#ওগো_প্রণয়ের_নিমন্ত্রণ🌼
#লেখিকা:-Nowshin Nishi Chowdhury
#৪র্থ_পর্ব
দুই বান্ধবী মিলে ঠিক করল আজকে দুপুরের লাঞ্চটা তারা একসঙ্গে করবে। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। মাইশার হঠাৎ ইমারজেন্সি কল আসায় তাকে আবার হসপিটালে ফেরত আসতে হয়েছে। আর লাঞ্চটাও হসপিটালে করতে হয়েছে মাইশাকে।
দুই বান্ধবী মিলে ঠিক করলো বিকেলে একসাথে কফি শপে বসবে। বেইলিরোড সংলগ্ন স্টার কফিশপে।
এখানকার কফি নাকি অথৈয়ের কাছে অসাধারণ লাগে তাই আর প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে এই কফি টেস্ট করানোর জন্য তার হাসপাতাল থেকে এতখানি দূরে তাকে টেনে নিয়ে আনছে।
সেই কথা মত বিকাল ৪ টায় সময় অথৈ এসে বসে আছে কফি শপে। অথৈয়ের এখন মনে হচ্ছে এই পৃথিবীর অন্যতম আরো একটি বিরক্তির কাজ হচ্ছে কারো জন্য অপেক্ষা করা।
সাড়ে বাজতে গেল এখনো মহারানীর খবর নেই। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে মাইশার নাম্বারে ডায়াল করল অথৈ।
দুইবার রিং হওয়ার পর ফোনটা কেটে গেল। অথৈয়ের রাগের পারদ চচ্চড় করে বেড়ে গেল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
— আসুক একবার ওই বিলেতি বিলাই। চুলের মুঠি ধরে যদি না টেনেছি। আমার নাম ও অথৈ রানী না।হুহ..
🤎
খুব দ্রুত তৈরি হচ্ছে ফালাক। ক্যারি ব্যাগ এর ভিতরে ল্যাপটপ আর প্রয়োজনীয় ফাইল ঢুকিয়ে দ্রুত চলে আসলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে। hair brush দিয়ে তার মাঝারি সাইজের ডার্ক-ব্রাউন চুলগুলো দ্রুত হাতে ব্রাশ করে নিল।
পরনের হোয়াইট শার্ট, নিচে ব্ল্যাক কালারের ডেনিম প্যান্ট। সুঠাম দেহে দারুন মানিয়েছে তাকে।হাতে ব্ল্যাক লেদার বেল্ট এর ঘড়ি। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। ব্যাস একেবারে ফরমাল লুকে তৈরি হয়ে গেল ফালাক।
বিছানার উপর থেকে অ্যাপ্রোন ও স্টাইস্টোসকোপ হাতে নিয়ে ঘাড়ে ক্যারিব্যাগটা ঝুলিয়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে আসলো ফালাক। দ্রুত পায়ে নেমে আসলো নিচে।
নিচে ড্রয়িং রুমে ফালাকের মা-বাবা পাশাপাশি বসে টিভিতে নিউজ দেখছে। অপর সোফায় দাদী বসে তাজবি গুনছে। এই মানুষটার চেহারার দিকে তাকালে তার খুব মায়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে যখন তার কার্যকলাপ গুলো মনে পড়ে তখন মায়ার বদলে রাগ লাগে তার । ভয়ংকর রাগ।
সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জুতা পরতে পরতে মাকে ডেকে বলল,
— আম্মু আমি বের হচ্ছি। আসতে দেরি হবে।
ফালাকের কণ্ঠস্বর শুনে সবাই সদর দরজার দিকে তাকিয়ে পরলো। ফালাকের মা উঠে এসে সদর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
— আজতো তোমার ছুটি ছিল বাবা। তাহলে এখন এমন হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছ?
জুতা পড়া শেষে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে দুহাতে মায়ের মুখটা ছুঁয়ে বলল,
— একজন ভিআইপি পেশেন্টের হার্ট অপারেশনের জন্য বোর্ড মিটিং আছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে অপারেশন ডেট ফিক্সড করা হবে। তার জন্যই হসপিটালে যাচ্ছি।
কথা শেষ করে মায়ের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে ফালাক বেরিয়ে গেল তার গন্তব্যে ।
🤎
দুর্ভাগ্যবশত ফালাকের গাড়িটা জ্যামে পড়েছে। মিটিং শুরু হতে আর মাত্র ১৫ মিনিট বাকি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্টেয়ারিং এর উপরে একটি চাপড় মারল ফালাক।
— যেদিন একটু দেরী হবে সেদিন চারিদিক থেকে নতুন নতুন ঝামেলা তৈরি হয়ে চলে আসবে একটার পর একটা।ধ্যাত।
পাশের সিটের রাখা ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। ডান হাতে স্টেয়ারিং ধরে বাম হাত দিয়ে ফোনটা নিয়ে সামনে ধরল। প্রফেসর শিকদার ফোন দিয়েছেন। রিসিভ করে ফোনটা পাশে সিটে রেখে কানে লাগানো এয়ারপডের সাহায্যে কথা বলতে শুরু করলো ফালাক।
— আসসালামু আলাইকুম স্যার। আমি আর দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি হসপিটালে।
অপর পাশ থেকে প্রফেসর ডাক্তার সিকদার ফালাককে বলে উঠলেন,
— তোমাকে এখন আর কষ্ট করে আসতে হবে না ফালাক। মিটিংটা আজকে পোস্টপোন্ড করা হয়েছে। পেশেন্ট পার্টি আমাকে স্পেসিফিকালি তোমার নাম মেনশন করে দিয়েছে। পেশেন্ট নিজে তোমার হাতেই অপারেশন হবে বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
তাই আমি রোগীর যাবতীয় ডকুমেন্টস তোমাকে সেন্ড করছি। তুমি চেক করে দুদিন পরে আমার সাথে দেখা করো। তারপরে না হয় সামনাসামনি কথা হবে।
ফালাক নির্বিকার উত্তর দিল,
— ওকে স্যার।
ওকে ইয়াং ম্যান। এ যেদিন তোমাকে আর হসপিটালে আসতে হবে না। তোমার জায়গায় রিয়াদকে বলবো সবকিছু সামলে নিতে। তুমি শুধু এই পেশেন্টের ডকুমেন্টস গুলো ভালোভাবে স্টাডি কর। এবং দুদিন পর এসে আমাকে খুব ভালো একটা আপডেট দাও। আই এম ওয়েট ফর ইউ।
অপারেশনটা তোমার লাইফে একটা টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে।
কথাটা কানে আসতে ফালাক ঠোঁট সামান্য প্রসারিত করে ফোনের ওপাশের মানুষটিকে বলল,
— আমি নিজে আমার লাইফের সবথেকে বড় টার্নিং পয়েন্ট স্যার।ওকে স্যার। দুদিন পরে আপনার টেবিলে সব আপডেট হাজির হয়ে যাবে। আল্লাহ হাফেজ।
কথাটা শেষ করে লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল ফালাক।
প্রফেসর ডাক্তার শিকদার ফোনটা সামনের টেবিলের উপরে রাখলেন। ফালাক তার ইন্টার্নশিপ উনার আন্ডারে কমপ্লিট করেছিল। সেই প্রথম থেকেই ফালাক বেশ পরিশ্রমী , দায়িত্ববান ও হাসিখুশি প্রাণবন্ত ছেলে।
কিন্তু বেশ কয়েক বছরের ব্যবধানে ছেলেটা ততটাই নির্জীব হয়ে গেছে। তার হাঁটাচলা কথাবার্তা কোনটার মধ্যেই আর সেই ফালাককে খুঁজে পান না প্রফেসর।
🤎
ফালাক তার গাড়ি থামালো বেইলিরোড সংলগ্ন ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের বিপরীতে অবস্থিত স্টার কফি শপ এর সামনে।
সে যখনই নিজের জন্য একটু সময় বের করতে পারে তখনই এই কফি শপ টিতে আসে। থাই গ্লাস এর পাশের টেবিলটিতে বসে বেশ সময় নিয়ে এক কাপ ব্ল্যাক কফি খায় এবং এক মনে বাহিরে তাকিয়ে থাকে ।
আজও তার ব্যতিক্রম নয় ফালাক। কফি শপের দরজা ঠেললে ভিতরে ঢুকে প্রথমে রিসিপশনে একটা কফির অর্ডার দিয়ে তার পছন্দমত টেবিলে গিয়ে বসলো সে ।
এক দৃষ্টিতে রাস্তার ওপাশে ভিকারুন্নেসা স্কুলের পাশে একটি চায়ের টং ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার পাশে একটি কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ আছে। বর্তমানে যেটার অবস্থা মৃতপ্রায়। কিন্তু ফালাকের চোখের সেটা চির সজীব ও সতেজতায় পরিপূর্ণ।
কারণ এই গাছ ফালাকের মনে কিছু পুরনো মিষ্টি স্মৃতিকে আবার নতুন উদ্যমে সজীব করে তোলে।
ঘাড় বাঁকিয়ে রাস্তার ওপর পাশে তাকিয়ে ফালাক দেখতে এখনো দেখতে পাচ্ছে,
— অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার অপর পাশে টং ঘরে ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে এক দুরন্ত কিশোরী পরনে স্কুল ড্রেস। চুলগুলো দুপাশে বিনুনি করা।
বৃষ্টিতে ভেজার জন্য বাবার হাত ঝাঁকিয়ে বায়না করছে। কিন্তু তার বাবা ছিল নাছোড়বান্দা। তাই বাবার অগোচরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে কিছুটা সামনে ঝুঁকে বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি গুলোকে মুঠোবন্দি করছিল সে।
_____
— স্যার আপনার কফি।
সম্মোহন কেটে গেল ফালাকের। সামনে তাকিয়ে দেখলো ওয়েটার তাকে কফিটা এগিয়ে দিচ্ছে। সে হাতের মধ্যে কফিটা নিয়ে চুমুক দেওয়ার আগে একটা কণ্ঠস্বর তার কানে এসে লাগলো।
” সরি রে। খুব দেরী হয়ে গেছে তাই নারে। কি করব বল । হসপিটালে এমার্জেন্সির আসার কোন টাইম টেবিল থাকেনা। হুটহাট এদিক থেকে ওদিক থেকে ইমারজেন্সি পেশেন্ট এসে পড়ে আর তাদেরকে ফেলে তো আর চলে আসা যায় না। তাই আসতে একটু দেরি হয়ে গেল তুই রাগ করিস না।
দেরি করে আসার জন্য আমার পক্ষ থেকে তোর জন্য একটা দারুন অফার আছে।
এখান থেকে কফি খেয়ে আজ দুই বান্ধবী মিলে নিজেদের ইচ্ছেমতো শপিং করব। তারপর একেবারে ডিনার সেরে বাসায় ফিরব। প্ল্যানটা কেমন? দারুণ তাই নাহ….!
— এবার তো থোরা স্মাইল ক্যার লে মেরি জান।
কথাটা বলে মাইশা অথৈয়ের গালটা টিপে দিল। তখনই মাইশার ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুলের দিকে নজর যায় ফালাকের। চমকে উঠে ফালাক। মাইশা ফালাকের দিকে পেছন ঘুরে বসার কারণে চেহারা দেখতে পাচ্ছে না সে।
কিন্তু এই আংটিটা যে বড্ড চেনা ফালাকের। এই আংটিটা যে সে তার খুব প্রিয় মানুষকে ভালোবেসে পরিয়ে দিয়েছিল তার অনামিকা আঙ্গুলে।
কথাগুলো ভাবার মাঝে সামনের টেবিল থেকে মাইশা এবং অথৈ উঠে কফি হাউজ থেকে বের হয়ে গেল তারা। ফালাক এক মুহূর্ত দেরি না করে কফি শপ থেকে বাইরে চলে আসলো। কিন্তু ততক্ষণে মেয়ে দুইটি গাড়িতে উঠে পড়েছে।ফালাক দেখে দৌড়ে যেতেই পেছন দিক থেকে কেউ তার হাত টেনে ধরল।
ফালাক একবার পেছনে ঘুরে আবার সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল গাড়িটা বেইলিরোড ক্রস করে বেরিয়ে গেল। রাগে ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিল যার ফলে উক্ত ব্যক্তি ছিটকে কিছুটা দূরে সরে গেল । নিজেকে সামলে নিয়ে ফালাকের উদ্দেশ্যে বলল,
— মরীচিকার পিছনে কেন দৌড়াচ্ছো ফালাক..?
#চলবে.…!
[ সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে যেটুকু সময় পেয়েছি লিখে গল্পটা পোস্ট করলাম। আশা করছি গল্পটা কেমন হয়েছে সবাই আমাকে জানাবেন। সবাইকে ঈদ মোবারক ☺️ ]