অবান্তর_চিরকুট,পর্ব-11,12

#অবান্তর_চিরকুট,পর্ব-11,12
♡আরশিয়া জান্নাত
11

শীতের প্রকোপ বেড়েছে অনেক। রাস্তায় বের হলে ভালোই টের পাওয়া যায়, ফুটপাতে চিতুই আর ভাপা পিঠার স্টলে উপচে পড়া ভীড়, জায়গায় জায়গায় চায়ের আড্ডাই বলে দেয় শীত জমে উঠেছে। শহুরে শীত কুয়াশা কিংবা শিশিরে টের না পেলেও এইসব টুকটাক ঘটনায় টের পাওয়া যায়।
ছিন্নমূল মানুষের একজোটে বসে আগুন পোহানো দেখতে অন্য রকম কষ্ট লাগে। মনে হয় জীবন নিয়ে এতোশত অভিযোগ না করলেও চলে, তাদের চেয়ে তো ভালো আছি।
রাফসান তাঁর সঙ্গে করে আনা ব্যাগগুলি কয়েকটি অস্থায়ী আশ্রয়ের ভেতর রেখে অন্য পথ দিয়ে বেরিয়ে গেল। যদিও তার খুব ইচ্ছে করছে একটু অপেক্ষা করে পিছু ফিরে সেই মানুষগুলির হাসিমুখ দেখতে।

জহির সাহেব সরাসরি রাফসানের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। রাফসান তখন সবে রান্নার পাট চুকিয়ে রুমে যাচ্ছিল।

“আস্সালামু আলাইকুম। জ্বি বলুন?”

জহির সাহেব বেশ মন দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। 5’7″/8″ হাইটের মাঝারি গড়নের ছেলে, চেহারায় তেমন বিশেষত্ব নেই সাধারণ বাঙালি ছেলের উদাহরণ যেমন ঠিক তেমনই দেখতে। তাহজীবের তুলনায় কম সুদর্শন হলেও চেহারায় মায়া আছে।

“মি. রাফসান?”

“জ্বি, আপনাকে চিনলাম না?”

“আমি জহিরুল ইসলাম সিতারার বাবা।”

“ওহ আচ্ছা আচ্ছা, আসুন ভেতরে আসুন। আপনি একটু বসুন আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি”

“সমস্যা নেই তুমি যাও”

জহির সাহেব চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নিলেন। রাফসান ফিরতেই তিনি বললেন, দেখো রাফসান আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি। তোমার সঙ্গেও তেমনটাই বলতে চাই। আমার মেয়ে সিতারা খুব আবেগপ্রবণ, সে তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা পার করেছে একজনের দাসত্ব করে। তাঁর ধারণা ভালোবাসা মানেই সেই মানুষটার অধিনস্থ হয়ে যাওয়া, সে যা বলবে যেমন বলবে তেমন করে চলা। আমি আমার মেয়ের চঞ্চলতা দেখে অভ্যস্ত ছিলাম, সেই মেয়েটাকে বন্দিখাঁচায় বেঁধে রাখা পাখির মতো দেখতে কতোটা কষ্ট হয়েছে আমি বলে বোঝাতে পারবোনা। তবুও বাবা হিসেবে মেয়ের মনের সুখটাই প্রধান্য দিয়েছি।
আমি সবসময় চেয়েছি এমন কারো সঙ্গে আমার মেয়েকে বিয়ে দেবো যে তাঁকে বুঝবে, তার এই মেনে নেওয়ার স্বভাবটাকে দাসত্ব না ভেবে বরং মর্মটা বুঝবে। ও যে মানুষকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতে পারে তা বুঝবে,,,,

বলেই চোখ মুছলেন তিনি। তারপর নিজেকে সামলে বললেন, তুমি তোমার পূর্বের স্ত্রীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলে। আমি তোমার সম্পর্কে সবটা শুনেছি, সত্যি বলতে তুমি আসলেই খুব ভালো মনের মানুষ। কিন্তু আমার মনে একটা শঙ্কা জেগেছে, তুমি স্বাধীনতা দিয়ে একজনকে হারিয়েছ। আমি জানিনা সেই হারানোর ক্ষতটা তোমার চিন্তাভাবনায় কতখানি প্রভাব ফেলেছে। যে একবার স্বাধীনতা দিয়ে হেরে যায় সে পরবর্তীতে কাউকে বিশ্বাস করে ছাড় দিবে কি না,,,,

রাফসানকে নিরব থাকতে দেখে জহির সাহেব বললেন, আমি বাবা হিসেবে অন্তত এটা চাইবোনা আমার মেয়ে আবারও কারো সন্দেহের পাত্রী হয়ে থাকুক। তোমার অতীত আমাকে এটাই সংকেত দিচ্ছে, আমি এখানে আমার মেয়ের ভবিষ্যত কারাবাস দেখছি।

রাফসান মুচকি হাসি দিয়ে বললো, আপনার ভাবনায় কোনো ভুল নেই আঙ্কেল। বাবা হিসেবে এমন কিছু ভাবা আপনার জন্য জায়েজ। কিন্তু এখানে আমি আমার হয়ে কিছু বলতে চাই। মিস সিতারা অন্যরকম একটা মেয়ে, তাঁর মতো মেয়ে আমি আগে দেখিনি। আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা পারস্পরিক সাংঘর্ষিক। আমি যদি ভাবি ফ্রিডম দেওয়ায় আমার স্ত্রী চলে গেছে, আর মিস সিতারা যদি ভাবে তিনি ফ্রিডম স্যাক্রিফাইজ করেছেন বলে তাঁর প্রাক্তন ছেড়ে গেছে। তাই আমাদের বিপরীত হতে হবে তবে এখানে আমাদের একসঙ্গে কিছু ভাবা বোকামি ছাড়া কিছুই হবেনা। এখানে আপনি হয়তো একটা ব্যাপার জানেন না, তা হলো আপনার মেয়ের চিন্তাভাবনাতে একটুও পরিবর্তন আসেনি। সে এজন্য তাঁর প্রাক্তনকে ইগ্নোর করেননি যে তিনি তাঁকে শাসনের নামে বন্দি রাখতেন, বরং এজন্য ছেড়েছেন সে তাঁকে সম্মান করতোনা, সকলের সামনে ছোট করতো।
আর কথা হলো পরাধীনতার, মানুষের একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা ভালোবাসার শেকলে আবদ্ধ থাকতে ভালোবাসে। বাঙালি মেয়েরা এদিকে আরো বেশি এগিয়ে। আমি অন্তত আমার জীবন থেকে এটাই শিক্ষা পেয়েছি। আমি আমার স্ত্রীকে সেই শেকলে রাখিনি বলেই সে ভেবেছে আমার ভালোবাসা পানসে। এখানে শাসন নেই, সন্দেহ নেই, কিছু নিয়ে রাগ নেই অভিযোগ নেই। তারমানে ভালোবাসাও নেই,,, মেয়েরা তাঁর প্রিয়জনের শাসনে ভালোবাসা খুঁজে পায়, সন্দেহকে ভাবে হারিয়ে ফেলার ভয়, রাগ দেখানোকে ভাবে অধিকারবোধ। তাই আমার মনে হয় না আপনার এই বিষয়ে এমন শঙ্কা পুষে রাখা ঠিক হবে। বাকি আপনি যা ভালো বোঝেন।

জহির সাহেব কেমন ঘোরে চলে গেলেন। এমন করে তো তিনি ভেবে দেখেননি।

“আঙ্কেল লাঞ্চটা বরং আমার সঙ্গেই করুন আজ। আমার রান্না বেশি খারাপ না, আশা করি বিশেষ অসুবিধা হবেনা।”

জহির সাহেব হেসে বললেন, খেয়ে দেখি আমার জামাই কেমন রাঁধে!
রাফসান লজ্জায় পড়ে গেল।
_______________________________

সিতারার মাথা থেকে অনেক বড় একটা বোঝা নেমে গেল যেন। তাঁর বাবা রাফসানকে বেশ পছন্দ করেছে, অবশ্য সে তো জানতোই পছন্দ না করার কিছু নেই। এখন তাহজীব চাইলেও কিছু করতে পারবেনা। তাহজীব আসবার আগেই তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি হয়ে যাবে। জহির সাহেব তো পারছিলেন না আজকেই বিয়েটা সেরে ফেলতে, রাফসানকে তাঁর কেন এতো পছন্দ হলো বুঝে আসছেনা তাঁর। কি এমন বলেছেন তিনি?
কিন্তু সিতারার মা সোফিয়া বেঁকে বসলেন। তিনি খানিকটা রেগে বললেন, আমার মেয়ে কোন দিক দিয়ে পঁচে গেছে জহির? তুমি ওর জন্য ডিভোর্সী ছেলে চুজ করলে? তুমি না পারলে আমাকে বলতে আমি ওর জন্য ভালো ছেলের ব্যবস্থা করতাম।

“ডিভোর্সী মানেই খারাপ না সোফিয়া। ছেলের সম্পর্কে আমি খোঁজ নিয়েছি, বলতে পারো হীরের টুকরো ছেলে। আমার মেয়ের যে সুবুদ্ধি হয়েছে এতে আমি আপ্লুত।”

“এসব বলে লাভ নেই। আমার মেয়েকে আমি এমন ছেলের কাছে দিবোনা, তাঁর উপর অনাথ ছেলে কোনো সমস্যা হলে বিচার দিবো কার কাছে? বিপদে আপদে কে পাশে দাঁড়াবে? বাপদাদার কিছু আছে কিনা সে খবর নিয়েছ?”

“উফফ এসব কেমন কথা। একটা ছেলে কতোটা ভালো হলে তাঁর প্রাক্তন শ্বশুর তাঁকে ছেলে পরিচয়ে বিয়ে দিতে চায় বোঝো? আর টাকাপয়সা দিয়ে আমি মানুষ বিচার করিনা, ছেলে কেমন সেটা হচ্ছে আসল। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমার মেয়ে এই ছেলেকে পছন্দ করেছে।”

“তোমার মেয়ে তাহজীবের উপর জিদ করে এসব করছে। দেখো তাহজীবের সামনে এই ছেলে কিচ্ছু না। সারাজীবন ছোট হয়ে থাকবে। তুমি ওর বাবা হয়ে এই ভুল করতে দিও না”

“তুমি তোমার মেয়েকে এখনো চেনোনি। ও যদি জিদ করে করতো তবে এমন কাউকে চুজ করতো যার সামনে তাহজীব কিছু না। কিন্তু ও সেরকম করেনি, বরং ভরসাযোগ্য হাত খুঁজেছে। তুমি এখন অযথাই অশান্তি করো না।”

“তোমাদের যা মন চায় করো। আমার কথার কোনো দাম ই নেই। লোকে আমাকে যখন জিজ্ঞাসা করবে কেন আমি মেয়েকে এমন ছেলের কাছে দিয়েছি তখন আমি কি বলবো? তখন সবাই ঠিকই বলবে নিশ্চয়ই কোনো কেলেঙ্কারি আছে,,,”

“যা মন চায় ভাবুক। আমার কিছু যায় আসেনা।”

“তোমার কখনোই কিছু যায় আসেনা অসহ্যকর।”

সোফিয়া রাগ করে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে অনশনে নেমেছেন। এই ছেলের সঙ্গে তিনি কিছুতেই মেয়ের বিয়ে দেবেন না। রূপে গুণে কোনদিকে নেই তাঁর মেয়ে? সে কেন এমন ছেলেকে বিয়ে করবে! কি যে এক কপাল নিয়ে এসেছে বুঝে আসেনা। আরেক হারামি ঐ তাহজীব, সারাজীবন মেয়েকে স্বপ্ন দেখিয়ে বিয়ে করলো আরেক জনকে। সব হয়েছে ঐ বদের জন্য। কত ভালো ভালো প্রপোজাল সিতারা ফিরিয়েছে ঐ ছেলের জন্য।
“আল্লাহ তোর বিচার করুক হারামজাদা।”

সিতারা কোচিং ক্লাস নিয়ে এসে শুনে তাঁর মা অনশনে গেছেন। রাফসানের সঙ্গে বিয়ে না দেওয়ার দাবিতে। ঘটনাটা শুনে সিতারা হাসতে হাসতে খুন, মায়ের সামনে গিয়ে গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে লাগলো। সোফিয়া মেয়ের এহেন কান্ডে রেগে আরো আগুন হলো তবুও মুখে কিছু বললো না। সিতারা হাসতে হাসতে বললো, মা তুমি সত্যি অনশনে গেছ। হেহেহে এখন মিছিল করো। স্লোগান দাও, দাঁড়াও স্লোগানটা আমি বলে দিচ্ছি,
“মানি না মানবোনা রাফসাইন্নার সাথে
আমার মেয়ের বিয়ে দেবোনা।
যতদিন আছে পদ্মা মেঘনা যমুনা
ভাত পানি ছোঁবো না আমি ছোঁবো না।”

সোফিয়া তাঁর মেয়ের স্লোগান শুনে হাসতে শুরু করলেন।

চলবে,,,,

#অবান্তর_চিরকুট (পর্ব-12)

♡আরশিয়া জান্নাত

দার্জিলিং থেকে ফেরার দুইদিন পর সকালে ব্রেকফাস্ট করার সময় তাহজীব জানতে পারলো আজ সিতারার কাবিন হবে।
তাহজীব অবিশ্বাসী গলায় বললো, তাঁরার বিয়ে? কার সঙ্গে? হুট করে বিয়ের খবর মানে কি?
তাহজীবের মা ঠান্ডা গলায় বললো, গতসপ্তাহে তাঁদের আংটি বদল হয়েছে। তুই ছিলিনা তাই জানিস না। সিতারার জাঁকজমক করে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই বলেই সাদামাটা আয়োজন করা হবে।
তাহজীব কিছুটা উত্তেজিত গলায় বললো, কে এই ছেলে? নাম পরিচয় কি? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা?
আফসানা বিরক্তস্বরে বললো, তুমি এতো রিয়েক্ট করছো কেন? ওনার বয়স তো কম হয়নি, এখন বিয়ে করবে না তো কখন করবে?
তাহজীব কিছু বলতে গিয়েও বললোনা। ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে লাগলো। কোনোরকম খাওয়া শেষ করেই রুমে গিয়ে সিতারাকে কল করলো কিন্তু সিতারা রিসিভ করলোনা। সিতারার বাবা জহির সাহেব তাহজীবকে ফোন করে বললো, অযথা সিতারাকে ফোন করে ডিস্টার্ব করোনা।ও এখন ব্যস্ত আছে। আর শোনো বৌমাকে সঙ্গে করে আসতে ভুলোনা। বিকেলেই কাবিন হবে চলে এসো।
তাহজীব ফোন ছুঁড়ে ফেললো। রাগে তাঁর মাথার মগজ টগবগ করছে যেন।
“তোর এতো বড় সাহস তাঁরা। তোর ডানা গজিয়েছে না? আমিও দেখবো কি করে তোর বিয়ে হয়।”

হাতে মেহেদি দিয়ে বসে আছে সিতারা। ইসমা পাশে বসেই এটাসেটা বলছে, সিতারাও হাসিমুখে গল্পে সায় দিচ্ছে। ফাইজা এসে বললো, আপু তুমি রাফসান ভাইয়ার নামের অক্ষর লিখেছ?
ইসমা–হু লিখেছি। তোরে বলতে হবেনা।
ফাইজা–কই দেখি?
সিতারা– এই তো দেখ।
ফাইজা–অনেক সুন্দর। আপু তুমি এতো সিম্পল ভাবে বিয়ে না করলেও পারতে। আমার কত শখ ছিল জানো?
সিতারা– চিন্তা করিস না ইসমার বিয়েতে সব শখ পূরণ হবে।
তাহজীব– তা তোর বিয়েতে পূরণ করতে সমস্যা কি? এমনভাবে বিয়ে করছিস যেন পেট বাঁধিয়ে ধরা খাওয়ার ভয়ে আছিস!
তাহজীবের কথা শুনে ইসমার রাগে গা জ্বলতে লাগলো। আজেবাজে কথা বলা যেন ফ্যাশন তাঁর!
সিতারা হেসে বললো, পেট বাঁধাই আর যাই করি সে নিয়ে আপনার মাথাব্যথা কেন? বিয়ে তো হচ্ছেই সে তো আর মাঝপথে ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেনা।
–যাক তাহলে স্বীকার করলি দায়বদ্ধতা আছে।
— আপনার জন্য মাঝেমধ্যে আমার আফসোস হয়। কথার সঠিক অর্থ বোঝেন না নিজের মনমতো গড়ে নেন। যাই হোক ভাবীকে এনেছেন নাকি বাসায় আটকে এসেছেন? আপনিতো আবার অনুষ্ঠানে ভালোবাসার মানুষকে শো করতে চাননা,,,
আফসানা এমন ভাবে সেজেগুজে এসেছে যেন তাঁরই বিয়ে। ইসমা তখন ফিসফিস করে বললো, তোমার বেলাই যতো নাটক করতো। দেখো বৌকে কিছু বলার সাহস পায় না।
আফসানা– ওমা সিতারা আপি আপনি এখনো রেডি হননি? ব্রাইডাল মেকাপে কত টাইম লাগে জানেন? এখন শুরু না করলে লেট হয়ে যাবে তো!
তাহজীব বাঁকা করে হেসে বললো, তাঁরা সাজতে পারেনা,আর হেভি সাজ ওর স্কিনে স্যুট করেনা।
ইসমা ত্যাড়া করে বললো, কে বলেছে আপু সাজতে পারেনা? ওর মেকাপ আর্ট দেখেছেন? আসলে আপুর গাঁয়ের রং টাই এমন সাজার প্রয়োজনই পড়েনি কখনো। আর আমাদের দুলাভাইয়ের এই সাজহীন আপুকেই বেশি পছন্দ। তিনি বারবার করে বলেছেন সিতারার ইচ্ছেমতো সব হবে, তাঁর সমস্যা হয় এমন কিছুই যেন করা নাহয়। শাড়িতে সমস্যা হলে সেটাও পড়তে নিষেধ করেছেন। আপু যে কত্ত স্বামীসোহাগী হবে এখনই টের পাওয়া যাচ্ছে।
তাহজীব রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল।
____________________

খুব সাধারণ বললেও আত্মীয়স্বজন নেহাতই কম আসেনি। মোটামুটি একটা উৎসবমুখোর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তাহজীব শত চেষ্টা করেও বরের পরিচয় বা ঠিকানা কারো কাছ থেকে জানতে পারেনি। সকলেই যেন মুখে তালা মেরে বসে আছে। তাঁর মা তো এতে আরো এক ধাপ এগিয়ে, তিনি সাফ বলে দিয়েছেন “কোনোরকম সমস্যা যদি বাঁধিয়েছিস আমার সঙ্গে তোর কোনো সম্পর্ক থাকবেনা।”
এই প্রথম তাহজীবের নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। বেশ স্বাভাবিকভাবেই সিতারার আর রাফসানের কাবিন সম্পন্ন হলো। দু’মাস পর অনুষ্ঠান করে সিতারাকে নিয়ে যাবে এমন কথা থাকলেও রাফসানের ফুফু আজকেই সিতারাকে নিয়ে যাওয়ার দাবি করলেন। এতে কেউই দ্বিমত করলোনা,যদিও সোফিয়া কিছুটা নাখোশ ছিলেন। এখানের সবাই জানে পরে অনুষ্ঠান হবে কিন্তু নিয়ে গেলে তো আর সেটা হবার সম্ভাবনা কম।
সিতারাকে বিদায় দিয়ে তাহজীবের মা তার ভাইকে বললেন, শুধুমাত্র তাহজীবের উপর রাগ দেখিয়ে এমন সহায়সম্বলহীন ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিলি। দেখিস আবার পরে যেন ভোগান্তি না হয়।
জহির সাহেব বললেন, রাফসান একা থেকে যদি এই অবধি টিকে থাকতে পারে তবে এখন কেন পারবেনা? তাছাড়া আমার মেয়েও তো আছে প্রয়োজনে ওরা দুজন মিলে সব গড়ে নিবে। ভাগ্যের চাকা ঘুরতে কতক্ষণ?

“এসব মুখে বলা সহজ। বাপের দিনের সম্পত্তি না থাকলে নতুন করে জোড়াবে সেই আশায় থাকা এখন খুব কঠিন। সবকিছুর যা দাম, যাই হোক তোর মেয়ে তুই যেখানে ইচ্ছে বিয়ে দিয়েছিস আমি বলার কে।”

“তুমি বলার কেউ না তা বলিনি আপা। তোমরা দোআ করো যেন ওরা ভালো থাকে।”

ইপ্সিতা সিতারাকে বেডরুমে বসিয়ে বললো, ভাবি আপনি যে কত লাকি বলে বোঝাতে পারবোনা। রাফসান ভাইয়ার মতো মানুষকে চুজ করাটা আপনার জীবনের বেস্ট ডিসিশন হবে দেখবেন। আমার বান্ধবীতো সেটা বুঝেনি আশা করি আপনি বুঝবেন।

রাফসানের মন আজ কেমন জানি অনুভূতিহীন। এই বিয়েটা সে কেন করেছে নিজেও জানেনা। যতো চেয়েছে সংসার ত্যাগ করে ভবঘুরে হবে ভাগ্য তাকে ফের সংসারে জুড়ে দিলো। সাফার স্মৃতিচারণ করাও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই! দুইটা ভিন্ন মানুষ যাদের জীবনে অন্য কেউ ছিল, আজ তাঁদের সন্ধি। অতীত আজ অবান্তর চিরকুট। নতুন জীবনটায় সবকিছু নতুন করে শুরু করার পথটা কি সহজ হবে? সে কি পারবে সাফার সব ভুলে সিতারাকে মনে জায়গা দিতে, কিংবা সিতারা কি পারবে তাহজীবকে ভুলে তাকে ভালোবাসতে?
এই প্রশ্নগুলোই ঘুরেফিরে মস্তিষ্কে হানা দিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মন তো বদলাতে সময় লাগেনা। সময় হয়তো সব ঠিক করে দিবে।

“কি রে সারারাত কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি?”

“না এমনি দাঁড়িয়ে ভাবছি।”

নাঈম তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললো, সাফার কথা ভাবছিস তাই না?

“সে তো সব ভুলে গেছে। আমি কেন ভুলতে পারিনা?”

“সে অন্যের সাথে আছে বলে তোকে মনে পড়েনা। এখন থেকে তোর ও মনে পড়বেনা দেখিস, মানুষ একা থাকলে পুরনো সব স্মৃতি ঘিরে থাকে। তুই এখন সেসব বাদ দে। তোর জীবনে সিতারার এমন নাটকীয় আগমন টা নিশ্চয়ই আল্লাহর লেখা তাকদির। এইদিকে আপাতত ফোকাস কর।”

“সাফার কি একটুও কষ্ট হবেনা যদি জানে আমি বিয়ে করেছি?”

ইপ্সিতা সেটা শুনে বললো, আপনি এখনো এসব ভাবছেন ভাইয়া? এমন সফটকর্ণার রাখলে তো চলবেনা। আপনি এখন অন্য কারো হাজবেন্ড, অতীতের কাউকে মনে রেখে তাঁর সঙ্গে অন্যায় করবেন না প্লিজ। এই হারটা আন্টি দিয়েছে, আপনার তো কোনো খবর নেই আজ যে নতুন বোকে কিছু গিফট দিতে হতো সেই খবর আছে?

রাফসান হেসে বললো, আমি অতোটাও ভোলামন না। মিস সিতারাকে অবহেলায় ফেলে রাখবো তা ভেবোনা।

রাফসান চলে যেতেই নাঈম বললো, সাফাকে বলেছিলে?

“হুম”

“কিছু বলেনি?”

“যা বলেছে তা বলার ইচ্ছে নেই”

“তোকে অন্য কারো হতে দেখা আমার জন্য কতোটা যন্ত্রণার ছিল আমি বলে বোঝাতে পারবোনা তারা! যে জীবনে তুই নেই সেই জীবন রাখার ইচ্ছেও আমার নেই। I quit….”

মেসেজটা দেখে শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল সিতারার। তাহজীব সত্যি সত্যিই কিছু করে বসে নি তো!

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here