একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ৩৪

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৪
কুমিল্লা শহরে থাকবার জন্য ভালো মানের হোটেল পাওয়া খুবই দুষ্কর। যেগুলো আছে তাদের মাঝে হোটেল কিউ প্যালেসটাকেই মিশেল মোটামুটি পছন্দ করল। মঈন সেখানেই মিশেলের থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়ে বলল, “কিছু খেয়ে নিও। প্লিজ। আমাকে বাসায় যেতে হবে।”
এই বলে বেরিয়ে এল সে। তারপর থেকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। রাত থেকে শুরু করে সকাল, সকাল থেকে দুপুর অবধি সিগারেটের প্যাকেট কটা শেষ করেছে এখন আর মনে করতে পারছে না। কিছু একটা খেতে হবে। কাল সন্ধ্যার পর থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। পেট এর ভেতর গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মঈন একটা রিকশা ডেকে কান্দিরপাড় চলে এল। সিটি মার্কেট এর ২য় তলায় ক্যাফে এভেনজার্স এর বাইরে চেয়ার টেনে বসল সে। ভেতর থেকে ওয়েটার এসে বলল, “স্যার, ভেতরে টেবিল খালি আছে।”
মঈন বলল, “লাগবে না। মেন্যুটা দিয়ে যান।”
মঈন মেন্যু দেখে খাবার অর্ডার দিলো। ওয়েটার বলল, “স্যার বিশ, ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।”
মঈন পায়ের উপর কনুইয়ের ভর রেখে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। ক্লান্তি ওর শরীর বেয়ে উপচে পড়ছল। শিল্পীকে চূড়ান্ত কষ্ট দিতেই তো সে চেয়েছিল। এখন তা দেওয়া হয়ে গেল, কিন্তু বিপরীতে সে নিজে কি পাচ্ছে? উত্তর হলো যন্ত্রণা। তবুও শিল্পীর এ কষ্ট প্রাপ্য ছিল। বন্ধু ভেবেছিল শিল্পীকে। শিল্পী তার এই বন্ধুত্বের, ভরসার সুযোগ নিয়েছে। জোহরাকে এক পলক দেখবার জন্য সে যখন হলের সামনে চড়কির মত ঘুরঘুর করত তখন শিল্পী একদিন ওকে দেখে ভরসার হাসি হেসেছিল। মঈন ধরে নিয়েছিল শিল্পী মঈনের বিষয়টা ধরতে পেরেছে। যে ওকে বুঝে তার সাথে বন্ধু্ত্ব করতেই হয়। এজন্যেই মঈন এগিয়ে গিয়েছিল। তারপর কখন যে দুজন এত বেশি ভালো বন্ধু হয়ে গেল, টেরই পেল না সে। প্রয়োজনে তো লোকে বন্ধুর কাছেই যায়। সেও গিয়েছিল, আর অবশেষে বন্ধু কি করল? প্রতারণা!
খাবার এসে পড়েছে। ওয়েটার আবার জিজ্ঞাসা করল, “স্যার আপনি চাইলে কিন্তু ভেতরে আসতেই পারতেন।”
“চাইছি না।”
ওয়েটার খাবার পরিবেশন করে চলে গেল। মঈন চামচ তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে রেলিং এর নীচে তাকাল। নীচে তাকিয়ে রিকশার সুন্দর জ্যাম, আর ব্যস্ত মানুষ দেখতে দেখতে সে খাবার মুখে তুলল। অনেকের কাছে মনে হতে পারে জ্যাম আবার সুন্দর কি করে হয়? ঢাকা ছাড়া পৃথিবীর সব জ্যামই মার্জিত এবং সুন্দর জ্যাম। মঈন অবজ্ঞার হাসি হাসল! এখন আবার তাকে বলে সে নাকি ওকে ব্যবহার করেছিল! কক্ষণো না। শুধু ভরসা করেছিল! ভরসা করতে করতে নিজেকে পর্যন্ত তুলে দিলো। ভুল করেছিল। ভাগ্যিস জোহরার সাথে দেখা’টা হলো! আবার কখনো কখনো মনে হয় দেখা না হলেই ভালো হতো। শিল্পীকে এই কষ্টগুলো পেতে হতো না। ওদের সংসারটা এভাবে শেষ হয়ে যেত না। বাচ্চাগুলোরও এই দুর্দশা হতো না। সত্যি বলতে শিল্পীকে কষ্ট দিতে গিয়ে সে আনন্দের চাইতে বেশি বেদনা’ই কুড়ায়। কিন্তু এখানে মূখ্য বিষয়টি হলো শিল্পীকে কত বেশি কষ্ট ফিরিয়ে দেয়া যায়, এটি করতে গিয়ে ওকে কতটা যন্ত্রণা পেতে হয়, কি কি খোয়াতে হয় তা ধর্তব্য নয়। মঈন হাতের গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে না রাখতেই মিলার কলটা এলো। মঈনের লজ্জায় কলটা ধরতে ইচ্ছে করছে না। বাচ্চাদের সামনে কি করে মুখ দেখাবে সে এখন? ওদের বাবার এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার চলছে। এতদিন আকারে ইঙ্গিতে ওদের মা ওদের যা বলছিল, ওরা যা বিশ্বাস করতে চাইছিল না তাই ওদের সামনে খোলাশা হয়ে গেল। প্রমাণ হয়ে গেল। মিলা কেন কল করছে? কলটা ধরলেই হয়তো বলে বসবে, “বাবা আমরা তোমাকে অনেক ঘৃণা করি।” এরকম কিছু বলতেই কি কল করছে? কলটা বেজে নিজে নিজেই কেটে গেল। সবকিছুর’ই একটা সময় থাকে। সময় ফুরালে সবকিছু এমন করেই ফুরিয়ে হয়ে যায়। এই যে সে এখন যা ভাবছে তা ভাবা পুরোপুরি অনর্থক। বাচ্চাদের কথা তো ওর আরো আগে ভাবা উচিত ছিল। মঈন মোবাইলটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। মিলা আবারো কল করল। এইবার মঈনের মনে হলো মিলা খুবই লক্ষী মেয়ে। ও কখনো এমন কিছু বলবে না। বললে মুবিন বলতে পারে। মুবিনের খুব রাগ, জেদও বেশি। একদম ওরই মতন। মিলা যেহেতু কল করছে অবশ্যই জরুরি কিছু। শিল্পী? শিল্পী ঠিক আছে তো? কিছু করেটরে বসেনি তো? কথাটা মনে হতেই দ্রুত টেবিল ছেড়ে ক্যাফের ভেতর গিয়ে বিল মেটাল। তারপর ব্যস্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মিলাকে কলব্যাক করল, “বলো, মিলা।”
মিলা কিছু বলছিল না। মোবাইলের ওপাশে শুধু কান্নার শব্দ। মঈন একটা রিকশায়য় উঠে রিকশাওয়ালাকে আঙুল দিয়ে পথ দেখাল। এখন কথা বলার মত সময় তার নেই। রিকশাওয়ালা বলল, “আমি ঐদিকে যামু না।”
মঈন ক্ষেপে গিয়ে বলল, “আরে মিয়া যাও তো।”
রিকশা ওয়ালা বিড়বিড় করতে করতে রিকশা টান দিয়ে বলল, “এই দুনিয়াত গজব পড়ত না তো কোন দুনিয়াত পড়ব? বড়লোকের বাহাদুরি আল্লাহ ছুটাইব।”
মঈন এসবে কান না দিয়ে মোবাইলে আবারো বলল, “কি হয়েছে, মা? এভাবে কাঁদছ কেন?”
“আমার জন্য সব হয়েছে।”
“কি হয়েছে? তোমার মা ঠিক আছে?”
“হু।”
মঈন একটু ইতঃস্তত করে বলল, “কি করছে ও? তোমাদের কি খুব মেরেছে?”
“না, মা ঘুমাচ্ছেন।”
“তাহলে?”
মিলা এক মুহূর্ত একটু থামল। থেমে বলল, “বাবা, মুবিন চলে গেছে।”
“চলে গেছে মানে?”
“ওকে রাগ করে উল্টাপাল্টা কথা বলেছিলাম। তাই ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে জানি না। চিঠি দিয়ে গেছে।”
“কখন গিয়েছে?” মঈন মুহূর্তেই ঘেমে গেল।
“জানি না। তবে সকালে টের পেয়েছি।”
“সকালে টের পেয়েছ আর তুমি এখন বলছ আমাকে? এতক্ষণে?” মঈন ধমকে উঠল।
মিলা চোখ মুছে কিছু বলতে চাইছিল। তার আগেই মঈন বলে উঠল, “তোমার মাকে কেন বলোনি?”
“বলেছি, সকালেই বলেছি।”
“মুবিনের খোঁজে এখনও বের হয়নি?”
“না।”
“কি বলল?”
মা বলেছিলেন, “শুনেছি তোমাদের বাবাও নাকি এই বয়সে একবার বাড়ি ছেড়ে সুনামগঞ্জ পালিয়ে গিয়েছিল। সময়মতো আবার ফিরেও এসেছে। তোমার ভাই তো আর ভালো হয়নি। হয়েছে বাপটার মতই বদমাইশ। সেও আমাকে জ্বালিয়ে অঙ্গার করার কোনো পথ’ই আর বাকি রাখবে না। এখন যাও সামনে থেকে যাও। সারারাত ঘুমাইনি, ঘুমাতে দাও।”
মিলা বুঝে মার মাথা এখন ঠিক নেই। আর সে খুব ভালো করেই জানে কতটুকু বলতে হতো, তাই বলল, “শুনে মায়ের শরীর খারাপ হয়ে গেছে। তাই জোর করে ঘুম পারিয়েছি।”
মঈনের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। সে কঠিন গলায় বলল,
“আমার ছেলে সকাল থেকে বাসায় নেই, আর সে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে? পৃথিবীতে অনেক জঘন্য মহিলা দেখেছি, কিন্তু তোমার মায়ের মতন আর একটি জঘন্য মহিলা কখনো আমার চোখে পড়েনি।”
.
অপেক্ষা করা হচ্ছে ইমাদের জন্য। অপেক্ষা’টা করছে কড়ি। অপেক্ষা করবার স্থান ধর্মসাগর পাড়। সে বসে আছে ধর্মসাগর পাড় জুড়ে থাকা কৃত্রিম দীর্ঘ আসনে। যে আসন পুরো দীঘিটাকে আগলে রেখেছে নিজের গহীনে, বুকের ঠিক ভেতরে।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here