একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ১৩

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ১৩
ইমাদ বালিশে মাথা রেখে এপাশ ওপাশ করছে। মিলাদের ওখানে নাঈমকে পাঠালে কেমন হয়? না, না তা করা যাবে না। এ ত নিজের এঁটো অন্যকে খাওয়ানোর মতন। যে জায়গায় নিজে আর কখনো যাবে না, সেখানে সে কী করে অন্য একজনকে পাঠাতে পারে? যা তার নিজের জন্য পছন্দ নয়, তা অন্যের জন্য বাছাই করা অন্যায়। নাঈমের জন্য অন্য কোনো ব্যবস্থা করতে হবে। সামান্য একটা টিউশনীকে ওর মত মানুষের মুখ থেকে হাসি মুছে ফেলবার মত শক্তিশালী করে তোলা যাবে না।
.
অবশেষে, অসংখ্য ভাবনা-চিন্তার অবসান ঘটিয়ে কাদিন বিয়েতে মত দিয়েছে। মতামত ইতিবাচক। দীপাদের পক্ষ থেকেও কোনো সমস্যা ছিল না। সমস্যা থাকলেও দীপার মা সম্ভবত এখানেই মেয়ে দিতেন। মেয়ে যে রাজি হয়েছে এতে তিনি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। বড় করে বিয়ের আয়োজন শুরু হলো দু’দিক থেকেই। দীপার মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে একলাই সব দিক দেখছিলেন। ইমাদ আর নিলয় দুজনের একজনও এই বিয়েতে আনন্দিত না হওয়া সত্ত্বেও দুজন নিজ থেকেই এগিয়ে এল। কমিউনিটি সেন্টার ঠিক করা থেকে শুরু করে অনেক ঝামেলাই তারা মেটাল। তবে দুজনেই দীপার সাথে রাগ! কেউ কথা বলছে না। দীপা নিলয়কে নানান ছুঁতোয় ডাকলেই নিলয় কটমট করে তাকাচ্ছে। জবাবে ধমক দিচ্ছে। পিঞ্চ মেরে মেরে কথা বলছে। আর ইমাদ ফিরেও তাকাচ্ছে না। দুই বন্ধুর এমন আচরণে দীপা বেশিক্ষণ কান্না চেপে রাখতে পারল না। কেঁদেকেটে শেষ হয়ে গেল সে। ক্রোধে মাকে ডেকে বলল, “নিলয় আর ইমি যেন আমাকে হলুদ ছোঁয়াতে না আসে। এলেই আমি স্টেজ থেকে নেমে যাব।” বলতে বলতে চোখ মুছল সে। কাজল লেপ্টে গেল হাতে।
.
বাড়ির মূল গেইট থেকে শুরু করে গলির মুখে গিয়ে মরিচা বাতির যাত্রা থেমেছে। বিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে হলেও কাদিনের হলুদ সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছে বাসার ছাদে। রিমা আর কড়ি একই পাড়ের একই হলুদ শাড়ি পড়েছে। সবাই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। কাদিন হলুদের জন্য স্টেজে এসে উঠল। একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়াচ্ছিল। তখনি কাদিনের মোবাইলে একটা কল এল। কাদিন মোবাইল রিসিভ করে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। চোয়াল শক্ত হয়ে মুখটা থমথমে হয়ে উঠল। তারপর বহু কষ্টে স্টেজে বসেছিল সে। ইচ্ছে করছিল সব ভেঙে নেমে আসতে। তবুও সে হলুদ ছোঁয়ানোর পালা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। পরে নেমে এসে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। পাঞ্জাবী খুলে, হাত – মুখ ধুয়ে কপালে হাত রেখে শুয়ে রইল বিছানায়। মাথা ব্যথা করছে। আঙুলগুলো কপালে বুলাতে বুলাতে উঠে বসল। দরজা খুলে বেরিয়ে এসে কড়িকে এদিকওদিক খুঁজল। রিমিকে পেয়ে বলল, “আপু, কড়ি কোথায়?”
“ও বোধহয় এখনও উপরে। গান টান হচ্ছে ত। নামেনি এখনও।”
“কায়েসকে বলে একটু ডেকে আনতে পারবে? দরকার ছিল।”
“কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
“পরে বলব।”
গানের শব্দে কাদিনের মাথা ফেটে যাচ্ছে। এত জোরে জোরে গান বাজানোর কোনো মানে হয়! কাদিন তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ফিরে এল। কড়ি এল এর খানিক পরই, “ডেকেছিলে, মেজো ভাইয়া?”
“হ্যাঁ।” কাদিনের কণ্ঠটা গমগম করে উঠল।
কড়ি তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, “কি হয়েছে?”
“দরজা বন্ধ করে বস।”
কড়ি কাদিনকে দেখতে দেখতে দরজা বন্ধ করল। কাদিনের সামনে এসে দাঁড়াল সে। কাদিন বিছানা থেকে আরেকটু এগিয়ে বসল। বলল, “দীপা, সুইসাইড এটেম্প নিয়েছিল।”
কড়ি খানিক চুপ করে থেকে বলল, “হুম।”
কাদিন অবাক চোখে তাকাল, “তুই আগে থেকে জানতিস?”
“হ্যাঁ।”
“আমার কাছে লুকিয়েছিস কেন?”
“লুকাইনি তো।”
কাদিন উঠে দাঁড়াল, “লুকাসনি?”
“তোমার কাছে কেউ কিছু লুকাতে যাবে এও কি সম্ভব!”
“কেন সুইসাইড করতে চেয়েছিল তা নিশ্চয়ই জানিস না।”
“জানি।” কড়ির কণ্ঠ স্থির।
“কি জানিস?”
“ওর এক্স ওকে অন্য একটা মেয়ের জন্য ধোঁকা দিয়েছিল।”
“সবকিছু জেনেও তুই কি করে আমার সাথে এমনটা করতে পারলি?”
কড়ি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কাদিন’ই আবার বলল, “ওর আগে একটা সম্পর্ক ছিল এটা কোনো সমস্যা না। অনেকেরই থাকে। সমস্যা হলো এটা যে ও সেই সম্পর্কটার জন্য আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত চলে গিয়েছিল।”
“তোমার কথা পরিষ্কার না, মেজো ভাইয়া।”
“তুই এখন বড় হয়েছিস, কড়ি। একটা সম্পর্কে কতটুকু নির্ভরতা, কতটুকু বিসর্জন থাকলে মানুষ এ ধরনের পথ বেছে নেয়?”
“একটা মানুষ অন্য একটা মানুষকে কতটুকু ভালোবাসলে এ পথ বেছে নেয়? এমন করে কেন ভাবতে পারোনি?”
“ওহ গড!” কাদিন বিরক্ত হয়ে গেল।
সে আরো বলল, “আচ্ছা চল তোর মত করেই ভাবি। তোর কথাটাই ধরি। সে যদি আরেকজনকে এত বেশি ভালোবাসে তবে আমাকে কি করে মেনে নিবে?”
“মন দিয়ে চাইলেই ভালোবাসা আদায় করা যায়। যে মেয়েটা ভালোবাসার আবেগে মরতে রাজি হয়ে যায় সে যাকে আবার ভালোবাসবে সে কতটা লাকি তুমি, আমি তা কল্পনাতে ভাবতেও অপারগ।”
“রিডিকিউলাস।” রাগে, বিরক্তিতে কাদিনের মুখ তেতো হয়ে এল।
কড়ি নরম গলায় বলল, “দীপার জায়গায় আমি থাকলেও কি এসব ভাবতে?”
“আমার বোন এমন কোনো কাজ কখনো করতেই পারে না।”
সাথে সাথে কড়ির ভেতরটা পুড়ে কয়লা হয়ে গেল । চোখ নামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এঁদের না বলে পালিয়েছিল সে? এঁদের? একবার যদি টের পেত কি হত তাঁদের? কান্নার দলাটা গিলে ফেলল কড়ি। গলায় কাঁটার মত বিঁধছিল আর শুধু যন্ত্রণা দিচ্ছিল।
কাদিন জানালা খুলে গ্রিলে দু’হাতে ভর দিয়ে দাঁড়াল। ঘাড় নীচু করে রেখেছে সে। কড়ি ভাইয়ের দিকে না তাকিয়েই বলল, “আমি এখন আসি।” সে আর দাঁড়াতে পারছে না। শক্তিতে, সাহসে কুলাচ্ছে না তার।
কাদিন বলল, “আমি এ বিয়ে করব না।”
.
দীপার হলুদের অনুষ্ঠান এখনও শেষ হয়নি। জাঁকজমকপূর্ণ আলোর ঝলকানিতে দীপাকে ছোট একটা হলদে পাখির মত দেখাচ্ছে। যে পাখি ডানা মেলে নতুন ঠিকানায় উড়ে যাচ্ছে। ইমাদ দূর থেকে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করল, “সে ঠিকানা খাঁচার না হোক। ঠিকানাটুকু হোক নীল স্বচ্ছ এক আলোর আকাশ। দীপুর ঠিকানা আকাশ হোক। দীপুর ঠিকানা আকাশ হোক।”
নিলয় পাশে এসে দাঁড়াল, “ইমাদ?”
ইমাদ চোখ বন্ধ রেখেই বলল, “হুম।”
“আমাদের ত স্টেজে উঠা নিষেধ।”
ইমাদ চোখ মেলল। নিলয় বলল, “আন্টি বললেন দীপুর কড়া নিষেধ।”
“আচ্ছা।”
নিলয় কিছু বলল না আর। ইমির সাথে কথা বলা আর না বলা একই। সে হয়রান হয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। ইমাদ ওর হাতটা টেনে ধরল। নিলয় বলল, “কি?”
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here