ইতির_সংসার পর্ব ২২

0
467

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ২২

ডাক্তার উনার চেম্বারে ঢুকে ইতিকে বসতে বলে টুকটাক হাতের কাজ সেরে নিয়ে দুই কাপ চা আনতে বলেন উনার এসিস্ট্যান্ট কে। চা আসতে আসতে উনি ইতির সাথে কথা শুরু করেন। এদিকে ডাক্তারের সময় নেয়া দেখে ইতির টেনশন শুরু হয়ে যায়। গলা খাঁকারি দিয়ে ডাক্তার বলতে শুরু করেন -“আপনাদের বিয়ের কতদিন? প্রেমের বিয়ে না পারিবারিক বিয়ে?”

-“৮ মাস হয়েছে আমাদের বিয়ের। পারিবারিক ভাবে। নাঈমের কি অবস্থা দেখলেন স্যার?” উদ্বিগ্ন ইতি জানতে চায়।

-“আলহামদুলিল্লাহ এখনো পর্যন্ত ভালো আছে, বাকিটা রিপোর্ট দেখে বলতে পারব। আপনাদের পরিবারে কারা আছেন? মানে একসাথে কে কে থাকেন?” ডাক্তার আবারও প্রশ্ন করেন।

-“আমি, নাঈম, ওর বাবা-মা আর ওর বোন যার সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে কিন্তু আমাদের সাথেই থাকে।” বলে ইতি।

-“নাঈম কি খুব মানসিক চাপে থাকে? আপনি কি খুব ঝগড়া করেন ওর সাথে?”

-“না ডাক্তার সাহেব, আমি বিয়ের পর থেকে আমার স্বামীকেই আমার ধ্যান জ্ঞান জানি। আমার প্রতিটা সময় কেটে যায় কিভাবে ওকে ভালো রাখব সেটা ভেবে। কিন্তু কেউ অসুস্থ হলে আপনারা শুধু এটাই ধরে নেন কেন যে স্ত্রীর সাথেই ঝগড়া হয়েছে বা স্ত্রী শুধু ঝগড়া করে? যৌথপরিবারে তো আরো মানুষ থাকে। শুধু বৌইই দোষী? বাকি সব ধোয়া তুলসীপাতা? আপনার কথা শেষ হলে আমি যাই নাঈমের কাছে? আমাকে বেশিক্ষণ না দেখলে ও অস্থির হয়ে যায়। ঝগড়া করলে এটা সম্ভব ছিল বলুন?” হঠাৎই রেগে যায় ইতি।

চা চলে আসে। এসিস্ট্যান্ট যাওয়ার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে ইতির দিকে চা এগিয়ে দেন ডাক্তার। তারপর বলেন -“উত্তেজিত হবেন না প্লিজ। আপনার স্বামীর ভালোভাবে চিকিৎসা শুরুর জন্য ব্যাকগ্রাউন্ড জানা প্রয়োজন। কারণ শুধুই ওষুধ কখনো রোগীকে সুস্থ করেনা। আপনি হয়তো আমার ব্যাপারে জানেন না। আমি খুব কম রোগী দেখি, রোগীর পরিবারের সাথে অনেক কথা বলি, অসুস্থতার উৎস জানার চেষ্টা করি। আলহামদুলিল্লাহ আমার চিকিৎসায় রোগী সুস্থ হয়নি এমন খুব কম। আমি চাইনা পুরনো রোগী আমার দরজার বাইরে অপেক্ষা করুক, সব নতুন রোগী চাই আমি। সুতরাং আপনার কাছে খারাপ লাগলেও আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়া জরুরি। আমি অন্যদের সাথেও কথা বলব রিপোর্ট আসা পর্যন্ত যাতে রিপোর্ট হাতে পেয়ে চিকিৎসা শুরু করতে সময় না লাগে। নিন চা খান, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

-“সরি ডাক্তারসাহেব। আসলে গতকিছুদিন এতকিছু ঘটে গেছে যে ইচ্ছে থাকলেও শান্ত থাকতে পারিনা। পরিবারের বড় ছেলে তো আসলে ছেলে না, তারা হয় এটিএম মেশিন। বাবা-মা বোনের জন্য করেই যাবে শুধু কিন্তু স্ত্রীর জন্য কিছু করা যাবেনা। আর বেশি কিছু বলতে চাচ্ছিনা। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ, বুঝে নেন প্লিজ। আমি নাঈমের কাছে যাই, যদি সম্ভব হয় ওর পরিবারের অন্যদের বুঝান, আমি হাতজোড় করে অনুরোধ করছি। ওরা এতো বেশি টক্সিক যে হজম করা কঠিন। আল্লাহ হাফেজ। চায়ের জন্য ধন্যবাদ।” বলে ইতি ডাক্তারকে সালাম দিয়ে চলে যায় নাঈমের কাছে।

ডাক্তার এবার নাজমা বেগমকে আসতে বলেন। উনি এলে এসি বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন -“কি খাবেন বলুন?”

নাজমা বেগম বলে উঠেন -“আমার ছেলে মরতেছে আর আপনি বলেন খেতে। এই সময় খাওয়া নামে গলা দিয়ে?”

-“কে বলল আপনার ছেলে মরতেছে? আমি তো দেখে এলাম ভালো। মানুষ চিনতে পারছে, স্বাভাবিক জ্ঞান আছে তাহলে তো ভালো আছে বলা চলে তাইনা বলুন? নাকি আপনি চান আপনার ছেলে সত্যিই মরুক?” জিজ্ঞেস করেন ডাক্তার।

-“কি আবোলতাবোল কথা বলেন? আমি কেন চাইবো আমার ছেলে মরুক? আমিতো চাইই আমার ছেলে সুস্থ থাকুক, ভালো থাকুক…….”

-“আর আগের মতো জানপ্রাণ দিয়ে খাটুক তাইনা ম্যাম?” নাজমা বেগমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেন ডাক্তার। -“দেখুন ম্যাম, ছেলে আপনার এটা ঠিক আছে। ছেলের জন্য জন্ম থেকে কষ্ট করেছেন সেটাও ঠিক আছে কিন্তু ছেলে এখন বড় হয়েছে, বিয়ে করেছে, তার একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে। সেটা তো বুঝতে হবে তাইনা?”

-“আমি বুঝিনা কে বলল? ঐ ডাই/নিটা? সে তো বলবেই। বিয়ের পর থেকেই আমার ছেলেকে হাত করছে, তাবিজ করছে সে। নইলে অমন মা ভক্ত ছেলে আমার সে কেমনে ফোন বন্ধ করে শুধুমাত্র ডাই/নিটাকে সাথে নিয়ে ঘুরে আসে? আগে তো কখনও এমন করেনি আমার ছেলে।” রেগে যান নাজমা বেগম।

-“দেখুন ম্যাম, আমিও এক মায়ের ছেলে। আবার একজনের স্বামীও বটে। ছেলে হিসেবে মায়ের প্রতি যেমন আমার দায়িত্ব কর্তব্য আছে ঠিক তেমনই আছে আমার স্ত্রীর প্রতিও। একজন মা যেমন একটা ছেলের সব চাহিদা পূরণ করতে পারেনা ঠিক তেমনই স্ত্রীও পারেনা সবকিছু পূরণ করতে। আপনার ছেলের তার স্ত্রীর কাছে যে চাহিদা তা কি আপনি মিটাতে পারবেন? নাকি সম্ভব বলুন? ছেলেমেয়ে বড় হলে তাদের বিয়ে দিতে হয়। আর অন্যসব সম্পর্কের চেয়ে সবচেয়ে কাছের সম্পর্ক হল স্বামী স্ত্রী। কোন ছেলে যদি তার স্ত্রীর দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে না পারে তাহলে সে আল্লাহর কাছে ঠেকে থাকে কিন্তু তারা যদি একাধিক ভাইবোন হয় তাহলে বাবামায়ের জন্য ঠেকে থাকেনা। স্বামীর উপার্জনে সবচেয়ে বেশি হক্কদার তার স্ত্রী, তারপর পরিবারের অন্য কেউ। এগুলো আমার কথা না, ইসলামের কথা। হয়তো এই মুহুর্তে আমি আপনাকে রেফারেন্স দিতে পারছিনা তবে আপনি চাইলে অবশ্যই রেফারেন্স যোগাড় করব ইনশাআল্লাহ।” ধীরে ধীরে বলেন ডাক্তার সাহেব।

-“আপনার রেফারেন্স আপনার কাছেই রাখেন। আমার ছেলের চিকিৎসা মাগনা করছেন না, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিচ্ছেন, তাহলে এতো লেকচার কেন দিচ্ছেন? আপনার কাজ রোগীকে সুস্থ করে তোলা, সেটাই করুন। ওই ডাই/নির কাছে থেকে টাকা খেয়ে আমাকে লেকচার দিতে হবে না। আর আমার ছেলেকে সুস্থ করতে না পারলে বলুন ঢাকায় নিয়ে যাই। যত্তসব আজাইরা প্যাচাল শুরু করেছেন।” রেগে যায় নাজমা বেগম।

ডাক্তার সাহেব কিছু বলতে যাবেন সেই সময় পর্দা ঠেলে চেম্বারে ঢুকেন নাঈমের বাবা, ইলিয়াস সাহেব। -“সরি ডাক্তার সাহেব, আপনার অনুমতি না নিয়েই ঢুকে পড়েছি। কিন্তু আমার স্ত্রীর গলার টানে না এসে পারলাম না। কাকে কি বুঝাতে যাচ্ছেন আপনি? এই মহিলাকে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করা আর মহিষের সামনে বীন বাজানো একই কথা। কারো কোনো ভালো কথা এর কানে ঢুকেনা, নিজে যা ভালো মনে করবে সেটাই করবে। আমার জীবনটাতো শেষ হয়েই গেছে এখন আমার ছেলের জীবন শেষ করার উপায় বের করছে। ওর পক্ষ থেকে সরি বলছি ডাক্তার সাহেব।” বলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন -“সারাজীবন তো শুধু টাকাই চিনে গেলে, মানুষ মানুষের মন এসবের তো কোন দাম নাই তোমার কাছে। ডাক্তার সাহেবকে যা বলেছ তার জন্য ক্ষমা চাও। উনি তোমার ছেলের চিকিৎসার জন্য এক টাকাও নিচ্ছেন না। শুধু তাই না রোগী সুস্থ হয়ে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত উনি রোগীর কাছে কোন টাকাই নেন না। উনার মতো চিকিৎসা তুমি ঢাকার কোন ডাক্তারের কাছে পাবানা। উনি নিজের জন্মস্থানকে ভালোবেসে এখানেই আছেন। বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে কয়জন ফিরে এসেছে দেশে? উনার মতো মানুষকে তুমি অপমান কর তোমার এতো সাহস? তোমার ছেলে কেন অসুস্থ হয়েছে জানো? তোমার জন্য, তোমার আচরণের জন্য। ছেলের টাকা ভালো লাগে কিন্তু ছেলে কি চায় তার মন কি বলে কখনো খোঁজ নিয়েছ? নিবা কই থেকে? স্বার্থ/পর মহিলা একটা। নিজের মতো করে মেয়েটাকেও গড়ে তুলছ। এত্ত নেগেটি/ভিটি মানুষের মধ্যে থাকতে পারে তোমার সাথে বিয়ে হবার আগে জানতে পারিনি। ছেলের কামাই খাওয়ার খুব শখ তাইনা? জীবনে আমার মায়ের হাতে এক টাকা দিতে দিয়েছ? আমি কারো ছেলে তখন সেটা ভুলে গেছিলা তাইনা? ছেলেকে বাঁচাতে চাইলে এক্ষুনি ডাক্তার সাহেবের কাছে ক্ষমা চাও, এক্ষুনি মানে এক্ষুনি।” স্ত্রীর হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলেন ইলিয়াস সাহেব।

ইলিয়াস সাহেবের মুখের কথা শুনে নাজমা বেগম মনে হয় অবাক হতেও ভুলে গেছেন। সবসময়ের চুপচাপ মানুষটার এ কি রূপ?

ওদিকে নাঈমের কেবিনে চলছে আরেক ঘটনা।
চলবে।
@সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here