আষাঢ়ে_মেঘ,পর্ব_৩

#আষাঢ়ে_মেঘ,পর্ব_৩
#নাজমুন_বৃষ্টি

রিধি চোখ খুলতেই নিজেকে হাসপাতালে’র ব্যাডে আবিষ্কার করলো। পাশেই রিধির মা সুলতানা বেগম রিধির হাত ধরে বসে আছে। তার ভাই সিহান বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সিহান বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে তার বোনটার কী হলো! রিহানের বিয়ের কথা চলাকালীনের পর থেকে তার এই চঞ্চল বোনটা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল।

-‘কিরে মা! কী হয়েছে তোর? আমিও এতো তাড়াহুড়োর মধ্যে তোর খাবারের খেয়াল রাখতে পারিনি আর তুইও সেই সুযোগে আর খাস নি। তুই বুঝিস না? ওই ফ্ল্যাটে আমি একজন দেখাশোনা ছাড়া আর কেউ নেই। রিহানের মায়ের মতো করে সব কিছু আমাকেই গোছাতে হচ্ছে যার ফলে আমার তোর প্রতি তেমন খেয়াল ছিল না। তুই কী এখনো ছোট? তুই যে এখনো সুযোগ পেলেই খাবারের এমন অনিয়ম করিস যার ফলাফল আজকের এই হাসপাতালের ব্যাডে। তোর বাবা জানতে পারলে কী হবে ভেবে দেখছিস? আর করবি না এমন। আর এতো কীসের টেনশন করিস? এই বয়সে মাথায় এতো কীসের চাপ দিস? ডাক্তাররা এসব কী বলে গেল!’ সুলতানা বেগম বলে উঠল রিধিকে উদ্দেশ্য করে।

-‘আহ মা, রিধি মাত্রই উঠল এমন করছো কেন? আই বোন, এগুলো খেয়ে নেয়। তোর খাবারের অনিয়মের জন্য এমন হচ্ছে। এগুলো খেয়ে ওষুধ খেয়ে নেয়। তারপর আমরা চলে যাবো বাসায়।’ বলেই সিহান রিধির দিকে স্যুপের বাটি থেকে এক চামচ এগিয়ে দিল।

রিধি ভাইয়ের দিকে ঝাপসা চোখে একবার তাকিয়ে খেয়ে নিলো।
খেতে খেতেই হঠাৎ খেয়াল হলো, আচ্ছা সে তো তিশাদের বাড়িতেই পড়ে গিয়েছিল। তাহলে রিহান ভাই কী একবারও দেখলো না! এক ফলকের জন্যও রিধিকে দেখতে আসলো না! মানুষটার কথা ভাবতে গিয়েই রিহান ভাইয়ের কবুল বলার আওয়াজটা তার কানে আবারো প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। হয়ত বিয়ে করে তার নতুন বউএর সাথেই আছে রিহান ভাই। এখন আর রিধির কথা ভাবার সময় নেই। রিধির চোখ বেয়ে হঠাৎ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।

রিধিদের ক্যাবিনের বাইরে দরজার কাঁচটা দিয়ে রিহান এক ফলক রিধির দিকে তাকালো। সে আজ চাইলেও রিধির পাশে যেতে পারছে না। মাত্র একদিনের ভেতর মেয়েটার চেহারা একদম শুকিয়ে গিয়েছে। রিধিকে এখানে আনার পরপরই রিহান তিশাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌছিয়ে দিয়ে জরুরি কাজের কথা বলে বেরিয়ে গিয়েছিলো। সিহানের ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করে এই হাসপাতালে এসেছে। সে যে তার রিধিকে না দেখে এক মুহুর্তও কল্পনা করতে পারবে না। এখন আর চাইলেও রিধির সাথে আগের মতো আর কথা বলা হবে না। ডাক্তার ওই রুম থেকে বের হওয়ার পর পরই রিহান ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞেস করেছিল রিধির ব্যাপারে। রিধির কান্নারত মুখ দেখে রিহানে ইচ্ছে হলো এখনই গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে রাখি কিন্তু এই ইচ্ছেটা যে আর পূরণ হওয়ার নয়। এখন দুজনের মাঝে অনেক বড়ো দেয়াল। যে দেয়ালটা ডিঙিয়ে রিধির কাছে যাওয়া অসম্ভব। রিধির দিকে তাকাতে তাকাতে রিহানের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। ভেতরে সিহানকে উঠে যেতে দেখে রিহান তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সরে গেল।
রিধির হঠাৎ মনে হলো দরজার কাঁচ দিয়ে ওই পাশে রিহান ভাইয়ের মতো কাওকে জানি সরে যেতে দেখেছে। রিধি দরজার দিকে আবারো দৃষ্টি দিল। কই না, এখন তো আর দেখা যাচ্ছে না। হয়ত তার দেখার ভুল। রিহান ভাইয়ের আজ বিয়ে হয়েছে, সে তিশা আপুকে ছেড়ে কেন রিধির জন্য এখানে আসবে!

সিহান সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে রিধিকে ধরে হাসপাতালের সবকিছু ঠিকঠাকভাবে সম্পূর্ণ করে রিধিকে গাড়িতে তুলে দিলো। অবশ্য হাসপাতালের কতৃপক্ষ একদিন রেখেই রিধিকে ছাড়তে চেয়েছিল কিন্তু রিধি হাসপাতালে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে ভেবে সিহান জোর করে নিয়ে এসেছে।
রিধির পাশে সুলতানা বেগম উঠে রিধিকে বুকে জড়িয়ে নিলো। তিনি বুঝতে পারছে না, হঠাৎ করেই মেয়েটা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। আশেপাশের এগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে নিজের মেয়েটার দিকেই ভালোভাবে নজর দিতে পারলো না যার ফলে তার মেয়ে আজ এমন পরিস্তিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে, এসব ভেবেই তার নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হলো। হয়ত তার মেয়ে মানসিকভাবে ডিপ্রেসড। মেয়ের সাথে অতটা ফ্রি না হওয়াতে মেয়ে তার থেকে যথেষ্ট দুরুত্ব বজায় রেখে চলতো। সুলতানা বেগমও আর নজর দেয়নি কিন্তু এখন বুঝতে পারছে। তার জন্যই হয়ত তার মেয়ে আজ এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি এসব ভাবতেই ভাবতেই রিধির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। রিধি একদম ছোট বাচ্চার মতো গুটিসুটি মেরে তার মায়ের বুকে স্থান নিয়েছে।
হঠাৎ রিধি তার মায়ের কোল থেকে মাথা উঠিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে আশেপাশে তাকালো। তার মনে হলো, রিহান ভাই এখনই তার গাড়ির পাশ দিয়ে গিয়েছে কিন্তু এদিক সেদিক তাকানোর পরও সে রিহান ভাইয়ের কোনো অস্তিত্ব দেখতে পারেনি। তার মস্তিষ্কে এখন শুধুই রিহান ভাই চলাফেরা করে। সে আবারো গিয়ে মায়ের বুকে গুটিসুটি মেরে রইল।

বাসায় ফিরতেই রিহান ভাইদের ফ্ল্যাট ডিঙিয়ে উঠার সময় মকবুল শেখকে দরজায় চিন্তাগ্রস্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। রিধিকে দেখতেই তিনি তার চিন্তার চেহারায় কোনোমতেই একটা হাসি টেনে আনলো। সিহানের কাছ থেকে তিনি রিধির সব খবরাখবর নিয়েছেন। তিনি রিধির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল,
-‘কিরে মা, খানা পিনা ঠিকমত না খেলে চলবে? ঠিকমত খাবি তো মা।’

রিধি ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নাড়তেই মকবুল শেখ সিহানকে রিধির সাথে যেতে বললেন। রিধিকে সিহান ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মকবুল শেখ আর সুলতানা বেগমের কথোপকথন শুনে থমকে গেল।
-‘ভাইসাব, আপনাকে এমন চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে ক্যান? আপনি এভাবে দরজার দ্বারে দাঁড়িয়ে আছেন যে?’ সুলতানা বেগম বলে উঠলেন।

-‘রিহান বাসায় ফেরেনি এখনো। তিশা মেয়েটা রুমে বসে আছে রিহানের অপেক্ষায় আর রিহানের মোবাইলও বন্ধ।’ মকবুল শেখ থমকে যাওয়া কণ্ঠে বলল।

রিধি যেতে যেতেই বড়ো মামার এমন কথা শুনে থমকে গেল। তার মানে হাসপাতালে রিহান ভাইকে দেখা তার ভ্রম ছিল না, সেটা সত্যিই রিহান ভাই ছিল! কিন্তু এখন এসব করে কী হবে! উল্টো দুজনের মাঝে তৃতীয় জন হিসেবে তিশা মেয়েটাই কষ্ট পাবে।
সিহান বোনের থেমে যাওয়া দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রিধি এবার হেঁটেই রুমের ভেতর প্রবেশ করলে সিহান বলে উঠল,
-‘বোন তুই থাক। আমি একটু বাইরে যাই।’

রিধি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই সিহান দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। রিধি সিহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে জানে তার ভাই এখন রিহানকে খুঁজতে যাচ্ছে আর খুঁজে পাবেও। রিধির মাঝে মাঝে ভয় হয়, যদি রিহান ভাই সিহান ভাইকে এসব কিছু বলে ফেলে তাহলে সিহান ভাই কী করবে তা রিধি ভাবতেও পারে না। রিধির কারণেই এই একটা মাত্র কথা রিহানভাই সিহানভাইকে বলেনি এতো কাছের বন্ধু হয়েও। রিধিই ওয়াদা নিয়েছিল রিহানের কাছ থেকে – যাতে রিহান রিধির ভাই সিহানকে কথাটি না বলে। যদি মকবুল শেখ রাজি হয় তাহলে রিধির পরিবার জানবে এদের প্রণয়ের কথা। কিন্তু রিহান মকবুল শেখকে তাদের দুজনের কথা বলার আগেই এসবকিছু ঘটে গেল। রিধি আর কিছু না ভেবে রুমে গিয়ে শুয়ে রইল।

রাত ঘনিয়ে আসতে লাগল। রিধি সব ভাবনা মাথার বাইরে ফেলে খেয়ে রুমে শুয়ে রইল কারণ সিহান ভাইয়ের আদেশ রিধি ফেলতে পারবে না। সিহান ভাই এখনো ঘরে ফেরেনি, বোধহয় রিহান ভাইয়ের সাথেই আছে। কিন্তু রিধি বুঝতে পারলো না, সিহান ভাই রিধিকে কল না দিয়ে মেসেজ কেন দিল! তিনি মেসেজে রিধিকে আদেশের সুরে লিখেছেন- যাতে রিধি খেয়ে শুয়ে পড়ে আর রিধিও বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে শুয়ে পড়লো।
ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক বারোর ঘরে তখনই সুলতানা বেগম রিধির রুমে ছুটে আসলো। তিনি এসেই রিধিকে বলতে লাগলেন,
-‘রিহান এখনো বাড়ি ফেরেনি। তিশা মেয়েটা রুম থেকে বের হচ্ছে না, কিছু খাচ্ছেও না। তুই একটু গিয়ে দেখবি? খাই কী না? মেয়েটা সেই কখন থেকে একা একা বসে আছে। তোর মামা এসবের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আমি ওষুধ দিয়ে ঘুমাতে বলে আসছি। এখন বোধহয় ঘুমাচ্ছে।’

রিধি মাথা নেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে রিহান ভাইদের ফ্ল্যাটে গেল। সুলতানা বেগম রিধির পেছন পেছন এসে কিছু খাবার একটা প্লেটের মধ্যে দিয়ে রিহানের রুমের দিকে ইশারা করলো।

রিধি প্লেট নিয়ে রিহান ভাইয়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়ালো। এই রুমে এতদিন রিহান ভাইয়ের জন্য আসলেও আজ অন্যকারোর জন্য আসা। এই রুমে এখন রিধির কোনো অধিকার নেই। এখন এই রুমে ঢুকতে তার অনুমতি প্রয়োজন। এসব ভাবতেই রিধির বুক ভারী হয়ে এলে সে তাড়াতাড়ি নিজেকে সংযত করে দরজা নক করতেই ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। দ্বিতীয়বার নক করতেই এবার ভেতর থেকে আওয়াজ এলো।
-‘দরজা খোলা।’

রিধি দরজা ঠেলে রুমে ঢুকতেই থমকে গেল।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here