একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্ব: ৬৯

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৯
সুন্দরবনে প্রথম যে স্পটে ওরা নামল সেটা হলো হাড়বাড়িয়া। সবাইকে বনের ভেতর যেতে হবে একটা কাঠের ট্রেলের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে। গাছের ফাঁকফোঁকর দিয়ে সূর্যের তীর্যক রশ্মি এসে ট্রেলের উপর পড়ছে। যেন সোনালি গালিচার আস্তরণ। দলবেঁধে সূর্যের আলোর পথে ট্রেলে নেমে পড়ল সবাই। ভয়ঙ্কর সুন্দর এই সবুজের অরণ্যে যত হারিয়ে যেতে থাকল তত ম্যানগ্রোভ গাছের শ্বাসমূল, গোলপাতা, জঙ্গলজুড়ে থাকা বিচিত্র গাছপালার আধিপত্য দেখা গেল। চোখ জুড়িয়ে যায়। এখানে একটা পদ্মপুকুর আছে। পুকুরের একপাশ দিয়ে ঘুরে আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে আসতে হয়। মুবিন মনে মনে ঠিক করল রানা কিংবা নিলয় দুজনের একজনকে সে এই পুকুরে ফেলবে। যাকে সুবিধা করতে পারবে তাকেই। ইমাদ চারিদিক দেখতে দেখতে ধীরে সুস্থে এগুচ্ছিল। সাথে নিলয়। বাকিরা সবাই দলবেঁধে আছে। আর মুবিন দৌড়োচ্ছে সবার আগে আগে। সে চারিদিকে দৃষ্টি ছুড়ে ছুড়ে কেবল পশুপাখি আর প্রাণের উৎস খুঁজছে। একটু পর পর বিভিন্ন পাখি ডেকে উঠলে মুবিনও শিষ বাজায়, পাখিদের পাল্টা জবাব দেয়। কিন্তু ট্রেলের উপর দিয়ে হেঁটে ওর ঠিক পোষাচ্ছিল না। ওর মন চাইছে ট্রেল থেকে লাফিয়ে নেমে সোজা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে। ইমাদ ব্যাপারটা দূর থেকে দেখেই বুঝতে পারল। কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তা থেকে দ্রুত বড় বড় পা ফেলে সবাইকে কাটিয়ে সে মুবিনের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল সে। মুবিন তাকাল ভ্রু কুঁচকে। ইমাদ তাকাল না। মাঝে মাঝে পশুপাখিরও দেখা মিলছে। সামনে একটা ওয়াচ টাউয়ারটার। ওয়াচ টাউয়ার থেকে পুরো হাড়বাড়িয়া দেখা যাবে এক পলকে। ওয়াচ টাউয়ারের সিঁড়ি বেয়ে উপর উঠে বেশিরভাগ মানুষ ব্যাকগ্রাউন্ডে হাড়বাড়িয়ার অপার সৌন্দর্য নিয়ে ছবি তোলার প্রলোভন প্রতিহত করতে পারল না। ওরা ছবি তুলতে লাগল। মুহূর্তেই শান্ত পরিবেশটা গমগম করে উঠল। কোনো কোনো প্রেমিকযুগল ওয়াচ টাউয়ারের দেয়ালে নিজেদের নাম লিখে গেছে। নিলয় ইমাদের পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বলল, “লিখবি নাকি তুইও? কড়ি+ ইমাদ।”
কড়ির সাথে একটু কথা বলার তেষ্টাটা নিলয় যেন আরো বাড়িয়ে দিলো। ইমাদ একটু সাইডে গিয়ে মোবাইল হাতে নিলো। নাহ নেটওয়ার্কের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। ঠিক মত কল’ই যাবে না। আর কল গেলেও কড়ি যে কল রিসিভ করবে, কথা বলবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। ওদিকে সুযোগ পেয়ে মুবিন নিলয়কে প্রায় ল্যাং মেরে ফেলেই দিচ্ছিল। নিলয় পড়ে যেতে যেতে কোনোমতে রেলিং ধরে ঝুলে থাকল। সবাই নিলয়ের চিৎকার শুনে দৌড়ে গেল। মুবিন এত ভয়ানক! এত ভয়ঙ্কর! টেনে তুলল ওরা নিলয়কে৷ সবাই মিলে চেপে ধরল মুবিনকে, “এটা তুমি কি করলে?”
মুবিন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “আমি কি করলাম?”
“তুমি নিলয়কে ল্যাং মারলে?”
“না, উনি ঐ দড়িতে পা বেজে পড়লেন।” মুবিন মাটিতে গড়িয়ে পড়ে থাকা একটা দড়ির দেখিয়ে হামি তুলল। কারো কিছু বলার আছে এখানে? কি’বা বলা যেতে পারে এই বিচ্ছুটাকে? কিছুই না।
.
হাড়বাড়িয়া ঘুরা শেষ করে শিপে ফেরত চলে এল সবাই। জঙ্গলঘেরা নদীর উপর দিয়ে চলতে চলতে শিপের খোলা ছাদের ডাইনিংয়ে বসে দুপুরের খাওয়া দাওয়া হলো। পরবর্তী গন্তব্য সুন্দরবনের আরেক রূপ কটকায়। শিপ চলছে নিরন্তর গতিতে মহা সমারোহে। কেউ কেউ খাওয়া দাওয়া শেষে খানিক বিশ্রাম নেবার অভ্যাসে চলে গেল নিজ নিজ কেবিনে। রানাও উঠে কেবিনের দিকে যাচ্ছিল।
ইমাদ ডাকল, “ঘুমোবেন?”
রানা কুঁড়ি মুড়ি দিয়ে বলল, “শিপে ঘুমাতে কেমন লাগে দেখতে চাই।”
“এখন থাকেন রানা ভাই। রাতে শিপেই ঘুমাতে হবে।”
“রাতে ঘুমানোর চিন্তা থাকলে মাথা থেকে সরাও। রাতে জম্পেশ আড্ডা হবে। ঘুমাতে দিব না একটি প্রাণীকেও।”
ইমাদ মাথা নাড়ল, “আচ্ছা।”
অনেকেই ইমাদের মত পড়ন্ত বিকেল উপভোগের প্রলোভনে বসে রইল শিপের ডেকে। এক কাপ চা হাতে সুন্দরবনের নদী আর বনের সূর্যাস্ত দেখে ভুলে গেল জীবনের যান্ত্রিকতা, মন ভাঙার গল্প, বুকপকেটে থাকা অতীত এবং দূরের ভবিষ্যৎ। নদী যেন কথা বলে।
মুবিনের একটু পর পর ক্ষুধা লাগে। তার ব্যাগভর্তি নানান ড্রাইফুড। সে খায় আর পুরো শিপ মুখস্থ করছে। কোথায় কি আছে, কে কি করছে সে সব জানে। এমনকি সে এক ফাঁকে শিপের রান্নাঘর থেকেও ঘুরে চলে এসেছে। এই শিপ নিয়ে তাকে যেকোনো পরীক্ষা নিতে এলে প্রশ্নকর্তা নিজে হয়রান হয়ে যাবে। বিকেল ঢেকে সন্ধ্যা যখন ঘোমটা তুলতে লাগল মুবিন ঝপাৎ করে সুইমিংপুলে লাফ দিলো। চিত সাঁতার, প্রজাপতি সাঁতার, বুক সাঁতার কাটল ইচ্ছেমত। চোখের পাতা বন্ধ, কানে কি নৈসর্গিক শব্দ। আহা জীবন। আহা জল। মুবিন প্রশান্তি খুঁজে বেড়ায়। এই ঠান্ডা জলে, নীল গগণে, সবুজ বনে, এখানে ওখানে। কোথায় শান্তি? কোথায় একটু শান্তি?
অনেকক্ষণ পর সুইমিংপুল থেকে উঠে এসে চুপচাপ ভেজা কাপড়েই বসে ছিল ও। তারপর এক কাপ চা খেল। এখানে যখন ইচ্ছা যত ইচ্ছা, তত চা খাওয়া যায়। ও যদি চা-খোর হতো ভালোই হতো। লোকে বলে চায়ের নেশা বড় নেশা। যারা নেশা করে, ওরা যতক্ষণ না নেশা করতে পারে ততক্ষণ পাগলের মত করতে থাকে। নেশা করার পর ওরা শান্তি পায়। শান্তি! নেশা করলে যদি একটু শান্তি পাওয়া যায়। মুবিন রাতের দিকে কেমন ঢুলছিল। ইমাদ অনেকভেবে চিন্তে এগিয়ে গেল। মুবিনের কাঁধে হাত রাখল, “কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?”
মুবিন এক ঝটকায় কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে দিলো। ওর চোখ ঢুলুঢুলু।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here