আঁখির আড়ালে,পর্বঃ- ০৫ ও ০৬

আঁখির আড়ালে,পর্বঃ- ০৫ ও ০৬
সাদিয়া_সৃষ্টি

বৃষ্টি মানেই আলাদা ভালোলাগা। বৃষ্টির দিনে পেট পুজা করবার এই একটাই খাবার খিচুড়ি। খিচুড়ি মূলত বাউলদের খাবার। এই ছন্নছাড়া গানপাগল মানুষগুলো গান শুনিয়ে মানুষের বাড়িতে পেতেন চাল ও ডাল। তাই তারা এই চাল ডাল মিলিয়ে খুব দ্রুত ও ঝামেলা মুক্ত ভাবে রেধে ফেলতেন খিচুড়ি। গ্রামাঞ্চলে রান্নাঘর ঘরের বাইরে হওয়ায় ভিজে যেত চুলা। তাই সহজেই চাল ডাল ও সবজি মিলিয়ে খুব দ্রুত হয়ে যায় খিচুড়ি। এসব কারণেই বৃষ্টির দিনের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে খিচুড়ি সংস্কৃতি। ইলিশ মাছ ভাজা এসেছে, বর্ষাকালে নদীর তাজা ইলিশ মেলে অধিক পরিমানে। এই কারণে খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা জড়িয়ে গেছে।

সকাল হতে না হতেই দিশা নেমে পড়েছে কাজে। বাড়ির রান্নাঘর থেকে সব জিনিস পত্রের জোগাড় করা শুরু করেছে। রান্নাঘরের এক কোণে পড়ে থাকা হাঁড়ির স্তুপ থেকে বের করেছে এক বড় হাড়ি। সেটা শান্তিপুকুরে গিয়ে ভালোভাবে ছাই দিয়ে মাজাঘষা করেছে। চকচক না করা পর্যন্ত ধুয়েই গিয়েছে যেন। তার উপর সকাল সকাল রোদের উত্তাপ প্রচুর। এর মাঝে কয়েকবার দিশার মা তাকে বকে গিয়েছেন। রোদের মধ্যে এতো পানি ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক না- বলে। কিন্তু সে কথা আর দিশা শুনলে। মাথার উপর চমৎকার রোদ। তার মধ্যে একবার শান্তিপুকুর তো আবার খন্দকার বাড়ি ছুটে ছুটে জিনিসপত্র পরিষ্কার করছে। উদ্দেশ্য খিচুড়ি রাঁধবে সে আজ। তাও নিজে নিজেই। আর অনেক মানুষের জন্য। কিন্তু গরমের মধ্যে সাধারণত খিচুড়ি খাওয়া উচিত নয়। এতে হজমে সমস্যা হয়। দিশা কি ভেবে যে খিচুড়ি রাধতে চায়, সেটাই কেউ বুঝতে পারছে না। রুবিনা, মাহিরা আর সাবিহাও সকাল সকাল খন্দকার বাড়িতে এসে উপস্থিত। তাদেরকে সকালে দ্রুতই আসতে বলেছিল দিশা। বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে দৌড়াতে থাকা দিশাকে তারা দেখতে পায়। একেক বার একেক দিকে যাচ্ছে। কিন্তু সব যাওয়া আসা যেন রান্নাঘরে গিয়ে শেষ হয়েছে। মূল দরজা দিয়ে ঢুকলে উত্তর দিকে রান্নাঘর। দুটো রান্না ঘর ওদের। একটা মাটির ঘর, আরেকটা বাঁশের তৈরি। মাটির ঘরে সব জোগাড় করে রাখা হয়। রান্না করা হয় মূলত বাঁশের ঘরটাতে। মাটির ছোট ঘরে রান্না করতে অসুবিধা হয় দিশার মায়ের। তাই পরে বড় করে এই ব্যবস্থা করেছেন দিশার বাবা।

দিশার ছুটোছুটি দেখে ওরা ৩ জনও কাজে লেগে পড়ে। দিশা এখন উঠোনে আগুনের ব্যবস্থা করছে যেখানে রান্না করবে। রুবিনারাও রান্না করতে যা যা লাগবে সেসব জোগাড় করছে। সব এনে এনে চুলার কাছে রাখছে। এক পর্যায়ে থেমে গিয়ে দিশার মাকে জিজ্ঞেস করল,

— কাকি, দিশার কি হইছে? এতো দৌড়াইতেছে কেন? আজ কি দাওয়াত দিছেন নাকি আপনারা?

দিশার মা ঠিক মতো লক্ষ্য করে বলে উঠলেন,

— আমি কিছু করি নাই। সব ও করছে। ওকে প্রশ্ন কর। আমাকে আর কিছু বলতে আসবি না।

বলেই মুচকি হেসে তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন। রুবিনা সহ বাকি ২ জন তব্ধা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রথমে কপট রাগ দেখিয়ে কথা বললেও পরে মুচকি হাসির কারণ তাদের না জানা হলো, আর না হলো বোঝা। তারা দাঁড়িয়ে আছে দেখে দিশা আবার কাজ করতে বলল। তাও আর বেশি কিছু ভাবল না। যা হচ্ছে, পরে তো সব দেখাই যাবে। আপাতত সেই কৌতূহল দমিয়ে রাখল ওরা আর কাজে লেগে পড়ল।

__________

বিহান সকালে প্রতি দিনের মতো হাত মুখ ধুয়ে খাবার খেতে বসে পড়ল। সামনে মকবুল মির্জাকে বসে থাকতে দেখে সে সালাম দিল। মকবুল মির্জাও সালামের উত্তর দিয়ে খবরের কাগজে মন দিলেন। মকবুল মির্জা লোকটি বেশ মনে ধরেছে বিহানের। আসার পর থেকে তার আপ্যায়নে কোন ত্রুটি রাখেন নি। সব দিক থেকেই খেয়াল রেখেছেন বিহানের। এর বিনিময়ে কিছু নেননিও তিনি। আজকাল এমন মানুষ পায়া যায় না। প্রতি মুহূর্তে মানুষটার প্রতি বিশ্বাস যেন বেড়ে চলেছে বিহানের। শুরুর দিকে নতুন জায়গায় হওয়ায় একটু একটু সন্দেহ হত, সেটাও দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তার জায়গায় জড়ো হচ্ছে বিশ্বাস, একটু একটু করে। তাছাড়া হয়েছে শ্রদ্ধা। এইতো সেদিনও তো একটা বাড়িতে কেউ একজন অসুস্থ হওয়ার খবর কানে পেতেই কোন দিন বিবেচনা না করেই তার বাড়িতে কবিরাজ নিয়ে ছুটে গেলেন। মানুষ মানুষের জন্য কথাটার যেন মূর্ত প্রতীক মকবুল মির্জা। তাই বিহান নিজের সন্দেহের খাতা বন্ধ করে রেখেছে। তার চেয়ে অন্য দিকে মনোযোগ দিয়েছে সে। আর অন্যদিকটা যে ”দিশা” সে নিয়েও কোন সন্দেহ নেই।

বিহানের পাশে বসে আছে শাকিল। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ খাবারে। বিহান তার দিকে একবার তাকিয়ে নিজেও খাবারে মনোযোগ দিল। মকবুল মির্জা কাজে যাওয়ার আগে শাকিলের সাথে সব ব্যাপারে কথা বলে তারপর বের হয়ে গেলেন মির্জা বাড়ি থেকে।

শাকিলও হাত মুখ ধুয়ে এসে বিহানের সামনে বসে পড়ল। তারপর বলল,

— গতকাল আপনি তো দিশার সাথে ঘুরতে চলে গেলেন, আপনাকে কেউ মানা করেনি এর আগে?

— হ্যাঁ, রবি ভাই বলেছিলেন।

— তারপরও গেলেন? আমাকে বলার সুযোগ টুকুও দিলেন না গতকাল।

— খেয়াল করিনি। আপনিও তো পরে আসেন নি।

— আমি তো ওই কাজের জন্য ডাক পড়েছিল। তাই চলে গেলাম। পরে ভাবলাম কাল রাতে কথা বলব। কিন্তু বলে ওঠা হয় নি। তবে আজ বলছি, ওই দিশার সাথে মিশবেন না।

— কেন?

— সব কিছুর কারণ জানার দরকার নেই। আব্বাও মানা করেছেন। আপনার ওর সাথে কথা বলার দরকার নেই। বাকি যার সাথে ইচ্ছা কথা বলতে পারেন।

— শুধু উনার সাথেই কেন কথা বলব না? মিশব না?

— বললাম না কোন কারণ বলতে পারব না।

কথাটা একটু জোরেই বলে উঠল শাকিল। তারপর কি করেছে বুঝতে পেরে নিজের স্বর কমিয়ে বলল,

— আসলে ওর মাথায় একটু সমস্যা আছে। আর তাছাড়া গ্রামের কেউ ওর সাথে তেমন মেলামেশা করে না।

— কাল তো ঘুরলাম, কই, মাথায় সমস্যা আছে বলে তো মনে হলো না।

— প্রথম দেখায় বুঝবেন না।

— তাহলে গ্রামের কেউ যে মেশে না বললেন, কিন্তু আমি তো দেখলাম, প্রায় সবাই ওর সাথে কথা বলছে।

— বললাম না প্রথম দেখায় বুঝবেন না। তাছাড়া গ্রামের মেয়েদের সাথে এভাবে মেশা ঠিক দেখায় না। আব্বা তো আপনাকে আগেও বুঝিয়েছেন? তাই না?

— আপনিই তো বললেন যে ও বাদে যেকোনো কারো সাথে কথা বলতে পারব। তাহলে সব মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারব কিন্তু ওর সাথে না কেন?

— বার বার প্রশ্ন করবেন না। আমি আপনার ভালোর জন্যই বলছি কথা। মেনে চলবেন দয়া করে। আপনার কোথাও যাওয়ার দরকার পড়লে আমাকে জানাবেন, আমি সাহায্য করব।

–আমি একাই পারব। সমস্যা হবে না আমার।

বিহান আর কথা বাড়াল না। মূলত তার কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না। এদিকে শাকিল মানা করছে। তো অন্যদিকে তার খারাপ লাগছে। একবারের জন্যও ভাবতে ইচ্ছা করছে না যে সে এক দিনের জন্য ওই কাজল দেওয়া চোখ দেখতে পারবে না। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল,

”আমি শহরে ফিরে গিয়ে ওই কাজল কালো চোখ জোড়া না দেখে থাকতে পারব তো?”

_________

দিশাদের বাড়িতে রান্না প্রায় শেষের দিকে। নিজের কোমরে আঁচল গুঁজে বড় খুন্তি সজোরে নাড়িয়ে চলেছে সে। মাথার উপর সূর্যের উত্তাপ ততক্ষণে ‘নাই’ হয়ে গিয়েছে। তার বদলে জমা হয়েছে কালো কালো মেঘ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আকাশে। দুরের আকাশ থেকে ভেসে ভেসে আসছে আরও কালো মেঘ। যেন এ এক বিশাল মেঘের ভেলা। তাতে ভর করে বৃষ্টিকন্যা ভেসে ভেসে আসছে বৃষ্টির আগমনী বার্তা নিয়ে। সকালের কড়া রোদের পর এক প্রশান্তি নিয়ে সকলের আনন্দের কারণ হয়ে সে আসছে। শুরুতে সকলের কাজের ক্ষেত্রে অনাগ্রহ দেখা দিলেও এখন তা ক্রমশ বাড়ছে। ছুটোছুটির পাশাপাশি বৃষ্টির দিনের ছড়া কেটে চলেছে বাচ্চারা। খেলায় মেতে উঠেছে উঠোনের এক প্রান্তে। আরেক প্রান্তে চলছে রান্না। দিশা গতকাল-ই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল খন্দকার বাড়িতে আসার জন্য। অবশ্য না জানালেও সবাই একবারের জন্য হলেও নিজের সময় মতো এ বাড়িতে আসে। কিন্তু একসাথে হয়তো সবার আসা হয়ে ওঠে না সব সময়। আর যখন হয়, তখন বাড়িতে কিচিরমিচিরে ভরে যায়। একেকজন একেক কথা বলে। সকলের মধ্যে মতের ভিন্নতা দেখা গেলে সবাই যখন একসাথে কথা বলে ওঠে তখন দিশার মায়ের এক তেজী ধমক খেতে হয় অবশ্যই। সেখানে আজ বেশ কয়েক বার দিশার মা বকে দিয়েছেন এদের। তাও বৃষ্টির জন্য এদের আনন্দের শেষ নেই। বাড়ির সব কাজ ছেড়ে ছুটে এসেছে এরা। অন্যদিকে দিশা করে চলেছে খিচুড়ির আয়োজন। মাঝে মাঝে অন্যদের সাথে দু-একটা কথাও বলছে। আবার আশেপাশে নজর বুলাচ্ছে। এক পর্যায়ে কারো চোখে চোখ পড়তেই সেখানেই আটকে গেল দিশার চোখ। আবার যেন সে গভীর সমুদ্রে ডুব দিল। মানুষটার চোখ অন্য সবার থেকেই আলাদা। মানুষটার চোখ আলাদা নাকি তার অনুভূতি আলাদা সেটা নিয়ে ভাবল না দিশা। হাত নিজের মতো নাড়িয়ে চললেও মনটা আর সেখানে নেই। ২-৩ দিনের এই বিলাতি বাবুকে দেখলে দিশা সত্যিই নিজেকে সামলাতে হিমশিম খায়। ওই যে মন বলে, কোন এক অজানা অনুভূতির সাথে পরিচিত হবে সে। সেটাই হয়। এক অজানা অনুভূতি ঘিরে ধরে তাকে। বাকি সব শব্দহীন মনে হয়। এদিকে মাহিরা যে সেই কখন থেকে দিশাকে ডেকে চলেছে, সেই দিকেও খেয়াল নেই দিশার। হঠাৎ কেউ তার কাঁধ ধরে তাকে ডাক দিলে সে ভাবনা থেকে বের হয়ে আসে। তারপর আবার সামনের দিকে তাকায়। না, কেউ নেই সেখানে। নিজের ভাবনার প্রতি চরম বিরক্ত হয়ে মনে মনেই এক বকা দেয় নিজেকে। তারপর অন্যদের সাথে কথা বলায় লেগে পড়ে।

হঠাৎ করে আবার বাচ্চাদের দিকে নজর যায় তার। ঝুম্পাকে কোলে নিয়ে সবার মাঝে বসে আছে বিহান। নিজের কল্পনা নাকি বাস্তব সেটা বুঝতে ব্যর্থ হয় এবারও। আশেপাশে বাচ্চা ছেলে মেয়েরা তাকে ঘিরে রেখেছে। আর বিহান হেসে হেসে সবা সাথে কথা বলছে। সেদিকে তাই খেয়াল না করে নিজের কাজে মন দেয় সে। ওই বিশাল বড় ভারী হাড়ি আগুন থেকে নামিয়ে রান্নাঘরে রেখে দেয়। তারপর সকলের খাবারের ব্যবস্থা করতে যায়। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হয়ে গিয়েছে। আকাশ থেকে মাঝারি আকারের পানির বিন্দু মাটিতে এসে পড়ছে। টিনের চালে ঝুমঝুম আওয়াজ করে চলেছে তা। বাড়ির রোঁয়াকে সারি দিয়ে সবাই বসে পড়েছে। এক এক করে খাবার দেওয়ার সময় যখন আবার বিহানকে দেখতে পেল দিশা, তখন প্রতিবারের মতো আবার থেমে গেল সে। তার সামনে বিহান বসে আছে। খাবারের অপেক্ষায়। তার দিকে মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। ২১ বছর বয়সী দিশার মনে তা অন্য এক অনুভূতির সৃষ্টি করছে। নিতান্ত নতুন মানুষের সংস্পর্শে আসার ফল নাকি অন্য কিছু সেটা বুঝতে ব্যর্থ দিশা। তবুও সে এই অনুভূতি বুঝতে চায় না। এই অজানা নামহীন অনুভুতিতে এক আলাদা আনন্দ আছে। সেটা বেশ লাগছে দিশার কাছে।

কারো ডাকে আবার ধ্যান ভাঙে দিশার। তবে এবার বিহান তার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় নি। তার সামনেই বসে আছে। কলাপাতা বিছিয়ে। নিজের হাত থেকে বাটি রেখে দিশা নিজের চোখ ডান হাতের পিঠ দিয়ে ঘষল। তাও বিহান হারিয়ে গেল না। কারো কথা কানে পৌঁছাতেই সে বুঝতে পারল যে তার সামনে সত্যিই বিহান বসে আছে। এটা কোন ভ্রম নয়। তাই সে বেশি না ভেবে নিজের কাজ করতে থাকল। নাহলে ভাবা যায়? সে কত সময় ধরে বিহানের চোখের দিকেই তাকিয়ে ছিল!

বৃষ্টির দাপটে কাছে বসে থাকা মানুষের কথা শোনাও কঠিন হয়ে উঠছে। আকাশের এমন হুটহাট বদলে যাওয়ার খেলা বেশ লাগছে সবার কাছে। অনেকে জানে যে কথা শুনতে পারবে না। তাও জোরে জোরে চিৎকার করে কথা বলছে। আর অন্যরা চেষ্টা করছে সেটা শোনার। ওদের এই কাণ্ড দেখে বিহান না চাইতেও হেসে ফেলছে বারবার।

সেই সকাল থেকে আকাশে কড়া রোদ। তারপর হুট করে আকাশ কালো ঘন মেঘে ছেয়ে গেল। এখন অনেক জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। আবার কিছুক্ষণ পর দেখা যাবে আকাশে আবার রোদ উঠেছে। এসব কেউ ঠিক মতো নির্ণয় করতেও পারবে না। এই বৃষ্টি তো এই রোদ। কোন ঠিকঠিকানা নেই যেন আকাশের!

ভাবতে ভাবতে মুখে আরেক লোকমা খাবার তুলে নিল দিশা।

__________

দিশা যেমনটা ভেবেছিল, তেমনই হলো। বিকালের দিকে আকাশে আবার কড়া রোদের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে সারা দুপুর বিহান ওদের সবার সাথে খন্দকার বাড়িতে ছিল। বৃষ্টি বাড়ার সাথে সাথে ইমতিয়াজ সহ আরও কিছু ছেলের আগমন হয়েছিল। সবার খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন দিশার মা। তারপর বৃষ্টি না কমা পর্যন্ত চলে তাদের গল্পগুজব। তারপর আবার ধীরে ধীরে বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসলে সবাই নিজ নিজ কাজে চলে যায়। বাচ্চারাও চলে যায় নিজ বাড়িতে। দিশা আর বিহান আপাতত মাঠের দিকের রাস্তা ধরে হাঁটছে। তারা এখনো ফাঁকা মাঠে পৌছায়নি। আশেপাশে মাটির ঘর আর মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা। দেখতে সরু মনে হলেও আশেপাশে বেশ জায়গা রয়েছে। তবে আঁকাবাঁকা পথ হওয়ায় আর রাস্তার দুই পাশ ঘেঁষে বসতবাড়ি থাকায় ছোট বলেই মনে হয়। সেদিন ঘোরাঘুরির পর ইমতিয়াজের ঠেলা গাড়ি ফেরত দেওয়াও হয়েছিল। তাই আজ হেঁটে হেঁটেই ঘুরতে হবে তাদের। হাঁটতে হাঁটতে একসময় দুজনেই গন্তব্যে পৌঁছে যায়। মাঠ পেরিয়ে নদীর কাছ পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আজ ওরা গ্রাম ঘুরতে বের হয়েছে দেরিতে। আর তার উপর হেঁটে হেঁটে বেশি দূর আসতে পারে নি। অন্ধকারও নেমে এসেছে ধরণীর বুকে। পশ্চিত আকাশে সূর্য একেবারে অদৃশ্য হওয়ার উপক্রম। লাল আভার পরিমাণ খুব কম। তাছাড়াও আযান দিয়ে দিয়েছে মসজিদে। যদিও সেটা কেউ শুনতে পায়নি। সাধারণত সূর্যের অবস্থান দেখে এই গ্রামের মানুষ মসজিদে যাওয়া আসা করে। আর ছেলেরা যখন মসজিদে যায়, তখন বাড়ির মেয়েরাও নামাজ আদায় করে নেয়। অদ্ভুত ভাবে ওদের ধারণা করা সময়টা প্রতিবার-ই মিলে যায়। এই নিয়ে দ্বন্দ্ব তাই কখনো হয় নি। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সকল সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই নিয়ে গ্রামের কারো মধ্যে কোন সমস্যা হয়নি আজ পর্যন্ত। বলতে গেলে নামের সাথে এই জন্যই বেশি মিল গ্রামের। “শান্তিপুর”।

হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার মতো মানুষ বেশিরভাগ-ই দেখা যায়। কোন ঠিক থাকে না তাদের। বিহান সেই কখন থেকে দিশাকে এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে, কিন্তু দিশা না জবাব দিয়েছে আর না ইশারা করেছে। শুধু অন্যমনস্ক হয়ে হেঁটেই চলেছে। যার জন্য বিহান আর কথা বাঁড়ায় নি। কিন্তু যখন খেয়াল হলো দিশার, নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় দিশা আর দেরি করে নি। তারা ফেরার জন্য রওয়ানা দেয়। তবে ফেরার পথে কারো চিৎকার শুনতে পায় তারা। দিশা খেয়াল করল কি না তা জানা নেই, তবে বিহান সাথে সাথেই থেমে গেল। দিশাকেও ডাক দিল সে।

— দিশা, শুনুন।

— জ্বি বলুন।

— আপনি কি আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন এখানে?

— হ্যাঁ, দিন যত শেষ হতে থাকে ততই ঝিঁঝিঁ পোকাদের আওয়াজ অনেক ভালোভাবে শোনা যায়।

— আমি সেই আওয়াজের কথা বলছি না।

— তাহলে কোন আওয়াজের কথা বলছেন?

— কারো চিৎকার।

বিহানের উত্তর শুনে কিছ সময়ের জন্য দিশাও থমকে গেল। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করল। সব শেষে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

— না, শুনিনি। অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। এখন বাইরে থাকা ঠিক হবে না। চলুন, বাড়ি ফেরা যাক।

— কিন্তু…

— হতে পারে, কোন অশরীরীর চিৎকার শুনেছেন আপনি। বেশি ভাববেন না। গ্রাম এলাকায় এমন হতেই পারে। আপনি চলুন।

— জ্বি চলুন।

বিহান সম্মতি প্রকাশ করলেও তার খটকা লাগল মনে। যেন দিশা কিছু লুকানোর চেষ্টা করল। তবে প্রকাশ করল না সে। মানুষটা একটা রহস্যের থেকে কম কিছু না বিহানের কাছে। তবে লুকানোর চেষ্টা কেন করতে চাইবে দিশা? দিশা কি কিছু জানে এ সম্পর্কে? আর না জেনে থাকলেও আড়াল করার কারণ কি হতে পারে?

মনে অনেক রকমের প্রশ্ন আটকে রেখে নিজের পা বাড়াল বিহান। কিছু মুহূর্তের মধ্যেই জায়গাটা পুরো অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। আলোর দেখা একদমই পাওয়া যাচ্ছে না যেন। অন্ধকারেই আন্দাজে চলতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো তার। দিশা বুঝতে পারল কি না সেটা তার জানা নেই। কিন্তু দিশা নিজ থেকে এসেই বিহানের হাত ধরে অন্ধকার পথেই এগিয়ে চলল। চলতে চলতে একসময় মির্জা বাড়িতে এসে থামল ওরা। ততক্ষণে দিশা বিহানের হাত ছেড়ে দিয়েছে। দিশার দিকেই তাকিয়ে ছিল বলে বিহান সেটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু দিশাকে আবার অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেখে ওর খেয়াল হলো ও নিজে কোথায় আছে। ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বাড়ি ভেতরে চলে গেল বিহান।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here