আমি_তোমার_গল্প_হবো,পর্ব:১৪,১৫

আমি_তোমার_গল্প_হবো,পর্ব:১৪,১৫
জাহান আরা
পর্ব:১৪

সকাল থেকে শবনমের বুক কাঁপছে দুরুদুরু করে।শেষ বারের মতো প্রলয় কে দেখতে ইচ্ছে করছে একবার।
প্রলয় রুম থেকে বের হয় নি এখনো।
শবনম সবার অলক্ষ্যে রুম থেকে বের হয়।প্রলয়ের রুমের দরজার সামনে গিয়ে এদিক ওদিক তাকালো শবনম।
কাউকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
শবনম দরজায় টোকা দিলো।দুইবার একসাথে তারপর এক বার।আবার দুইবার একসাথে তারপর এক বার।
প্রলয় সারারাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে জানালার সামনে।
ঠান্ডায় শরীর কাঁপছে। নিজেকে নিজের মনে হচ্ছে আস্ত একটা ডিপ ফ্রিজ।

দরজায় টোকা পড়ার শব্দ শুনে প্রলয়ের হুশ এলো।কোনোমতে টলতে টলতে দরজার সামনে এলো।দরজা খুলতেই শবনম হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে পড়লো।
প্রলয় অপলক তাকিয়ে রইলো শবনমের দিকে।শবনমের চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রলয় সেদিকে তাকিয়ে রইলো।
অশ্রু ফোঁটা শবনমের গাল বেয়ে চিবুকে এসে স্থির হলো।তারপর টুপ করে ঝরে পড়লো,হাত বাড়িয়ে প্রলয় হাতে নিলো।তারপর ড্রয়ার থেকে জিপলক ব্যাগটা নিয়ে ব্যাগে জমিয়ে রাখলো।

শবনম প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রলয় আগের চাইতে রোগা হয়েছে।অবাক হলো শবনম ভীষণ।
একরাতে মানুষটার এতো করুণ অবস্থা কেনো?
কেনো ভাগ্য এতো বিরূপ হলো শবনমের?
কি ক্ষতি হতো যদি প্রলয় শবনম কে ভালোবাসতো?

শবনমের কাছে এসে প্রলয় বললো,”চলে যাও শবনম,আজ তোমার বিয়ে,আমার সাথে এক রুমে তোমাকে দেখলে কেউ খারাপ ভাবতে পারে।চলে যাও।”

প্রতিবাদ জানানোর কোনো সাহস নেই শবনমের। যেমন ভগ্ন হৃদয় নিয়ে এসেছিলো তেমনি ভগ্ন হৃদয় নিয়ে বের হয়ে গেলো প্রলয়ের রুম থেকে।দুচোখ ভরে প্রলয় কে দেখার সাধ মিটলো না শবনমের।

সকাল ৯টায় রাহেলা বানু শবনম কে পার্লারে পাঠালেন। শবনমের সাথে পার্লারে যাবার মতো কেউ নেই এই মুহূর্তে। রাহেলা বানু কিছুটা ব্যথিত হলেন।
“আহারে,মেয়েটার বিয়ে অথচ কেউ নেই যে মেয়েটাকে পার্লারে নিয়ে যাবে।”

শবনম মনে মনে এই সুযোগ টা চাচ্ছিলো।
ড্রাইভার শবনম কে নামিয়ে দিয়ে চলে এলো।
পার্লারের রিসিপশনে কিছুক্ষণ বসে রইলো শবনম। ১০ মিনিট বসে থেকে শবনম বের হলো।পার্লারের মেয়েটাকে বলে গেলো,আমার একটু কাজ আছে,কাজ সেরে আসছি।
বুকের ভিতর কি অজানা ব্যথা শবনম কে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে সে একা শবনম জানে।
কি অদ্ভুত ভালোবাসা!
কেনো মানুষের জীবনে এলো এই ভালোবাসা?
কেনো ঝড়ের মতো এসে সাজানো জীবনের সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়?
কে দিবে এই উত্তর?

ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে রাস্তা ক্রস করছিলো শবনম। বাম পাশ থেকে একটা গাড়ি ফুল স্পিডে আসছে শবনম খেয়াল করলো না।
খেয়াল হলো শবনমের শক্ত হাতের হ্যাঁচকা এক টান খেয়ে।মুহুর্তে বুঝতে পারলো শবনম কি দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো এইমাত্র।
কলিজা ধুকপুক করতে লাগলো শবনমের। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে সে।

এতো বড় একটা দুর্ঘটনা থেকে কে বাঁচিয়েছে তার দিকে ফিরতে গিয়ে শবনম বিস্ময়ে থ হয়ে রইলো।শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে হাসি মুখে।
শ্রাবণ কে শবনম আশা করে নি এখানে।
শবনমের এরকম হতভম্ব অবস্থা দেখে শ্রাবণ হেসে ফেললো। তারপর বললো,”কোথায় যাচ্ছিলে এরকম আনমনা হয়ে বলো তো?
তুমি তো দেখছি আমাকে বিপত্নীক করতে চাও।এরকম অসতর্ক হয়ে কেউ চলাফেরা করে রাস্তায়?”

শবনমের বলার মতো কিছু ছিলো না।কি জবাব দিবে শ্রাবণ কে?
শ্রাবণ শবনমের হাত ধরে আবার রাস্তা পার করে দিলো।পার্লারের সামনে যেতেই শবনম জিজ্ঞেস করলো,”আপনি এখানে কেনো?”

শবনমের প্রশ্ন শুনে শ্রাবণ মাথা নিচু করে ফেললো।শবনম দেখলো শ্রাবণের গাল,কান লাল হয়ে উঠেছে।শবনম আশ্চর্য হলো।
এতো লজ্জার কি আছে?

মাথা নিচু করেই শ্রাবণ জবাব দিলো,”আমি এসেছি তোমাকে দেখতে,সেজেগুজে আমার বউ বের হবে,তার মুখ সবার আগে আমি দেখতে চাই।তাই এসেছি এখানে।”

শবনম কিছু বললো না আর।সোজা পার্লারে ঢুকে গেলো।
শবনম যেতেই শ্রাবণের মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।

.

প্রলয় রুম থেকে বের হলো কন্যা বিদায়ের সময়।বঁধু বেশে শবনম কে দেখে প্রলয়ের ছোটখাটো একটা স্ট্রোক হবার জোগাড়।
এই মেয়ে এতো সুন্দর কেনো?
বঁধুর সাজে কেনো মেয়েটাকে এতো বেশী ভয়ংকর সুন্দর লাগছে?
প্রলয়ের মনে হলো হঠাৎ করে,অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে প্রলয়।
এই মেয়েটা একেবারে তার হতো।যে কিনা প্রলয় কে ভালোবাসতো নিজের চাইতে বেশি।
এই মেয়েটার লম্বা চুলে প্রলয় বিনুনি করে দিতো।
সময় অসময়ে এই মেয়েটার চুলের খোঁপা খুলে দিতো প্রলয়।
রুটি বানাতে গেলে মেয়েটাকে রাগিয়ে দেয়ার জন্য গালে আটা লাগিয়ে দিতো প্রলয়।
মেয়েটা রাগ করলে চুমু খেয়ে খেয়ে তার রাগ ভাঙাতো প্রলয়।
গভীর রাতে….

না আর ভাববে না প্রলয়। আর কিছু ভাববে না সে।শবনম কাঁদবে না বলে ঠিক করে রেখেছিলো কিন্তু প্রলয় কে দেখে হঠাৎ করে আর নিজেকে সামলাতে পারে নি।
মনে মনে প্রলয় বললো,”কেঁদো না শবনম। শুধু শুধু চোখের পানি ফেলো না।আমায় মতো দুর্বল মানুষের জন্য কাঁদতে নেই।আমাকে সৃষ্টিকর্তা সেই ক্ষমতা দেয় নি।আমি যে খুবই তুচ্ছ প্রাণী। ”

শ্রাবণীর বুক ফেটে যাচ্ছে। প্রলয় ভাই তার হয় নি বলে যতোটা কষ্ট পেয়েছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে নিজের ভালোবাসার মানুষ কে ও প্রলয় ভাই পায় নি বলে।
সৃষ্টিকর্তাকে জিজ্ঞেস করলো শ্রাবণী,”এ কোন খেলা খেলছো তুমি উপরে বসে?
আমি প্রলয় ভাইকে না পাই আমার আফসোস নেই,কিন্তু প্রলয় ভাইকে কেনো তার ভালোবাসার মানুষ কে দিলে না খোদা?দুটি হৃদয় এভাবে কেনো ভেঙে দিলে তুমি?”

চলবে…….??
#আমি_তোমার_গল্প_হবো
পর্ব:১৫
জাহান আরা

আজকের দিনটা শ্রাবণের জন্য অন্যরকম। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।শ্রাবণ শেরওয়ানি খুলে বাসর ঘর সাজানোর কাজে লেগে গেলো।
শ্রাবণের বন্ধুরা সবাই হা হয়ে শ্রাবণের কর্মকাণ্ড দেখছে।
তামিম এসে একবার ধমকে ধামকে বললো,”ছি শ্রাবণ!
দুনিয়ায় মনে হয় একা তুই-ই বিয়ে করেছিস তাই নিজের বাসর নিজে সাজাচ্ছিস!
লজ্জা করে না ব্যাটা তোর?
কোথায় আমরা সাজাবো তা না উল্টো তুই এসে মাতব্বরি করা শুরু করে দিয়েছিস,বলি আড্ডা থেকে শুরু করে সব কাজে কি আমরা সবাই তোর হুকুমেই চলবো না-কি?
আজকে অন্তত আমাদের দায়িত্ব দিতি,বিয়ে তো আমি ও করেছি,কই আমি তো তোর মতো এতো বেহায়া ক্যান তুই?”

মুরুব্বী,আত্মীয় স্বজনেরা এসে শ্রাবণের এই কাজ দেখে কেউ কেউ শ্রাবণ কে বেহায়া,নির্লজ্জ ছেলে বলে আখ্যা দিলেন।
শ্রাবণ কারো কথায় কান দিলো না।
শবনম শ্রাবণের এই বেহায়াপনার কথা শুনে লজ্জায় মরে যাচ্ছে যেনো

শ্রাবণের মধ্যে উৎসাহের শেষ নেই।ইতোমধ্যে রুমের সব আসবাবপত্র বের করে ফেলেছে বন্ধুদের দিয়ে।পুরো রুম সাজিয়েছে ময়ুরের পালক দিয়ে।
বিছানার পায়ের পাশটা সাজানো হয়েছে ময়ুরের পালক দিয়ে,দেখে মনে হচ্ছে যেনো কোনো ময়ুর পেখম মেলে দাঁড়িয়ে আছে। পুরো রুমে নীল,বেগুনি লাইটিং।
তাজা গোলাপের সুবাসে পুরো রুম সুবাসিত।
পুরো ফ্লোরে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে গালিচা বানানো।

শ্রাবণের এক কথা,বাসর রাত তো জীবনে একবার আসবে,বাসর ঘর ও জীবনে একবার সাজাবো,সেটা কেনো অন্যদের পছন্দমতো সাজাবো আমি?
আমার স্পেশাল রাতকে স্পেশাল করে সাজাবো আমার যেভাবে পছন্দ।

শবনমের মাথা ধরে আছে,এ বাড়িতে আসার পর থেকে একটানা মানুষের প্রশ্নের জবাব দিয়েই যাচ্ছে শবনম।
শ্রাবণদের আত্মীয়রা অনবরত প্রশ্ন করেই যাচ্ছে শবনম কে।
বিরক্তি চেপে রেখে শবনম জবাব দিচ্ছে।
শ্রাবণী বুঝতে পারলো শবনমের বিরক্তি ভাব। যে মেয়েটা সদ্য নিজের ভালোবাসার মানুষ কে ছেড়ে এসেছে তার মানসিক অবস্থা কতোটা ভালো হতে পারে শ্রাবণী বুঝে আর কেউ না বুঝলেও।
আর শবনমের জন্য তো বিষয়টা বেশি সিরিয়াস

শ্রাবণী এসে বললো,”অনেক হয়েছে,ব্যস।এবার ভাবী একটু বিশ্রাম নিবে।”
শ্রাবণীর ছোট চাচী বললেন,”কেনো রে শ্রাবণী,প্রতিদিন তো আর আমরা এসে বসে থাকবো না নতুন বউয়ের সাথে কথা বলার জন্য,আজকেই তো সবাই একটু বিরক্ত করবে,আজকে একটু কষ্ট দিবে সবাই।তুই এভাবে সবাইকে তাড়িয়ে দিচ্ছিস কেনো?”

শ্রাবণী ছোট চাচীর দিকে তাকিয়ে বললো,”কি অদ্ভুত নিয়ম তোমাদের বলোতো চাচী,কোথায় তোমরা মানুষটাকে একটু রিলাক্স করতে দিবে,আজকে তার জীবনের অন্যতম একটা দিন।আজকের দিনে তার ভীষণ মন খারাপ,একমাত্র সে জানে কাকে রেখে এসেছে সে,কাকে ছেড়ে কার কাছে এসেছে,তার ভিতরে যে আগুন জ্বলছে তা সামলানোর জন্য তাকে একটু স্পেস দিবে।অথচ তোমরা কি অমানবিক আচরণ করছো চাচী।”

শবনম বুঝতে পারলো শ্রাবণী কি বুঝাতে চাইছে। এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে শবনম কে মুক্ত করার চেষ্টা করায় শবনম খুবই কৃতজ্ঞ হলো।
শ্রাবণী কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের রুমে নিয়ে এলো শবনম কে।রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে শবনম কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
শবনম ভীষণ অবাক হলো। শ্রাবণী কে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো,”কি হয়েছে তোমার? ”

কাঁদতে কাঁদতে শ্রাবণী বললো,”কেনো এরকম করলে ভাবী?
কেনো মেনে নিলে,প্রলয় ভাইকে কেনো ছেড়ে এলে তুমি?
নিজের ভালোবাসার মানুষ কে রেখে আসতে কি কষ্ট আমি জানি ভাবি,কেনো রাজি হলে প্রলয় ভাইয়ের কথাতে?”

শবনম নিজেকে জোর করে শক্ত করলো,কিছুতেই কাঁদবে না বলে নিজেকে বুঝাতে লাগলো।
ধাতস্থ হয়ে বললো,”সে তো আমার না বোন,সে তোমার।”

শ্রাবণী বিস্মিত হলো শবনমের কথা শুনে,শবনমের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে বললো,”কি বলছো ভাবী?”

শবনম নিজেও বিস্মিত। কিন্তু প্রলয় তাকে যা বলেছে তাই বললো সে শ্রাবণী কে।
“প্রলয় তো আমাকে বলেছে,ও তোমাকে ভালোবাসে।”

“ভাবী আমার মাথায় ঢুকছে না কিছু।আমি ওই বার যখন খালার বাসায় গেলাম প্রলয় ভাইকে নিজের ভালোবাসার কথা বলতেই সে হেসে উড়িয়ে দিলো।আমাকে বললো,সে তোমাকে ভালোবাসে।আমাকে বোন ভাবে সে।বিশ্বাস করো ভাবী আমি তখন লজ্জা পেয়েছি শুনে।আমি তাকে স্বামী রূপে পেতে চাই আর সে আমায় বোন ভাবে।নিজেকে নিজের ভীষণ নিচু মনের মনে হয়েছিলো।”

শবনম কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
অনেকক্ষণ চুপ থেকে শ্রাবণী বললো,”কোথাও কিছু একটা ভুল হয়েছে ভাবী।প্রলয় ভাই নিশ্চয় অন্য কাউকে ভালোবাসে,তাই আমাদের এভাবে বোকা বানিয়েছে।”

শবনমের বিশ্বাসের পৃথিবী যেনো হঠাৎ করে ভেঙে গেলো।
প্রলয় কি তবে এভাবে শবনমের হাত থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলো?
শবনমের মনে হলো যাকে সে দেবতা ভাবতো সে আসলে অপদেবতা।
এতোবড় একটা ধাক্কা খাবে শবনম ভাবে নি কখনো।

চলবে…..???

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here