আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥,পর্ব_২৪,২৫

আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥,পর্ব_২৪,২৫
সাহেদা_আক্তার
পর্ব_২৪

আমি আয়নার দিকে তাকালাম। এক পলক তাকাতেই আবার চোখ সরাই নিলাম। কি হল আজকে আমার! কেউ আমারে বাঁচাও, আমি যে লজ্জার সাগরে ডুইবা গেলাম।

আমি যখন রুম থেকে বাইর হইলাম তখন নয়টা প্রায় বাজতে চলল। আমি আশেপাশে তাকাইতে লাগলাম। নাহ্, চেরিকে কোথাও দেখা যাইতেসে না। আমি মুনের কাছে গেলাম। মুন জিজ্ঞেস করল, কই ছিলি? আমি মুখে হালকা লজ্জা টাইনা বললাম, রুমে। তুই আমাকে কি জিনিস আনতে বলসিলি? মুন টিস্যু দিয়া মুখ মুছতে মুছতে কইল, কেন একটা ইয়া বড়ো খাম্বা পাশ নাই? আমি লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেইলা কইলাম, তুইও তার দলে নাম লিখাইলি? মুন আমারে পাত্তা না দিয়া বলল, আয় তো, আমাকে মেহেদী লাগিয়ে দে। আমি আরো বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেইলা মেহেদী হাতে নিয়া মনে মনে কইলাম, এখন থেকেই জামাইর বন্ধুর দলে যোগ দেয়া শুরু করসে। বিয়ার পর তো আমারে আর চিনবোই না।

যখন মেহেদী লাগাই উঠলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে এগারটা বাইজা গেসে। আমি উঠেই খাবারের কাছে ছুইটা গেলাম। খিদায় পেটের ইন্দুর চিকা সব যুদ্ধ শুরু করসে। এতক্ষণ তো তলোয়ার যুদ্ধ চলতেছিল। এখন না খাইলে ক্ষেপণাস্ত্র মাইরা বসবো। আমি খাইয়া উভয় পক্ষকে শান্ত কইরা একটা বড়ো হাই তুললাম। সেই ঘুম আসতেসে। আমি সবকিছু চেঞ্জ কইরা শুইতে আসলাম। দেখি রুমের ভেতর মানুষের বন্যা বয়ে গেসে। বিছানায় মানুষ, ফ্লোরে মানুষ, চেয়ারে মানুষ। আমার জায়গা নাই। মুনও দেখি এক কোনে শুয়ে পড়সে। আমি কই যাই? ওর ওখানে একটু খালি আছে মনে হয়। আমি পাহাড় পর্বত ডিঙাইয়া ওর কাছে গেলাম। ইস্, আমি পাই না ঘুমানোর জায়গা আর সে কোলবালিশ নিয়া ঘুমাইতেসে। আমি কোলবালিশটা নিয়া ছুইড়া মারলাম একপাশে। ও ঘুম ঘুম চোখে বলল, তুই আসছিস? নে শুয়ে পড়। বলে আমারেই কোলবালিশ বানাই ফেলল। কিসু বলতে যামু, পরে মনে হইল না থাক আজবাদে কাল তো চলেই যাবে। থাকি না কিছুক্ষণ। আমি শুয়ে রইলাম চুপচাপ। ও হাত দিয়া আমারে জড়াই ধরে আছে।

আমার মনে হল আমি কিছুকে মিস করতেসি। এই কয়দিন একবারও লাভার ভ্যাম্পায়ার ফোন দেয় নাই। ম্যাসেজও না। কেন জানি ওগুলাকে খুব মিস করতেসি। একটানা ছয় বছর পাইতে পাইতে অভ্যাস হই গেসে। একটু পর পর ফোন চেক করি ম্যাসেজ আসছে কি না। কি হল হঠাৎ? আমিই বা কেন এত ভাবতেসি? তাহলে কি আমার ওর প্রতি ফিলিংস চলে আসছে? না না, এটা কি কইরা হয়? চিনি না জানি না। না না, কিন্তু……। কেন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগতেসে। আকাশের প্রতি আমার ঐ সময় থেকে একটা আবেগ কাজ করসে। সেটা কি সত্যি ভালোবাসা ছিল? না শুধুই আবেগ? ভ্যাম্পায়ার আমাকে কেয়ার করতো। যতোই আমি বিরক্ত হই না কেন কেয়ারটা আমার ভালো লাগতো। এই রকম কেয়ার আমি নিজের ফ্যামিলি আর বন্ধ বান্ধব ছাড়া কারো কাছে পাই নাই। আমি কি কনফিউজড হয়ে যাইতেসি যে আমি কাকে ভালোবাসি? পা নাড়তেই আকাশের নুপুর হালকা শব্দ কইরা উঠল। আমি নিজের মনকে জিগাইলাম, তুই কি চাস? কিন্তু মন উত্তর দেওয়ার আগেই আমি ঘুমাই গেলাম।

সকালে ঘুম তাড়াতাড়িই ভাঙল। ফোনটা খুলে দেখি সাড়ে ছয়টা বাজে। একটা ম্যাসেজ! আমি খুশি মনে ম্যাসেজে ঢুকলাম। ধুর বাবা, কচুর সিমওয়ালা। সারাদিন ম্যাসেজ দেয়। উঠতে ম্যাসেজ বসতে ম্যাসেজ। একই ম্যাসেজ যে দিনে কয়বার দেয় তা হেরাও জানে না। ইচ্ছা করে ম্যাসেজগুলা গুইলা ওদের সরবত বানাইয়া খাওয়াই। ধ্যাত। আমি উঠতেই দেখি মুন ভালো মতোই আমারে কোলবালিশ বানাইসে।

– মুন, এই মুন। ওঠ।

– হুম… আরেকটু।

– আরে আজ তোর বিয়ে না? উঠ।

– হুম। আরেকটু ঘুমাতে দে। কালকে ওর সাথে অনেকক্ষণ জেগে ছিলাম।

– ওর সাথে জেগে ছিলি মানে?

– ওর সাথে মানে……

মুনের সাথে সাথে সব ঘুম হাওয়া। মুহুর্তে চোখ ফকফকে হই গেসে। ও উঠে বইসা আমার দিকে বেক্কলের হাসি দিতে লাগল। আমি কোমরে হাত দিয়া মুখ সুঁচালো কইরা বললাম, ব্যাপার কি? তলে তলে কি চলে? ও হাসি চওড়া কইরা বলল, কি কি কিছু নাতো। কি চলবে। কিছু না। আমি হঠাৎ নিজের হাতের দিকে তাকাই চমকাই কইলাম, এগুলা কি? মুন বলল, কি হইসে?

– আমার হাতে মেহেদী দিল কে?

– তোর জামাই।

– মানে? মুন সত্যি করে বল তো তুই কি লুকাচ্ছিস আমার কাছে।

– আরে বাবা, ক’দিন যাক। সব জানতে পারবি।

– মুন…

– একটা ম্যাজিক দেখবি?

– কি?

– দুই হাত একসাথে করে দেখিস। আমি যাই ফ্রেশ হয়ে নিই।

ও উঠে চইলা গেল। কি হইতেসে ভেতরে ভেতরে যা আমি জানি না। আমি দুই হাত একসাথে কইরা চোখ বড়ো বড়ো কইরা তাকাইলাম। আমার দুই হাতের মাঝে I আর U লেখা। দুই হাত একসাথে করলে একটা ভাঙা লাভ জোড়া লাগে। I ♥ U. আমি তাকাই আছি নিজের হাতের দিকে, মুন ফ্রেশ হই বলল, যা, ফ্রেশ হয়ে আয়। খাবো। খিদে পাইসে। তারপর আমার কাছে আইসা বলল, তোর মেহেদী রঙটা কি সুন্দর গাড় হইসে। একেবারে কালশে খয়রী। দেখবি তোর বর তোকে খুব ভালোবাসবে। এমনিতেও তো তোকে চোখে হারায়।

– মুন, তুই কার কথা বলছিস? বলবি আমাকে?

– বলবো বলবো। আগে আমার বিয়েটা হতে দে। যা ফ্রেশ হয়ে নে।

আমি ফ্রেশ হইয়া নাস্তা কইরা নিলাম। সারা সকাল চিন্তা করলাম, কে হইতে পারে? আকাশ? নাকি…… লাভার ভ্যাম্পায়ার কি দেশে আসছে? একবার তো বলছিল বিদেশে থাকে। তার জন্যই কি কোনো ম্যাসেজ বা কল করতেসে না? কিন্তু আসলে তো বলতো। মুন সব জানে। বলতেসে না। দাঁড়া একবার বিয়াটা শেষ হোক। তারপর সব পেট থেকে বাইর করমু।
.
.
.
.
আমি কমিউনিটি সেন্টারে দাঁড়াই দাঁড়াই চারপাশে দেখতেসি কেউ আমাকে নজরে রাখতেসে কি না। কাউকে তেমন সন্দেহ হইল না। আমি দাঁড়াই আছি এমন সময় পেছনে কেউ একজন বলল, আজকে কয়জনের মাথা ঘোরানোর দায়িত্ব নিয়েছো? আমি তাকাই দেখি আকাশ। সোনালী রঙের পাঞ্জাবীতে সাদা চকচকে সুতার কাজ করা। আমি তো ওখানেই ফিদা। কেন যে এত হ্যান্ডসাম লাগে আমার চেরিটাকে। ইচ্ছা করতেসে তুইলা নিয়া যায়। যাগগে, আমিও কম যাই না। খয়রী লেহেঙ্গার সাথে আমার রেশমীর মতো লম্বা চুল ছাইড়া দিসি। সেগুলা কোমর ছাড়াই গেসে। দুই কানের পেছন থেকে রজনী গন্ধার থোকা অর্ধচন্দ্রাকৃতি কইরা চুলের উপর লাগাইসি। সিঁথিতে খয়রী রঙের একটা বড়ো টিকলি আর সাথে ম্যাচিং গয়না। মুখে বিয়ের ভারি সাজ। আকাশ বলল, সব তো ঠিক আছে, কালকের উপহারটা কি এখনো পায়ে আছে? আমি লেহেঙ্গা একটু তুলে দেখলাম। নাহ্, সব ঠিকই আছে। দুই পায়ে নুপুরগুলো ঠিকই আছে। আমি মাথা নিচু কইরা দেইখা সবেমাত্র মাথাটা তুললাম, আকাশে সাথে সাথে আমার ডান গালে একটা কিস করে হাঁটা দিল। আমি রোবটের মতো দাঁড়াই রইলাম। কি হইল এটা? যখন খেয়াল হইল ততক্ষণে আকাশ চলে গেসে। আমি লাল হইয়া একটা চেয়ারে যাই বইসা পড়লাম। বিদেশ থেকে আসার পর হঠাৎ আমার সাথে এমন আচরণের কারণ আমি কিছুই বুঝতে পারতেসি না। তবে কি আকাশ আমায়… তা কি কইরা হয়। ও তো চাঁদনিকে পছন্দ করে। আমার মাথায় কিছু ঢুকতেসে।

বিয়ে বৌভাত সব সুন্দর মতো মিইটা গেল। ও যে এখনো চাঁদনিকে পছন্দ করে সেটার প্রমান বৌভাতের দিনই পাই গেলাম। ঐদিন কোথা থেকে এসে আকাশরে জড়াই ধরছিল। এর মানে ওদের সম্পর্ক এখনো ভালো আর একে অপরকে ভালোবাসে। তাহলে আমার সাথে করা সবকিছুর কি ব্যাখ্যা হতে পারে? বিছানার কিনারায় মাথা ঝুলিয়ে এসব আমি ভাবতেসি আর তখনই মুন আমার রুমে ডুকল।

– কি রে পেত্নী? কেমন আছিস?

আমি উল্টো থেকেই কইলাম, তুই নাই তাই জ্বালাও নাই। শান্তিতেই আছি। বাব্বা, দুইদিনে তো জামাইয়ের আদর পেয়ে সেই তরতাজা হয়ে গেছিস।

– যাহ্, অসভ্য মাইয়া।

– তা বল, কেমন আছিস? শ্বশুর শাশুড়ি কেমন রে?

– খুব ভালো। আসার আগে তো ছাড়তেই চাইছিল না।

– ভালো।

– এবার তোর পালা।

আমি উঠে বসে কইলাম, কিসের পালা? মুন আমার পাশে বইসা বলল, তোকে তরতাজা হওয়ার জন্য জামাই বাড়ি পাঠাবো। দাঁড়া। আমি বিছানা থেকে নাইমা কইলাম, পিটা খাইতে না চাইলে চুপ থাক।

– আচ্ছা, চুপ করব। একটা কথা বলতো।

– কি?

– তুই কাউকে ভালোবাসিস?

– বাসতাম।

– বাসতি? এখন বাসিস না?

– জানি না রে। বুঝতে পারি না। আমার সব তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

মুন কিছু বলল না। আমি বললাম, আজকে নাকি বিকালে মেহমান আসবে। মুন বলল, জানি। আমি জিগাইলাম, কে রে? মুন একটা নিঃশ্বাস পেলে বলল, আসলে দেখবি। চল রেডি হবি। আমি টেবিল থেকে একটা বই হাতে নিয়া বললাম, হঠাৎ কিসের জন্য? মুন আলমারির কাছে গিয়া খুলে বলল, সব এখন বললে তো সমস্যা। ও সেই নীল শাড়িটা বের করল। আমি ওকে বললাম, আবার এই শাড়ি কেন? তোর কি এই শাড়ির উপর নজর পড়সে নাকি। সব সময় আমাকে এই শাড়িটা পড়তে বলিস। মুন জুয়েলারি চুজ করতে করতে বলল, কারন তোকে এই শাড়িতে বেস্ট লাগে। দেখি আয়। রেডি হয়ে নে। ও আমারে ইচ্ছা মতো রেডি করাইল। কেন রেডি করাইতেসে, এত কিছু থাকতে শাড়িই বা কেন কিছুই বুঝতেসি না। যতবড়ো হইতেসে তত মনে হয় মগজের উর্বরতা কমতেসে। কিছুই মাথায় ঢুকে না।

বিকালে কলিং বেল বাজতেই মুন গিয়া দরজা খুলল। আমি উঁকি মাইরা দেখলাম রেদোয়ান ভাই আসছে। আরও কেউ আসছে। আমি দেখতেসি না পর্দার জন্য। মুন আইসা বলল, ঘোমটা দিয়ে আয় আমার সাথে। আমি মুখ গোমড়া করে কইলাম, মনে হয় যেন আমাকে দেখতে আসছে। সর তো। আমি গিয়া দেখি আকাশের আব্বা আম্মা আসছে। সাথে আরেকটা লোক। চিনি না। আমি তো আন্টিকে দেইখা সেই খুশি। গিয়া বললাম, কেমন আছেন, আন্টি?

– ভালো। তুমি?

– আপনি আসছে আর আমি না ভালো হয়ে থাকি?

উনি আমাকে পাশে বসাই বললেন, আমরা একটা কাজে এসেছি এখানে। তোমার খালা কি তোমায় বলেছে?

– না আন্টি। কি কাজ?

– আসলে ব্যাপারটা তোমার আব্বু আম্মু থাকতেই ঠিক করা ছিল। এখন তুমি বড়ো হয়েছ তাই তোমারও মতামত জানতে চাইছি।

– কি বলেন না, আন্টি।

– আমরা আসলে তোমাকে দেখতে এসেছি। তুমি যখন ক্লাস এইটে ছিলে তখনই তোমার আব্বু আম্মুকে তোমার আর আকাশের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম।

কথাটা শুইনা আমি সেই লেভেলের টাসকি খাইলাম। আমার আর চেরির বিয়ের কথা! তাও ছয় বছর আগে!

চলবে…

#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥
#পর্ব_২৫
#সাহেদা_আক্তার

কথাটা শুইনা আমি সেই লেভেলের টাসকি খাইলাম। আমার আর চেরির বিয়ের কথা! তাও ছয় বছর আগে!

– ছোঁয়া তোমার মনে আছে তোমার জন্মদিনের আগের দিন আমরা তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম?

– জ্বি আন্টি।

– ঐ দিন আমরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম। যেহেতু তুমি অনেক ছোট ছিলে তাই আমরা ওয়েট করতে চাইছিলাম। তোমার বাবা মা বলেছিলেন ভেবে দেখবেন। পরেরদিন সকালবেলা ফোন করে বলেছিলেন যে তারা বিয়ের প্রস্তাবে রাজি। এই ব্যাপারে তোমার খালা খালুও জানতেন। এখন তুমি যথেষ্ট বড়ো হয়েছ। তোমার নিজস্ব একটা মতামত আছে। তাই আজকে আমরা জানতে এসেছি, তুমি কি এই বিয়েতে রাজি? আমরা কি কথা আগাতে পারি?

আমি চুপ কইরা রইলাম। এই দিনটার জন্য এত বছর অপেক্ষা করসি। একটা ‘হ্যাঁ’ বললেই আমি আমার চেরি ফলকে নিজের কইরা পামু। কিন্তু মনটা যে বড্ড দোটানায় ফেলতেসে। সে যে কি চায় তা কিছুই বুঝতেসি না। কেন আমি সহজে হ্যাঁ বলতে পারতেসি না। বুঝতেসি না। আমি কইলাম, আন্টি, আমার আব্বু আম্মু চলে গেছে ছয় বছর। তারা সারাজীবন ব্যয় করেছে আমাকে ভালো রাখার জন্য। তাদের সিদ্ধান্ত কখনো ভুল হবে না। সেদিক থেকে হ্যাঁ বলতে পারি। কিন্তু আমার একটু সময়ের প্রয়োজন এটা নিয়ে ভাবার জন্য।

– বেশ তো, সময় নাও। আমাদের সমস্যা নেই। তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। উনি হচ্ছে আকাশের মামা।

আমি সালাম দিলাম। আন্টি বললেন, তুমি ভেতরে যাও, ছোঁয়া মা। আমি চইলা আসলাম। শাড়ি গয়না খুইলা বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে গেলাম। হাতে একটা গাজর। চিন্তার চাকা ঘুরতেসে। কেন আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারতেসি না। চার মাসের আবেগ না ছয় বছরের কেয়ার? আমি যতদূর জানি যে চেরিফল আমাকে ভালোবাসে না। তবে এই কয়দিনের আচরন অবশ্য অন্য কথা বলতেসে। আর লাভার ভ্যাম্পায়ার গত ছ’টা বছর বলসে যে সে আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমি তাকে কখনো দেখিনি। শুধু ফোনালাপ মাত্র। সব ইয়ারফোনের মতো প্যাঁচাই গেসে। যত খুলতে চাইতেসে জট লাগতেসে।

আমি ফোনটা নিলাম। এখনো লাভার ভ্যাম্পায়ার একবারও ফোন দেয় নাই। আমি ফোন দিলাম। ফোন বন্ধ। ঠিক আছে তো? এত ব্যস্ত যে ফোন বন্ধ!? আমি একের পর এক ফোন দিতে লাগলাম। একই কথাই বলতেসে। তাও ট্রাই করতে লাগলাম। ওদিকে সবাই বসার রুমে কথা বলতেসে। মুন একটু পরে এসে কইল, ছোঁয়া আন্টি তোকে ডাকছে। আমি ঘোমটা দিয়া বসার রুমে গেলাম। আন্টি আমাকে একটা বালা পরাই দিলেন। আমি বললাম, আন্টি, আমি তো এখনো সিদ্ধান্ত জানাইনি তাহলে…

– জানো এটা আমার শ্বাশুড়ি মায়ের। আজ তোমাকে দিলাম।

– কিন্তু কিন্তু ……

– কোনো কিন্তু না। আমি আসি মা।

ওনারা বেরিয়ে গেলেন। আমি ওনাদের চলে যাওয়ার দিকে তাকাই রইলাম। তাহলে কি ওনারা বিশ্বাস করেন আমি তাদের প্রস্তাবে রাজি হই যাবো। কিন্তু আমার মন কেন মানতে চাইতেসে না?
.
.
.
.
আরো দুইটা দিন চইলা গেল। আমি এখনো ডিসিশান নিতে পারলাম না। সারাদিন এক হাতে গাজর খাইতেসি আর আরেক হাতে ফোন। এই লাভার ভ্যাম্পায়ারের সমস্যাটা কি? সেই যে ফোন বন্ধ করসে আর খোলার নামই নাই। আমি এদিকে ডিপ্রেশনে থাম্বেলিনার মতো ছোটো হই যাইতেসি। আজকে মুন চইলা যাওয়ার কথা। ওরে বিদায় দিয়া সবেমাত্র আমি বিছানাই শুইসি। এমন সময় ও হাঁপাইতে হাঁপাইতে আইসা বলল, ছোঁয়া…। আমি ওরে দেইখা ভয় পাইয়া গেলাম। বিছানা থেকে উইঠা ওরে বসাই একগ্লাস পানি দিলাম। ও পানি খেয়ে গ্লাসটা আমার হাতে দিল। আমি গ্লাসটা রাখতে রাখতে কইলাম, কি হইসে? ও বলল, আকাশ ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হইসে। সাথে সাথে গ্লাসটা স্লিপ কাইটা আমার হাত থেকে পইড়া ভেঙে টুকরা টুকরা হই গেল। মুন আরও কিছু বলার আগেই আমি ব্যাগ নিয়া দৌঁড় দিলাম বাইরে। মুন আমারে পিছন থেকে ডাক দিল কিন্তু আমার কানে কোনো ডাকই ঢুকল না।

শহরে ঢুকতেই খেয়াল হইল আমি আসলে কিছুই জানি না। শুধু এক্সিডেন্টের কথা শুইনাই দৌঁড় মারসি। কোথায় ভর্তি, কি অবস্থা, কেমন আছে কিছুই জানি না। আমার মতো গাধি আর কয়টা আছে? আমি ফোন বের কইরা মুনরে ফোন দিলাম। কল রিসিভ করতেই একগাদা ধমক শুনলাম। আমি মুখ বোঁচা করে বললাম, শোন না।

– কি শুনবো? কোনো কান্ডজ্ঞান আছে তোর। কিছু বলার আগেই দৌঁড়ে বের হয়ে গেলি।

– আসলে শুনেই ভয় পেয়ে গেছি। ও মানে তোর জামাইর বন্ধু কোথায় ভর্তি আছে?

– কি তখন থেকে জামাইর বন্ধু জামাইর বন্ধু করছিস। ক’দিন পরে সে তোর জামাই হবে।

– আচ্ছা বাবা, একটু ঠান্ডা হয়ে বল না, কোথায় আছে?

– আমি একটা ঠিকানা ম্যাসেজ করে দিচ্ছি। ওখানে যা। সেখানেই আকাশ ভাই আছে।

– আচ্ছা দে।

মুন একটা ঠিকানা ম্যাসেজ করল। আমি একটা রিকশা ধরাই চইলা গেলাম। গিয়া বেকুবের মতো দাঁড়াই রইলাম। এটা তো কোনো হাসপাতাল না। একটা বড় বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়াই আছি। কয়েকবার ঠিকানা মিলাইলাম। ঠিকই তো আছে ঠিকানা। এটা কার বাড়ি? আমি মুনরে ফোন দিয়া কইলাম, এটা কার ঠিকানা দিয়েছিস?

– তুই পৌঁছে গেছিস। ভেতরে যা।

এই বইলাই মুন ফোন কাইটা দিল। আমি ফোনটার দিকে বিরক্ত হই তাকাইলাম। এই মাইয়া আমারে কখনো কিছুর সবটা বলবে না। আমি গেটে নক করতেই দারোয়ান এসে কইল, কি চাই? কি বলমু? কিসুই তো বুঝতেসি না। কার বাড়ি, কে থাকে। কিছুই জানি না।

– আকাশ আছে?

– আপনি ছোঁয়া?

– জ্বি।

দারোয়ান গেট খুইলা দিল। আমিও ঢুইকা পড়লাম। বাড়িটার দিকে যাইতেই আমার পাঁচ মিনিট লাগল। এত বড় এটা কাদের বাড়ি? আমি দরজায় নক করতেই দেখলাম দরজা খোলা। আমি উঁকি মারলাম। দেখলাম আন্টি সোফায় বইসা আছে। আমি গিয়ে সালাম দিলাম। আন্টি হাইসা বললেন, আরে, ছোঁয়া যে। কি খবর?

– জ্বি আন্টি, ভালো। আমি শুনলাম, ইয়ে মানে ওর নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে।

– তা ছোটখাটো একটা হয়েছে। চেম্বার থেকে বাইকে করে আসার সময় বাইক উল্টে পড়ে গিয়েছিল।

– এখন কেমন আছে?

– আছে কোনো রকম। তুমি দেখে এসো।

– ইয়ে মানে যাবো?

– যাও। কয়দিন পরে তো চলেই আসবে। আজ গেলে কিই বা সমস্যা হবে।

আমি লজ্জায় মাথা নিচু কইরা সিঁড়ি দিয়া উপরে গেলাম। উপরে গিয়া মনে হইল, আন্টিকে তো জিজ্ঞেস করা হই নাই চেরির রুম কোনটা। ধুর বাবা। কি যে করি। আমি রুমগুলাতে উঁকি মারতে লাগলাম। একটাতে দেখলাম কেউ বিছানায় শুয়ে আছে। চিনতে অসুবিধা হইল না। আকাশ বিছানায় শুয়ে আছে। আমি সাবধানে ঢুকলাম। দেখে বোঝা যাচ্ছে ঘুমাচ্ছে। আমি বিছানার কাছে গিয়া দেখলাম পায়ে আর মাথায় ব্যান্ডেজ। ইচ্ছে করল একবার ছুঁয়ে দেখি। পরে ভাবলাম, থাক, ঘুমাচ্ছে যখন ঘুমাক। ধরলে যদি জেগে যায়।

আমি ওর রুমটা দেখতে লাগলাম। সুন্দর গোছানো। দেয়ালে ওর বড়ো একটা ছবি টাঙানো। ইস্, কি হ্যান্ডসাম লাগছে। তবে সামনাসামনি তো আরও বেশি হ্যান্ডসাম। বলেই নিজের মুখ ঢাইকা ফেললাম। আমি সবকিছু ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ একটা জিনিসে চোখ আটকে গেল। একটা নীল ডায়েরী। আমি হাতে নিতেই চিনতে পারলাম। এটা তো চেরির ডায়রী! যেখানে সে তার চাঁদনির স্মৃতি লিখে রাখসে। আমার মাথায় আগুন ধইরা গেল। ইচ্ছা করতেসে ডায়রীটা টুকরা টুকরা কইরা ফেলি। কিন্তু মন আমার মাথায় বরফ ঢাইলা বলল, কুল, ছোঁয়া কুল। একবার পইড়া দেখ কেমনে কি করসে। আর যাই হোক, আমার মতো লাভ স্টোরি রিডারের এতবড় একটা সুযোগ মিস করা ঠিক হবে না। মনে হইতেসে এই ডায়রীতেই সব রহস্য লুকাই আছে। আমি ডায়রীটা নিয়া রুম থেকে বাইর হই আসলাম। আসার সময় পড়ার রুমটা চোখে পড়ছিল। ওখানে গিয়া চেয়ারে পা তুইলা বসলাম। মনে হইতেসে কোনো জীবন কাহিনী পড়তে বসতেসি। যাহ হোক। আমি শুরু করলাম।

প্রথম পেইজের গানের কলিটা দেইখা একটা হাসি দিলাম। কি প্রেমটাই না ছিল তাদের! ছিল কেন বলতেসি। এখনো আছে। আমি পরের পৃষ্ঠা উল্টাইলাম। ঐদিন চেরি ফল আমার থেকে কাইড়া নিয়া গেসিল। আজকে যে করেই হোক আমি পুরাটা পইড়া শেষ করমু। আমি মনোযোগ দিয়া পড়া শুরু করলাম।

(ডায়রী)

♥ প্রথম দেখা:
গাড়ি করে যাচ্ছিলাম। প্রায়ই গান শুনতে শুনতে কলেজ যেতাম। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ড্রাইভার চাচাকে বললাম গান ছেড়ে দিতে। ড্রাইভার চাচা কি এক রোমান্টিক গান ছেড়ে দিল। আমার বিরক্ত লেগে উঠল। তবু কিছু বললাম না। চলুক, দেখি কেমন লাগে। নাহ্, সহ্য হচ্ছিল না। বাড়ি থেকে কলেজ যেতে আধা ঘন্টা লাগে। আমি এই আধা ঘন্টা একেবারে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে গেলাম। আমি মাত্র চাচাকে বলতে যাচ্ছিলাম, চাচা কালকে থেকে আর এমন গান দিবা না। হঠাৎ একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল। আমাদের কলেজের পাশেই একটা ফুসকা দোকান আছে। সেখানে স্কুল ড্রেস পরা একটা মেয়ে ফুসকা খাচ্ছে আর ঝালে লাফাচ্ছে। আমার দেখে ভীষন মজা লাগল। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটা ছিল, মেয়েটাকে দেখে হঠাৎ করে আমার গাড়িতে চলা রোমান্টিক গানগুলো ভালো লাগতে শুরু করল। চাচা বললেন, কি হল আকাশ বাবা? নামবা না? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।

– হুম।

আমি নেমে কলেজ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে গেলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটার ফুসকা খাওয়া দেখতে লাগলাম। হঠাৎ একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে এসে ওর জামা টেনে কি যেন বলল। ঐ মেয়েটা ছোট্ট মেয়েটার দিকে এমন মিষ্টি হাসি দিল যে আমার মনে হঠাৎ ঝড় শুরু হয়ে গেল। লজ্জায় আমার কান অবধি গরম হয়ে গেল। আমি নিজের চিন্তায় ডুবে গেলাম। যখন মেয়েটার দিকে খেয়াল করলাম ততক্ষণে সে চলে গেছে। কোনদিকে গেছে সেটা আর খেয়াল করতে পারলাম না।

বাড়িতে এসে অনেকক্ষণ মেয়েটাকে ভোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু কেন যেন মেয়েটার ঐ এক চিলতে হাসি আমার মনে গেঁথে গেল। আমি বিছানায় শুয়ে সেই হাসিতেই হারিয়ে গেলাম।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here