একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ৪

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪
নিলয় আর ইমাদ একই মেসে একই রুমে থাকে। ইমাদের চৌকিটা জানালা ঘেঁষে রাখা। বৃষ্টির ছাটে চৌকির চাদর আর নীল শার্টে ঢাকা ইমাদের পিঠ ভিজে যাচ্ছে। নিলয় বলল, “জানলা লাগিয়ে নে না।”
ইমাদ জানালার গ্রিলে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। তার চোখ দুটো বন্ধ। বন্ধ চোখের পাতার ভেতরে বারবার দীপুর মুখটা ভেসে আসছে। দীপু এখন কী করছে? সে ডাকল, “নিলয়?”
নিলয় বিছানায় আঁটা মশারীর ভেতর থেকে মাথা বের করে বলল, “ইয়েস।”
“তোর কোনো কাজ আছে এখন?”
“না। বারোটা পর্যন্ত ফ্রি।”
“তাহলে চল একটু ঘুরে আসি।”
“কই যাবি?”
ইমাদ ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে নেমে গেছে। জানালা টেনে বন্ধ করে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, “তোর ছাতাটা নিয়ে আয়। আমারটা ভেঙে গেছে।”
নিলয় ঝিমোতে ঝিমোতে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত টানানো দড়ির দিকে উঠে গেল। এলোমেলো কাপড়ের এর স্তূপ থেকে নিজের একটা শার্ট টেনে গায়ে চড়াল। দেয়ালে আঁটা পেরেক থেকে লম্বা হাতলের ছাতাটা নিয়ে ইমাদের পেছন পেছন বেরুলো। ইমাদ বিল্ডিং এর কার্নিশের নীচে দাঁড়ানো। নিলয় এসেই একটা রিকশা ডাকল। হুড ফেলে দুজন রিকশায় উঠল। নিলয় ছাতা ধরে রাখল। ইমাদ হাতেরর ভাঁজে হাত গুটিয়ে বসে রিকশাচালককে হাসপাতালে যেতে বলল। নিলয় বলল, “ওহ দীপুর কাছে যাচ্ছি।”
ইমাদ চুপচাপ বৃষ্টি দেখছে। সে নিলয়ের কথায় শুধু মাথাটা উপর নীচ নাড়ল।
ছাতা চুপসে পড়া পানিতে আধভেজা হতে হতে দুই বন্ধু হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছুল। সেখানে দীপার মায়ের সাথে তাদের দেখা হয়ে গেল। ইমাদ দীপার মাকে সাথে নিয়ে রিসিপশনে খানিকক্ষণ কথা বলল। তারপর উপরে দীপার কেবিনে গিয়ে বলল, “হ্যালো।”
দীপা দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়েছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে ইমাদ আর নিলয়কে দেখে হাসার চেষ্টা করল। ইমাদ বলল, “তোকে নিতে এসেছি।”
দীপা উঠে বসে বলল, “আম্মু কোথায়?”
নিলয় বলল, “আন্টির সাথে দেখা হয়েছে। গ্রাউন্ডফ্লোরে অপেক্ষা করছেন।”
দীপাকে নিয়ে ওরা দুজন নীচে নেমে এল। ইমাদ দীপার মাকে বলল, “আন্টি দীপু আমাদের সাথে আসুক?”
“তোমরা পৌঁছে দিবে বাসায়?” তিনি খানিক বিভ্রান্ত।
“হ্যাঁ। আপনি চিন্তা করবেন না।”
দীপার মা যেতে চাইলেন না। নিলয় জোর করে একটা রিকশা ডেকে দীপার মাকে উঠিয়ে দিলো। এরপর ফিরে এসে চোখে প্রশ্ন নিয়ে ইমাদের দিকে তাকাল। ইমাদ বলল, “কী?”
নিলয় জানতে চাইল, “এরপর কী?”
“আমরা হেঁটে ফিরব। পারবি না হাঁটতে?” দীপার দিকে তাকাল ইমাদ।
ওরা তিনজন হেঁটে বাড়ি ফিরছে। নিলয় আর ইমাদ একটা ছাতার নীচে হাঁটছে। দীপা ওদের সামনে। দীপা একা একা ভিজছে আর দুলতে দুলতে হাঁটছে। ইমাদ পেছনে থাকায় দীপার চোহারাটা ঠিকঠাক দেখতে না পারলেও সে জানে তাহমিদ ছাড়া দীপু যদি আর কিছু পাগলের মত ভালোবেসে থাকে তা হলো বৃষ্টি। বৃষ্টি এলেই সে কেমন উথালপাতাল হয়ে যায়।
.
দীপার বারান্দায় বসার আয়োজনটা বেশ। মেঝেতে বড় বড় তিন চারটে কুশন বিছানো। হেলান দিয়ে বসার জন্য ছোট ছোট কুশনও রাখা। চারিদিকে ফুলের টব। নিলয় আর ইমাদ আরাম করে বসে আছে। দীপা মাথায় টাওয়াল বেঁধে বারান্দায় এসে বসতে বসতে বলল, “আমি বোধহয় তাহমিদের চেয়ে ঝড়বৃষ্টিকেই বেশি ভালোবাসি। শুধু শুধু মরতে যাচ্ছিলাম। মরে গেলে আর কখনে বৃষ্টি ভেজা হতো না।”
নিলয় ইমাদের দিকে তাকাল। ইমাদের ঠোঁটের কোণায় শিশিরকণার মতন ছোট প্রায় নাই নাই একটি হাসি লেগে আছে। নিলয় ওর দিকে তাকাতেই হাসিটা মুছে ফেলল চট করে। নিলয় হেসে ফেলল। বলল, “ইমির বাচ্চা বহুত শেয়ানা।”
দীপা ইমাদের গাল টেনে দিতে হাত বাড়াল। ইমাদ দূরে সরে গেল। গমগম করা গলায় বলল, “তোর ভাই ইলাভেনে পড়ে না? ওর ম্যাথ বইটা একটু নিয়ে আয়। আর সাথে একটা কাগজ আর কলম। সন্ধ্যেয় টিউশনীতে যেতে হবে। স্টুডেন্ট এর পরীক্ষা নিব বলেছিলাম। প্রশ্নটা তৈরী করে ফেলি।”
দীপা ইমাদকে ভেঙচি কেটে ছোট ভাইকে ডাকল। দীপার ভাই বই, কাগজ আর কলম দিয়ে গেল। সাথে গরম গরম খিচুড়ি। ইমাদ সবার আগে খিচুড়িটা খেয়ে নিলো। এরপর বই খুলে প্রশ্ন তৈরীতে লেগে পড়ল। দীপা আর নিলয়ের এখনও খাওয়া শেষ হয়নি। ওরা খেতে খেতে গল্প করছে। দীপা গড়গড় করে বলছে, “তোর সাথে ত কড়ির দেখা হয়নি। দেখা হলে বুঝতিস কী ডেঞ্জারাস মেয়ে!”
“ডেঞ্জারাস বলছিস কেন?” নিলয়ের প্রশ্ন।
“সে একজনকে পাগলের মতন ভালোবাসতো। তাকে ভালোবেসে বাবা- ভাইদের ঠকাল। তার হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল।”
“তারপর?”
“তারপর সেই ছেলেটা তাকে ফিলিং স্টেশনে একা ফেলে, রাতের অন্ধকারে তার গয়নাগুলো নিয়ে চলে গেছে।”
নিলয় চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে বলল, “এই মেয়ে এত বলদ কেন?”
“বলদ বলছিস কেন?” দীপার মুখটা কালো হয়ে গেল।
“বলদই তো। বুদ্ধি থাকলে কেউ বাড়ি থেকে পালায়? তাও আবার গয়না সমেত!”
“না, না। মেয়েটা গয়না নিয়েছে অন্য কারণে।”
“কী কারণে?”
“ওর মা উত্তরাধিকারসূত্রে নিজের দাদীর কাছ থেকে অনেক গয়না পেয়েছিলেন। তার মা ছিলেন দুই প্রজন্ম পর হওয়া একমাত্র মেয়ে সন্তান। তাঁদের বংশ হলো ছেলের কারখানা।মেয়ে নেই। তাই ওর মা বিয়ের সময় অনেক গয়না পেয়েছিলেন। ওর মায়ের বাপ-চাচারা একমাত্র মেয়েকে স্বর্ণে মুড়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েছিলেন। কড়ির মা করেছিলেন কি তার সব গয়নাগাটি তার চার ছেলে মেয়ের জন্য সমান ভাগে ভাগ করে রেখে গিয়েছিলেন।”
“জায়গাজমির মত গয়নাগাটিরও উইল আছে নাকি?” নিলয় ঠাট্টা করে হেসে ফেলল।
দীপা ব্যাখা করল, “তিনি আসলে অনেকদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছিলেন ত তাই আগেভাগেই মৃত্যুর রূপ দেখে ফেলেছিলেন। তাই নাকি গয়নাগাটি ভাগ করেছিলেন।”
“ওহ বুঝতে পেরেছি, কিন্তু ঐ মেয়ে গয়নাগাটি সাথে নিলো কেন?”
“মায়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে নিয়েছিল। ওর বাবার রাগ খুব। মেয়ে পালিয়েছে শুনলে মেয়েকে তিনি আর কখনো বাড়িতে ফিরতে দেবেন না। আর না কখনো তার মায়ের রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতিগুলো ছুঁতে দেবেন।”
“মেয়েটা পালাল কেন? বাড়িতে মেনে নেয়নি?”
“হ্যাঁ, ওর বাবা মানেননি।”
“ফর হোয়াট?”
“ছেলেটা ড্রপ আউট করা ছাত্র। অনার্স এ ভর্তি হয়েও থার্ড ইয়ারে উঠে ছেড়ে দিয়েছিল। ইন্টার পাশ ছেলের কাছে কে মেয়ে দিবে? কড়ির বাবা আবার পড়াশুনা নিয়ে খুব কঠোর। ভালো ছাত্রদের সুনজরে দেখেন।”
“আচ্ছা।” নিলয় সুর তুলে টেনে টেনে বলল।
দীপা নিলয়ের হাতে খামচে দিলো, “তুইও ইমির মত আচ্ছা আচ্ছা শুরু করলি? আচ্ছা শুনলেই আমার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে। দেখ না ফাজিলটা কেমন! অামাদের আড্ডায় কখনো ওকে পাই না আমরা। এই তুই বই রাখ বলছি। এখনি রাখ।” দীপা বইটা ইমাদের সামনে থেকে সরিয়ে নিলো। ইমাদ জোর করে বইটা ফিরিয়ে নিয়ে আবার নিজের কাজে মনোযোগী হলো।
দীপা ইমাদের চুল টেনে দিলো রাগে। নিলয় হাসতে হাসতে বলল, “রোবটাকে এবার ক্ষ্যামা দেরে, দীপু। ওকে ওর কাজ করতে দে। তুই আমায় বাকিটা বল। ও তো সেদিন সেখানে তোদের সাথেই ছিল। সব শুনেছে না একবার? এক কথা কয়বার শুনবে?”
“আমি এক কথা বারবার বলি?” দীপা রেগে আগুন।
নিলয় বলল, “না, না তা বলিনি। আচ্ছা আচ্ছা এরপর বল নারে মা। উফ তুই আরেকটা।”
ইমাদ অবশ্য সেদিন কিছুই শুনেনি। পাশে বসে থাকলেও নিজের ভাবনার জগতেই সে বিচরণ করছিল। তবে আজ সে সবই শুনছে। দীপারা অতসব বুঝে না।
ইতোমধ্যে দীপা আধা বিরক্তি আধা উৎসাহ নিয়ে আবার নিজের কথারভান্ডার খুলে বসেছে, “কড়ি যখন টের পেল ছেলেটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে সে কী করেছে জানিস?”
“না বললে জানব কী করে?”
দীপা বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে অবিশ্বাসের গলায় বলছে, “সে কান্নাকাটি না করে সুন্দর মত তার বাসায় ফিরে গেছে। বাসায় ফিরে গিয়ে আবার ভাইদের কলও করেছে। বলল, বাসায় চুরি হয়েছে। বাসায় তেমন টাকা পয়সা ছিল না। তাই চুরি হলে তো গয়নাই চুরি হবে। সন্দেহ জন্মাবার কোনো পথ থাকবে না।”
“সে যে পালিয়েছে তার বাবা আর ভাইয়েরা তখনো টের পায়নি না?”
“না। ওর ভাগ্য ভালো ছিল। ওঁরা ওর চাচাতো ভাইয়ের বিয়েতে ছিল।”
“আরিব্বাস!” নিলয়ের মাথায় হাত।
দীপা বাকিটা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ল। সে উতলা হয়ে বলল, “বড় ভাইয়ের ভাগের অংশ তার বউয়ের কাছেই। আর বাকিসব তার বাবার আলমারিতে ছিল। সে তার ভাগের গয়না নিয়ে পালিয়েছিল,কিন্তু বাকি দুই ভাইয়ের ভাগের গয়নাগুলি ত ছিলই। সে ওগুলোও লুকিয়ে ফেলল। নাহলে ত ধরা খাবে।”
“ইয়েস চোর নিলে শুধু ওরগুলোই কেন নিবে?” নিলয় শব্দ করে এক হাত দিয়ে নিজের অন্য হাতে চাপড় মেরে উঠল। সে আরো বলল, “ভাবা যায়! তুইও মেয়ে আর এই মেয়েও মেয়ে। অন্য একটা মেয়ের জন্য তোর বয়ফ্রেন্ড তোর সাথে ব্রেকআপ করায় তুই দুই দুইবার হাতটাত কেটে সুইসাইড এটেম্প নিয়ে ফেলেছিস।”
দীপা একমত হয়ে গালের দুপাশে হাত ছুঁয়াল। তওবা কাটতে কাটতে বলল, “সেটাই তো। আর না বাবা। আর না। ওকে দেখে শিক্ষা নিলাম।”
নিলয় ইমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “অ্যাই, ইমি। ওকে পেলি কই তুই?”
ইমাদকে উত্তর দিতে হলো না। দীপাই বলে দিলো, “ইমি সে রাতে ওই ফিলিং স্টেশনেই ছিল। ওর কী একটা কাজে যেন গিয়েছিল। পরে কড়িদের দেখতে পায়। আর আমার আউলাবাউলা মাথাটা ঠিক করতে কড়িকে খুঁজে নিয়ে আসে।”
“রোবট বহুত কাজের।” নিলয় গর্বের হাসি হাসছে।
দীপা একটা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিশিয়ে দিলো। বলল, “তোরা না থাকলে আমার যে কী হতো!”
নিলয় বলল, “তুই না থাকলে আমাদেরই চলে না। তুই হলি আমাদের নিউজরিডার। সবখানের সব খবর তোর কাছেই ত ফ্রিতে পাওয়া যায়।”
দীপা হঠাৎ আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল। নিলয়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরল তার, “হু ডাকছিলি?”
“হ্যাঁ। কড়ির বফ ওকে ছেড়ে কেন চলে গেল এ বিষয়ে কিছু বললি না যে?”
“কড়ি নিজেও জানে না কেন ওকে ছেড়ে চলে গেল।”
“গয়নার জন্য হতে পারে।”
“না গয়নার জন্য হবে না। ও বড় লোকের ছেলে।”
“মিথ্যে বলেনি ত আবার?”
“না। এটা সত্যি যে ও বড়লোকের ছেলে। শুধু গয়নার জন্য ওকে ছেড়ে দিবে বিষয়টা কেমন না?”
“হুম তা ঠিক।”
“কড়ি বলেছে ও কেন এই কাজটা করল তা কড়ি জেনেই ছাড়বে।”
“ছেলেটার কোনো ক্ষতিটতি হলো না তো। লাইক এক্সিডেন্ট জাতীয় কিছু বা কেউ ধরে নিয়ে গেল?”
“কী জানি কতকিছুই হতে পারে।”
ইমাদ এর প্রশ্ন তৈরী করা শেষ। সে বইটা বন্ধ করে সৃজনশীল প্রশ্নগুলোতে আরো একবার চোখ বুলাল। কী ভয়ানক! সব প্রশ্ন ভুল! আবার সে ভুল করে ফেলেছে।
চলবে…
★অটোগ্রাফ সহ আমার ২য় বই “যে শ্রাবণে ফাগুন” এর প্রি-অর্ডার চলছে….
★প্রি- অর্ডার লিঙ্কঃ
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=882805749142024&id=100022378217757
ফোনে অর্ডার করুন- ১৬২৯৭ এই নাম্বারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here