ইতির_সংসার পর্ব ২৪

0
620

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ২৪

সবার দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে ডাক্তার সাহেব বলেন -“আমার মতে মিসেস ইলিয়াস আর তুলির কাউন্সেলিং প্রয়োজন। রিলেশনশিপ কাউন্সিলর অথবা ফ্যামিলি কাউন্সিলরের কাছে কিছুদিন অন্তত কাউন্সেলিং করতে হবে। তাহলে উনারা বুঝবেন উনাদের এসব আচরণ কতটা যুক্তিযুক্ত। একজন ডাক্তার হিসেবে আমার এটাই মনে হয়। এবার আসি নাঈমের ব্যাপারে। সে সম্পুর্ণ সুস্থ আলহামদুলিল্লাহ। তার যা সমস্যা ছিল সেটা তার মা ও বোনের ক্রমাগত মানসিক চাপে হয়েছে। নাঈমের সুস্থ থাকার জন্যই উনাদের কাউন্সেলিং করা জরুরি। এবার আসি একটা সুখবরে। মূলত এটা বলার জন্যই সবাইকে একত্রিত করা। আশাকরি এই সুখবরে নাঈম পুরোই সুস্থ হয়ে যাবে কোন মেডিসিন ছাড়াই। কি বল ইতি তাইনা?” বলে ইতির দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন -“এখন কিন্তু ইতির আরো বেশি যত্নের প্রয়োজন নাঈম। তোমাকেও আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। কারণ তুমি এখন শুধু কারো সন্তান নও, সন্তানের বাবা হতে যাচ্ছ।”

একসাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠেন ইতির বাবা-মা, মুরাদের মা ও ইলিয়াস সাহেব। উঠে গিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। -“বাবারে আমার। কত্তযে খুশি হইছি বুঝাতে পারবোনা। তোকে বিয়ে দেয়ার পর থেকে স্বপ্ন দেখতেছিলাম আমি দাদা হইছি। আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ। মা ইতি, তুমি আমার মায়ের আরেক রূপ। আজ এই বুড়ো ছেলেকে তুমি যে খুশি দিয়েছ আমি মন থেকে দুয়া করি তোমার সন্তানেরা যেন তোমাকে সবসময়ই মাথায় করে রাখে।” বলতে বলতে আবেগে কেঁদে উঠেন তিনি।

ইতির বাবা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন -“এইতো সেদিন তোকে কাপড়ে পেঁচিয়ে এনে আমার কোলে দিল আর আজ তুই আমাকে নানা হবার খবর দিলি মা। আল্লাহ তোকে ও তোর সন্তানকে নেক হায়াত দিক। সবধরনের বালামুসিবত থেকে দূরে রাখুক। আমিন।”

সবাই একসাথে বলে উঠে আমিন। ইতির এই সুখবরে সবাই খুশি শুধু তুলি আর ওর মায়ের মুখে হাসি নাই। ইতি সেটা খেয়াল করে কিন্তু কিছু বলেনা। এরা দুজন খুশি হবে সেটা সে আশাও করেনি। কেমন মানুষ এরা? অনেককেই দেখেছে ভাবি ননদে দা কুমড়ো সম্পর্ক কিন্তু ফুপি হিসেবে বেস্ট, দাদী হবার খুশিতে অনেকে ছেলের বউয়ের সাথে ভালো ব্যবহারও করে। অথচ এরা জানি কেমন।

নাঈম আর ইতিকে নিয়ে সবাই বাসায় ফিরে আসে। মুরাদের মা খাদিজা বেগম উনার বাসা থেকে খাবার রান্না করিয়ে এনেছেন দুপুরের জন্য। তাই আর তুলির বাবা-মাকে উনি যেতে দেন না। দুপুরে সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া করে উঠলে উনি ইতি আর নাঈমকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে তুলিকে বাসন মাজাসহ খাওয়ার পরে যা যা করতে হয় সব সেরে উনাদের জন্য চা বানাতে বলে দুই বেয়াইকে ড্রইংরুম ছেড়ে দিয়ে দুই বেয়ান নিয়ে নাজমা বেগমের রুমে গিয়ে বসেন। খাদিজা বেগমের উপস্থিতিতে নাজমা বেগম না পারছেন ইতির মাকে তাচ্ছিল্য করতে না পারছেন ইতিকে খাটাতে।

এদিকে নাঈম ঘরে ঢুকেই ইতিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে -“আমার সত্যিই এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা আমি বাবা হব। আমার একান্ত আপন আরেকজন দুনিয়ায় আসবে। বল তুমি আমার কাছে কি চাও? এই মুহুর্তে যেটাই চাইবে আমি তোমাকে দেব কথা দিলাম। তুমি শুধু বল কি চাও ইতুমনি।”

নাঈমের বুকে মুখ লুকিয়ে ইতি বলে -“আমি শুধু চাই তোমাকে সবসময়ই খুশি রাখতে, ভালো রাখতে। তুমি ভালো থাকলে, তুমি বেঁচে থাকলে আমার সব পাওয়া হবে। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবনা সত্যি।” বলে হুহু করে কেঁদে উঠে ইতি।

নাঈম ওর চোখ মুছিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে -“পাগলি আমি তো আছিই। যতক্ষণ তুমি আমার সাথে আছ আমিও বেঁচে আছি। তুমি আমাকে ছেড়ে গেলেই আমি মারা যাব সত্যি। এখন রেস্ট নাও। নইলে আমার বাবু বলবে বাবা পঁচা। মাকে খালি কষ্ট দেয়।”

কেটে যায় ৩ মাস। ইতি ফিরে আসায় তুলিকেও সাথে নিয়ে যান খাদিজা বেগম। তুলির সাথে নাজমা বেগমের প্রতিদিন ফোনে কথা হলেও খাদিজা বেগম ওকে বাপের বাড়ি আসতে দেয়না। জানেই যে সে গেলেই ইতির সাথে অশান্তি করবে। যদিও উনার সাথেও কম অশান্তি করছেনা তা না।

ইতির ৩ মাসের সময় একদিন ওর মা আসেন ইতিকে নিয়ে যেতে। গর্ভবতী মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চান। নাঈম প্রথমে আপত্তি করলেও নিজের মায়ের আচরণ আর ইতির যত্নের কথা ভেবে যেতে দিতে রাজি হয়। কথা হয় ডেলিভারি পর্যন্ত ইতি মায়ের বাড়িই থাকবে, নাঈম যাওয়াআসা করবে। যেহেতু কয়েকমাসের জন্য যেতে হবে সেহেতু কিছু প্রস্তুতির ব্যাপার আছে সেজন্য ইতি পরদিন যেতে চায়। ওর মাও বুঝে রাজি হয়। ইতি কয়েকমাসের জন্য যাচ্ছে তাই নাজমা বেগম খাদিজা বেগমকে বলে কয়ে তুলিকে ক’দিনের জন্য আনান।

পরদিন ইতি স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছিল তাই দেরিতে ঘুম থেকে উঠে, ইদানীং মর্নিং সিকনেস বেড়ে গেছে ওর। ঘুম থেকে উঠে দেখে ওয়াশরুমে পানি নাই। কি হয়েছে জানতে রুম থেকে বের হয়ে শুনে পানির মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। ততক্ষণে নাঈম অফিসে চলে গেছে, ইলিয়াস সাহেব তখন বাজারে। এদিকে ঘুম থেকে উঠে তলপেটে চাপ, পানি নাই, বিশ্রী অবস্থা। নাজমা বেগমের ওয়াশরুমে সারাবছর পানি মজুদ করা থাকে কিন্তু এখন ইতির প্রয়োজনে উনি দিবেন না। তাই বাধ্য হয়ে ইতি যায় উঠোনের অপরপ্রান্তে প্রায় পরিত্যক্ত টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে। টিউবওয়েলের চারপাশটা ছোট ছোট আধলা ইট দিয়ে রাখা। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে টিউবওয়েলটা অনেক শক্ত হয়ে গেছে। ইতি ছোট এক বালতি পানি তুলে নিয়ে ঘুরে আসতে নিতেই হঠাৎ পায়ের নিচের ইটটা একপাশে দেবে যায় আর সে তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় বালতির উপরেই। সাথে সাথে এক চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।

কতক্ষণ সেভাবে পড়ে ছিল কেউ জানেনা। ইলিয়াস সাহেব বাজার থেকে ফিরে ইতি মামনি বলে ডাকতে ডাকতে বাসায় ঢুকেন। উনি ইতির প্রিয় কিছু খাবার এনেছেন বাজার থেকে। ইতির রুমের দরজায় কড়া নাড়েন কিছুক্ষণ। সাড়া না পেয়ে ভাবেন ঘুম থেকে উঠেনি। কিচেনে খাবার রেখে হাতমুখ ধুতে গিয়ে দেখেন পানি নাই। টিউবওয়েল থেকে হাতমুখ ধোয়ার উদ্দেশ্যে কলপাড়ে গিয়ে দেখেন ইতি বেকায়দা ভাবে অজ্ঞান পড়ে আছে আর ওর শরীরের নিচের দিক র/ক্তে ভেসে যাচ্ছে।

সাথে সাথে চিৎকার করে স্ত্রী কন্যাকে ডাকেন উনি, কিন্তু কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। এম্বুলেন্সে কল দিয়ে আসতে বলে নাঈমকে কল দিয়ে জানান। এরমধ্যে উনি চেষ্টা করেন ইতিকে কোলে করে ঘরে আনার। কিন্তু উনার বার্ধক্য আর ইতির অজ্ঞানজনিত ওজনবৃদ্ধির জন্য পেরে উঠেন না। পাগলের মতো দৌড়ে স্ত্রীর ঘরে গিয়ে দেখেন নাজমা বেগম নাই আর তুলি কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে আর তালে তালে নাচছে। এক ধাক্কা দেন তিনি মেয়েকে। তখন তুলি কান থেকে হেডফোন খুলে জানতে চায় কি হয়েছে?

ইলিয়াস সাহেব তুলিকে নিয়ে ধরাধরি করে ইতিকে বারান্দায় এনে শুইয়ে দিতেই এম্বুলেন্স চলে আসে। এরমধ্যে অনেকবার চেষ্টা করেছেন ইতির জ্ঞান ফেরাতে, পারেন নাই। ভয়ে বারবার শুধু ইতির পালস পরীক্ষা করছেন আর আল্লাহকে ডাকছেন।

এতোকিছু হয়ে গেল নাজমা বেগমের কোন খোঁজ নাই। ফোন দিয়ে দেখা যায় ফোন বাসায় ফেলে উনি গেছেন পাড়া বেড়াতে। এম্বুলেন্সের আওয়াজে গলির এক বাসা থেকে বের হয়ে দেখেন এম্বুলেন্স এটেন্ডেন্ট স্ট্রেচার নিয়ে উনার বাসার দিকেই যাচ্ছেন। হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ঢুকে দেখেন ইতি বারান্দায় শুয়ে, তার পাশে বসে নি:শব্দে কেঁদে যাচ্ছেন ইলিয়াস সাহেব, ইতির শরীরের নিচের দিক র/ক্তে ভেসে যাচ্ছে।

এম্বুলেন্স এসে ইতিকে নিয়ে যায়, সাথে যান ইলিয়াস দম্পতি। ক্লিনিকে পৌঁছে দেখেন নাঈম ও ইতির মা-বাবা মাত্র এসে পৌঁছেছে। নাঈম পৌঁছেই আগে কেবিন ঠিক করে। এম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে ইতিকে নিয়ে যাওয়া হয় ইমার্জেন্সিতে। ডাক্তার প্রাথমিক ভাবে দেখে ওটিতে দেয়ার নির্দেশ দেন। তার আগে একটা হোল এবডোমেন আলট্রাসনোগ্রাম করাতে বলেন।

শরীর থেকে প্রচুর র/ক্ত পড়ে যাওয়ায় খুবই দুর্বল হয়ে যায় ইতি। জ্ঞান ফিরে আসলেও খুব দুর্বল। আমার বাচ্চা বলে তলপেটে হাত দিয়ে কাপড় থেকে হাতে র/ক্ত লাগতে দেখে আবারও অজ্ঞান হয়ে যায়।

প্রচুর ব্লাডডোনার যোগাড় করতে বলে ইতিকে নিয়ে ওটিতে যায় ডাক্তার। জরুরিভাবে আগে র/ক্ত বন্ধ করতে চেষ্টা করেন। এদিকে নাঈম সবাইকে ফোন দিয়ে ও পজিটিভ র/ক্তের কেউ আছে কি না খোঁজ নিতে থাকে। ফেসবুকে বড় বড় র/ক্তের গ্রুপগুলোতে পোস্ট দেয় ডোনার চেয়ে।

দুজন ডোনার এগিয়ে আসে। দ্রুত তাদের র/ক্ত নিয়ে স্ক্যানিং করে ওটিতে পাঠানো হয়। ওটির বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে। খাদিজা বেগম খবর পেয়ে এসেই তুলিকে সপাটে এক চ/ড় লাগান। সবাই অবাক হয়ে যায় শান্ত খাদিজা বেগমের এই আচরণে। উনি তুলিকে জিজ্ঞেস করতে থাকেন -“কি করেছ তুমি স্বীকার কর তুলি। এতোদিন ইতির কিছু হলনা আর তুমি গেলে সাথে সাথে এতোবড় দুর্ঘটনা? কি করেছ স্বীকার কর এক্ষুনি।”

গালে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তুলি বলে -“আমি কি করছি? যা কিছু হয় খালি আমারই দোষ?”

-“হ্যাঁ তোমার দোষ হবেই। তুমি কাকে ফোনে বলেছ যে আমি আসি আগে তারপর সব ঠিক করে দেব, আমাকে চিনেনা। কাকে বলেছ বল? নিশ্চয়ই মা মেয়ে পরামর্শ করছিলে। আমি পাশে থেকে সব শুনেছি। এতো শয়/তানি কেন তোমাদের মনে? ছিহ।” আরো কিছু বলতেন খাদিজা বেগম কিন্তু নার্স ওটি থেকে বের হয়ে নাঈমকে খুঁজে দেখে চুপ হয়ে যান। নার্স কি বলতে চায় নাঈমকে?

বি:দ্র: প্রিয় পাঠক, একটা লেখায় প্রাণসঞ্চার করেন আপনারাই। আপনাদের সুন্দর গঠনমূলক মন্তব্য লেখকের লেখার গতি এগিয়ে দেয় অনেকগুণ। প্লিজ আপনারা শুধু next না লিখে লেখা সম্পর্কে আপনাদের মতামত জানান। তুলির কেমন পরিণতি চান আপনারা?
©️সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here