#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৯
ইমাদ বাইরে এসে দেখল কড়ি কোথাও নেই। সে মোবাইল বের করে মেসেজ পাঠাল, “কোথায়?”
কড়ির অন্ধকারের গহীন থেকে বেরিয়ে এল, “ভালো আছেন!”
ইমাদ বলল, “জি।”
“উহু ভালো আছেন কিনা জানতে চাইনি। বলেছি আপনি ভালো আছেন। মানে আপনি মানুষ ভালো।”
“আচ্ছা।”
কড়ি প্রশ্ন করল, “উনার মন খারাপ হবে বলেই ত গিফ্টটা দেননি, তাইনা?”
ইমাদ কড়ির দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না।
কড়ি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, “আপনি এত সাধু কেন বলুন তো? শুনেছি অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।”
ইমাদ কড়ির দিকে দু’কদম এগিয়ে এল। রহস্যময় গলায় বলল, “কী চুরি করলাম?”
কড়ি দু’কদম পিছনে গিয়ে বলল, “দয়া করে এই ধরনের সস্তা ফ্লার্ট আপনি করবেন না। এসব আপনার সাথে যায় না। আপনার ব্যক্তিত্বের অপমান হয়।”
ইমাদ হেসে ফেলে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল। বলল, “সাধু সেজে থাকা চোরদের আবার ব্যক্তিত্বও থাকে নাকি?”
“আপনাকে বান্ধবীর জন্য পাগলপারা হয়ে অচেনা একটা মেয়ের পিছু নিতে দেখতে ভালো লাগে, সবার সামনে নিজেকে পরোয়ানাবিহীন দেখানো অথচ, সবচেয়ে বেশি সবার পরোয়া করা মানুষ হিসেবে আপনাকে বেশ লাগে। বন্ধু গিফ্টট দিতে পারেনি বলে, গিফ্ট এনেও লুকিয়ে রাখা আপনাকে দারুণ লাগে। কিন্তু সদ্য ছ্যাকা খাওয়া একটা মেয়েকে সাডেন প্রপোজ করা আপনাকে বিরক্ত লাগে, ফ্লার্ট করা আপনার উপর রাগ হয়, প্রেমিকা থাকা সত্ত্বেও আমার উপর লাইন মারা আপনাকে নিন্দা না করে পারা যায় না। কেন এমন করেন?”
ইমাদ কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, “এক্সকিউজ মি?”
কড়ি হেসে হেসে বলল, “অনামিকার প্রতারক প্রেমিক হিসেবেও আপনাকে মানায় না। প্রতারক শব্দটা কেটে অনামিকার শুধু প্রেমিক হতে পারেন না?”
“আচ্ছা।” ইমাদ নিজের প্যান্টের দু’পকেটে হাত রাখল। নীচে তাকিয়ে দু’দিকে মাথা নাড়তে নাড়তে ঠোঁট টিপে শব্দহীন হাসতে লাগল।
কড়ি বলল, “ভালো আছেন, ভালো থাকুন।”
ইমাদ পা দিয়ে মাটির রাস্তাটা খুঁড়তে খুঁড়তে বলল, “তারপর কি করব? আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখব?”
এখনো ইমাদের চোখে মুখে হাসি খেলা করছে। কড়ি চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল, “ভাইরে ভাই এই আপনাকে দেখলে আমার মনমেজাজ খারাপ হয়ে যায়।”
ইমাদ মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে উঠল, “ভাই টাই বলবেন না।”
“হোউপলেস!” কড়ি বিরক্ত হয়ে চলে যাচ্ছিল। ও ভেবেছিল ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে শুনে ইমাদ পিছু হটেছে। তাই এখন কথা বলাই যায়। কিন্তু এই ছেলে তো আগের মতই আছে। এত ভালো একটা মানুষ সমানতালে এত বেকার কি করে হয়! কড়ি অবাক। ওর মন সায় দিচ্ছিল না তাই কথা বলে বিষয়টা পরিষ্কার করতে এসেছিল। কিন্তু না এই ছেলের সাথে কথা বলার উপায় নেই।
ইমাদ ডাকল, “কড়ি, শুনুন।”
কড়ি চাপা ক্রোধে জবাব দিলো না। পিছনেও তাকাল না। ইমাদ এবার একটু জোরেই ডাকল, “কড়ি?”
কড়ি বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল, “বলে আমায় উদ্ধার করুন।”
“অাপনি একটু দাঁড়াবেন? অনামিকাকে নিয়ে কথা বলতে চাই।”
“দুঃখিত, আমার কাজ আছে ভেতরে।”
“প্লিজ?”
কড়ি কয়েক সেকেন্ড কি যেন ভাবল। তারপর বলল, “আচ্ছা তাড়াতাড়ি বলুন।”
ইমাদ পকেট থেকে মোবাইল বের করল। ওর মোবাইলে কল রেকর্ডার অ্যাপস আছে, “একটু এদিকে আসুন।”
কড়ি হেঁটে গেল আগের জায়গায়। ইমাদ বলল, “অনামিকা নামের রেকর্ডিংগুলো চ্যাক করুন একটু। চাইলে আমার কল লিস্টের অন্য রেকর্ডিংগুলোও চেক করতে পারেন।”
কড়ি মোবাইল হাতে নিলো। ইমাদ বলল, “আমি কখন, কার সাথে, কি কথা বলি সব আছে। এমনকি অনেক অনেক পুরোনো কলের রেকর্ডিংও আছে। আপনার সাথে ঐ যে নানুয়া দিঘীর পাড় দীপুকে নিয়ে কথা বলার জন্য যে কল দিয়েছিলাম সেটা পর্যন্ত আছে। অবশ্য ওটা অত আগেরও না।”
কড়ি ভলিয়্যুম কমিয়ে রেকর্ডিং অন করল। অনামিকার সাথে সবগুলো রেকর্ডিং শুনলো সে। সবগুলোই প্রায় একইরকম। অনামিকা একতরফাভাবে এটাসেটা বলে যায়। আর ইমাদ বারবার জিজ্ঞাসা করে আপনি কে? কে বলছেন? আপনাকে কি আমি চিনি? ব্যস এইটুকুই।
কড়ি ইমাদের হাতে মোবাইলটা ফিরিয়ে দিলো। ইমাদ মোবাইল পকেটে রাখতে রাখতে বলল, “মেয়েটা আমাকে মেসেজও করে। সময়মত খাওয়া দাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আকাশে মেঘ করলে লিখে, কি মনে হয় বৃষ্টি হবে আজ? চাঁদ দেখা না গেলে লিখে, চাঁদ কি আপনি কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন? বেশি রোদের দিনে লিখে, এত রোদ আজ! বের হওয়ার দরকার নেই।”
কড়ি শেষ কথাটা শুনে হাসতে লাগল। ইমাদ বলল, “আপনি কি করে এই বিষয়টা জানলেন তা জানার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি আসলে জানি না মেয়েটা কে। না জানা পর্যন্ত ব্লকও করব না। আগে জানব মেয়েটা কে, তারপর ব্লক করব।”
কড়ি হাসতে হাসতেই বলল, “কণ্ঠ শুনে মনে হয় বাচ্চা মেয়ে। অত বেশি বড় না। তবে রোমান্টিক আছে! ব্লক করার দরকার নেই। চালিয়ে যান। কিছু একটা হলেও হতে পারে।”
“আমার যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর হওয়া সম্ভব না।”
কড়ি এত মজা পেল কথাটায় যে ইমাদ ঠিক যেমন করে নির্লিপ্ত গলায় আচ্ছা বলে সেও ঐ ভঙ্গিতেই বলল, “আচ্ছা।”
ইমাদ কড়ির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কড়ি বলল, “শুনুন আপনার কোনো স্টুডেন্ট হতে পারে। টিউশনি করান না?”
“জি।”
“হ্যাঁ, তাহলে আপনার কোনো ছাত্রী হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।”
“আচ্ছা।”
“আমি আসলে স্যরি। এজন্যই তো বলি আপনার সাথে না ঠিক এসব যাচ্ছিল না। তাই আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। শুধু শুধু একটা মানুষকে আজীবন মনে মনে ভুল বুঝার চেয়ে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া ভালো। তাছাড়া, মানুষটা যদি আপনার মত হয় তাহলে তো তা অবশ্যই করতে হয়।”
“আচ্ছা।”
কড়ি ঘুরে যেতে যেতে বলল, “আমি আসছি আর আবারো স্যরি।”
ইমাদ ভাবলেশহীনভাবে বলল, “আমার যা হওয়ার আপনার সাথে হয়ে গেছে। আর হবে না।”
কড়ির হাসি হাসি মুখটা আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল। কড়ি থমকে দাঁড়াল। যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়েই বলল, “আপনি খুব ভালো করেই আমার অবস্থাটুকু জানেন। এখন আমার কাছ থেকে এমন কিছু আশা করে থাকলে আপনি বোকামি করছেন। আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি আমার পরিবারের কথার বাইরে এক পাও দিব না। বাবার পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করব। আমাকে ভালো না বাসার অনুরোধ রইল। আর বেসে থাকলে আমি আপনার অনুভূতির সম্মান করি। আমাকে ক্ষমা করুন।” কড়ি দু’হাত এক সাথে জড়ো করে ক্ষমা চেয়ে চলে গেল। এই প্রথম ইমাদ দায়সারাভাবে আচ্ছা বলতে পারল না।
ঘরে যেতেই নিলয় বলল, “কোথায় ছিলি, বন্ধু?”
“এদিকেই।”
“আমাদের কুমিল্লা যাওয়া দরকার না? আমার ছাত্রর পরীক্ষা ভাই।”
“আচ্ছা।”
নিলয় মাথা চুলকে বলল, “কাল চল, ফিরে যাই।”
“আচ্ছা।”
“কিন্তু সমস্যা হলো দীপুর শ্বশুর না ছাড়তে চাইছেন না। আমরা চলে যাব জানাতেই শক্ত করে না, না করে উঠলেন। কি করে যে বুঝাই! বলছেন একেবারে উনার মেয়ের বিয়ে খেয়ে যেতে।”
ইমাদ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, “আচ্ছা।” পরক্ষণেই হাত থমকে গেল ওর! চোখের মণি স্থির! মেয়ের বিয়ে? কড়ির পরিবার বিয়ে ঠিকও করে ফেলেছে! সর্বনাশ। তিন চারটে বোতাম খোলা অবস্থাতেই ইমাদ আবার ঘর থেকে বের হয়ে গেল। শার্টের বোতাম লাগিয়ে বের হওয়ার মতন অবস্থা তার এখন নেই।
চলবে…