল মেয়ে আমার, এভাবে কাঁদে নাকি কেউ?”
“ওদেরকে ভিতরে নিয়ে বসতে দাও।”

পিছন থেকে ভারী গলার আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারলাম আব্বু এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে ছেড়ে সেদিকে ফিরতেই দেখলাম আব্বু আমাদের দিকেই আসছে। আব্বু কাছে এসে প্রিয়ককে জরিয়ে নেয় নিজের হাতের মাঝে। তাতে বিন্দুমাত্র অবাক হইনি আমি৷ আমাকে যেমন ওই বাসার সবাই খুব ভালোবাসে প্রিয়ককেও তেমন এবাসার সবাই খুব ভালোবাসে৷ প্রিয়ক এর মাঝেই সবার খোঁজ খবর নিয়ে নিয়েছে। আমাদের দুজনকে আমারই রুমে পাঠিয়ে ফ্রেস হয়ে নিতে বলে। আমারই রুম! যা একসময় আমার সকল ক্লান্তি মেটানোর উৎস ছিল। কত কত স্মৃতি যে জরিয়ে আছে তা বলার বাহিরে। কত নির্ঘুম রাতের নিরব কান্নার সাক্ষী যে এই ঘর, ঘরের প্রতিটি বস্তু। ওরা যদি কথা বলতে পারত তাহলে এই মুহুর্তে প্রিয়ককে নিজেদের মাঝে আসতে দিত না। চিৎকার করে জানাতো সবাইকে। বাট আফসোস।

নিষুতি রাত। কিছু রাত জাগা পাখি ব্যতীত আর কোনো কিছুর আওয়াজ নেই। এর মাঝে খুব দূর থেকে ভেসে আসছে কিছু করুন সূর। মনে হচ্ছে কান্না করছে কেউ। সেই আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আমার। পাশ ফিরতেই দৃষ্টি যায় প্রিয়কের ঘুমন্ত মুখের দিকে। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। আজও তার বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ আমি। খুব সন্তর্পণে নিজেকে তার বাহুবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে উঠে বসি আমি। তৃষ্ণা মেটাতে টেবিলের উপর থাকা বোতল থেকে পানি খেয়ে নেয়৷ বোতলটা রাখার সময় চোখ যায় টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে একটি ডায়রী। প্রিয়কের ডাইরী। এর সাথেও জরিয়ে আছে একটি মধুর স্মৃতি। যা ভেসে উঠল চোখের পাতায়।

ডিসেম্বর মাস। ইংরেজি মাসের শেষমাস হলেও বাংলা মাসের নবম মাস। পৌষ মাস। জে এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছিল। খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। তার পুরো ক্রেডিট না গেলেও অর্ধেকের বেশি ক্রেডিট ছিল ভাইয়ার। আমাকে একস্ট্রা ভাবে এত সুন্দর আর সহজ করে সব পড়া বুঝাতো যা সহজেই বুঝতাম আমি। আর মনেও থাকতো। তাই ঠিক করেছিলাম ভাইয়াকে একটা গিফট দিবো। যেই ভাবা সেই কাজ। বাট কী দিবো? তখনই মাথায় এলো ডায়রীর কথা। ফ্রেন্ডের সাথে গিয়ে কিনেছিলাম এটা দোকানটার পাশেই ছিল ঘড়ির দোকান। একটা ঘড়ি ও কিনেছিলাম সেদিন। ভাইয়াকে তা দিতেই এতটা খুশি হয়েছিল তা বলার বাহিরে। কেঁদে ফেলেছিল ভাইয়া। সেদিনই প্রথম ভাইয়াকে কাঁদতে দেখেছিলাম আমি। আমাকে সেদিন খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরেছিল ভাইয়া।

ডায়রীটা হাতে নিয়ে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলাম আমি। খুব যত্ন করে রেখেছে ডায়রীটা। একটুখানি দাগ পড়তে দেয়নি তাতে। হুট করেই মাথায় এলো ভাইয়ার আমার সাথে করা অন্যায় গুলোর কারন লেখা নেয় তো এখানে! জানতে হবে আমাকে। যা ভাবা তাই কাজ।

বাইরের অতিরিক্ত শব্দে চোখ মেলে তাকালাম আমি। মাথাটা ভার ভার লাগছে আমার। তবুও উঠে বসলাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম বেলা অনেক হয়েছে। পাশে প্রিয়ক নেই। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেস হয়ে নিলাম। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম বাড়ির সবাই ভীষণ ব্যস্ত। মা চাচীরা রান্নাঘরে হরেক রকম খাবারের আয়োজন করায় ব্যস্ত। বাড়ির নতুন জামাই বলে কথা! জামাই! হাসি পেয়ে গেল কথাটা ভাবতেই। আমাকে একা একা হাসতে দেখে এগিয়ে এলো আমার দাদীমা। এসেই বলল,
“কিলো নাতিন, এত হাসছ ক্যান?নাতজামাইয়ের সোহাগের কতা মনে পরল নি?”
“তোমার মতন না গো বুড়ি আমি। ”
“হ্যারে বু। তোগো মদ্যে সব ঠিক আছে লো? পিয়ক কিছু কইছে নি লো?”
দাদীর আদর মাখা কন্ঠশুনেই বুঝতে পারলাম আার জন্য কতটা চিন্তিত ছিল। দাদীর কথায় এক পলকের জন্য দৃষ্টি প্রিয়কের দিকে চলে যায়। মামাদের সাথে কাজে ব্যস্ত সে। সেই সাথে ছোট বাচ্চাদের সাথে চলছে দুষ্টামি। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দাদীকে বললাম,
“সব ঠিক আছে গো, দাদীমা। তুমি এত চিন্তা কইরো না। শরীর খারাপ করবো তোমার। ”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ। ”

সকাল পেরিয়ে দুপুর ঘনিয়ে আসে। প্রকৃতি তীব্র রোদের তাপে গরম হতে থাকে। এসময় একটু শীতল বৃষ্টির ছোয়া পেতে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে প্রকৃতির কোণে কোণে থাকা ক্লান্ত শরীর। সেই ছোয়া দিতেই যেন নেমে আসে বৃষ্টির ধারা। বৃষ্টির কণা মাটিতে স্পর্শ করার আগে স্পর্শ করছে আমাকে। বৃষ্টির পানির সাথে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জলের ধারা। এমনও দিন দেখতে হবে তা জানা ছিল না আমার। কষ্টটা যে এত পরিমানে হতে পারে তা কখনই ভাবতে পারিনি। চোখের নোনা জল যেমন বৃষ্টির ফোঁটায় ধুয়ে যাচ্ছে তেমন যদি কষ্ট গুলোকেও ধুতে পারতাম! বাট আফসোস!

কাল রাতের কথা মনে পড়ল। ডায়রীর প্রথম পৃষ্টায় খুব সুন্দর করে লেখা

“তুই আমার কাছে ভীষণ প্রিয়। কারন তোকে দেওয়া মানুষটা যে আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান। তাই তোকেও ঠিক ততটাই যত্নে রাখবো যতটা আমার সেই মেয়েটিকে রাখা যায়।”

চলবে..??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here