আষাঢ়ে_মেঘ,#পর্ব_১

#আষাঢ়ে_মেঘ,#পর্ব_১
#নাজমুন_বৃষ্টি

নিজের ভালোবাসা’র মানুষটার সাথে অন্যকারো বিয়ে দেখার সহ্যক্ষমতা রিধির হয়নি, সে কোনোমতে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে রুমে এসে ডুকরে কেঁদে উঠল। কিছু সময় পর গভীর রাতে হঠাৎ অনুভব করলো তার পায়ের ধারে কেউ একজন বসে চোখের পানি ঝরাচ্ছে। রিধি জানে এটা রিহান ভাই। আজ উনার হলুদ ছিল কাল বিয়ে। অথচ তিনি কারো পরুয়া না করে গভীর রাতে রিধির রুমে এসেছে। রিহান ভাইয়ের আজকের পর থেকে হয়ত এভাবে ব্যালকনি দিয়ে আর আসা হবে না রিধির রুমে।
রিধির চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু নির্গত হচ্ছে। সে চুপচাপ ঘুমের ভান ধরে শুয়ে রইল।

-‘আমি জানি রিধু। তুই ঘুমোসনি। চল না, আমরা কোথাও পালিয়ে যায় রিধু!’

রিধি চুপচাপ ঘুমের ভান ধরে রইল। সে আজ উঠবে না। আর কোনো মায়া বাড়াবে না মানুষটার প্রতি। মানুষটা তার প্রতিউত্তর না পেয়ে হয়ত চলে যাবে। রিধি চোখ বন্ধ করে রইল।

রিহান তার হাতটা আলতো করে রিধির পায়ের উপর রাখলো।
রিহানের ছোঁয়ায় রিধি কেঁপে উঠল। তা দেখে রিহান কান্না মাখা চোখে হাসলো।

-‘শেষবারের মতো একটু তাকা রিধু?’
‘আজকের পর থেকে তো আর আসবো না। মাঝ-বিরাতে আর কোনোকিছু’র আবদার ধরবো না তোর কাছে। রিধু, তাকাবি না?’ রিহানের কণ্ঠ অসহায় দেখালো।

রিহানের এমন অসহায় কণ্ঠ শুনে রিধি আর চোখ বন্ধ করে থাকতে পারলো না। সে পাশ ফিরে চোখ মুছে শোয়া থেকে উঠে বসে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলে উঠল,

-‘আপনি চলে যান রিহান ভাই। কেউ দেখলে সমস্যা হবে।’

-‘আমার দিকে তাকাতেও তোর বাধে, রিধু?’ রিহান মলিন চোখে রিধির দিকে তাকালো।

রিধি তবুও ফিরল না। তার আজ এই চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই। এই চোখের দিকে তাকালেই তার দুনিয়া উলোট-পালট করে দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে সব ছেড়ে-ছুড়ে এই মানুষটার বুকে ঝাপ্টে পড়ে বলতে,’আমাকে ছেড়ে আর কাউকে বিয়ে করতে পারবেন না, রিহান ভাই,’ কিন্তু রিধি তা বলবে না। সে জানে, যদি এই কথাটা সে এখন রিহানকে বলে তাহলে এখনই রিহান সব ছেড়ে-ছুড়ে রিধিকে নিয়ে পালিয়ে যেতে রাজি। রিধি এই কথাটা বললে রিহান তার হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো করবে খুশিতে। কিন্তু বাস্তবতা যে বড়োই ভিন্ন। এই আশা যে কোনোদিনও পূরণ হওয়ার নয়। রিধিও নিজেকে রিহানের কাছে দুর্বল দেখাবে না। রিধি এখনো রিহানের উপর দুর্বল দেখালে রিহান এই বিয়ের পরুয়া করবে না। রিধি নিজের দুর্বলতাকে আড়ালে রেখে উপরে যথাসম্ভব শক্ত থাকার চেষ্টা করে শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল,

-‘চলে যান রিহান ভাই। আর আসবেন না এখানে।’

রিহান নিস্পলক দৃষ্টিতে রিধির দিকে তাকালো। এরপর রিধির পায়ের পায়ের কাছে মেঝে থেকে উঠে এসে রিধির পাশে বসলো। রিধি পাশ ফিরে যেতেই রিহান রিধিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে তার দু’গাল নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠল,

-‘আমাকে এখন আর ভালোবাসিস না রিধু?’

রিধি নাক-মুখ কুঁচকে রিহানকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। রিহান রিধির ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে একটু পিছনে সরে গেল।

রিধি অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে উঠল,
-‘আপনি নেশা করেছেন, রিহান ভাই?’

-‘আমি তোকে ভুলতে পারবো না রিধি। কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস আমাকে বল?’রিহান মেঝেতে বসেই অসহায় কণ্ঠে বলে উঠল।

-‘আর আপনি নেশা করলে আমি যে কষ্ট পায় সেটা বুঝেন না?’

রিধির কথায় রিহানের সেই দুঃখী চেহারায় ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।
-‘তুই তো সেদিন থেকেই কষ্ট পাচ্ছিস রিধু। শুধু উপরে নিজেকে শক্ত দেখাতে চাচ্ছিস।’

রিধি চমকে তাকালো রিহানের দিকে। তা দেখে রিহান তাচ্ছিল্য হাসলো।

-‘আপনি আর নেশা করবেন না রিহান ভাই। নাহলে আমি কিন্তু আপনার সাথে আর কথা…’ রিধি বাকিটুকু আর উচ্চারণ করতে পারলো না।

-‘থেমে গেলি! আজ থেকে এই নেশায় আমার সঙ্গী। তোকেই নিজের করে রাখতে পারলাম না সেখানে এই নেশা ছেড়ে কী করবো!’ বলেই রিহান হাসলো। রিহানের কথায় রিধি কিছু বলতে পারলো না।

-‘শেষবারের মতো আমার সাথে একটু চন্দ্রবিলাস করবি রিধু? প্রমিস করছি, তোকে আর কোনোরকম বিরক্ত করবো না। একটা কথাও বলবো না। শুধু চুপচাপ আমার পাশে পাঁচ মিনিটের জন্য দাঁড়িয়ে চন্দ্রবিলাস করবি?’

রিহানের কণ্ঠে কী ছিল রিধির জানা নেই। সে রাজি না হয়ে পারলো না। বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে অনেক মেহমান। ছাদে গেলে কেউ দেখে ফেলবে ভেবে রিধি চুপচাপ নিজের খোলা ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। আজ চাঁদের আলো নেই তেমন। যাও একটু-আধটু আলো দিচ্ছে তাও হালকা মেঘের আস্তরণ এসে মাঝে মাঝে ঢেকে দিচ্ছে কিন্তু তবুও পুরো বিল্ডিংটা জ্বলজ্বল করছে। কারণ আজ রিহান ভাইয়ের হলুদের রাত ছিল যার ফলে লাল-নীল বাতিতে সম্পূর্ণ বিল্ডিং জ্বলজ্বল করছে।
রিহান এসে চুপচাপ রিধির পাশে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুসময় পর রিহান পকেট থেকে তার মোবাইলটা বের করে সময় দেখে বলে উঠল,

-‘তোর থেকে নেওয়া পাঁচমিনিট সময় শেষ।’ বলেই তাড়াহুড়ো করে মোবাইল পকেটে ভরে ফেলল।

রিধি নিস্পলক দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকাল। এরপর কিছু বুঝে উঠতেই আশেপাশে তাকিয়ে রিহানকে বলে উঠল,
-‘আপনার কথা আমি রেখেছি। এবার আপনি আপনার কথা রাখুন রিহান ভাই। চলে যান।’

রিহান এক ফলক অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো এরপর ব্যালকনি দিয়ে নিচে নেমে যাওয়ার সময় আবারো রিধির দিকে তাকালো।
-‘প্লিজ রিধু চল আমরা পালিয়ে যায়?’

-‘কাল আপনার বিয়ে। আপনি যান।’

রিহান নিচে নেমে গেল। রিধি দেখেছে রিহানের চোখে পানি। ছেলে মানুষের না কি কাঁদতে নেই কিন্তু কষ্ট পেলে ঠিকই কাঁদে। রিধি নিজের রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল। সে কীভাবে সহ্য করবে রিহান ভাইয়ের বিয়ে! এই মানুষটাকে সে কী আধো ভুলতে পারবে! নিয়তি এমন কঠিন কেন হলো ওদের! দুইজন ভালোবাসার মানুষ এঁকে অপরকে চেয়েও কেন পেলো না!

————–

রিহান চাবি খুলে বাসায় প্রবেশ করতেই দেখলো তার বাবা মকবুল শেখ সোফায় দুহাত মাথার পেছন দিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। রিহানের পায়ের আওয়াজ শুনেই চোখ খুলে তাকালো। রিহান বাবাকে দেখেও না দেখার ভান করে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালে মকবুল শেখের গম্ভীর ডাকে থেমে গেল।

-‘এতো রাতে কোথ থেকে আসছো? কোথায় গিয়েছিলে?’

-‘সেটা তোমার জানার প্রয়োজন বলে আমি মনে করি না বাবা।’ বলেই রিহান নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে গেলে মকবুল শেখের চিৎকারে থেমে গেল।
মকবুল শেখ বসা থেকে উঠে রিহানের সামনে দাঁড়িয়েই চিৎকার করে বলে উঠল।

-‘দিন দিন বেয়াদব হচ্ছ তুমি। বাবার উপর এভাবে কথা বলার স্পর্ধা কে দিয়েছে তোমাকে?’

-‘আস্তে চিৎকার করো। বাসায় মেহমান।’ বলেই রিহান মকবুল শেখের চোখের সামনে রুমের দরজা জোরে বন্ধ করে দিল।
মকবুল শেখ রিহানে ব্যবহারে থমকে গেল। তার ছেলে তো এমন ছিল না তাহলে এই একটা বিষয়েই কী তাদের বাবা-ছেলের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরতে চলেছে! কিন্তু এটা ছাড়াও যে আর উপায় নেই!

————-

কেটে যাচ্ছে রাত। সবাই আরামে ঘুমাচ্ছে। শুধু একই বিল্ডিংয়ের উপর-নিচে একই সাথে দুইটা রুমে কারো চোখেই ঘুম নেই। একজন কেঁদে-কেটে বালিশ ভিজিয়ে উঠে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে আরেকজন সেই তলার সোজাসুজি নিচের ব্যালকনিতে বসে নিজের দুঃখগুলোকে নেশার সাথে উড়াচ্ছে। পার্থক্য শুধু উপর-নিচ। একটু পাশাপাশি হলেই হয়ত দুইজন দুইজনের দুঃখগুলো দেখতে পারতো। আজ তাদের এই দুঃখের সাক্ষী চাঁদ। একই বিল্ডিংয়ের দুইজন উপর-নিচ ব্যালকনিতে দুই কপোত-কপোতীর আজ দুঃখের সাক্ষী চাঁদ। হয়ত আজকের পর থেকে দুইজনের পথই আলাদা হয়ে যাবে। আজকের পর থেকে কেমন হবে তাদের ভিন্ন ভিন্ন পথ চলা! তারা কী কাটাতে পারবে তাদের বাকি জীবনটুকু ভিন্নভাবে! বাস্তবতা এতো কঠিন!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here