অবান্তর_চিরকুট (পর্ব-16)

#অবান্তর_চিরকুট (পর্ব-16)
♡আরশিয়া জান্নাত

“রাফসান ভাইয়ার সাথে কেমন আছিস আপু? উনার সাথে এডজাস্ট হচ্ছে?”
সিতারা ফল কাঁটতে কাঁটতে বললো, বুঝলি ইসমা একটা বয়স থাকে আবেগের। সেই সময়ে অন্যসব বাদ দিয়ে কেবল চোখের দেখা আর হৃদয়ের ধুকপুকানিটাই শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার অনুভূতি মনে হয়। সেই বয়স পার করেছি অনেক আগেই। সত্যি বলতে রাফসান সাহেব আমার ষোড়শীর প্রেম না। সে আমার কম্ফোর্ট জোন হয়ে গেছে। তার সামনে আমি আমার মনের কথা অনায়াসে বলতে পারি, আমায় এটা হিসেব করতে হয়না সে রেগে যাবে বা কথাটার ভুল অর্থ বের করবে। উনি খুব অন্যরকম মানুষ বুঝলি!”

“তাহজীব ভাইয়ার প্রতি তোর যে ভালোবাসা ছিল ঐরকম ফীল হয়না?”

“না। তাহজীবের প্রতি আমার আসক্তি ছিল। তাকে আমি ভালোবাসতাম পাগলের মতো, আর সেই ভালোবাসায় এতটাই বিভোর ছিলাম যে অন্যকিছু চোখে পড়তোনা। জানিস রাফসান সাহেবের সঙ্গে এখনো আমার প্রণয় হয়নি। আমরা দুজন দুজনকে সম্মান করি, বন্ধুর মতো সঙ্গ দেই। আমরা দুজনেই দুজনকে সময় দিচ্ছি অতীতকে টেক ওভার করার।”

“তোমাদের ব্যাপারটা খুব সুন্দর! আমি খুব ভয় পেতাম জানো? ভাবতাম তুমি বুঝি তাহজীব ভাইয়ার পাগলামি দেখে রাফসান ভাইকে ছেড়ে চলে আসবে…..”

“এমনটা ভাবিনি তা নয় কিন্তু। প্রথম ভালোবাসা কখনোই ভোলা যায়না। যদিও এটা প্রায়ই ভুল মানুষের সঙ্গে হয়। মানুষটা ভুল সঠিক যাই হোক অনুভূতিটা থাকে একদম নির্ভেজাল।তাহজীব আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা যাকে ভোলা অসম্ভব। জানিস ইসমা যেদিন আফসানা বললো সে মা হতে চলেছে আমার মন কতখানি ভেঙে গেছিল? আমার মনে হলো তার কাছে ফেরার আর উপায় নেই। একটা নিষ্পাপ শিশুকে অনিশ্চয়তায় ফেলার পাপ আমি করবোনা। অথচ দেখ আমি তো তাদের হানিমুনের ছবি দেখেছি, তাহজীব যেসব ক্যাপশন দিয়ে ছবি আপলোড করেছে তা দেখেও এই বিশ্বাস ছিল এসব লোক দেখানো। বাস্তবে সে আমাকেই ভালোবাসে। কিন্তু আমি ভুল ধারণায় ছিলাম,,,,,ভালোবাসাটা রাফসান সাহেবের কাছ থেকে শেখা উচিত। সে তার প্রাক্তনকে ভালোবাসে বলেই আমার দিকে ঐ দৃষ্টিতে তাকায়নি এখন অবধি। নড়বড়ে মনের ভালোবাসা শরীরে এসে পথ হারায়।খাঁটি ভালোবাসায় সেটা হয়না।”

“তাহজীব ভাইয়ের পল্টি তো অবিশ্বাস্য ছিল। সে যেভাবে মুহূর্তে রূপ বদলেছে! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল সে তোমায় ভালোবাসতো। যাই হোক আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে। তুমি রাফসান ভাইয়ার সাথে সুখী থাকবা বলেই এখানে তোমার ভাগ্য গেঁথেছে। আল্লাহ তোমাকে অনেক ভালোবাসে বুঝছো? ঐ বদরাগীর থেকে বাঁচাইছে তোমারে।”

“তাই নাকি?”

“হুম। তা ভাইয়া ফিরবে কখন? এতোক্ষণ বাসায় একা থেকে কি করো? বোর লাগে না??”

“একা কই বাড়িওয়ালার ছোট মেয়ে মাঈশা বেশিরভাগ আমার সঙ্গে থাকে। ওনারা তোর ভাইয়াকে অনেক পছন্দ করে, ভালো কিছু রান্না হলে সবার আগে পাঠিয়ে দেয়। আন্টি তো সবসময় বলে, রাফসানের মতো ছেলে হয়না।”

“বাহ! তা আপু তুমি চাইলেই তো জব বা ছোটখাটো বিজনেস করতে পারো? সময়টাও কাজে লাগলো সংসারেও হেল্প হলো!”

“চাইলেই পারি কিন্তু করবোনা।”

“কেন? ভাইয়ার পছন্দ না?”

“না না সে কিছু বলেনি। এটা আমার উপর ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমিই আসলে এটা ইগ্নোর করছি। উনি একা মানুষ, ছোট থেকে একাই বড় হয়েছেন। আমি চাই উনি সেই একাকিত্ব আবার ফীল না করুক। আমি আমার সময়টা সম্পূর্ণভাবে উনাকেই দিতে চাই। এখন তুই বলতেই পারিস অনলাইন বিজনেস বা খুটিনাটি কিছু করেও উনাকে সময় দিতে পারবো। কিন্তু সবাই যদি টাকা আয় করি খরচ করবে কে? রাফসান ইনকাম করুক আর আমি সংসারটা মন দিয়ে করি। হিহি”

ইসমা হেসে বললো,তোর থেকে এটাই আশা করা যায়,তুই তো বরাবরই সাংসারিক ছিলি।

“এই তো বুঝলি। আচ্ছা তোরা আছিস তো কিছুদিন? আমার এখানেও থাকতে হবে কিন্তু শুধু ফুপীর ওখান থেকে ঘুরে গেলে হবেনা।”

“বেশিদিন থাকবোনা এবার। পরেরবার ফাইজাকে নিয়ে আসবো তখন থাকবো তোর এখানে। ও তোকে অনেক মিস করে আপু। কি ম্যাজিক যে করেছিস, আমার ভাইবোন সব তোর ভক্ত হুহ!”

“হাহাহা। তুই আসলেই হিংসুক!”

“হুহ সত্যি বললেই হিংসুক”
_________________

তাহজীব আফসানার খুব যত্ন নেয়। ডেলিভারির ডেট আসতে আর বেশিদিন নেই। সিতারার কথাশুনে সেদিনই সে ঠিক করেছিল এমন বর হয়ে দেখাবে যেন আফসানাও তারার মতো স্বামী সম্পর্কে বলে বেড়াতে পারে। প্রথম প্রথম রেষারেষিতে হলেও ধীরে ধীরে সত্যিই মন থেকে কেয়ার করা শুরু করেছে। শত হলেও তার সন্তানের মা হতে যাচ্ছে আলাদা সহমর্মিতা তো থাকবেই!
ওদিকে রাফসানের সঙ্গে সিতারার সম্পর্ক এখন বেশ মজবুত হয়েছে বলা চলে। তারা দুজন দুজনকে নিজেদের স্বস্তির স্থান মনে করে। যদিও অতীতের রেশ এখনো পুরোপুরি যায়নি তবে ক্ষত শুকিয়ে আসছে ঠিকই। এখন আর রাফসান ভবঘুরের মতো একা পথে পথে ঘুরে বেড়ায়না। সিতারা যে অধীর আগ্রহে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে সেই চিন্তাতেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় ফেরে। সঙ্গে আনে যখন যা ইচ্ছে করে। রাফসানের মনে হয় সিতারা মেয়েটা খুব সাধারণ, বাড়তি কোনো চাহিদা নেই, ডাল ভাত খেয়েই নিঃশব্দে দিন কাটাবে এমন ধরনের। অথচ সে কত ধনী পরিবারের মেয়ে। রাফসানকে যখন সে বিয়ের কথা
বলেছিল রাফসান তখনো জানতোনা সিতারার পারিবারিক অবস্থান। জানার পর সে অবশ্য মনে মনে ভয় পেয়েছিল, এমন ঘরের মেয়েকে ভালোভাবে রাখতে পারবে কিনা তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তার তো শেষ ছিল না। কিন্তু তার সব ধারণা বদলে গেল বিয়ের শপিং এ। সিতারার এই অতি সাধারণ মনোভাবই তাকে অসাধারণ করে তুলেছে বলা বাহুল্য। আজকাল সিতারার প্রতি মুগ্ধতা কাজ করে। ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখার জন্য ফজরের এলার্মের আগেই উঠে পড়ে,মেয়েটা যখন হাঁটতে হাঁটতে চুলে হাত খোঁপা করে তাতে ফুলের মালা পেঁচায় কতোটা মোহনীয় লাগে তা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেনা। সাফা অতি রূপবতী মেয়ে ছিল, তার তুলনায় সিতারা কম রূপবতী হলেও তার চেহারায় মায়ার অভাব নেই। হাসি দিয়ে যখন কথা বলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যেতে ইচ্ছে করে। রাফসান ঠিক বুঝতে পারে সে সিতারার প্রেমে পড়ে গেছে। অবশ্য বিয়ের পর ভালোবাসা হয়েই যায়। এই সম্পর্কের জোরটা অন্যরকম। নাহয় রাফসান কি কখনো ভেবেছিল সাফাকে তার সারাদিনেও মনে পড়বেনা, মাথায় শুধু ঘুরবে সিতারা কি করছে এখন? সে কি দুপুরে ঠিকঠাক খেয়েছিল? গোসলে লেট করেনিতো? মেয়েটার যে অভ্যাস দু’দিন পরপর ঠান্ডা লেগেই থাকে। আচ্ছা ফেরার পথে কি নেওয়া যায়? আরো কতশত চিন্তা। সেইসবের ভীড়ে সাফার অস্তিত্ব মেলেনা। তবে একদমই যে মনে পড়েনা তা নয়। এখন মনে আসলেও সরিয়ে দেয়। এই মনে এখন অবান্তর চিরকুটের জায়গা নেই। এটার সবটা জুড়ে থাকবার অধিকারী কেবল সিতারা।
হয়তো সিতারাও তেমনই ভাবে। নয়তো এতো মন দিয়ে সংসারটা না করলেও চলতো। দুজন মানুষের সংসারটায় সে চাইলেই নয়ছয় করে করতে পারতো। কিন্তু সিতারা তেমন করেনি। সে প্রতিটা কাজ যত্ন নিয়ে করে বুঝিয়ে দেয় এই সংসারটা তার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ।
রাফসানের পছন্দ অপছন্দ কত অল্প দিনেই না ঠোঁটস্থ করেছে সে। এখন রাফসানের নিজের চেয়ে সেই বেশি জানে সব। মেয়েদের বোধহয় সৃষ্টিকর্তা এমনভাবেই বানিয়েছেন এরা অল্পদিনের চেনা মানুষটাকে কেন্দ্র করে খুব সহজেই নিজের বৃত্ত তৈরি করে ফেলে। ইপ্সিতার কলে ধ্যান ভাঙলো রাফসানের। অনেকদিন পর সে ফোন করেছে তাই প্রথম রিং এই কল রিসিভ করলো রাফসান,

“হ্যালো ইপ্সিতা। কেমন আছ?”

“আস্সালামু আলাইকুম ভাইয়া। ভালো আছি আপনি কেমন আছেন?”

“ওয়ালাইকুম আস্সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। ”

“ভাবি ভালো আছে?”

“হ্যাঁ ভালোই। তা তোমার কি অবস্থা? কোনো খোঁজখবরই নেই দেখি!”

“ভাইয়া সাফার খবর জানেন কিছু? ও কি দেখা করেছিল আপনার সঙ্গে?”

“নাহ। কেন কি হয়েছে ওর ফোন বা দেখা করার প্রয়োজন তো নেই। কেন সেসব করবে?”

“যদি করেও আপনি রেসপন্স করবেন না। ও এখন আপনার কাছে ব্যাক করার চিন্তাভাবনা করছে। আপনি কিন্তু ভুলেও ওকে সুযোগ দেবেন না,,,,”

রাফসান স্তব্ধ হয়ে শুনে রইলো ইপ্সিতার কথা।

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here