#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৩
মিলা আতঙ্কে নীল হয়ে বলল, “মা, মুবিন চলে গেছে।”
শিল্পী হাঁটু থেকে চিবুক তুলল, “বস।”
মিলা কিছু বুঝতে না পেরে বলল, “কি?”
শিল্পী মেঝেতে পাশে হাত রেখে ইশারায় জায়গা দেখিয়ে দিলো। মিলা কান্না রোধ করে অস্থির হয়ে বলল, “মা, মুবিনের চিঠি…।”
শিল্পী বলল, “কি লিখেছে?”
“ও চলে গেছে, মা। সব দোষ আমার। আমি কেন ওকে এগুলো বলতে গিয়েছিলাম!” মিলা কপালে হাত রাখল। সারা শরীর দরদর করে ঘামচে ওর। হাত কাঁপছে।
শিল্পী বলল, “বাপ চলে গেছে, ছেলেও যাক।”
মিলা এবার কেঁদে ফেলল, “মা এমন কেন করছো?”
“তুইও কি চলে যাবি? আচ্ছা তাহলে যা, যা।” শিল্পী হাত দিয়ে চলে যাওয়ার ইশারা করতে করতে বলল।
মিলা বলল, “এসব কি বলছ, মা?”
“আমি তোদের সব বলতে চাই। সব শুনে মনে হয় না আমার কাছে আর থাকবি। আগে চলে গেছে ভালোই হয়েছে।”
মিলা হাঁটু মুড়ে বসে মাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল কিন্তু ওর হাত দুটো ওর কোলের উপরই পরে রইল। চাওয়া এবং অপারগতার দোটানা বোধহয় একেই বলে। শিল্পী টলতে টলতে মেঝে থেকে উঠে বিছানায় কাত হয়ে শুলো। মিলা ঘাড় তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। শিল্পীর মুখ দেয়ালের দিকে ফেরানো, মিলার দিকে পিঠ দেয়া। সে বলল, “আমার দিকে তাকাস না তো।”
মিলা বিছানায় হেলান দিয়ে দু হাঁটু একসাথে জড়ো করে ঘুরে বসল। শিল্পী বলতে শুরু করল,
আমি আর মঈন তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। একই বিষয়, একই ব্যাচ। ওকে চিনতাম কিন্তু কখনো কথা হতো না। এক রাতে খেয়াল করলাম ও আমার হলের বাইরে বসে আছে এবং প্রতি রাতেই নির্দিষ্ট একটা সময় জুড়ে বসে থাকে। আমি হলের ছাদ থেকে প্রায়ই ওকে দেখতাম। বুকের মধ্যে যে কেমন করে উঠত তখন! কিন্তু কোনোদিন সাহস করে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি যে, কি চাও? কেন বসে থাকো এখানে? শুধু আমিও পড়া ফেলে ঐ সময়টায় ছাদে হাঁটাহাঁটি করতাম। হলের সামনের পাহাড় দেখার ভান করতে করতে আসলে পাহাড়ের নীচে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা ইটের আসনে বসে থাকা মঈনকে দেখতাম। এর বেশি কিছু করার মত খুঁজে পাইনি তখন। পরে একদিন ছাদ থেকেই আমাদের চোখাচোখি হয়ে গেল। শ্বাস রুদ্ধ করে জমে গেল সে। মাথা চুলকাতে চুলকাতে হাসবার চেষ্টা করল। কি যে নার্ভাস ছিল! আমি ওর নার্ভাসনেস কাটাতে আমার হাসি ছুঁড়ে দিলাম। পরদিন থেকেই আমাদের কথা শুরু হয়ে গেল। আমরা একসাথে প্রচুর ঘুরাঘুরি করতাম। আমার এখনও মনে আছে আমি তখন চোখ মারতে জানতাম না। একদিন ওকে বললাম, “মঈন?”
“আমাকে চোখ মারা শেখাবে?”
ও হাসতে হাসতে বলল, “শেখালে কি দেবে?”
আমি ওর মুখ থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম, “কি চাও তুমি? আমার কাছে কি চাও?”
ও নীচের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “সময় এলে বলি?”
আমি শ্বাস বন্ধ করে জানতে চাই, “সময় বলতে তুমি কি বুঝো, বন্ধু?”
ও আকাশের দিকে মুখ তুলে রোদকে আরাম দিতে দিতে বলে,
“সময় হলো আমাকে গ্র্যাজুয়েট করার মন্ত্র, সময় হলো আমার চাকুরীর জাদু।”
আমি হাসি, মিটিমিটি, লজ্জায় লাল হওয়া হাসি। তারপর মঈন আর আমি চবির ২১০০ একর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াই। পাহাড়ি এবং সমতল ভূমিগুলোকে স্বাক্ষী রেখে নিজেদের রঙীন দিনগুলোর স্বপ্ন বুনতে বুনতে এগিয়ে চলি। তারপর একদিন সময় আসার আগেই সময় ফুরিয়ে যায়। মঈন এক বিকেলে হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে ছুটে আসে। ওর কপাল চুইয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছিল। কিন্তু আমার হাতে ও যখন চিঠিটা গুঁজে দিলো তখন ওর ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া আমাকে থমকে দিয়েছিল। ও কোনোমতে বলল, “শিল্পী, তোমার দায়িত্ব। জোহরাকে চিঠিটা যে করে হোক পৌঁছে দিও। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে।”
মিলা চমকে উঠে প্রশ্ন করল, “জোহরা কে?”
শিল্পী সোজা হয়ে শুয়ে হাত দিয়ে কপাল ঢাকল। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার রুমমেট। জুনিয়র ছিল। আমার বড় আদরের। আপু আপু ডেকে জান দিয়ে দিতো। আমার পরীক্ষা থাকলে নিজে চা করে এনে দিয়ে বলত, চা খাও, আপু। ঘুম আসবে না।”
ও অসুস্থ হলে আমি ওর সব কাপড়চোপড় ধুয়ে দিতাম। বেশিরভাগ সময় আমরা একসাথেই খেতাম। হলের খাবার খাওয়ার মত ছিল না। তাই নিজেরা রেঁধে খেতাম। ও রাঁধলে আমাকে আর রাঁধতে দিতো না। আমি রান্না করলেও ওকে সাথে নিয়ে খেতাম। যেখানে ঘুরতে যেতাম সাথে করে নিয়ে যেতাম। মঈন আর আমি ক্লাসের পর যখনই একসাথে হতাম সাথে জোহরাও থাকত। জোহরা ছিল বাড়ি থেকে দূরে থাকা আমার একমাত্র আপনজন, সঙ্গী। ওকে ফেলে কোথাও যাওয়া হতো না।”
মিলা ঘাড় নীচু করে বলল, “বাবা কি উনাকে আগে থেকেই চিনতেন?”
শিল্পী কষ্টের হাসি হাসল। বলল, “ওর জন্যই হলের বাইরে বসে থাকত। ওর জন্যই আমার সাথে বন্ধুত্ব করেছিল।”
“পরে?”
“আমি চিঠিটা পড়ে হলের বাথরুমে মুখ চেপে ধরে বসে পাগলের মত কাঁদি। আমার কান্না থামেনা, কোনোমতেই না। মানতে পারছিলাম না। আমি শুধু ওর বন্ধু। না বন্ধুও না, আমি শুধু তোমাদের বাবার জন্যে ছিলাম তার ভালোবাসার মানুষের রুমমেট, বড় আপু। কাঁদতে কাঁদতে মানসিকভাবে আমি শেষ হয়ে যাই। যতদিনে নিজেকে সামলাই, সামলে চিঠিটা নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে যাই, জোহরার বাসায়, ততদিনে তিনবার সূর্য ডুবে গেছে।”
মিলা উঠে এসে বিছানায় বসল, মায়ের কাছে। জড়িয়ে ধরল মাকে। শিল্পী মেয়ের বুকে ঢলে পড়ল। তার শ্বাস প্রশ্বাসও বড় ক্লান্ত। খুব আস্তে আস্তে সে বলল, “গিয়ে শুনি জোহরার আকদ হয়ে গেছে।”
মিলা মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কি লেখা ছিল, চিঠিতে?”
“বলতে ইচ্ছে করছে না তবুও বলছি। জোহরার প্রতি ভালোবাসার কথা লেখা ছিল। আর লেখাছিল ও ভেবেছিল চাকুরী পেয়ে যোগ্য হয়ে জোহরা সামনে দাঁড়াবে। জোহরা অনেক বড় ঘরের মেয়ে। সে তুলনায় মঈনের কিচ্ছু নেই। তাই না শোনার ভয়ে কখনো কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু যখন শুনলো বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে তখন নিজের অক্ষমতা, অযোগ্যাতা এসব নিয়ে পড়ে থাকবার কথা কল্পনাও করতে পারেনি।”
মিলা চুপ করে রইল। ওর মাথায় হাজারটা প্রশ্ন এলোমেলোভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর মনে হলো এই মুহূর্তে মুবিন যদি পাশে থাকত তাহলে এসব শোনা এতটা কঠিন মনে হতো না। মিলা চোখ বন্ধ করে মনে মনে মুবিনকে ডাকল, “মুবিন কোথায় তুই? মুবিন? আমি একা কেন এসব শুনব? তোকেও শুনতে হবে। মুবিন?”
মিলার মনে হলো মা কিছু একটা বললেন। সে চোখ মেলল। শিল্পী বলল, “বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছে করে করিনি। আমি ইচ্ছে করে করিনি।” শিল্পীর গলা ভেঙে এল। চোখের পাতা ভারি হয়ে এল কিন্তু সে কাঁদল না। মিলার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে সোজা হয়ে বসল। আরো বলল, “অনুশোচনায় নিজেকে তোদের বাবার কাছ থেকে পুরোপুরি দূরে সরিয়ে ফেললাম। কোনোমতে, শুধু এইটুকু বলতে পেরেছিলাম যে, “আমাকে ক্ষমা করে দিও। জোহরার বিয়ে হয়ে গেছে।”
শিল্পী আবারো চুপ। খানিক বাদে নিজেই আবার ভারি নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, “কিন্তু বেশিদিন দূরে সরে থাকতে আমি পারিনি। ও ক্লাসে আসা ছেড়ে দিয়েছিল এমনকি পরীক্ষা পর্যন্ত দেয়নি। খোঁজ নিয়ে দেখলাম ও হল ছেড়ে বাড়ি চলে গেছে। আমি নিজেকে আর আটকে রাখতে পারিনি। ওর এক বন্ধুর কাছ থেকে ওর বাড়ির ঠিকানা যোগাঢ় করে পরীক্ষা শেষে একা, একটা মেয়ে অচেনা এক গ্রামে চলে গেলাম ওর খোঁজ করতে করতে। ওর বাড়ি গিয়ে ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আবার ফিরিয়ে আনলাম। আমি এখনও তোদের মরহুম দাদীর আমার হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়া ভুলতে পারিনি। ওর ঐ কঠিন সময়টায় কি করে আমি ওর পাশে না থাকি? আর আমার জন্যই তো তার ওরকম অবস্থা হয়েছিল।”
মিলা আচমকা বলে উঠল, “তোমার কোনো দোষ নেই, মা।”
শিল্পী মেয়ের কথায় কান না দিয়ে বলল, “তোর বাবার পাশে থাকতে থাকতে, ওকে সামলাতে গিয়ে একসময় আমরা সত্যিকার বন্ধু হয়ে উঠি। মঈন একসময় জোহরার জন্য আমার বন্ধু হয়েছিল। পরে সে নিজের জন্যই আমাকে বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছিল। আমি সবসময় ওর প্রতি নিজের অনুভূতিগুলো চেপে রাখার চেষ্টা করেছি। কখনো প্রকাশ করতে চাইনি। কতটুকু পেরেছিলাম তোদের বাবাই ভালো বলতে পারবেন।”
মিলা প্রশ্ন করল, “তোমাদের বিয়েটা কি দাদী দিয়েছিলেন?”
“নাহ, ও নিজেই আমাকে চেয়েছিল। বলেছিল বন্ধুকে আজীবন পাশে চাই। পাশে পেতে যা যা করতে হবে সব করতে চাই।” হঠাৎ করে কান্নার দলায় শিল্পীর কণ্ঠ রোধ হয়ে এল। কান্নায় দমবন্ধ হলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, “আমি মনে করি এইটুকুই আমার দোষ ছিল। লোভী হয়ে উঠেছিলাম। আমি ওকে না করতে পারিনি।”
মিলার গলা ব্যাথা করছিল। ঢোক গিলে ও ভেজা কণ্ঠে শুধু বলতে পারল, “কেঁদো না, মা। প্লিজ কেঁদো না।”
শিল্পী যেন কান্নায় আরো ডুবে গেল। দু’পা একসাথে জড়ো করে দুলতে দুলতে কাঁদল, গুনগুন করতে করতে কাঁদল। মিলা শুধু অসহায়ের মত তাকিয়ে রইল। একটু পর বলল, “পানি দিব, মা?”
শিল্পী আঁচলে নাক মুছতে মুছতে বলল, “দে।”
মিলা এক গ্লাস পানি এনে দিলো। পানি ঢালবার সময় মিলা বুঝল ওর খুব শরীর খারাপ। মাথা ব্যাথায় ফেটে যাচ্ছে। চোখ পর্যন্ত টনটন করছে। শিল্পী পানির গ্লাসটা হাতে নিলো ঠিকই, কিন্তু খেলো না। চুপচাপ ছুঁড়ে ফেলে দিলো দেয়ালের শরীরে। মিলা ভয়ে চোখ বড় বড় করে চিৎকার করে উঠল, “মা!” দেয়ালের অশ্রু মেঝেতে গড়িয়ে পড়তে লাগল। শিল্পী সেদিকে তাকিয়ে বলল, “তোদের নিয়ে যেবার রাঙামাটি বেড়াতে যাই তখন জোহরার সাথে এত বছর পর আমাদের আবার দেখা হয়ে যায়। তখনি সব শেষ।”
মিলার মনে পড়ে গেল ঘটনাটা। ওরা আগে ত ভালোই ছিল। পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা শেষে ওরা যখন ঘুরতে যাওয়ার আবদার করেছিল, তখন বাবা ওদের সবাইকে রাঙামাটি নিয়ে গিয়েছিলেন। আর সেই ট্যুর থেকেই মা – বাবা কেমন বদলে গেলেন! বাড়িটা আর বাড়ি রইল না।
শিল্পী এলোমেলো, রুক্ষ চুলগুলো খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বলল, “তখন কেন আমি ওর পাশে ছিলাম তা ভাবলে অনেকগুলো উত্তর পাই। একবার মনে হয় যাকে ভালোবাসি ওকে ক্ষয়ে যেতে দিতে চাইনি। আবার মনে হয় ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে বোধহয় চেয়েছিলাম। তবে ওর তা মনে হয় না। ওর মনে হয় আমি ইচ্ছে করে ওকে আর জোহরাকে আলাদা করেছি। আর এরপর নিজে ওর ঘাড়ে উঠে বসেছি।”
চলবে…