#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৮
অফিস থেকে ফিরেই কাদিন বাসায় চিৎকার চেঁচামেচি শুনলো। শু খুলে শো র্যাকে জুতা রাখতে রাখতে ক্রুদ্ধ মেহেদীর তীব্র বাক্যবাণগুলো সে খুব ভালো করে খেয়াল করল। তারপর এগিয়ে গেল দীপার ঘরের দিকে। ঘরে গিয়ে বুঝল ঘটনা কি। ঘটনা দীপা মেহেদীর হেডফোন এনেছিল। সেটা ভেঙে ফেলেছে। মেহেদীর ভাষ্যমতে এই হেডফোন সে তার বন্ধুর বড় ভাইকে দিয়ে দেশের বাইরে থেকে আনিয়েছিল। কাদিন যে কথাগুলো শুনলো সেগুলো অনেকটা এরকম “যত্ন করে রাখতে না জানলে অন্যের জিনিস তুই ধরিস কেন?”
“স্যরি। আমি তোকে আরেকটা এনে দিব।”
“সেটা তো তোকে অবশ্যই কিনে দিতে হবে৷ তবে নেকস্টটাইম আর কখনো আমার কোনো জিনিসে হাত দিবিনা।”
“আমি কি জানি এটা ভেঙে যাবে?”
“তুই জানিসটা কি? তোর হাতে পরলে কোনো জিনিস থাকেনা। এর আগেও তুই নানা ঝামেলা বাধিয়েছিস। তোর মাথায় ঘিলু নেই কোনো?”
দীপা করুণ মুখ করে মেহেদীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে গেল। মেহেদী বিরক্ত হয়ে দীপার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “দূর হো। তুই একটা সমস্যা।”
কাদিন এই পর্যায়ে দরজায় দাঁড়িয়েই গমগম করে উঠল, “হোয়াট ইজ দিস, মেহেদী? আমি তো তোমাকে অন্যরকম ভাবতাম।”
মেহেদী বলল, “স্যরি ভাইয়া আপনি এসেছেন খেয়াল করিনি। আসুন ভেতরে এসে রেস্ট নিন।”
কাদিন ঘরের ভেতর গেল। মেহেদী বের হয়ে চলে আসছিল৷ কাদিন তাকে থামাল, “দাঁড়াও মেহেদি। সামান্য একটা বিষয়ে তুমি তোমার বড় বোনের সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না৷ তুমি যেসব কথা বলেছ তার জন্য তোমার এখনই উচিত তোমার আপুকে স্যরি বলা।”
“এটাই প্রথমবার না, আপু এর আগেও আমার কত কত শখের ডিভাইস নষ্ট করেছে।”
“ডিভাইসের সাথে সাথে তুমিও নষ্ট হচ্ছ নাকি?”
“শী শ্যুড বি মোউর রেসপন্সিবল।”
“এন্ড ইউ শ্যুড রেসপেক্ট হার।” কাদিন পুরো ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিলো মেহেদীকে।
দীপা বলল, “ওকে বকতে হবে না৷ ও নতুন না, একাও না। জগতের সবাই আমার সাথে এভাবেই কথা বলে। ইন্ক্লুডিং ইউ।”
মেহেদী আর কাদিন দুজনেই যেন বিদ্যুৎপৃষ্ট হলো। মেহেদীর ভাই সত্ত্বা কোথাও হতে বলে উঠল, “আমার বোনের সাথে এভাবে কথা বলে কাদিন ভাইয়া! ইটস আ মেন্টাল টর্চার।”
কাদিনের স্বামীর সত্ত্বা তো আগেই লড়ছিল দীপার ভাইয়ের সাথে। জগতে আমরা কেবল অন্যের ভুল ধরি৷ ঘরজুড়ে পিনপতন নীরবতা। বাজ পরা মুহূর্তটা কেটে উঠতেই মেহেদী মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
পশুর নদীর জলে সাঁতার কেটে শিপ এগুচ্ছে সুন্দরবনের দিকে। কিছুক্ষণের মাঝে চারিদিকে সবুজের ছোঁয়া লাগল। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল অরণ্যের সবুজ গাছ গাছালি। সুন্দরবন সবুজ আর পশু, পাখির প্রাকৃতিক প্রাসাদ। এখানে সিংহ রাজা নয়৷ রাজা ডোরাকাটা হলুদ রাজকীয় পোশাক পরিহিত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। এখানে রহস্য, রোমাঞ্চ, অপার সৌন্দর্য্য যেমন আছে, তেমনি আছে ভয়, অশনি সংকেত, হুমকি,হিংস্রতা। প্রাকৃতিক সবুজ প্রাসাদের সর্বত্র বিচরণ জনসাধারণের জন্য নয়। জনসাধারণ কেবল বনবিভাগ থেকে অনুপ্রাপ্ত গুটি কয়েক অংশে পা রাখতে পারবে। হাড়বাড়িয়া, করমজল, দুবলারচর, কচিখালি, কটকা, হিরণস্পট এই কয়টি স্থান ছাড়া প্রাসাদের বাকি অংশ বিপজ্জনক এবং নিষিদ্ধ। ঘণ্টা দুয়েক চলার পর শিপটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে নোঙর করল। ইমাদ জাহাজ থেকে নামার আগে মুবিন নেমেছে কিনা চোখ বুলিয়ে নিলো। শিপ ছাড়ার পর থেকে আর কেবিনে বসেনি। পুরো শিপ জুড়ে টৈ টৈ করেছে। ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে সবাইকে ট্যুর গাইড স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলো কোন স্পটে কতক্ষণ থাকবে, কোথায় কি করবে, কি করা যাবে, কি করা যাবে না। মুবিন খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল। কিন্তু ইমাদ সহ বাকি সবাই সুনিশ্চিত ট্যুর গাইড এখানে যা যা বলছে মুবিন ঠিক তার উল্টো কাজগুলোই করবে।
.
অভ্র! প্রতিদিন কলম নিয়ে আসতে ভুলে যাওয়া ছেলেটি, পদার্থবিজ্ঞানের প্রাইভেটে কিচ্ছু না বুঝা ছেলেটি, প্রাইভেট শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগে এসে, ছাদের কোণে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল চালাতে থাকা ছেলেটি ঝা করে মডেল টেস্টে ফার্স্ট হয়ে গেল। রেজাল্ট শুনে মিলার মাথা ভনভন করে উঠল। এটা কীভাবে সম্ভব? সে তার হা হয়ে যাওয়া মুখ কিছুতেই বন্ধ করতে পারছিল না৷ সে অনেকক্ষণ নীচু হয়ে বেঞ্চে মাথা দিয়ে রাখল। বিড়বিড় করে বারবার নিজের মনে আওড়াতে লাগল, অভ্র ফার্স্ট! আমি সেকেন্ড! সেদিন ফিজিক্স টিচার কি পরাল মিলা কিছু বুঝল না। কিছু শুনল না৷ কোনোমতেই, মনোযোগ ধরে রাখতে পারল না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগল৷ কখন সময় শেষ হবে? কখন ছুটি হবে? শেষ পর্যন্ত ছুটি হলো। মিলা একটা ঘোরের মধ্য দিয়েই বেরুচ্ছিল। গেটের সামনে অভ্র দাঁড়িয়ে৷ মিলাকে দেখে এগিয়ে এল, “রোদমিলা, থ্যাঙ্ক ইউ। কতগুলো টপিক আমি তোমার কাছ থেকে বুঝেছি। স্যারের চাইতে আমি তোমার কাছে ভালো বুঝি। তুমি বড় হয়ে টিচার হবে।”
মিলা ফ্যাকাসে চেহারা নিয়ে বলল, “মাই প্লেজার।”
অভ্র বলল, “কংগ্রেচুলেশন্স তোমাকেও।”
মিলা যন্ত্রের মত বলল, “হুম থ্যাঙ্কস। আমি যাই।”
অভ্র আবার পিছু বলল, “আমাকে তাড়িতচুম্বকের অংক গুলো একদিন বুঝিয়ে দিবে?”
মিলা ছোট করে বলল, “দেখি।”
তারপর খুব তাড়াহুড়া করে একটা রিকশা ডেকে চলে গেল। সারাদিন সে এই ভেবে বিরক্ত হয়ে রইল যে, এটা কীভাবে হলো! এটা কি হলো!
চলবে…