আষাঢ়ে_মেঘ,পর্ব_২

#আষাঢ়ে_মেঘ,পর্ব_২
#নাজমুন_বৃষ্টি

সকাল হতেই সম্পূর্ণ বাসাটা বিয়ের রবে ভরে গেল। রিধি রুমে চুপচাপ বসে আছে। তার মোটেও ইচ্ছে করছে না রিহান ভাইদের ফ্ল্যাটে যেতে। রিহান ভাই অন্য কারোর জন্য বিয়ের সাঝে সাজবে সেটা রিধি যে সহ্য করতে পারবে না। রাতে না ঘুমানোর ফলে প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। সে না ঘুমিয়ে থাকতে পারে না। কিছু সময় পর দরজা ধাক্কানোর শব্দে রিধি দরজা খুলে দেখতে পেল তার মা অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

-‘কী রে! ওই বাসায় কত কাজ আর তুই এখানে এখনো বসে আছিস!’

-‘আসছি মা। তুমি যাও।’

রিধির মা সুলতানা বেগম আর কিছু না বলে চলে গেলেন।
রিধি চুপচাপ উড়নাটা জড়িয়ে বের হওয়ার সময় ভাইয়ের সাথে দেখা। সিহান তার বোনের রুমেই এগিয়ে আসছিলো।

-‘শোন রিধি। এই ডালাটা রিহানকে দিস তো। আমি একটু কাজে আসছি, কিছুক্ষন পর কাজ শেষ করে যাবো। রিহান অপেক্ষা করছে, তুই যাচ্ছিস যখন একেবারে নিয়ে যা।’ বলে সিহান রিধির দিকে বরের পাঞ্জাবী আর অন্যান্য কিছু জিনিসের একটি ডালা এগিয়ে দিল।

-‘তুমি নিয়ে যাও ভাইয়া। আমার একটু কাজ আছে।’

রিধির কথায় রিহান ভ্রু কুঁচকে তাকালো রিধির পানে।
-‘তোর কী কাজ আবার? সকাল থেকে তো মাত্র এখনই রুম থেকে বের হলি। মা ওই বাসায় তোকে ডাকতেছে। যা না বোন।’

রিধি নিজেই যাচ্ছিলো রিহান ভাইয়ের বাসায়। গিয়ে মা’কে একটু দেখা দিয়ে চলে আসবে ভেবে যাচ্ছিলো কিন্তু রিহান ভাইয়ের সামনে ভুলেও পড়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। সিহান ভাই কাল থেকেই অনেক তাড়াহুড়োতে আছে। ব্যস্ত অনেক, হবেও না বা কেন! রিহান ভাই তার বন্ধু কম ভাই বলে কথা! হয়ত সত্যিই অন্যদিকে কাজ আছে এই ভেবে রিধি সিহানের হাত থেকে ডালাটা হাতে নিতেই সিহান মুচকি হেসে বোনের গাল টেনে চলে গেল।

রিধি চুপচাপ সিহানের যাওয়ার পানে তাকালো। তার এই ভাইটা তাকে প্রচুর ভালোবাসে। যদি জানে, আজ তার বোনটা যার জন্য প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছে! তাহলে হয়ত এই বিয়েটাই সে হতে দিতো না। সবার সম্পর্ক এক ফলকে ছিন্ন হয়ে যেত।

রিধি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। এই বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় ফ্ল্যাটে রিহান ভাইরা থাকে আর এর উপরেরটাতে রিধিরা থাকে। রিধি সিঁড়ি বেয়ে নেমে রিহান ভাইদের ফ্ল্যাটে ঢুকলো।
সম্পূর্ণ বাসাটাতে অনেক মেহমানে ভরপুর। রিধি চারদিকে তাকাতেই চোখটা ঝাঁপসা হয়ে এলো। এই সবকিছু মেহমান তো তার উদ্দেশ্যে হওয়ার কথা ভেবেছিলো রিধি! নিয়তি এমন কঠোর কেন হলো!

-‘রিধি মা।’

কারো ডাকে রিধির হুশ ফিরতেই তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলো। তাকিয়ে দেখল মকবুল শেখ ডাকছে ওকে।
-‘কী হয়েছে মা! তোকে এমন মনমরা দেখাচ্ছে কেন! আর হাতের এগুলো রিহানের না-কি?’

-‘কিছু হয়নি আঙ্কেল। হ্যাঁ, এগুলো রিহান ভাইয়ের।’

-‘ওহ, তাহলে যা রিহানকে দিয়ে আয়। বউ আনতে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। তোরাও রেডি হয়ে নেয়। আমি একটু গিয়ে এদিকে দেখি, সব কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কী না!’ বলেই সামনের দিকে মকবুল শেখ হাঁটা ধরলো।

রিধি রিহানের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। রিহানের রুমের সামনে দরজার কাছে যেতেই তার কলিজা কেঁপে উঠল। ওই যে, সব কাজিনরা মিলে রিহান ভাইয়ের বাসর সাঝাচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, রিহান ভাই ওয়াশরুমে। হয়ত গোসল করছে। রিধি ফুলগুলোর দিকে তাকাতেই চোখগুলো ঝাপসা হয়ে এলে সে তাড়াতাড়ি ডালাটা রিহান ভাইয়ের রুমের কর্নারের টেবিলটাতে রেখে চলে আসতে নিতেই রিহানের ডাকে থেমে গেল। সে পেছনে ঘুরেই দেখল রিহান ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে। রিহান ভাই ওয়াশরুম থেকে বের হতেই বাকি সবাই ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে গেল। হয়ত তিনি রুম সাঝাতে বারণ করেছিলেন কিন্তু ওরা উনার গোসল করার সময়টাতে চুরি করে ঢুকেছিল।

-‘এভাবে চলে যাচ্ছিস কেন?’

রিধি কিছুই বলল না। এই রুমটাতে যতক্ষণ থাকবে ততক্ষন তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে থাকবে। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

-‘এতো তাড়াতাড়িই অধিকার ছেড়ে দিলি রিধু?’

রিধি দরজার সামনে থেমে গেল।

-‘জানিস রিধু? এখন আর বাবার কথাগুলোকেও মানতে ইচ্ছে হয় না। বাবার উপর কথা বলেছি কাল, হয়ত তিনি কষ্টও পেয়েছেন অনেক কিন্তু আমার অন্যসময়ের মতো বাবার উপর খারাপ ব্যবহারের জন্য আর আফসোস হচ্ছে না। আশেপাশের সবকিছুর প্রতি চরম বিতৃষ্ণা চলে আসছে। কেউ আমার মনের অবস্থা বুঝতে চাচ্ছে না রিধু, একমাত্র তুইই বুঝতি কিন্তু দেখ আমাদের নিয়তি! এই দেখ না, এদের বলছি আমার রুমে ফুলও না আনতে আর এরা আমার গোসলের সুযোগ নিয়ে এসব রুমে ঢুকিয়েছে। ওরা কেউই বুঝতে চাচ্ছে না, আমার মনের রক্তক্ষরণ। আমার যে দমবন্ধ হয়ে আসছে রিধু। তোকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো!’ রিহান কথাগুলো বলতেই বলতেই তার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল।
রিধির নিজেও চোখের পানি আটকাতে পারছে না, সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পেছনে ঘুরে চোখের পানি মুছে বলে উঠল,
-‘এটাই হয়ত নিয়তি রিহান ভাই। নিয়তি যত তাড়াতাড়ি মেনে নিতে পারবেন ততই ভালো। এখন হয়ত বলছেন আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন না কিন্তু হয়ত একমাস পরেই তিশা আপুকে ভালোবেসে একই কথা বলবেন। সময়ের সাথে সাথে সব পরিবর্তন হয়ে যাবে রিহান ভাই।’

রিধির কথার প্রেক্ষিতে রিহান মৃদু শব্দ করে একটা তাচ্ছিল্য হাসি দিল।
-‘এতো বছরেও তুই আমাকে চিনতে পারলি না রিধু? না-কি ইচ্ছে করেই এমন বলছিস! তুই কী মনে করিস? আমার পক্ষে এই মন অন্য কাওকে দেওয়া সম্ভব? আমার এই মন আজীবন তোর নামেই খোদাই করা থাকবে রিধু। তিশাকে আমি ভালোবাসতে পারবো না। ওকে আমি আমার বোনের মতোই দেখতাম সবসময়। শুধুমাত্র বাবার এই একটা কথায় আর মায়ের কথা ভেবেই এই বিয়েতে আমি রাজি হচ্ছি। বিয়ে হলেই কী সব ভোলা যায় রিধু!’
‘চল না রিধু? আমরা কোথাও চলে যায়? বাবার কথার মতো আমিও তো তোকে একসাথে থাকার কথা দিয়েছিলাম। আমার প্রতিশ্রুতি কী এতটাই তুচ্ছ!’

———-
রিহিলার মনে হচ্ছে সবকিছু তার সামনেই হচ্ছে। ডাইরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে সে একটা ঘোরে চলে গেল। তার চোখ বেয়ে অনর্গল পানি ঝরতে লাগলো। বাস্তবতা এতো কঠিন কেন হলো ওদের জন্য! বাইর থেকে তার বিয়ের প্রচুর শোরগোল শোনা যাচ্ছে। এতদিন এই বিয়ে নিয়ে হাজার উৎফুল্ল থাকলেও আজ তার মন সেদিকে নেই। ডাইরির পাতায় তার মন। সে আবারো পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ডাইরি পড়ায় মনোযোগ দিল।

—————

-‘আমাকে ভুলে যান রিহান ভাই।’ কথাটি বলতে গিয়ে রিধির বুক ধড়ফড় করে উঠল। হঠাৎ করেই কান্না পেয়ে গেল তার। সে বুঝতে পারলো, কথাটি বলতে গিয়ে তার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল আর যদি সত্যিই এমন হয় সে কীভাবে থাকবে! সে উড়না দিয়ে মুখ চেপে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে দৌড়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল।
রিহান রিধির যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে ঝাঁপসা চোখে তাকিয়ে রইল। কেন হলো তাদের নিয়তি এমন! দুজন দুজনকে ভালোবেসে তবুও কেন পেলো না!
রিধি রুমে ঢুকেই মেঝেতে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লো। হঠাৎ মা আসতেই সে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো।

-‘রিধি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেয়। সবাই এখনই বেরিয়ে পড়বে।’ বলেই চলে যেতে নিলে তিনি রিধির দিকে আবার ফিরে বলে উঠল,
-‘এ কী রিধি। তোর চোখ-মুখের এই অবস্থা কেন!’

-‘মা আমার মাথা ব্যথা করছে। আমি বরং না যাই?’

-‘তোর মাথা ব্যথা বেশিক্ষন থাকবে না। ওষুধ খেয়ে নেয়। দ্রুত আয়।’ বলেই তিনি প্রস্তান করলেন।

রিধি জানে তার মা অনেক কঠোর। পরে হয়ত সন্দেহ করবে। তাই সে চুপ মেরে গেল। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও রেডী হয়ে মনকে শক্ত করে সবার সাথে বেরিয়ে পড়ল।
.
.

তিশা আপুকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে। রিহান ভাইয়ের সাথে তিশা আপুর বসার পর থেকেই রিধির কান্না পাচ্ছে। তিশা আপুর পাশেই তার অসুস্থ মা হুইল চেয়ারে বসে আছে। তার পাশেই মকবুল শেখ দাঁড়িয়ে আছে। তিশা আপুর বাবা নেই আর রিহান ভাইয়ের মা নেই। রিহান ভাইয়ের মা আর তিশা আপুর মা দুজন দুজনের অনেক কাছের বান্ধবী ছিলেন। রিহান ভাইয়ের মা যখন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তখন তিনি মকবুল শেখকে তার একটা ওয়াদা রাখার প্রতিশ্রুতি দেন, তার বিধবা বান্ধবীর একমাত্র মেয়েকে যেন তিনি রিহানের বউ হিসেবে ঘরে তুলে। মকবুল শেখও তার প্রানপ্রিয় স্ত্রীর ওয়াদা মেনে আজকে এই বিয়ের আয়োজন করলেন কিন্তু এসবের ব্যাপারগুলো শুধু বড়োরাই জানতো, রিহান-রিধি কেউই জানতো না। যার ফলে আজ দুজন মানুষ না বুঝেই এতটা কষ্ট পাচ্ছে।
রিধি আর কিছু না ভেবে মলিন চোখে তার সামনে একসাথে বসা রিহান ভাই আর তিশা আপুর দিকে তাকিয়ে রইল।
বিয়ের কবুল বলার সময় রিহান এক ফলক চোখ তুলে ভিড়ের মাঝে রিধির দিকে তাকালো। রিধি ঝাঁপসা চোখে তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে। রিহান তাকাতেই সে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে পেছন ফিরে চলে আসতে নিলো। সবাই রিহানের দিকে তাকিয়ে আছে কবুল বলার জন্য। রিহান রিধির দিকে আরেক ফলক তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে এক নিঃশ্বাসে তিন কবুল বলতেই সবার মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। রিধি পেছনে ফিরে চলে যেতে নিতেই রিহানের কবুল বলার আওয়াজটা তার কানে বারেবারে বাজতে লাগলো। সত্যিই রিহান ভাই আজ থেকে অন্য কারো হয়ে গেল! এটা ভাবতেই রিধির মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। সে মেঝেতে পড়ে যেতে নিতেই রিহানের দৃষ্টি তখন রিধির দিকে পড়লো।

#চলবে ইন শা আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here