আমি_তোমার_গল্প_হবো,চিঠি

আমি_তোমার_গল্প_হবো,চিঠি
জাহান আরা

শবনম,
প্রথমবার তোমাকে দেখার সাথে সাথে যে কথাটা আমার মাথায় এলো তা হলো,আকাশ থেকে নেমে আসা একটা পরী আমাদের বাসায় এরকম খালি পায়ে হাটছে কিভাবে?
পরীদের কি শীত করে না?
শুনেছি পরীদের দেশে কোনো বৃষ্টি হয় না,এখন তো মনে হচ্ছে ঠান্ডা ও নেই ওদের দেশে।

আমাদের চারপাশে অনেক সুন্দর মানুষ আছে।কিমতু কিছু সৌন্দর্য থাকে হৃদয়ে দাগ কেটে যাওয়ার মতো।

বাসায় ফিরে টের পেলাম আমার হঠাৎ করেই প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে।
আমি বাসায় ঢুকতেই অসুস্থ হয়ে গেলাম কেনো তা নিয়ে ভাবতে লাগলাম।
ভাবনাচিন্তা করে বুঝতে পারলাম আমি আসলে তোমাকে দেখে খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছি।

কি আশ্চর্য!
আমি প্রলয়,যাকে দেখলে মেয়েরা নার্ভাস ফিল করে,আমার সাথে কথা বলতে এলে যেখানে মেয়েদের গলা শুকিয়ে যেতো সেই আমি তোমাকে দেখে নার্ভাস হয়ে গেলাম।
তুমি যখন রেগে গিয়ে লাল হয়ে গেলে তোমাকে মনে হচ্ছিলো পাকা টমেটো।
তুমি যদি জানতে রাগ করলে তোমাকে কি পরিমান সুন্দর লাগে তবে আমার ধারণা তুমি সবসময় রেগে থাকতে।
তোমার সেই অগ্নিমূর্তি দেখার জন্য আমি বারবার তোমাকে বুয়া বলে ডেকেছি।

তোমাকে যখন আমি বন্যা আপার কথা বললাম দেখতে পেলাম মাথানিচু করে তুমি চোখ মুছছ।অনেক বছর পর কেউ আমার আপার জন্য চোখের পানি ফেললো,তাকে কি ভালো না লেগে উপায় আছে?

আকাশীরং শাড়ি পরে তুমি যখন খাওয়ার টেবিলে এলে আমার মনে হলো আস্ত একটা আকাশ নেমে এসেছে তোমার সাথে।সেই সাথে বুকে একটা অচেনা ব্যথা হলো।জানো কি সেই ব্যথা?
আর কিছুদিন পরে আমি নিজে এই আকাশের তারা হয়ে যাবো।

তুমি যখন শাড়ি পরে খালি পায়ে সারা বাসা ঘুরে বেড়াতে আমার ভীষণ ইচ্ছে করতো তোমার দিকে তাকিয়ে দেখতে।আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে চাইতাম কোমল,নরম একজোড়া পা কেমন করে দাপিয়ে বেড়ায়।

কিন্তু ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিতে পারি নি আমি শবনম। আমি তো আর দশটা মানুষের মতো না।আমার জীবন সবার মতো না।
আমার রুমের আলমারিতে দেখবে কতোগুলো প্রেসক্রিপশন,রিপোর্ট আছে।
আমার ব্রেইন ক্যান্সারের রিপোর্ট ওগুলো।

ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে ছিলাম আমি তখন।তুমি বলো শবনম,কিভাবে আমি তোমাকে আমার জীবনে আনার কথা ভাববো এরকম পরিস্থিতিতে। খানিক সময় আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পেতো,কিন্তু আমি মরে গেলে যে তুমি আজীবনের জন্য নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে আমি কিভাবে তা হতে দিতাম বলো।

আমি চেয়েছি আমার ভালোবাসার মানুষটির একটা নিরাপদ আশ্রয় হোক।
আমার পরে আমি যাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি সে হলো শ্রাবণ।
শ্রাবণ যেদিন আমাকে বললো ও তোমাকে ভালোবাসে সেদিন আমি একইসাথে আনন্দ,কষ্ট দুটোই পেয়েছি।
কষ্ট ছিলো তুমি অন্যের হবে তা আমি কিভাবে সহ্য
করবো।কিন্তু তবুও স্বস্তি পাচ্ছিলাম মানুষটি শ্রাবণ ভেবে।

শবনম,যখন আমার বয়স ৭ বছর আমরা তখন সবাই মিলে বেড়াতে গিয়েছিলাম আমাদের গ্রামের বাড়িতে।
খালারা ও গিয়েছিলো।
আমি আর শ্রাবণ সমবয়সী,ও আমার ভাই,আমার বন্ধু সবকিছু ও।

বর্ষার দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে সবাই যখন ঘুমাচ্ছিলো,আমি আর শ্রাবণ তখন গ্রাম দেখতে বের হই।কেমন মেঘলা আকাশ,যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে।ঠান্ডা বাতাস হচ্ছিলো।
হাটতে হাটতে আমরা তখন একটা খালের কাছে চলে এসেছি।বাঁশের একটা চিকন সাঁকো ছিলো খাল পার হবার জন্য।
শ্রাবণ বললো,”চল ফিরে যাই।”

কিন্তু আমি শুনলাম না।সাঁকো তে উঠে পড়লাম।
খালে তখন ভরা পানি।
মাঝখানে গিয়ে আমি পা হড়কে পড়ে গেলাম সাঁকো থেকে।
শ্রাবণ একমুহূর্ত না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
ও নিজেও সাঁতার জানে না,আমি ও জানি না।অথচ আমাকে বাঁচানোর জন্য শ্রাবণ পানিতে ঝাঁপ দিলো।
দুজন দুজনকে আঁকড়ে ধরে আছি।টের পাচ্ছি দুজনেই ডুবে যাবো।
নিজের কথা না ভেবে আমাকে বাঁচানোর জন্য শ্রাবণ আমাকে টানতে লাগলো ওর কাঁধে ওঠার জন্য।পানিতে দুজনেই হাবুডুবু খাচ্ছি,এই হাবুডুবু খাওয়া অবস্থায় শ্রাবণ আমাকে ওর কাঁধে উঠিয়ে নিলো। আমার ভারে শ্রাবণের অবস্থা নাজেহাল।
আমি তারস্বরে চেঁচিয়ে মা’কে ডাকতে লাগলাম।শ্রাবণ পানি খাচ্ছে আর আমি ওর কাঁধে বসে কাঁদছি আর মা’কে ডাকছি।

আমাদের গ্রামের এক লোক খালে জাল পেতেছিলো,সেই জাল তুলতে এসে দেখতে পায় আমি শ্রাবণের কাঁধে বসে কাঁদছি,শ্রাবণ পানি খাচ্ছে আর দু’হাতে আমাকে উপরের দিকে ঠেলে ধরে রেখেছে।

শবনম,যে ছেলেটা নিজের বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য এরকম রিস্ক নিতে পারে সে কি তোমাকে ভালো রাখার যোগ্য না বলো?

আমি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তোমাকে চিঠি লিখছি আজ।
শবনম,আমার কোনো আক্ষেপ ছিলো না আমার ক্যান্সার নিয়ে।আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।
তোমাকে দেখার পর,তোমাকে ভালোবাসার পর আমি প্রতিনিয়ত আল্লাহকে জিজ্ঞেস করে গেছি,কি ক্ষতি হতো তোমার সাথে আমার দেখা না হলে।আমার যে এখন মৃত্যুর পরেও আক্ষেপ থেকে যাবে আমার শবনম কে আমি পেলাম না।তাকে রেখে এসেছি আমি পৃথিবীতে।
কেনো এমন হলো শবনম?

আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি শবনম।

বাস্তবতা খুব কঠিন শবনম,কঠিন বাস্তবতা তোমাকে আমার হতে দেয় নি।আমার বুকের ভিতর গড়ে তোলা প্রেমের তাজমহল ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে।
আমার ভাগ্য আমার সহায় ছিলো না বলে আমি পারি নি তোমাকে আমার করতে।আমি তোমাকে তাই উপেক্ষা করে গেছি বারবার।
আমি কি ক্ষমার যোগ্য বলো শবনম?

তোমার কাছে একটা অনুরোধ রইলো।আমার মা’কে তুমি দেখে যেও মাঝেমাঝে এসে।আমার অশ্রবিন্দুদের তুমি দেখো।

আমি ছাড়া ওদের কেউ ছিলো না।যখন আমি থাকবো না ওরা যেনো ভেসে না যায়।

ভালো থেকো শবনম। ভীষণ ভালো থেকো তুমি।
আমি ভালো থাকবো সাড়ে তিন হাত মাটির নিচের অন্ধকার ঘরে।
যে ঘরে একবার গেলে আর ফেরত আসা যায় না।
শবনম,এই পারে তো আর দেখা হবে না।ওই পারে যখন আসবে তুমি,তখন আবার দেখা হবে।তোমার জন্য এক বুক ভালোবাসা এই বুকে জমে ছিলো,সেই ভালোবাসা বুকে নিয়েই আমি মাটির নিচে চলে যাবো!
কি কষ্ট!
কি কষ্ট!
তুমি যদি জানতে!

এক সময় তুমি দাদী হবে,তোমার নাতি নাতনিদের নিয়ে গল্প করার সময় রূপকথার গল্পের বাহানায় হলেও আমার গল্প বলো।আমি তোমার গল্প হবো।
একটা অসমাপ্ত গল্প শবনম। আমাকে ভুলে যেও না শবনম।
ভালোবাসার জন্য না,ঘৃণা করার জন্যে হলেও আমাকে একটু মনে করো মাঝেমাঝে।

~প্রলয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here