#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩২
মিশেল দেখল মুবিন হলঘর থেকে বিভিন্নজনের নিয়ে আসা উপহারগুলো একসাথে যতগুলো পারা যায় নেয়ার জন্য বুকের মাঝে দু’হাতে চেপে ধরল। তারপর একটা ঘরে নিয়ে গেল। ফিরে এল, আবার বাকিগুলো একই কায়দায় নিলো।
আবার এলো, আবার নিলো। এমন করে করে পুরো হলঘরটা খালি করল সে। মিশেল বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছিল। তখনি মঈন বের হয়ে এল। মিশেলকে বলল, “চলো।”
মিশেল বলল, “কোথায়?”
“তোমার জন্য হোটেল বুক করতে।”
“তোমার ছেলে মেয়ে দুটো ভীষণ সুন্দর।”
মঈন মিশেলের লাগেজ টেনে ধরে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরুলো, “এভাবে তোমার চলে আসটা ঠিক হয়নি।”
মিশেল মঈনের পেছন পেছন যেতে যেতে বলল, “তোমাকে না দেখে আর থাকতে পারছিলাম না, হানি।”
“তোমাকে বলেছিলাম আমি এখন সুস্থ আছি।”
“বিশ্বাস হচ্ছিল না। খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। মনে হচ্ছিল আমার কাছে মিথ্যে বলছ। তুমি ঠিক নেই।”
“চলে আসার আগে একবার অন্তত আমাকে জানানো উচিত ছিল।”
“আমি সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।”
“অন্তত, আমার বাসায় আসা উচিত হয়নি তোমার।”
“কেন? কি সমস্যা? তুমি ত তোমার স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছোই।”
মঈন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না আর।
.
বিশাল বড় এক অন্ধকার, দম বন্ধ করা রাতের শেষে সকালে মিলা ঠিকই সময়মত স্কুলে যেতে তৈরী হয়ে গেল। কিছু খেল না অবশ্য, টিফিন নেবারও ইচ্ছে নেই। মিলা স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মুবিনের ঘরের দরজায় টোকা দিলো, “মুবিন দেরি হচ্ছে আমাদের।”
ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মিলা আবারো বলল, “মুবিন! আমার আজকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস আছে। একদম দেরি করবি না।”
মুবিন তবুও কোনো জবাব দিলো না। মিলা বিরক্ত হয়ে এক ধাক্কায় দরজা খুলে বলল, “ফাইন, তোকে ফেলেই চলে যাচ্ছি আমি।”
কিন্তু কোথায় মুবিন? ঘরে নেই কেন? ওয়াশরুমে? মিলা ওয়াশরুমেও মুবিনকে পেল না। আরো বেশি বিরক্ত হয়ে গেল সে। এবার সত্যি সত্যি একা চলে যাবে। এত যন্ত্রণা আর ভালো লাগে না! ওরাও জ্বালাবে আবার ওদের ছেলেও জ্বালাবে! ঘুরে চলে যাচ্ছিল সে তখনি মনে হলে বিছানায় গিফ্টের বাক্সগুলোর মাঝখানে একটা বড় সড় কাগজ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মিলা ফিরে এসে কাগজটা হাতে নিলো। বড় বড় করে সেখানে মুবিনের বাজে হাতের লেখা শোভা পাচ্ছে। লিখা আছে, “সব গিফ্ট তোর, রোদমিলা। আমি চলে গেলাম। মা – বাবার সব আদরও তোর।”
কাগজ হাতে নিয়ে মিলার হাত – পা দুটোই কাঁপতে শুরু করে দিলো। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সে মার ঘরে দৌড়ে গেল। শিল্পী সারারাত এক ফোঁটাও ঘুমায়নি। ওর অবস্থা আরো বেশি নাজেহাল।
.
কাদিন ছুটির দিন পেয়ে দুপুরে ঘুমাচ্ছিল। দীপা এ সময়টায় সাধারণত টিভি দেখে। টিভির ভলিয়্যুমের শব্দে কাদিনের ঘুম ভেঙে গেল। সে চোখ মেলে ঘাড় উঁচু করে টিভি চলছে দেখে অবাক হয়ে গেল। কিন্তু কিছু বলল না। দীপা বলল, “কি হয়েছে? এভাবে কি দেখছেন? ক্যাটরিনাকে দেখেন? আপনার প্রিয় নায়িকা?”
দীপা দেখল কাদিন বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে কি যেন বিড়বিড় করল। সে কাদিনের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, “কি বিড়বিড় করছেন?”
কাদিন বলল, “কিছু না।”
“আরে কিছু না বললে ত হবে না। ক্যাটরিনাকে ফিসফিস করে কি বললেন? বলুন না, বলুন না। রাগ করব না। অনেক ভালো বউ আমি।”
কাদিন উঠে গেল। বিছানা ছেড়ে যেতে যেতে বলল, “একে তো টিভির এত সাউন্ড তার উপর আবার ঘ্যানঘ্যানানি একটা মানুষ ঘুমাবে কি করে? ধ্যাত ছুটির দিনটাই বরবাদ। কেউ ঘুমিয়ে থাকলে কি করে আরেকজন এমন ভলিয়্যুমে টিভি দেখতে পারে আমার বুঝে আসে না।”
দীপার এত মন খারাপ হলো যে সে টিভি বন্ধ করে দিয়ে রিমোট খুঁটতে লাগল। গ্রাম থেকে ফিরে আসবার পর থেকেই তো সে কাদিনের মন বুঝে চলবার চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু যেই লাউ সেই কদু। কিচ্ছু পারছে না সে, কিচ্ছু হচ্ছে না। কোলের উপর থেকে বালিশটা সরিয়ে ও বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। কাদিনের পেছনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যরি, আমি টিভি অফ করে দিয়েছি। আপনি শুয়ে পড়ুন।”
“বন্ধ করতে হবে না। যাও টিভি দেখো গিয়ে। এখন আর ঘুমাতে পারব না।”
“আপনি যদি এখন না ঘুমান আমি আর কোনোদিন টিভি দেখব না।” কথাটায় যে দীপার নিজের প্রতি নিজের কতটা বিরক্তি মিশেছিল, কতটা অভিমান জমেছিল তা কাদিন বুঝেও বলল, “আমাকে এখন বেরুতে হবে।”
কাদিন চলে গেল। দীপা আর কি করবে? কি করবে সে? আল্লাহ কেন এত ক্রিটিকাল, এত বেশি জটিল একটা মানুষের সাথেই ওকে জুড়ে দিলো? আর যেহেতু জুড়ে দিলোই তাহলে ওকে কেন একটু বোধবুদ্ধি দিলো না? নিজেকে আজকাল আরো বেশি অসহ্য লাগে দীপার। কাদিন চলে যেতেই শব্দ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজল সে। মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে!
.
জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত অনেক বেশি অনিশ্চিত কড়ি তা আগে থেকেই জানতো। কিন্তু এত বেশি অপ্রত্যাশিত তা ওর বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার আগে ভাবতেও পারেনি। ও তো এমনি এমনি ইমাদকে কষ্ট দিতে চায়নি বলে বলেছিল কিছু করা যায় কিনা দেখছে। সে জানতো কিছুই করা যাবে না। কিন্তু কেমন করে সব হয়ে গেল? এখন ত সমস্যা আরো বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে! বিয়ে একটা ভাঙলে কি হয়েছে? একবার যখন দেখা শুরু হয়ে গেছে একটার পর একটা দেখতেই থাকবে সবাই। তারপর হুট করে আবার আরেকটা ঠিক হয়ে যাবে। অন্যদিকে, বেচারা ইমাদ সাহেবের মনে আশার বাতি আরো প্রগাঢ় হয়ে জ্বলে উঠেছে। যত বেশি আলো জ্বলবে, আশার প্রদীপ নিভে গেলে জীবন তত বেশিই অন্ধকার হয়ে যায়। আগের বিয়েটা হয়ে গেলেই ইমাদের জন্য ভালো ছিল। কষ্ট কম হতো। এখন কষ্টটা আরো বাড়বে! কড়ি পাশ উল্টে শুলো। একটা প্রজাপতি এসে জানলা দিয়ে ঘরের দেয়ালে বসেছে। প্রজাপতির ডানাগুলো বেগুনী। এত সুন্দর প্রজাপতি সে আর কখনো দেখেনি। এই সুন্দর প্রজাপতিটা যখন উড়ে এসে কড়ির বাহুতে বসল কড়ি চোখ বন্ধ করে ফেলল। জীবন সুন্দর। প্রজাপতির ওই ডানা দুটোর মত সুন্দর। আর জীবনে সুখও খুব সহজ একটা বিষয়। যে জীবনে আকাশে সুন্দর একটা চাঁদ উঠলেই অন্ধকার কেটে যায়, গোধূলী বেলায় জানালায় একটা চড়ুই বসলেই একাকিত্ব কেটে যায়, প্রজাপতি উড়ে এলেই রঙিন হয়ে যায়, সে জীবন নিয়ে আবার চিন্তা কিসের? ইমাদের জীবনও সুন্দর হতে হবে। ও থাকুক আর নাই থাকুক। কারো জন্য কি কারো জীবন থেমে থাকে? আর কষ্ট আসলে আমাদের নিজেদের তৈরী করা বিশেষ চাহিদা। যা আমরা পেতে চাই না বললেও আসলে সবসময় শুধু ওটাই খুঁজে বেড়াই। পাশ দিয়ে সুখ হেঁটে গেলেও ফিরে তাকাই না। তবুও সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে যেন ইমাদ কোনোভাবে কষ্ট না পায়।
চলবে…