ইতির_সংসার পর্ব ২৩

0
489

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ২৩

ইতিকে যখন ডাক্তার সাহেব ডেকে নিয়ে যান তখন নাঈম ছিল আধো ঘুমে আধো জাগরণে। হঠাৎ পুরোপুরি সজাগ হয়ে দেখে ইতি পাশে নাই, সে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামতে যায় ইতিকে খুঁজতে যাবে সেজন্য। তুলি এগিয়ে এসে ভাইকে ধরতে লাগে তখন দুই ভাই বোন স্যালাইনের তারে জড়াজড়ি করে পড়ে যায়। সাথে সাথে নাঈমের হাতের ক্যানুলা ছুটে যায়, ফিনকি দিয়ে র/ক্ত বের হতে শুরু করে। তুলি ভয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়।

ইতি ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে ভাবে নাঈম ঘুমাচ্ছে এই সুযোগে গিয়ে ওর মেডিসিন গুলো আনা যাক। সামনে আগাইতে যাবে এইসময় তুলির চিৎকার শুনে দৌড়ে কেবিনে এসে দেখে ভাইবোন জড়াজড়ি করে নিচে পড়ে আছে আর নাঈমের হাত দিয়ে গলগল করে র/ক্ত পড়ছে। এক চিৎকার দিয়ে নার্সকে ডেকে ইতি সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়।

নার্স এসে আগে নাঈমের হাতের র/ক্তপাত বন্ধ করে ব্যান্ডেজ করে দিতে যায় কিন্তু নাঈমের চিৎকারে পারেনা। একেতো অনেকক্ষণ ইতিকে না দেখে অস্থির হয়ে গেছিল তার উপর চোখের সামনে ইতিকে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে দেখে নাঈমকে সামলানো কঠিন হয়ে যায়। হইচই শুনে তাড়াতাড়ি করে মুরাদের মা ছুটে আসেন, উনি ইতির মা কে সাথে নিয়ে ক্যানটিনে গেছিলেন চা খেতে। দুজনে মিলে তাড়াতাড়ি করে ওদের সামলে নেন। ইতিকে তুলে এটেন্ডডেন্ট বেডে শুইয়ে দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করে ইতির মা। নার্স নাঈমের ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে ইতির প্রেসার চেক করতে যায়। এরমধ্যে ইতির জ্ঞান ফিরে এলে নাঈমকে খুঁজতে থাকে। ইতির মা সরে বসলে দেখা পায় নাঈমের, পাশের বেডে শুয়ে তাকিয়ে আছে ইতির দিকে। মুরাদের মা ওকে চেপে ধরে আছে বেডের সাথে নইলে তখনই ছুটে যায় ইতির কাছে এমন অবস্থা।

সেই সময় নাজমা বেগম ও ইলিয়াস সাহেব কেবিনে আসেন। দুজনেই ভিতরের অবস্থা দেখে অবাক। নাঈম যখন পড়ে যায় তুলিকে নিয়ে তখন স্যালাইনের স্ট্যান্ড লেগে তুলি হাতে ব্যাথা পায়। এতো দুজনের অবস্থা দেখে চুপ ছিল কিন্তু মায়ের দেখা পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর কথায় তখন জানা যায় ওর হাতেও আঘা/ত লেগেছে। আবার নার্সকে ডাকলে সে তৎক্ষনাৎ পেইন কিলার ক্রীম লাগিয়ে দিয়ে যায়।

ইতি একটু ধাতস্থ হয়ে উঠতে গেলে সবাই ওকে উঠতে মানা করে। কিন্তু ও সবাইকে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। নাঈমের সাথে ওর কথা আছে জানায়। তখন মুরাদের মা সবাইকে ঠেলে নিয়ে বের হয়ে গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে যায়।

ইতি আস্তে আস্তে নাঈমের বেডে এসে বসে, ওর হাত ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে -“তোমার জন্য একটা খবর আছে। কিন্তু তুমি যদি সুস্থ না হও তাহলে কেমনে বলি বল?”

-“ইতি, আমি যেকোনো খবর শুনার আগে তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি তোমার গায়ে হাত তুলে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও প্লিজ। তুমি ক্ষমা না করলে আমি মরেও শান্তি পাবোনা। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।” নাঈম আকুল হয়ে ইতির কাছে ক্ষমা চায়।

হঠাৎ করে ইতি কেঁদে দেয়, নাঈমের কপালে চু/মু দিয়ে বলে -“এবারের মতো ক্ষমা করে দিলাম কিন্তু এরপর আর কখনো আমরা তোমাকে ক্ষমা করব না। কঠিন শা/স্তি দেব।”

-“হ্যাঁ তোমার আব্বু আম্মুর কাছেও ক্ষমা চাইব। উনারাও কষ্ট পেয়েছেন আমার আচরণে।” নাঈম বলে।

এবার নাঈমের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয় ইতি, নাঈমের নাক টেনে দিয়ে বলে -“আম্মু আব্বুর কাছে ক্ষমা তো চাইতেই হবে কারণ তুমি তাদের সন্তানকে কষ্ট দিয়েছ। তবে তুমিও খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারবে সন্তান কষ্ট পেলে বাপমায়ের কোথায় গিয়ে লাগে।” বলে নাঈমের বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে।

-“আমি আসলে বুঝতেছিনা তুমি কিসের কথা বলছ? আমি কিভাবে বুঝব? মানে? তুমি বলতে চাচ্ছ আমি মানে আমরা মানে আমাদের ঘরে নতুন কেউ আসতেছে? কি বল? কবে হল এই সুখবর?” অস্থির হয়ে যায় নাঈম।

ইতি আস্তে আস্তে বলে -“যখন তুমি আমাকে মারলে তখন আমি তোমাকে এই কথাই বলতে চাচ্ছিলাম। আম্মুর বাসায় যাওয়ার সময় বলতাম। কিন্তু তুমি তো তার আগেই…..”

ইতির মুখ চেপে ধরে নাঈম। -“আমি কত বড় অমা/নুষ যে যার ভিতরে আমার সন্তান বেড়ে উঠছে আমি তার গায়েই হাত তুলেছি। আল্লাহ ক্ষমা করে দিও আমাকে। ইতি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি আর কক্ষনও তোমার সাথে এভাবে রাগ করবনা। প্রমিজ।”

-“হ্যাঁ, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি, যদিও করা উচিৎ না। তবে হ্যাঁ ক্ষমা করলেও আমার গায়ে হাত তুলে যে অপরাধ তুমি করেছ তার শা/স্তি তোমাকে পেতেই হবে। অপেক্ষা কর পেয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আমি দেবনা, তোমার সন্তান দিবে বড় হয়ে।” ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে ইতি।

বাবা হবার আনন্দে মশগুল নাঈমের চোখেই পড়েনা কথাগুলো বলার সময় ইতির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ দরজায় নকের শব্দে দুজনেই তাকায় দরজার দিকে। নার্স দাঁড়িয়ে আছে নাঈমের রিপোর্ট হাতে নিয়ে। ইতিকে সেগুলো দিয়ে বলে ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করতে।

নাঈমকে বুঝিয়ে রেখে ইতি রিপোর্টগুলো নিয়ে যায় ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার সাহেব রিপোর্ট দেখে হাসিমুখে বলেন -“একদম সুস্থ আপনার স্বামী। তার কোন শারীরিক সমস্যা নাই। কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকায় এমনটা হয়েছে। আমিও সেটাই ভাবছিলাম। উনি যদি সুস্থবোধ করেন তাহলে উনাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন কাল সকালে। তবে আমি সাজেস্ট করব ওকে নিয়ে যাওয়ার আগে যদি সম্ভব হয় আপনার শ্বশুর শাশুড়ি সহ আপনাদের নিয়ে বসতে। কিছু কথা বলা প্রয়োজন।” রিপোর্ট দেখে ডাক্তার সাহেব বলেন।

-“অবশ্যই ডাক্তার সাহেব। কখন বসতে চান বলুন। আমি সবাইকে জানিয়ে দেব।” বলে ইতি।

-“আমি ১১টার মধ্যে চলে আসি। তাহলে ১১টায়ই হোক। আর কেউ আসুক আর না আসুক আপনার শাশুড়ী আর ননদ যেন অবশ্যই উপস্থিত থাকে।” বলেন ডাক্তার সাহেব।

অনেক কষ্টে নাজমা বেগমকে রাজি করিয়ে সবাই মিলে একসাথে এসেছে ডাক্তারের চেম্বারে। নাঈমকে বাসায় নিয়ে যাবে জন্য সবাই খুশি, আরো খুশি ওর খারাপ কিছু হয়নি জন্য, তার চেয়েও বেশি খুশি নাঈমের ঘরে নতুন মেহমান আসছে জন্য। শাশুড়িকে ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার রাজি করানোর জন্য শেষে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে হয় ইতিকে।

ইতি, নাঈম, নাজমা বেগম, ইলিয়াস সাহেব, তুলি, ওর শাশুড়ি ও ইতির বাবা-মা এলে ডাক্তার সাহেব বলতে শুরু করেন -“নাঈমের রিপোর্ট দেখলাম। আলহামদুলিল্লাহ এখন পর্যন্ত ভালো। ও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল স্ট্রেস ও প্যানিক এটাকে। আমি সবার সাথে কথা বলে যা বুঝলাম তাতে নাঈমের মা আর তুলি নাঈমকে খুব মানসিক চাপে রাখে। জানিনা উনাদের কি উদ্দেশ্য তবে এমন চাপ অব্যাহত থাকলে সেইদিন দূরে না যেদিন নাঈম স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে থাকবে অথবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এসাই/লামে থাকবে। কোনটা আপনারা চান নিজেরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিন। দেখুন কথাগুলো আমার হয়তো বলা মানায়না কিন্তু আমি চাই আমার রোগীরা যেন অসুস্থ হয়ে আবারও আমার কাছে ফিরে না আসুক। নাঈমের অসুস্থতার উৎস শুধুমাত্র মানসিক টানাপোড়েন। শারীরিক ভাবে সে সম্পুর্ন ফিট একজন ছেলে। এই বয়সী ছেলেদের যেমন হয়। দেখুন মিসেস ইলিয়াস স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে জান্নাতে। বাকি সমস্ত সম্পর্ক এসেছে বিবি হাওয়া ও হযরত আদম (আ:) দুনিয়ায় আসার পর। যে সম্পর্কটাকে আল্লাহপাক জান্নাতে সৃষ্টি করেছেন সেই সম্পর্কটাকে আমরা বরাবর তাচ্ছিল্য করে যাই। কেন? স্বামী যদি স্ত্রীর ভালোমন্দ দেখে তাহলে সে ভাড়ুয়া বা ভেড়া আবার স্ত্রী যদি স্বামীকে বেশি কেয়ার করে তাহলে সেটা হয় পজেসিভনেস। কেন এমন হবে? আমি আপনাকে শুধু বলছিনা, ম্যাক্সিমাম রোগী আসে বিয়ের পরের মানসিক টানাপোড়েন নিয়ে। একটা সুস্থসবল ছেলে বিয়ের পরে স্ত্রীকে নিজের মতো করে পেতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা না বিয়ের পর থেকেই একটা ছেলেকে দেখতে হয় কখন মা গাল ফুলালো আর কখন স্ত্রী।

এমন তো না যে আপনাদের দুজনের কেউ নাঈমকে কম ভালোবাসে। মিসেস ইলিয়াস যদি ছেলেকে জন্ম দেন তাহলে মিসেস নাঈম জন্ম দিয়েছেন একজন স্বামীকে। মিসেস ইলিয়াসের ভালোবাসা দেয়ার তিনজন মানুষ, মিস্টার ইলিয়াস আর দুই ছেলেমেয়ে কিন্তু মিসেস নাঈমের তো শুধুই নাঈম তাইনা? তাহলে কেন আপনি ওদের হিংসা করেন বা একসাথে দেখলে রেগে যান বলবেন কি মিসেস ইলিয়াস? পরের বাড়ির একটা মেয়ে আমার ছেলেকে ভালোবাসার জন্য নিজের সবকিছু উজাড় করে দিচ্ছে এটা দেখলেই তো মেয়েটাকে মাথায় তুলে রাখতে ইচ্ছে করে। আমার দুই মেয়ে আর এক ছেলে। ছেলে বিয়ে দিয়েছি। এখন আমার তিন মেয়ে আলহামদুলিল্লাহ। যা কিনি বা যাই করি ৩ মেয়ের জন্য সমান। বৌমা এখন মায়ের বাড়িই যেতে চায়না। আর আমার স্ত্রী তো বৌমাকে এমন ভাবে রাখে যেন মাথায় রাখলে উকুনে খাবে আর মাটিতে রাখলে পিঁপড়ে খাবে। বৌমার মুখ ভার দেখলে এখনো ছেলেকে ধরে পি/টায় আমার স্ত্রী। আমি আর ছেলে কামাই করি, সে আর তিন কন্যা মিলে মনের সুখে উড়ায়। কখনো ভুলেও বৌমার সাথে গলা উঁচু করে কথা বলেনা আমার স্ত্রী, ওর যুক্তি আমারও মেয়ে আছে, আমি পরের মেয়েকে আনন্দে রাখলে আল্লাহ আমার মেয়েদের আনন্দে রাখবেন। একটা পরের মেয়েকে ঘরে এনে এভাবেই আপন করে রাখতে হয়।” বলেন ডাক্তার সাহেব।

-“হইছে থামেন, অতো লেকচার দেয়া লাগবে না। এখানে কেন ডাকছেন সেটাই বলেন।” স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বাঁধা দেন নাজমা বেগম।

ডাক্তার সাহেব শান্তকন্ঠে বলেন -“তাহলে শুনুন কেন ডাকছি।”

জানতে চান কেন ডেকেছেন?
©️সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here